মঙ্গলকাব্য: মধ্যযুগে বাংলার সমাজ ও সাহিত্য-বাঙ্গালীর শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি

মঙ্গলকাব্য: মধ্যযুগে বাংলার সমাজ ও সাহিত্য-বাঙ্গালীর শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি

মঙ্গলকাব্য-মধ্যযুগে বাংলার সমাজ ও সাহিত্য-বাঙ্গালীর শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি

১। প্রাচীন মঙ্গলকাব্যের নাম কী?

(ক) অন্নদামঙ্গল

(খ) মনসামঙ্গল

(গ) ধর্মমঙ্গল

(ঘ) চণ্ডীমঙ্গল

২। মনসামঙ্গল কাব্যকে অন্য কী নামে অভিহিত করা হয়?

(ক) বিষ্ণুপুরাণ

(খ) ব্রহ্মপুরাণ

(গ) পদ্মাপুরাণ

(ঘ) কালিকাপুরাণ 

৩। মনসামঙ্গল কাব্যের একজন কবির নাম লেখো।

(ক) নারায়ণদেব

(খ) বিদ্যাপতি 

(গ) চণ্ডীদাস

(ঘ) জ্ঞানদাস

৪। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের একজন কবির নাম লেখো।

(ক) কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ

(খ) চণ্ডীদাস

(গ) মুকুন্দরাম চক্রবর্তী

(ঘ) জ্ঞানদাস

৫। মুকুন্দরামের ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কী নামে পরিচিত?

(ক) অন্নদামঙ্গল

(খ) অনদ্যামঙ্গল

(গ) পদ্মাপুরাণ

(ঘ) অভয়ামঙ্গল

৬। দ্বিজমাধব কোন্ কাব্যের রচয়িতা ?

(ক) মনসামঙ্গল

(খ) চণ্ডীমঙ্গল

(গ) ধর্মমঙ্গল

(ঘ) অন্নদামঙ্গল

৭। ধর্মমঙ্গল কাব্যের একজন কবির নাম লেখো।

(ক) দ্বিজমাধব

(খ) নারায়ণ দেব

(গ) কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ

(ঘ) ঘনরাম চক্রবর্তী

৮। অষ্টাদশ শতকের একজন কবির নাম লেখো।

(ক) চণ্ডীদাস

(খ) ঘনরাম চক্রবর্তী

(গ) জ্ঞানদাস

(ঘ) দ্বিজমাধব

৯। ‘অভয়ামঙ্গল’ কাব্যটি কার লেখা?

(ক) নারায়ণ দেব

(খ) দ্বিজ মাধব

(গ) মুকুন্দরাম চক্রবর্তী

(ঘ) জ্ঞানদাস

১০। একটি অপ্রধান মঙ্গলকাব্যের নাম হল –

(ক) কৃষ্ণমঙ্গল

(খ) অভয়ামঙ্গল

(গ) মনসামঙ্গল

(ঘ) চণ্ডীমঙ্গল

১১। কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ কোন্ মঙ্গলকাব্যের কবি?

(ক) চণ্ডীমঙ্গল

(খ) ধর্মমঙ্গল

(গ) মনসামঙ্গাল

(ঘ) অন্নদামঙ্গল

১২। মুক্তারাম সেন কোন মঙ্গলকাব্যের কবি?

(ক) মনসামঙ্গল

(খ) চণ্ডীমঙ্গল

(গ) অনাদ্যমঙ্গল

(ঘ) ধর্মমঙ্গল

১৩। ‘কালকেতু ও ফুল্লরা’ কোন মঙ্গলকাব্যের কাহিনি ?

(ক) মনসামঙ্গল

(খ) ধর্মমঙ্গল

(গ) চণ্ডীমঙ্গল

(ঘ) অন্নদামঙ্গল

১৪। ‘রাজা হরিশ্চন্দ্র ও মদনা’ কোন মঙ্গলকাব্যের কাহিনি?

