কারক

কারক কি বা কাকে বলে। কারক সম্পর্কে সম্পূর্ণ আলোচনা নিম্নে দেওয়া হল।

“কারক” বাংলা ব্যাকরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় , যা বাক্য নির্মাণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলা ভাষায় বাক্য গঠনে “কারক” এর বিভিন্ন ধরণ এবং কার্যপ্রদানের বিভিন্ন কাজের ব্যাপারে জানুন। বাংলা ব্যাকরণে “কারক” এর প্রাধান ভূমিকা এবং তার বাক্যের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে সম্পূর্ণ আলোচনা করা হয়েছে।

কারক কী ?

বাক্যের সমাপিকা ক্রিয়াপদের সঙ্গে ওই বাক্যের নামপদ অর্থাৎ বিশেষ্য ও সর্বনামপদগুলির সম্পর্ককেই কারক সম্পর্ক বলা হয়। কারক শব্দের বুৎপত্তিগত অর্থ হল যে করে।

কারকের প্রকারভেদ

কারক ছয় প্রকার। যেমন- ১) কর্তৃকারক , ২) কর্মকারক , ৩) করণকারক , ৪) নিমিত্তকারক , ৫) অপাদানকারক ,                                        ৬) অধিকরণ কারক

              ক্রিয়াকে প্রশ্ন                            যে কারকে উত্তর

                  কে, কারা ?                                   কর্তৃকারক

                  কী, কাকে ?                                   কর্মকারক

         কী দিয়ে, কীসের দ্বারা ?                      করণকারক

            দান, জন্য, সাহায্য ?                     নিমিত্তকারক

            হইতে, থেকে, চেয়ে ?                    অপাদানকারক

         কাল, সময়, স্থান, বিষয় ?                   অধিকরণকারক

বিভক্তি কী ?

যে বর্ণ বা বর্ণসমষ্টি শব্দের শেষে যুক্ত হয়ে পদ গঠন করে বা শব্দকে বাক্যে ব্যবহারের উপযোগী করে তোলে তাকে বিভক্তি বলা হয়।

 বাংলা ভাষায় বিভক্তিচিহ্নগুলি হল- এ, কে, য়, তে, রে, ইত্যাদি। এছাড়া শূন্য বিভক্তি।

উদাহরণ – আকাশে আজ তারার মেলা। আকাশে = আকাশ + এ বিভক্তি,   তারার = তারা + র বিভক্তি

বাবাকে কলকাতায় যেতে হবে। বাবাকে = বাবা + কে বিভক্তি,  কলকাতায় = কলকাতা + য় বিভক্তি

বিভক্তির প্রকারভেদ

বিভক্তি সাধারণত দুই প্রকার – ১) শব্দ বিভক্তি , ২) ধাতু বিভক্তি

শব্দ বিভক্তি কাকে বলে ? উদাহরণ দাও।

শব্দের সঙ্গে যে বিভক্তি যুক্ত হয় তাকে শব্দ বিভক্তি বলে।

উদাহরণ – বসন্তকালে নানা রঙের ফুল ফোটে। এখানে ‘বসন্তকালে’ ’রঙের’ শব্দের সঙ্গে যথাক্রমে  ‘কে’ ‘এর’ বিভক্তি যুক্ত হয়েছে। এই বিভক্তি গুলিকে বলা হয় শব্দ বিভক্তি। এবং ‘বসন্তকালে’ ‘রঙের’ এগুলো হলো নাম পদ।

ধাতু বিভক্তি কাকে বলে ? উদাহরণ দাও।

ক্রিয়া ক্ষেত্রে ধাতুর সঙ্গে যে বিভক্তি যুক্ত হয় তাকে বলে ধাতু বিভক্তি।

উদাহরণ – আমি করি, সে করে, তুমি করিবে ইত্যাদি। করি = কর + ই বিভক্তি, করে = কর + এ বিভক্তি,     করিবে = কর + ইবে বিভক্তি

বিভক্তির নাম   বিভক্তি

প্রথমা বিভক্তি   ০, অ

দ্বিতীয়া বিভক্তি   কে, রে

তৃতীয়া বিভক্তি   দিয়া (দিয়ে), দ্বারা

চতুথী বিভক্তি   কে, রে

পঞ্চমী বিভক্তি   হইতে, থেকে,চেয়ে

ষষ্ঠী বিভক্তি    এর, র

সপ্তমী বিভক্তি   এ, তে, য়

অনুসর্গ কাকে বলে ? উদাহরণ দাও

‘অনু’ অর্থ পরে বা পশ্চাতে এবং ‘সর্গ’ অর্থ অবস্থান। যেসকল অব্যয়পদ বিশেষ্য বা সর্বনামের পরে কখনো স্বাধীনভাবে আবার কখনো শব্দ বিভক্তির ন্যায় বাক্যে ব্যবহৃত হয়ে অর্থ প্রকাশ করতে সাহায্য করে, তাদেরকে অনুসর্গ বা কর্মপ্রবচনীয় বা পরসর্গ বলে।

