বৈষ্ণব পদাবলী: মধ্যযুগে বাংলার সমাজ ও সাহিত্য-বাঙ্গালীর শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি

বৈষ্ণব পদাবলী: মধ্যযুগে বাংলার সমাজ ও সাহিত্য-বাঙ্গালীর শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি

বৈষ্ণব পদাবলী- মধ্যযুগে বাংলার সমাজ ও সাহিত্য-বাঙ্গালীর শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি

১। বৈষ্ণব পদকর্তা বিদ্যাপতির জন্মস্থান হল –

(ক) মধুবনী গ্রাম

(খ) বিসফি গ্রাম

(গ) নান্নুর গ্রাম

(ঘ) কাঁদড়া গ্রাম

২। ‘মৈথিল কোকিল’ বলা হয় –

(ক) বিদ্যাপতিকে

(খ) চণ্ডীদাসকে

(গ) জ্ঞানদাসকে

(ঘ) গোবিন্দদাসকে

৩। ‘অভিনব জয়দেব’ বলা হয় –

(ক) চণ্ডীদাসকে

(খ) গোবিন্দদাসকে

(গ) জ্ঞানদাসকে

(ঘ) বিদ্যাপতিকে

৪। কবি বিদ্যাপতির পিতার নাম –

(ক) শ্রীপতি ঠাকুর

(খ) নরপতি ঠাকুর

(গ) গণপতি ঠাকুর

(ঘ) দিনপতি ঠাকুর

৫। বিদ্যাপতির ভাবশিষ্য কাকে বলে?

(ক) জ্ঞানদাসকে

(খ) গোবিন্দদাসকে

(গ) বিদ্যাপতিকে

(ঘ) চণ্ডীদাসকে

৬। ‘দ্বিতীয় বিদ্যাপতি হলেন –

(ক) জ্ঞানদাস

(খ) গোবিন্দদাস

(গ) চণ্ডীদাস

(ঘ) বড়ু চণ্ডীদাস

৭। বিদ্যাপতি কোন ভাষায় গ্রন্থ রচনা করেছেন ?

(ক) ব্রজবুলি

(খ) বাংলা

(গ) হিন্দি

(ঘ) কোনোটাই নয়

৮। ‘কীর্তিলতা’ গ্রন্থটির রচয়িতা হলেন –

(ক) জ্ঞানদাস

(খ) গোবিন্দদাস

(গ) চণ্ডীদাস

(ঘ) বিদ্যাপতি

৯। কোন্ কবি কাব্যে নিজেকে ‘খেলন কবি’ বলেছেন?

(ক) গোবিন্দদাস

(খ) বিদ্যাপতি

(গ) চণ্ডীদাস

(ঘ) জ্ঞানদাস

১০। চণ্ডীদাসের ভাবশিষ্য হলেন –

(ক) গোবিন্দদাস

(খ) বিদ্যাপতি

(গ) জ্ঞানদাস

(ঘ) চণ্ডীদাস

১১। বিদ্যাপতির ভাবশিষ্য হলেন –

(ক) গোবিন্দদাস

(খ) চণ্ডীদাস

(গ) জ্ঞানদাস

(ঘ) বিদ্যাপতি

১২। ‘সই কেবা শুনাইল শ্যাম নাম’ – কোন পদকর্তার রচনা ?

(ক) জ্ঞানদাস

(খ) গোবিন্দদাস

(গ) চণ্ডীদাস

(ঘ) বিদ্যাপতি

১৩। গোবিন্দদাসের জন্ম আনুমানিক কত খ্রিস্টাব্দে?

(ক) ১৫৩০

(খ) ১৫৩৫

(গ) ১৫৩৭

(ঘ) ১৫৩৮

১৪। ‘পুরুষ পরীক্ষা’ গ্রন্থটির রচয়িতা হলেন –

(ক) জ্ঞানদাস

(খ) বিদ্যাপতি

(গ) গোবিন্দদাস

(ঘ) চণ্ডীদাস

১৫। রাধাকৃষ্ণের স্পষ্ট উল্লেখযুক্ত বিদ্যাপতির পদাবলির সংখ্যা প্রায় –

(ক) ২০০-র বেশি

(খ) ৩০০-র বেশি 

(গ) ৪০০-র বেশি

(ঘ) ৫০০-র বেশি

১৬। ‘জনম অবধি হম রূপ নেহারলু নয়ন না তিরপতি ভেল’ – কার লেখা পদ?