(ক) ধর্মমঙ্গল

(খ) মনসামঙ্গল

(গ) চণ্ডীমঙ্গল

(ঘ) কালিকামঙ্গল

১৫। ধনপতি ও খুল্লনা কোন্ মঙ্গলকাব্যের কাহিনি?

(ক) মনসামঙ্গল

(খ) চণ্ডীমকাল

(গ) ধর্মমঙ্গল

(ঘ) অন্নদামঙ্গन

১৬। বীর লাউসেন কোন্ মঙ্গলকাব্যের কাহিনি ?

(ক) ধর্মমঙ্গল 

(খ) মনসামঙ্গল

(গ) চণ্ডীমঙ্গল

(ঘ) কালিকামঙ্গল

১৭। জয়নারায়ণ সেন কোন মঙ্গলকাব্যের কবি?

(ক) ধর্মমঙ্গল

(খ) মনসামঙ্গল

(গ) চণ্ডীমঙ্গল

(ঘ) অভয়ামঙ্গল

১৮। মুকুন্দরাম চক্রবর্তী কোন জেলার লোক ছিলেন?

(ক) হাওড়া

(খ) বর্ধমান

(গ) বীরভূম

(ঘ) নদিয়া

১৯। বাংলার মনসাদেবী আর্যেতর — সংস্কার থেকেই আবির্ভূত।

(ক) দ্রাবিড়

(খ) ভোটচিনীয়

(গ) অস্ট্রিক

(ঘ) কোনোটাই নয়

২০। চাঁদসদাগর পুত্র লখিন্দরের জন্য কোন পর্বতে বাসরঘর নির্মাণ করেছিলেন?

(ক) সান্তালি

(খ) নন্দন

(গ) ত্রিকূট

(ঘ) কোনোটাই নয়

২১। মনসামঙ্গল কাব্যের একজন প্রতিষ্ঠিত কবি হলেন –

(ক) মুকুন্দরাম চক্রবর্তী

(খ) নারায়ণ দেব

(গ) ঘনরাম চক্রবর্তী

(ঘ) এঁদের কেউ নন

২২। বিপ্রদাস পিপলাই এর লেখা কাব্যটির নাম হল –

(ক) মনসাবিজয়

(খ) পদ্মাপুরাণ

(গ) অভয়ামঙ্গল

(ঘ) কোনোটা নয়

২৩। নারায়ণদেব রচিত কাব্যের নাম হল –

(ক) ধর্মমঙ্গল 

(খ) অন্নদামঙ্গল

(গ) চণ্ডীমঙ্গল

(ঘ) পদ্মাপুরাণ

২৪। নারায়ণদেব তাঁর কাব্যে কোন রসের বর্ণনায় বিশিষ্টতা দেখিয়েছেন?

(ক) বীর

(খ) করুণরস 

(গ) আদিরস

(ঘ) কোনোটাই নয়

২৫। চণ্ডীমঙ্গল কব্যের একজন উল্লেখযোগ্য কবি হলেন –

(ক) নারায়ণদের

(খ) মুকুন্দরাম চক্রবর্তী

(গ) বিপ্রদাস পিপলাই

(ঘ) এঁদের কেউ নন

২৬। চণ্ডীমঙ্গলের কাহিনি হল –

(ক) লহনা-খুলনার গল্প

(খ) বেহুলা-লখিন্দরের গল্প 

(গ) হরিশ্চন্দ্র মদনার গল্প

(ঘ) লাউসেন কাহিনি

২৭। ধর্মমঙ্গল কাব্যের উল্লেখযোগ্য কবি হলেন –

(ক) নারায়ণদের

(খ) দ্বিজমাধব

(গ) ঘনরাম চক্রবর্তী

(ঘ) এঁদের কেউ নন

২৮। মানিক দত্ত কোন কাব্যের আদিকবি হিসেবে পরিচিত?

(ক) ধর্মমঙ্গল

(খ) মনসামঙ্গল 

(গ) অন্নদামঙ্গল

(ঘ) চণ্ডীমঙ্গল

২৯। কবি দ্বিজমাধব-এর অপর একটি নাম ছিল –

(ক) মাধব

(খ) মাধব আচার্য

(গ) মধু আচার্য

(ঘ) কোনোটিই নয়

১। মঙ্গলকাব্যগুলির মধ্যে কোনটি প্রাচীন?

মঙ্গলকাব্যগুলির মধ্যে ‘মনসামঙ্গল’ প্রাচীন কাব্য।

২। মনসামঙ্গল কাব্যকে আর কী নামে অভিহিত করা হয়? 

মনসামঙ্গল কাব্যকে ‘পদ্মাপুরাণ’ নামে অভিহিত করা হয়।

৩। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের নরখণ্ডের দুটি কাহিনির নাম লেখো।

চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের নরখণ্ডের দুটি কাহিনি হল কালকেতু ব্যাধের কাহিনি ও ধনপতি সদাগরের আখ্যান।

৪। মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কী নামে পরিচিত? 

মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গল ‘অভয়ামঙ্গল’ নামে পরিচিত।

৫। ধর্মঠাকুরের কাহিনি কোন যুগে উদ্ভব হয়েছিল?

পালযুগে ধর্মঠাকুরের কাহিনির উদ্ভব হয়েছিল।

৬। ধর্মমঙ্গল কাব্যের মধ্যে কোন কবির গ্রন্থ প্রাচীন?

ধর্মমঙ্গল কাব্যের প্রাপ্ত পুথির মধ্যে রূপরাম চক্রবর্তীর পুথি সর্বাপেক্ষা

৭। চারটি অপ্রধান মঙ্গলকাব্যের নাম লেখো।

চারটি অপ্রধান মঙ্গলকাব্য হল শীতলামঙ্গল, ষষ্ঠীমঙ্গল, সারদামঙ্গল ও কৃষ্ণমঙ্গল।

৮। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের শ্রেষ্ঠ রচয়িতার নাম ? 

চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের শ্রেষ্ঠ রচয়িতা হলেন কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী।

৯। বাংলায় মনসামঙ্গলের কয়টি ধারা ও কী কী ? 

বাংলায় মনসামঙ্গলের তিনটি ধারা – রাঢ়ের ধারা, পূর্ববঙ্গের ধারা এবং উত্তরবঙ্গ ও কামরূপের ধারা।

১০। মনসার নাম কেতকা কেন?

কেয়াপাতায় মনসার জন্ম হয়েছিল বলে তাঁর নাম কেতকা।

১১। মনসাদেবীকে কে ‘চেঙমুড়ি কানি’ বলেন ? 

মনসাদেবীকে চাঁদসদাগর ‘চেঙমুড়ি কানি’ বলেন।

১২। চাঁদসদাগর কোন দেবতার ভক্ত ছিলেন ?  

চাঁদসদাগর শিবের ভক্ত ছিলেন।

১৩। নীলাম্বর মর্তে কোথায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন?

নীলাম্বর মর্তে ব্যাধের গৃহে ধর্মকেতুর পুত্র কালকেতুরূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

১৪। মনসামঙ্গল কাব্যে ‘মনসা’ নামটির উৎপত্তি কোথা থেকে? 

ড. সুকুমার সেনের মতে, ঋগ্বেদে রুদ্রের ক্রোধ ‘মনা’ নামে অভিহিত, সেই ভাবনা থেকেই মনসা নামের উৎপত্তি।

১৫। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের আদি কবি কে? 

চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের আদি কবি মানিক দত্ত ।

১৬। মুকুন্দরাম চক্রবর্তী কোন সময়ের কবি? 