(ক) চণ্ডীদাসের

(খ) বিদ্যাপতির

(গ) জ্ঞানদাসের

(ঘ) গোবিন্দদাসের

১৭। ‘সখি, হমারি দুখক নাহি ওর এ ভরা বাদর মহা ভাদর’ – কার লেখা পদ?

(ক) বিদ্যাপতির 

(খ) জ্ঞানদাসের

(গ) চণ্ডীদাসের

(ঘ) গোবিন্দদাসের

১৮। ‘মাধব, বহুত মিনতি করি তোয়। সেই ভুলসী তিল …’ – কার লেখা পদ?

(ক) জ্ঞানদাসের 

(খ) গোবিন্দদাসের

(গ) চণ্ডীদাসের

(ঘ) বিদ্যাপতির

১৯। ১৯ বৈষ্ণব পদাবলিতে কয়টি রসের কথা বলা হয়েছে?

(ক) দুটি

(খ) তিনটি

(গ) চারটি

(ঘ) পাঁচটি

২০। বৈষ্ণব পদকর্তা বিদ্যাপতি কী নামে পরিচিত?

(ক) দুঃখের কবি

(খ) মৈথিল কোকিল

(গ) বৈষ্ণবাচার্য

(ঘ) কোনোটাই নয়

২১। ‘পুরুষপরীক্ষা’, ‘কীর্তিপতাকা’, ‘শৈবসর্বস্বহার’, ‘গঙ্গাবাক্যাবলী’ প্রভৃতি গ্রন্থগুলির রচয়িতা হলেন –

(ক) চণ্ডীদাস

(খ) জ্ঞানদাস

(গ) গোবিন্দদাস

(ঘ) বিদ্যাপতি

২২। ‘বিভাগসার’, ‘দানবাক্যাবলী’, ‘দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনী’ গ্রন্থগুলির রচয়িতা হলেন –

(ক) জ্ঞানদাস 

(খ) বিদ্যাপতি

(গ) গোবিন্দদাস

(ঘ) এঁদের কেউ নন

২৩। বিদ্যাপতি কোন ভাষাতে রাধাকৃষ্ণপ্রেমবিষয়ক পদ লিখেছিলেন?

(ক) বাংলা

(খ) ব্রজবুলি

(গ) মৈথিলি

(ঘ) কোনোটাই নয়

২৪। বিদ্যাপতি মূলত ছিলেন –

(ক) শাক্ত

(খ) শৈব

(গ) বৈষ্ণব

(ঘ) কোনোটাই নয়

২৫। রবীন্দ্রনাথের ‘ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী’ কোন ভাষায় রচিত?

(ক) বাংলা

(খ) ব্রজবুলি

(গ) মৈথিলি

(ঘ) কোনোটাই নয়

২৬। ‘মাধব, বহুত মিনতি করি তোয় / দেই তুলসী তিল দেহ সমৰ্পিল / দয়া জনি ছোড়বি মোয়’ –  বিদ্যাপতির কোন পর্যায়ের পদ?

(ক) আক্ষেপানুরাগ

(খ) প্রার্থনা

(গ) অভিসার

(ঘ) পূর্বরাগ

২৭। চণ্ডীদাস বীরভূমের — গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

(ক) নান্নুর

(খ) কেন্দুবিশ্ব

(গ) ছাতনা

(ঘ) কোনোটা নয়

২৮। “কানুর পিরীতি চন্দনের রীতি ঘষিতে সৌরভময়’ – এটি কার রচিত পদ?

(ক) বিদ্যাপতির

(খ) জ্ঞানদাসের

(গ) চণ্ডীদাসের

(ঘ) গোবিন্দদাস

২৯। জ্ঞানদাসের রচিত পদগুলির মধ্যে বেশি উৎকৃষ্ট হল –

(ক) ব্রজবুলি

(খ) বাংলা

(গ) মৈথিলি

(ঘ) কোনোটা নয়

৩০। “তোমার গরবে গরবিনী হাম রূপসী তোমার রূপে’ – পদটির রচয়িতা হলেন – 

(ক) জ্ঞানদাস 

(খ) চন্ডীদাস

(গ) বিদ্যাপতির

(ঘ) এঁদের কারো নয়

৩১। ‘সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু / অনলে পুড়িয়া গেল’ পদটি –

(ক) চণ্ডীদাসের

(খ) বিদ্যাপতির

(গ) জ্ঞানদাসের

(ঘ) গোবিন্দদাসের

৩২। ‘গাগরি বারি ঢারি করি পিছল চলতহি অগুলি চাপি’ পদটি –

(ক) গোবিন্দদাসের

(খ) চন্ডীদাসের 

(গ) জ্ঞানদাসের

(ঘ) বিদ্যাপতির

১। বৈষ্ণব পদকর্তা বিদ্যাপতির জন্মস্থান কোথায়?