মুকুন্দরাম চক্রবর্তী ষোড়শ শতকের কবি।

১৭। ধর্মমঙ্গল কাব্যের চারজন কবির নাম লেখো।

ধর্মমঙ্গল কাব্যের চারজন কবি হলেন রূপরাম চক্রবর্তী, ঘনরাম চক্রবর্তী, সীতারাম দাস এবং যদুনাথ রায়।

১৮। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের চারটি চরিত্রের নাম লেখো। 

চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের চারটি চরিত্র হল ফুল্লরা, ভাড়ু দত্ত, মুরারি শীল, দুর্বলা দাসী।

১। চণ্ডীমঙ্গলের শ্রেষ্ঠ কবি কে? তাঁর কাব্যপ্রতিভা আলোচনা করো।   

১+৪  (২০১৫, ২০১৯, ২০২৩)

চণ্ডীমঙ্গলের শ্রেষ্ঠ কবি হলেন কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী। তাঁর রচিত গ্রন্থ ভণিতায় ‘অভয়ামঙ্গল’, ‘চণ্ডিকামঙ্গল’, ‘অম্বিকামঙ্গল’, ‘গৌরীমঙ্গল’, ‘কবিকঙ্কন চণ্ডী’ প্রভৃতি নামে উল্লিখিত থাকলেও ‘অভয়ামঙ্গল’ নামে বেশি প্রচলিত।

মুকুন্দরাম চক্রবর্তী চণ্ডীমঙ্গলের আদিকবি মাণিক দত্তের কাহিনি অনুসরণ করে কাব্য রচনা করলেও কাহিনির পূর্ণতা দেওয়ার জন্য নানান বৈচিত্র্যের সঞ্চার করেছেন। কবির শিল্পকৃতির বিশিষ্টতা বা শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় পাওয়া যায় চরিত্রচিত্রণে। মুকুন্দরাম জীবনে বহু দুঃখকষ্টের মধ্যে পড়ে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে বাস্তব পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছিলেন, যার জন্য চরিত্রগুলি খুবই দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

কবির কাব্যে সর্বত্র দরিদ্র মানুষের প্রতি মমতা ও সহানুভূতির প্রকাশ ঘটেছে। এই কারণে তাকে দুঃখের কবি বলে অভিহিত করেছেন অনেকেই। তবে কবি দারিদ্র্যের কাছে আত্মসমর্পণ করেন নি, দাম্পত্য সম্পর্কের মাধুর্য নষ্ট করেন নি, দুঃখ বেদনা ও নৈরাশ্য জয় করে জীবনকে রসযুক্ত করে তুলতে চেষ্টা করেছিলেন। তাই তাকে জীবনরসিক শিল্পী বলা যায়। 

কালকেতুর আখ্যানের তুলনায় ধনপতি শ্রীমন্তের কাহিনি অনাবশ্যক দীর্ঘ, কিন্তু চরিত্রচিত্রণের গুণে তা ক্লান্তিকর হয়ে ওঠে নি। লহনা-খুল্লনা কলহ, দুর্বলা দাসীর শঠতা, ধনপতির বাড়িতে নিমন্ত্রণে বণিকদের দলাদলি, নৌপথের বর্ণনা প্রভৃতি অংশ কবির বাস্তব দৃষ্টি এবং পরিহাসপ্রিয়তার গুণে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। বিশেষত মুরারি শীলের চরিত্র কবির স্বকপোলকল্পিত এক অমর সৃষ্টি, ভাড়ুদত্ত চরিত্র বাংলা সাহিত্যে দ্বিতীয় রহিত। 

কবির দক্ষ ঔপন্যাসিক গুণ ছিল বলে অনেকে মনে করেন। মুকুন্দরাম ভাবুক কবি নন, প্রত্যক্ষ জীবনের কবি। তাঁর রচনার ভাষা সরল ও অকৃত্রিম। ফলে অলংকার, বাকবৈদ্গদ্ধ এবং আতিশয্যের উচ্ছ্বাস তাঁর কাব্যে বিশেষ ফুটে ওঠে নি। জীবনদৃষ্টির প্রসন্নতা এবং মানুষের প্রতি সহৃদয় মমত্ববোধ কবির সৃষ্টিকে কালজয়ী করে তুলেছে।

২। মঙ্গলকাব্য কাকে বলে? কাব্যের এরূপ নামকরণের কারণ কি?

মঙ্গলকাব্য হল দেবদেবীর লীলামাহাত্ম্যমূলক আখ্যান। এই আখ্যানকাব্যের মৌল লক্ষ্য হল আরাধ্য দেবদেবীর পুজা প্রচার। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যকাল পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যে বিভিন্ন দেবদেবী বিষয়ক মঙ্গলকাব্য রচনার প্রচলন ছিল।

দেবমাহাত্ম্যমূলক আখ্যানকাব্যের নাম ‘মঙ্গল’ হল কেন, সে সম্পর্কে গবেষকগণ বিভিন্ন মত পোষণ করেছেন। কেউ কেউ মনে করেন, যে সুরে এই কাব্য গাওয়া হত, সেই সুরের নাম ‘মঙ্গলরাগ’। আবার কবি জয়দের ‘মঙ্গলরীতি’ শব্দটি ব্যবহার করলেও মঙ্গলসুরের কোনো কথা উল্লেখ করেন নি। 

কেউ-কেউ বলেন যে, দেবতার লীলামাহাত্ম্যমূলক কাব্য শ্রবণে ভক্তের মঙ্গল হয়, তাই মঙ্গল শব্দটি ব্যবহৃত হয়। অনেকের মতে এক মঙ্গলবার থেকে আরেক মঙ্গলবার পর্যন্ত আটদিন ধরে এই কাব্য গীত হত বলে একে মঙ্গলকাব্য বলা হয়ে থাকে। তাছাড়া আটদিন ধরে এই কাব্য গীত হত বলে একে ‘অষ্টমঙ্গলা’ও বলে। 

চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে আছে মঙ্গল নামক দৈত্যকে চণ্ডী বধ করেছিলেন, তাই মঙ্গলকাব্য নাম। আবার কেউ বলেন রাত্রি জেগে এই পালা গাওয়া হত বলে, ‘মঙ্গলকাব্য’কে অনেক সময় ‘জাগরণ’ বলে উল্লেখ করা হয়। ‘মঙ্গল’ শব্দটি জনপ্রিয়তার জন্য শাক্তবিরোধী বৈষ্ণব কবিরাও নিজেদের কাব্যের নামকরণে মঙ্গল কথাটি ব্যবহার করেছিলেন।

৩। মঙ্গলকাব্যের সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো।

প্রাচীন বাংলা মঙ্গলকাব্যগুলি দেবমাহাত্মাজ্ঞাপক পাঁচালি, যেখানে চণ্ডী, মনসা, ধর্ম বা অন্য কোনো দেবতার মহিমা বা পূজা প্রচারই মঙ্গলকাব্যগুলির মূল লক্ষ্য। মঙ্গলকাব্যগুলির গঠনবিন্যাস প্রায় একই রকম। যেমন বন্দনা, গ্রন্থোৎপত্তির কারণ ও আত্মবিবরণ, দেবখণ্ড, চার নরখণ্ড। প্রথমে কবি গণেশ প্রভৃতি পঞ্চদেবতার বন্দনা করে গ্রন্থোৎপত্তির কারণ উল্লেখ করেন। 

এরপর সৃষ্টিরহস্য থেকে শিব, সতী ও উমার কাহিনি এবং পরবর্তী অংশে স্বর্গভ্রষ্ট কোনো দেবতার মানবরূপে জন্ম এবং তাঁর চেষ্টায় মঙ্গলকাব্যের দেব-দেবীর পুজাপ্রচারের কাহিনী। এইসব বর্ণনা প্রসঙ্গে বারমাস্যা বা নায়িকার বারো মাসের দুঃখবর্ণনা, নারীদের পতিনিন্দা, চৌতিশা বা বর্ণানুক্রমিক চৌত্রিশ অক্ষরে দেবতার স্তব প্রায় সব মঙ্গলকাব্যেরই অপরিহার্য বিষয়। 