বিদ্যাপতির জন্মস্থান বিহারের দ্বারভাঙা জেলা মধুবনী পরগনার অন্তর্গত বিসফি গ্রাম।

২। মিথিলার বিদ্যাপতিকে কী বলা হয় ?

মিথিলার বিদ্যাপতিকে ‘মৈথিল কোকিল’ বলা হয়।

৩। বিদ্যাপতিকে ‘অভিনব জয়দেব’ বলা হয় কেন ? 

বিদ্যাপতির পদাবলিতে কবি জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দের’ প্রভাব আছে বলে অনেকে তাঁকে ‘অভিনব জয়দেব’ বলেছেন।

৪। বিদ্যাপতির ভাবশিষ্য কাকে বলা হয়?

বৈষ্ণব পদকর্তা গোবিন্দদাসকে ‘বিদ্যাপতির ভাবশিষ্য’ বলা হয়।

৫। ‘দ্বিতীয় বিদ্যাপতি’ কাকে বলা হয়?

বৈষ্ণব পদকর্তা গোবিন্দদাসকে ‘দ্বিতীয় বিদ্যাপতি’ বলা হয়।

৬। বিদ্যাপতি কোন ভাষায় গ্রন্থ রচনা করেছিলেন?

বিদ্যাপতি সংস্কৃত, মৈথিলি ও ব্রজবুলি ভাষায় গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।

৭। বিদ্যাপতির রচিত কয়েকটি গ্রন্থের নাম লেখো।

বিদ্যাপতির রচিত কয়েকটি গ্রন্থ হল কীর্তিলতা, কীৰ্তিপতাকা, দানবাক্যাবলী, পুরুষপরীক্ষা, শৈবসর্বস্বহার, বিভাগসার প্রভৃতি।

৮। কে নিজেকে ‘খেলন কবি’ বলেছেন ?

বিদ্যাপতি তাঁর ‘কীর্তিলতা’ কাব্যে নিজেকে ‘খেলন কবি’ বলেছেন।

৯। দু-জন মুসলমান পদকর্তার নাম লেখো।

দুজন মুসলমান পদকর্তা হলেন সৈয়দ মুরতজা, নাসির মামুদ।

১০। চৈতন্য- পূর্ববর্তী যুগের একজন বৈষ্ণব পদকর্তার নাম লেখো।

চৈতন্য-পূর্ববর্তী যুগের একজন বৈষ্ণব পদকর্তা হলেন বিদ্যাপতি।

১১। বৈষ্ণব পদকর্তা বিদ্যাপতির বিশেষ বৈশিষ্ট্য কী?

বিদ্যাপতি বাংলা ভাষায় কোনো পংক্তি রচনা না করেও বাঙালির হৃদয় মন্দিরে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন।

১২। বিদ্যাপতির ‘কীর্তিলতা’ গ্রন্থটির বিষয় বস্তু কী? 

বিদ্যাপতি মিথিলার রাজা কীর্তিসিংহের কীর্তিকাহিনি বর্ণনা করে অবহট্‌ঠ ভাষায় ‘কীর্তিলতা’ গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন।

১৩। মথুরা-বৃন্দাবনের স্থানীয় জনসাধারণের ভাষা কী ছিল?

মথুরা-বৃন্দাবনের স্থানীয় জনসাধারণের ভাষা ছিল ‘ব্রজভাষা’।

১৪। বিদ্যাপতি রাধাকৃষ্ণ পদাবলি ছাড়া আর কোন বিষয়ে পদরচনা করেছিলেন? 

বিদ্যাপতি রাধাকৃষ্ণ পদাবলি ছাড়া হরপার্বতী ও আরও নানা বিষয়ে পদ রচনা করেছিলেন।

১৫। বিদ্যাপতি কুলধর্মে কী ছিলেন?

বিদ্যাপতি কুলধর্মে শৈব ছিলেন।

১৬। বিদ্যাপতি রচিত পদের একটি পংক্তি উল্লেখ করো।

বিদ্যাপতি রচিত পদ হল ‘লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয়ে রাখলু / তবু হিয়া জুড়ন না গেল।।’

১৭। বৈষ্ণব পদাবলিতে কয়টি রসের কথা বলা হয়েছে ও কী কী?

বৈষ্ণব পদাবলিতে পাঁচটি রসের কথা বলা হয়েছে – শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর।

১। বৈষ্ণব পদ রচনায় বিদ্যাপতির প্রতিভার পরিচয় দাও। তাঁকে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অন্তর্ভুক্ত করার কারণ কি? 

৩+২  (২০১৬) 

বিদ্যাপতি দ্বারভাঙা জেলার মধুবনী মহকুমার অন্তর্গত বিসফি গ্রামে চতুর্দশ শতাব্দীর শেষ ভাগে প্রসিদ্ধ ব্রাহ্মণ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। মিথিলা কবির জন্মস্থান, মাতৃভাষা মৈথিলি এবং মিথিলায় তিনি ‘মৈথিল কোকিল’ নামে পরিচিত।

সংস্কৃত কাব্য ও অলংকারশাস্ত্রে পণ্ডিত, অনন্যসাধারণ কবিপ্রতিভার অধিকারী বিদ্যাপতি শৈব ও গাণপত্যের উপাসক হয়েও এবং মাতৃভাষা মৈথিলি হওয়া সত্ত্বেও রাধাকৃয়লীলা-বিষয়ক পদাবলিতে যে রচনারীতি, বাগবৈদগ্ধ, সুক্ষ্ম ব্যঞ্জনা উপস্থাপিত করে অপূর্ব শিল্পসৌকর্য ও অনন্যসাধারণ কাব্যিক রস উপস্থাপিত করেছেন, তা অভাবনীয়।

বিদ্যাপতি রাজসভার কবি হওয়ায় তাঁর রচনা বৈশিষ্ট্যে মার্জিত ভাষা এবং বিদগ্ধ মণ্ডনকলার প্রকাশ যেমন রয়েছে, তেমনি আদিরসের আতিশয্যও রয়েছে অধিক। বিদ্যাপতির রাধা মর্তজীবনের ভোগবতী পথে যাত্রা শুরু করে ধীরে ধীরে অমৃত প্রেমের উন্নীত ভাবলোকে সুপ্রতিষ্ঠিত। তাই তাঁর রাধা প্রথমদিকে দেহজ কামনায় চঞ্চল, পরে প্রেমের জাগরণ, ব্যাকুলিত হৃদয় নিয়ে বৈষ্ণবীয় ভাবপরিমণ্ডলে উত্তীর্ণ। বিদ্যাপতি রাধা চরিত্রের ক্রমপরিণতি অঙ্কনে বয়ঃসন্ধি, অভিসার-মিলন-মান, বিরহ বা মাথুর ও ভাব সম্মিলন-এর পদরচনায় অসামান্য কবিপ্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। 

বিপ্রলম্ভ প্রেমের গভীরতা বিদ্যাপতির পদে অস্ফুট রাধিকাকে বাঙ্ময় করে তুলেছে – 

“জনম অবধি হম রূপ নেহারলু

নয়ন না তিরপতি ভেল

লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয়ে রাখলু 

তবু হিয়া জুড়ল না গেল।” 

বিদ্যাপতির রাধা বিরহে পৌঁছে বেদনা সান্ত্বনা মানে নি –

“সখি হমারি দুখক নাহি ওর

এ ভরা বাদর মাহ ভাদর

শূন্য মন্দির মোর।” 

বিদ্যাপতির প্রার্থনা বিষয়ক একটি পদে যেভাবে তাঁর অন্তিম আকুতি উদ্‌গ্রীব হয়েছে তাতে তাঁকে বৈষ্ণব ভক্ত বলেই মনে হয়। যেমন –

“মাধব, বহুত মিনতি করি তোয়। 

দেই তুলসী তিল, এ দেহ সমৰ্পিলুঁ

দয়া জানি ছোড়বি মোয়।”

ড. অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, “ভাষা, ছন্দ, অলংকার, গীতিধর্মিতায় তাঁর পদ পূর্ব-ভারতের শীর্ষ স্থানীয়। ‘মৈথিল কোকিল’ ও ‘অভিনব জয়দেব, বিদ্যাপতি ঠাকুর ভিনপ্রদেশী হয়েও বৈষ্ণবপদের জন্যই বাঙালির পরমাত্মীয় বলে গৃহীত হয়েছেন।” পরিশেষে বলা যায়, বিদ্যাপতির রাধার প্রেমে আনন্দ ও বেদনা একাত্মীভূত হয়ে গেছে এবং তাঁর পদে আধ্যাত্মভাব অপেক্ষা মানবীয় আবেগের গভীরতা অধিক। অসামান্য ভাষাশৈলী এবং চিত্রনির্মাণের ক্ষমতা বিদ্যাপতির পদকে শাশ্বত কাব্যমূল্য দান করেছে।