প্রত্যেক মঙ্গলকাব্যেই বিবাহের নানাপ্রকার আচারের সুবিস্তৃত বর্ণনা পাওয়া যায়। বিবাহাচারের বর্ণনার ভিতর দিয়ে মধ্যযুগের সমাজ ও পরিবারের প্রকৃত পরিচয় যেন প্রত্যক্ষ হয়ে ওঠে। সমুদ্রযাত্রা ও যুদ্ধবর্ণনা মঙ্গলকাব্যের অন্যতম বিশিষ্ট লক্ষণ এবং কাহিনির উপসংহারে নায়ক-নায়িকার স্বর্গারোহণ বর্ণনা মঙ্গলকাব্যের একটি অপরিহার্য বিষয়।

৪। মনসামঙ্গলের কাহিনি সংক্ষেপে বর্ণনা করো।

মনসামঙ্গল বা পদ্মাপুরাণ কাব্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর নাম মনসা, কেতকা, পদ্মাবতী, তাই এই কাব্যকে মনসামঙ্গল বা পদ্মাপুরাণ বলে। মনসামঙ্গলের কাহিনিতে পাওয়া যায়, মনসা চণ্ডী ও মহাদেবের পূজা দেখে ঈর্ষাতুর হয়ে মর্তে নিজের পূজা পাওয়ার জন্য উদ্‌গ্রীব হয়ে ওঠেন। নীচুতলার মানুষের পূজা পেলেও উচ্চশ্রেণির মানুষের পূজাকাঙ্ক্ষিণী হয়ে বণিক শ্রেষ্ঠ শৈব চাঁদ সদাগরের কাছে যান। কিন্তু চাঁদ স্ত্রী দেবতার পূজা করতে স্বীকৃত হলেন না। ফলে, শুরু হয় অনিবার্য সংঘাত। 

এরপর দেবী মনসা চাঁদের মন জয় করতে না পেরে ভয় দেখান, বাগান বাড়ি ধ্বংস করেন, চাঁদের বন্ধু ধন্বন্তরীকে হত্যা করেন, চাঁদের ছয় পুত্রকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেন। চাঁদের চোদ্দোটি বাণিজ্যতরি ডুবিয়ে দিলেও পূজা না করার সংকল্পে দৃঢ় থাকেন চাঁদ। মনসার বরে চাঁদের এক পুত্র হয়; তাঁর নাম রাখেন লখীন্দর। কিন্তু বিবাহের রাত্রে মনসার শাপে তার মৃত্যু ঘটে। 

চাঁদ সান্তালি পর্বতে বিশ্বকর্মাকে দিয়ে লোহার বাসর নির্মাণ করান কিন্তু সেখানেও মনসার ষড়যন্ত্রে একটি ছিদ্র থাকে, যার মধ্য দিয়ে কালনাগিনী প্রবেশ করে লখীন্দরকে কামড়ায় এবং লখীন্দরের মৃত্যু ঘটে। বেহুলা মৃত স্বামীকে নিয়ে কলার ভেলায় ভেসে চলেন। শেষে অসংখ্য প্রলোভন ও দুর্ভোগ সহ্য করে স্বামীর দেহাবশিষ্ট নিয়ে নেতা ধোপানির সাহায্যে স্বর্গে আসেন এবং তাঁর নৃত্য-গীতে মহাদেব সন্তুষ্ট হয়ে মনসাকে নির্দেশ দেন লখীন্দরের প্রাণ ফিরিয়ে দিতে। 

অবশ্য মনসা শর্ত দেন, বেহুলা যদি শ্বশুর চাঁদকে দিয়ে তাঁর পূজা করান, তাহলে মনসা তাঁর স্বামীকে ফিরিয়ে দেবেন। বেহুলা শর্তে রাজি হলে ছয় ভাসুর, চোদ্দো ডিঙা, স্বামীকে নিয়ে বেহুলা বাড়ি ফিরে আসেন এবং চাঁদ বণিক স্নেহবশত বেহুলার কথায় মনসাকে পূজা করেন, তবে বাঁ হাতে। মনসা তাতেই সন্তুষ্ট হন এবং এইভাবেই মর্তে তাঁর পূজা প্রচলিত হয়।