বাংলা সাহিত্যে অন্তর্ভুক্ত করার কারণ :- বাংলা কাব্যভূবন বিদ্যাপতির কবিপ্রতিভার আলোকে আলোকিত হলেও কবি কিন্তু বাঙালি নন, একছত্রও বাংলা পংক্তি রচনা করেন নি, তবু বাঙালির হৃদয়মন্দিরে তিনি প্রতিষ্ঠিত আছেন। তাঁকে বাংলা সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত করার কারণ নিম্নরূপ –

(ক) তৎকালীন মিথিলা ও বাংলা উভয় স্থান সংস্কৃতচর্চার পীঠস্থান ছিল। সেই কারণে মিথিলার ছাত্র বাংলায় এবং বাংলার ছাত্র মিথিলায় আসা-যাওয়া করত। তার ফলে উভয়দেশের মধ্যে আত্মিক যোগসূত্র গড়ে ওঠে।

(২) স্বয়ং শ্রীচৈতন্যদের নিত্য তাঁর পদগান আস্বাদন করতেন। চৈতন্য কর্তৃক আস্বাদিত হয়েই বিদ্যাপতির রাধাকৃষ্ণ-বিষয়ক পদাবলি বাংলার বৈষ্ণব সমাজে সমাদর ও সশ্রদ্ধ স্বীকৃতি লাভ করেছে।

(গ) পরবর্তীকালে বাঙালি বৈষ্ণব কবিগণ বিদ্যাপতির আদর্শে অসংখ্য পদ রচনা করেছেন। বিশেষত, গোবিন্দদাস তাঁর পদগান অনুকরণ ও অনুসরণ করে পদরচনা করেছেন। আর এই কারণেই তিনি ‘দ্বিতীয় বিদ্যাপতি’ নামে অভিহিত হয়ে থাকেন। রবীন্দ্রনাথও প্রথম যৌবনে বিদ্যাপতির রচনাদর্শে ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলি রচনা করেছিলেন।

(৪) বাংলার বৈষ্ণব মহাজনেরা পরম নিবিড় ভালোবাসা দিয়ে তাঁকে নিজেদের করে নিয়েছেন। সেই সঙ্গে, রসিক বাঙালি হৃদয়ও তাকে আপন করে নিয়েছে।

বিদ্যাপতির চিরন্তন বাসভূমি বাঙালির হৃদয় মন্দিরে। শ্রদ্ধেয় দীনেশচন্দ্র সেন যথার্থ বলেছেন, “বাঙালি বিদ্যাপতির পাগড়ী খুলিয়া লইয়া ধুতি চাদর পরাইয়া দিয়াছে।”

২। বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্যে চণ্ডীদাসের অবদান আলোচনা করো। 

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ভাবগত ও ভাষাগত দিক দিয়ে এক অনন্য কবিব্যক্তিত্ব যিনি বাঙালি চিত্তকে পদাবলির অমৃতময় কাব্য রসসিঞ্চনে সিক্ত করে আপ্লুত করেছেন, তিনি হলেন পদাবলির চণ্ডীদাস। বৈষ্ণব পদাবলিতে চণ্ডীদাস রাধাকৃষ্ণের প্রেমকে বিরহের আগুনে পুড়িয়ে পুড়িয়ে নিখাদ সোনায় রূপান্তরিত করেছেন। প্রেম যে দ্রবীভূত হৃদয়, কান্না যে বিগলিত নয়ন এবং হাসি যে ছলছল আত্মা চণ্ডীদাস পাঠকদের তা কাব্যের মধ্য দিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন। তাই তাঁর পদে অমর প্রেমের দীপশিখার আলোক আজও পাঠকের চিত্তকে ভাবিয়ে তোলে এই ভাবতন্ময়তাই কবির কাব্যের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য।

চণ্ডীদাসের রাধার অন্তরে পূর্বরাগ সৃষ্টি হয়েছে শ্যাম নামটি শোনার মধ্য দিয়ে এবং শুধু নাম জপতে জপতেই কৃষ্ণপ্রেমের অনুরাগে হৃদয় রঞ্জিত হয়ে ওঠার আগেই বেদনাক্লিষ্ট হয়ে যায় রাধার মন। তাই তো বেদনাবিহ্বল কণ্ঠে সখিদের বলে,

“সই, কেবা শুনাইল শ্যাম নাম।

কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো 

আকুল করিল মোর প্রাণ।”

চণ্ডীদাসের রাধা প্রথম থেকেই কৃষ্ণগতপ্রাণা, যৌবনে যোগিনী, সমাহিতচিত্ত তপস্বিনীর মতো কৃষ্ণধ্যানে তন্ময়া –

“বিরতি আহারে               রাঙাবাস পরে

           যেমত যোগিনী পারা।

চণ্ডীদাস আক্ষেপানুরাগের পদে তুলনাহীন। সেখানে সমাজ, পরিবার ও প্রেমের দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত সত্তার আর্ত হাহাকার শোনা যায়। তাইতো রাধা কখনও বলেন, “বঁধু সকলি আমার দোষ।” আবার বলেন, “তোমার বঁধুয়া আন বাড়ি যায় আমার আঙিনা দিয়া।” তাই তার উক্তি, “আমার পরাণ যেমতি করিছে, তেমতি হউক সে।”

রাধার প্রেমের গভীরতা কত, তা চণ্ডীদাসের বিরহের পদে বোঝা যায়। কৃষ্ণবিরহে মুমূর্ষু রাধার অন্তরে সখীদের কোনো আশ্বাসবাণী তাকে তৃপ্ত করছে না বরং তাঁর মনে হয়েছে, “না হয় মরণ না রহে জীবন।” চণ্ডীদাসের ভাবোল্লাসের পদে বিপ্রলম্ভ রসের ব্যঞ্জনা এবং মিলনের দিনেও রাধার মনে উল্লাসের উত্তাপ নেই, বরং রয়েছে করুণার ঘনশ্যাম ছায়া। তাইতো রাধা বলেন,

“বহুদিন পরে বঁধুয়া এলে

দেখা না হইত পরাণ গেলে ।।

দুখিনীর দিন দুখেতে গেল। 

মথুরা নগরে ছিলে তো ভালো।”

চণ্ডীদাসের ভাষাভঙ্গিমা, ছন্দপ্রকরণ, বাণীবিন্যাস খুবই সাদামাটা। “কানুর পীরিতি চন্দনের রীতি ঘষিতে সৌরভময়,” “জল বিনে মীন যেন কবহুঁ না জীয়ে” প্রভৃতি বাক্যে বৈদগ্ধের খরশাণিত বিদ্যুদীপ্তি নেই, আছে ভোর আকাশের স্নিগ্ধ তারার নম্র আলোর দ্যুতি।

৩। বৈষ্ণব পদকর্তা জ্ঞানদাসের কবিপ্রতিভার পরিচয় দাও।

চৈতন্য পরিমণ্ডলের অন্যতম শক্তিমান কবি জ্ঞানদাস। তার কবিত্ব সরসীর মাঝখানে শুধু মধ্যযুগের নয়, আধুনিক যুগের ‘রসিক মরাল’ও অনায়াস সন্তরণের সুখ অনুভব করেন। 

জ্ঞানদাসের প্রতিভার স্ফূর্তি ঘটেছে পূর্বরাগ, অনুরাগ, রূপানুরাগ ও রসোদগারের পদে। পূর্বরাগ ও অনুরাগ পর্যায়ের পদে কৃষ্ণরূপ বর্ণনায় জ্ঞানদাসের ‘আত্মলীনতা’ একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য এবং এই কারণেই তিনি বৈষ্ণব কবিকুলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোমান্টিক গীতিগুণের অধিকারী।

জ্ঞানদাসের বাৎসল্যরসের পদ খুবই আকর্ষণীয়। তাঁর গোষ্ঠলীলার পদে গোপবালক ও কৃষ্ণজননী যশোদার নিবিড় কৃষ্ণপ্রীতি ও বাৎসল্যের পরিচয় পাওয়া যায়। কবির বিশেষ কৃতিত্ব সখ্যরসের সঙ্গে মধুররসের মিশ্রণ ঘটানো – ‘সাজ সাজ বলিয়া পড়িয়া গেল সাড়া।’ 

জ্ঞানদাসের আক্ষেপানুরাগের পদে একদিকে কৃষ্ণপ্রেম অন্যদিকে সমাজ-সংসার উভয়ের মাঝখানে দ্বিধাগ্রস্ত রাধার ব্যাকুলতা ফুটে উঠেছে এবং চণ্ডীদাসের রাধার যন্ত্রণার মতো জ্ঞানদাসের রাধাও যন্ত্রণাকাতর। তাই সখীকে ডেকে রাধা বলেন, ‘মনের মরম কথা শুন লো সজনি।’ তবে জ্ঞানদাসের রাধার খন্ডিতা রূপের মধ্যে একটা বিদ্রোহের ভাব প্রচ্ছন্ন –