৫। মনসামঙ্গলের কবি বিজয়গুপ্তের পরিচয় দাও।

মনসামঙ্গলের সর্বাধিক জনপ্রিয় কবি বিজয়গুপ্ত বরিশাল জেলার গৈলা ফুল্লশ্রী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কবির পিতার নাম সনাতন এবং মাতার নাম রুক্মিণী। কবির কাব্যের নাম পদ্মপুরাণ। তাঁর কাব্যে হোসেন শাহের উল্লেখ আছে। 

“ঋতু-শশী বেদশশী পরিমিত শক।

সুলতান হুসেন শাহ নৃপতি তিলক।।”

হুসেন শাহ ১৪৯৩ থেকে ১৫১৮ পর্যন্ত গৌড়ের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। কবি হেঁয়ালির ভাষায় যে শকাব্দের উল্লেখ করেছেন, তা থেকে মনে হয় ১৪৯৪ সালে তিনি মনসামঙ্গল কাব্য রচনা শুরু করেন। বিজয়গুপ্ত সংস্কৃতে পণ্ডিত ছিলেন বলে মনে হয় তাঁর রচনায় কবিত্বের চেয়ে পাণ্ডিত্যের প্রকাশ পেয়েছে বেশি। 

মনসামঙ্গলের মূল সুর করুণরস; কিন্তু তার কাব্যে করুণরসের থেকে হাস্য ও কৌতুকরসের পরিচয় পাওয়া যায় বেশি। ছন্দনির্মাণে কবির প্রশংসা অবশ্যই করতে হয় – 

“প্রেতের সনে শ্মশানে থাকে মাথায় ধরে নারী।

 সবে বলে পাগল পাগল কত সৈতে পারি।।”

বিজয়গুপ্তের সর্বাধিক কৃতিত্ব বাস্তবজীবনের নিখুঁত চিত্রাঙ্কনে ও বলিষ্ঠ চরিত্রচিত্রণে। বিজয়গুপ্তের চাঁদ বলিষ্ঠ পৌরুষে উজ্জ্বল। তবে জীবনসংগ্রামে অপরাজেয় পুরুষকারের প্রতিমূর্তি চাঁদের মহিমা কবি কাব্যের সমাপ্তিতে একটু ক্ষুণ্ণ করে ফেলেছেন। বেহুলা চরিত্রটিকে সমস্ত মাধুর্য ও পবিত্রতায় ভরে দিয়ে হৃদয়গ্রাহী করেছেন। শিবের চরিত্রচিত্রণেও কবির কৃতিত্ব লক্ষণীয়। বিজয়গুপ্ত শাক্ত কবি হলেও তাঁর কাব্যে বৈষ্ণব প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। কাব্যের নানা স্থানে তিনি নিজেকে বলেছেন, ‘জনমে জনমে হই রাধা কানুর দাস।’

৬। মনসামঙ্গলের কবি নারায়ণদেবের পরিচয় দাও।

মনসামঙ্গলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি হলেন ‘সুকবি বল্লভ’ নারায়ণদেব। কায়স্থ বংশীয় কবি নারায়ণদেব বর্তমান ময়মনসিংহ জেলার বোরগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। অনেকে তাকে শ্রীহট্ট জেলার অধিবাসী বলে দাবি করে থাকেন। কবি সম্ভবত পঞ্চদশ শতকের শেষ লগ্নে ‘পদ্মাপুরাণ’ কাব্য রচনা করে থাকবেন।

কবির কাব্য অন্যান্য মনসামঙ্গলের তুলনায় দীর্ঘ এবং মর্তলীলা অপেক্ষা পৌরাণিক কাহিনির বিস্তার বেশি। কবির রচনায় স্থানীয় ভাষা ও শব্দের ব্যবহার থাকলেও কাব্যের সরসতা ক্ষুণ্ণ হয় নি।