“সই কত রাখিব হিয়া। 

আমার বঁধুয়া আন বাড়ি যায়, আমার আঙিনা দিয়া ॥

যেদিন দেখিব আপন নয়নে, আন জন সঞে কথা।

কেশ ছিঁড়ে ফেলি বেশ দূর করি, ভাঙিব আপন মাথা।”

কবিধর্মের বিশেষ বৈশিষ্ট্য রোমান্টিকতা, তার পরিচয় পাই –

“রূপের পাথারে আঁখি ডুবিয়া রহিল।

যৌবনের বনে মন পথ হারাইল।”

জ্ঞানদাসের কিছু পদ রূপকল্প হিসাবে প্রথম শ্রেণির কবিকৃতির উজ্জ্বল স্বাক্ষর বলেই বিবেচিত। 

“রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর। 

প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর।”

এমনই আর একটি পদ –

“তোমার গরবে গরবিনী হাম রূপসী তোমার রূপে।”

জ্ঞানদাসের কবিপ্রতিভার সঙ্গে চণ্ডীদাসের প্রভাবই তার পদে অন্তর্লীন। সহজ লাবণ্য, অলংকার বিরল সৌন্দর্যের গভীর রূপ দুজনেরই উপাসা বিষয়। তবে চণ্ডীদাস বেদনার কবি আর জ্ঞানদাসের পদ অবিরল মাধুর্যের বর্ষণে সিক্ত। জ্ঞানদাস সহজ-সরল চিত্রধর্মী পদাবলি রচনা করে শাস্ত্রে, তত্ত্ব ও অপ্রাকৃত দর্শনের সঙ্গে প্রাকৃত প্রেমলীলার অপূর্ব সমন্বয় সাধন করেছেন।

৪। জ্ঞানদাসকে চণ্ডীদাসের ভাবশিষ্য বলার যৌক্তিকতা বিচার করো। 

জ্ঞানদাস বাংলা, ব্রজবুলি ও বাংলা-ব্রজবুলি বিমিশ্র – তিন রকমের ভাষাতেই পদরচনা করেছেন। কিন্তু যেসব গুণের জন্য জ্ঞানদাস চৈতন্যোত্তর পদকর্তাদের মধ্যে অতুল্য তার প্রায় সমস্তগুলি বাংলা ভাষায় লেখা। ভাবের নিবিড়তা এবং প্রকাশভঙ্গির অনাড়ম্বর সাবলীলতাই এইসব পদের শ্রেষ্ঠ বৈশিষ্ট্য। এই কারণে জ্ঞানদাসকে চণ্ডীদাসের সার্থক উত্তরসূরি বলে অভিহিত করা হয়।

চন্ডীদাস প্রধানত ভাবের কবি, জ্ঞানদাসও তদনুরূপ। একটি পরিচিত পদ

“সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু

অনলে পুড়িয়া গেল। 

অমিয় সাগরে সিনান করিতে

সকলি গরল ভেল।”

বৈষ্ণব পদসংগ্রহে এই পদ কখনও চণ্ডীদাসের, কখনো-বা জ্ঞানদাসের ভণিতায় উল্লিখিত হয়েছে। পদটির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ও বাকরীতি যেন চণ্ডীদাসকেই মনে করিয়ে দেয়। রাধাকৃষ্ণ প্রেমলীলার শিল্পী হিসেবে চণ্ডীদাসকে গভীরতম প্রাণবেদনার গীতিকার বলা যায়, আর জ্ঞানদাসকে বলা যায় ওই একই বেদনার সার্থক রূপদক্ষ শিল্পী। উভয়ের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে মতামতের নিরিখে দুটি পদ উপস্থাপিত করা যায়। কৃষ্ণরূপানুরাগে জ্ঞানদাসের পদে শোনা যায় –

“রূপের সায়রে আঁখি ডুবিয়া বহিল।

যৌবনের বনে মন হারাইয়া গেল।

ত্রিভঙ্গ হইয়া রূপ অন্তরে পশিল।

অনেক যতন কৈল বাহির না হৈল।।”

পাশাপাশি চণ্ডীদাসের পদে একই আর্তির অভিব্যক্তি শোনা যায় – 

“কাহারে কহিব মনের বেদনা

কেবা যাবে পরতীত।

হিয়ার মাঝারে পশিয়া রহিলে,

সদাই পরশে চিত।।”

তবে চণ্ডীদাসের রাধা যেমন আদ্যন্তই বিষাদপ্রতিমা, জ্ঞানদাসের রাধা তা নন।

৫। বৈষ্ণব পদকর্তা হিসাবে গোবিন্দদাসের কাব্যোৎকর্ষ বিচার করো।

সংস্কৃত সাহিত্যে বিদগ্ধ পণ্ডিত গোবিন্দদাস। তিনি প্রৌঢ় বয়সে পদ রচনা আরম্ভ করেছিলেন। বল্লভ দাস গোবিন্দদাস বন্দনায় তাকে ‘দ্বিতীয় বিদ্যাপতি’ বলে অভিহিত করেছেন।

গোবিন্দদাস বিদ্যাপতির কবিপ্রতিভার রাজসিক ঐশ্বর্যে আকৃষ্ট হয়েছিলেন, বিদ্যাপতির পদের সঙ্গে গোবিন্দদাসের পদের ভাবসাদৃশ্যগত এবং রূপসাদৃশ্যগত অনেকটা মিল রয়েছে।

গোবিন্দদাস ক্লাসিকাল রীতিবিন্যাসে, সংগীতধর্মে, জ্ঞানগভীরতায় ছিলেন অন্যতম শ্রেষ্ঠ পদকর্তা। তিনি নিজের কবিতার শিল্পরীতি ও ধ্বনিসৌন্দর্য সম্পর্কে সচেতন ছিলেন, তাই তিনি নিজের কাব্যাদর্শ সম্পর্কে বলেছেন,

“রসনারোচন লোচনবিলাস।

রচই রুচির পদ গোবিন্দদাস।”

শব্দে, ছন্দে, অলংকারে ও চিত্রসৃষ্টিতে গোবিন্দদাস কাব্যের যে শিল্পমূর্তি গড়েছেন, তা অনুপম। গোবিন্দদাসের পদে কবি, সাধক ও শিল্পীর ত্রিবেণিসংগম ঘটেছে। গৌরাঙ্গবিষয়ক পদরচনায় গোবিন্দদাস অসামান্য কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন: যাতে তিনি ভক্তহৃদয়ের আকুতি মিলিয়ে অপরূপ সৌন্দর্যময় শ্রীগৌরাঙ্গের ভাবতন্ময় দিব্যমূর্তি অঙ্কন করেছেন।

নীরদ নয়নে                নীর ঘন সিঞ্চনে

            পুলক-মুকুল-অবলম্ব।

স্বেদ মকরন্দ               বিন্দু বিন্দু চুয়ত

          বিকশিত ভাব-কদম্ব।”

গোবিন্দদাস ভক্তের শ্রদ্ধা, শিল্পীর রূপদর্শনের মুগ্ধতা ও তন্ময়তা নিয়ে রাধাকৃষ্ণের রূপবর্ণনা করেছেন।

“নন্দ নন্দন চন্দ চন্দন

          গন্ধ নিন্দিত অঙ্গ।

জলদ সুন্দর কম্বু কন্ধর

          নিন্দিত সিন্ধুর ভঙ্গ।।”

গোবিন্দদাস রূপদক্ষ কবি, যা কৃষ্ণের রূপদর্শনে রাধার প্রতিক্রিয়ায় বর্ণিত –

“ঢল ঢল কাঁচা অঙ্গের লাবণি

         অবনী বহিয়া যায়।

ঈষত হাসির তরঙ্গ হিল্লোলে

          মদন মুরুছা পায়।”

গোবিন্দদাসের শ্রেষ্ঠত্ব অভিসার পর্যায়ের পদরচনায়। অভিসারের পদের আবেগ, নিষ্ঠা ও দুরূহ দুর্গমকে উত্তীর্ণ হওয়ার অভীপ্সা সবই গোবিন্দদাসের পদে বর্তমান।

“কন্টক গাড়ী             কমলসম পদতল

            মঞ্জীর চীরহি ঝাঁপি।

নাগরিক বালি             ঢারি করি পীছল

            চলতহি অঙ্গুলি চাপি।”

গোবিন্দদাস চমৎকার শব্দচয়ন, ছন্দবিন্যাস, অলংকার প্রয়োগের যাথার্থ্য বজায় রেখে শিল্পকলার নিখুঁত নৈপুণ্য প্রকাশ করেছেন। ক্লাসিক ও রোমান্টিক ধর্মের এমন সার্থক সমন্বয় কদাচিৎ দেখা যায়। তাই চৈতন্যোত্তর যুগের শ্রেষ্ঠ পদকর্তা হিসাবে গোবিন্দদাসের নাম চিরদিন উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।

Leave a Comment