মনসামঙ্গলের মূল রস করুণরস, যা কবি অসাধারণ কৃতিত্বের সঙ্গে প্রকাশ করেছেন। লখিন্দরের মৃতদেহ নিয়ে গাঙুড়ের জলে বেহুলার ভেসে যাওয়ার করুণ চিত্রটি কবি অসামান্য দক্ষতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন। লখিন্দরের শবদেহকে সম্বোধন করে বেহুলা বিলাপ করেছে –

“জাগ প্রভু কালিন্দী নিশাচরে। 

ঘুচাও কপট নিদ্রা ভাসি সাগরে।।

প্রভুরে তুমি আমি দুইজন।

জানে তবে সর্বজন।।

তুমি তো আমার প্রভু আমি যে তোমার। 

মড়া প্রভু নহরে তুমি গলার হার।।”

পুত্রশোকাতুর সনকার মাতৃরূপটি নারায়ণদেবের রচনায় করুণমধুর হয়ে উঠেছে। চাঁদের চরিত্রের কঠোরতা ও কোমলতার সংমিশ্রণটি নারায়ণদেবের নিজস্ব কৃতিত্ব। নারায়ণদেবের রচনায় চাঁদ সদাগরের দ্বন্দময় মুহূর্তগুলি ফুটে উঠে তাঁকে মানবিক করে তুলেছে। বেহুলার চরিত্রেও তিনি মাধুর্য এবং ব্যক্তিত্বের পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছেন।

৭। ধর্মমঙ্গলের কবি ঘনরাম চক্রবর্তীর কবিপ্রতিভার পরিচয় দাও।

ধর্মমঙ্গল কাব্যের শ্রেষ্ঠ রচয়িতা ঘনরাম চক্রবর্তী অষ্টাদশ শতাব্দীর কবি। ঘনরাম বর্ধমান জেলার দামোদর তীরবর্তী কৃষ্ণপুর গ্রামের অধিবাসী ছিলেন। তাঁর বাবার নাম গৌরীকান্ত, মা সীতাদেবী। ধর্মমঙ্গল কাব্যে বাংলাদেশের রাঢ় অঞ্চলের ভূমিজ মানুষের নানা বীরত্বের আখ্যান আছে। ঘনরাম এইসব কাহিনিতে অভিজাত কাব্যরূপ দিয়েছিলেন। কবি লাউসেনের অনমনীয় পৌরুষ ও বীরত্বের সঙ্গে নৈতিক জীবনাদর্শের সম্মিলন ঘটাতে চেয়েছিলেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর অবক্ষয়ী সাহিত্যে নিঃসংশয়ে এ এক বিরল ব্যতিক্রম।

নারীচরিত্র সৃষ্টিতে ঘনরামের বিশিষ্টতা উল্লেখযোগ্য। কারণ, লখ্যা ডোম ও হরিহর মাইতির স্ত্রী প্রভৃতি চরিত্র রচনায় সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে উদার দৃষ্টিভঙ্গি। ঘনরামের পাণ্ডিত্য, রুচিবোধ গ্রাম্য লোকজীবনের কাহিনিকে সার্বজনীন কাব্যরূপ দান করেছিল। তাঁর পদ্যের ভাষা স্বচ্ছন্দ এবং অনুপ্রাস অলংকার বৈচিত্র্যপূর্ণ; বাগবিন্যাসে কাহিনি বর্ণনায়, শব্দপ্রয়োগে, নাগরিক বিদগ্ধতায় তিনি যথার্থ ভারতচন্দ্রের পূর্বসূরি। 

ঘনরামের ধর্মমঙ্গল আকারে প্রায় মহাকাব্যের মতো কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গি বা রচনাদর্শে তা পাঁচালির রীতিকে অতিক্রম করতে পারে নি। তথাপি কবিপ্রতিভার বিচারে অষ্টাদশ শতকে ভারতচন্দ্র এবং রামপ্রসাদের পরই তাঁর স্থান।

Leave a Comment