 অনুসর্গ শব্দের পরে বসে সংশ্লিষ্ট শব্দের সঙ্গে পরবর্তী শব্দের অর্থবোধক সম্পর্ক সৃষ্টি করে। অনুসর্গগুলো অব্যয় পদ এবং এদের নিজস্ব অর্থ আছে। অনুসর্গ দিয়ে কারক চেনা যায় এবং অনুসর্গ বিভক্তির মতো কাজ করে।

উদাহরণ :- দ্বারা, দিয়া, দিয়ে, কর্তৃক, হতে, হইতে, থেকে, চেয়ে, সঙ্গে, পক্ষে, পাছে, জন্যে, জন্য, পরে, মাঝে, নামে, পানে, তরে, সহকারে, বিহনে, ভিন্ন, ব্যতীত, ভিতর, ভেতর ,প্রতি, বিনা, অপেক্ষা, সহ, ওপর, অবধি, হেতু, বই, পর্যন্ত, মতো, নিকট, অধিক, ইত্যাদি।

বিভক্তি ও অনুসর্গের পার্থক্য

ক) অনুসর্গের স্বাধীন অর্থ ও স্বাধীন ব্যবহার আছে, বিভক্তির স্বাধীন অর্থ ও স্বাধীন ব্যবহার নেই।

খ) বিভক্তি পদের সঙ্গে যুক্ত অবস্থায় থাকে। অনুসর্গ পদের পরে আলাদা ভাবে বসে।

গ) বিভক্তি কোনো পদ নয়। অনুসর্গ নিজে এক ধরনের অব্যয় পদ।

ঘ) বিভক্তি শব্দ ও ধাতু, উভয়ের সাথে যুক্ত হতে পারে। অনুসর্গ শুধুমাত্র পদের পরে বসে, ধাতুর পরে বসে না।

নির্দেশক কাকে বলে ? উদাহরণ দাও

নির্দেশক হল এক ধরনের ধ্বনিগুচ্ছ, যেগুলির স্বাধীন অর্থ নেই, কিন্তু শব্দের সাথে যুক্ত হয়ে বচন নির্দেশ করে। ব্যাকরণে এরা লগ্নক নামেও পরিচিত। এদের আর এক নাম পদাশ্রয়ী নির্দেশক। কেউ কেউ পদাশ্রয়ীর পরিবর্তে শব্দাশ্রয়ী বলতে চান। 

উদাহরণ টি, টা, খান, খানি, খানা, গুলি, গুলো প্রভৃতি হল নির্দেশকের উদাহরণ। এই নির্দেশকগুলি শব্দের শেষে যুক্ত হয়ে একবচন বা বহুবচন নির্দেশ করে।

নির্দেশক ও বিভক্তির পার্থক্য

নির্দেশক ও বিভক্তি উভয়ের‌ই স্বাধীন অর্থ নেই এবং উভয়েই শব্দের শেষে যুক্ত হয়, তবু এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। যেমন – ১) বিভক্তি শব্দকে পদে পরিণত করে। নির্দেশক শুধুমাত্র বচন নির্দেশ করে।

২) নির্দেশকের পর বিভক্তি যুক্ত হতে পারে, কিন্তু বিভক্তির পর নির্দেশক যুক্ত হতে পারে না। যেমন – “ছেলেটিকে ডাকো।” — নির্দেশকের পর বিভক্তি যুক্ত হয়েছে। কিন্তু “ছেলেকেটি ডাকো” — এমনটা হয় না।

অকারক পদ কাকে বলে ? এর প্রকারভেদ করো

কারকপদের পাশাপাশি বাক্যে এমন পদ‌ও দেখা যায়, যারা ক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক রাখে না, কিন্তু অন্য কোনো কারকপদের সাথে সম্পর্ক রাখে‌। এই পদগুলিকেই অকারক পদ বলে।

অকারক দুই প্রকার – (ক ) সম্বন্ধ পদ , (খ ) সম্বোধন পদ

সম্বন্ধ  পদ সাধারণত র/এর বিভক্তি-যুক্ত যে বিশেষ্য ও সর্বনাম পদগুলি ক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত না হলেও কোনো না কোনো কারকপদের সাথে সম্পর্ক রাখে, তাদের সম্বন্ধ পদ বলে।

উদাহরণ   রামের ভাই খেলছে। বাক্যটিতে খেলা কাজটি রাম করছে না, রামের সাথে ক্রিয়ার যোগ নেই কিন্তু রামের সাথে কর্তা ‘ভাই’-এর সম্পর্ক আছে।

তপনের চোখ মার্বেল হয়ে গেল। এখানে ‘তপনের’ পদটি সম্বন্ধ পদ।  কারণ ‘তপন’ কর্তার  সঙ্গে ‘এর’ বিভক্তি যুক্ত হয়েছে।

সম্বোধন পদ – কাউকে সম্বোধন করে কিছু বলা হলে তাকে সম্বোধন পদ  বলে। সম্বোধন পদে সবসময় শূণ্য বিভক্তি যুক্ত হয়।

উদাহরণ মা, আমাকে জল দাও। এখানে ‘মা’ – কে উদ্দেশ্য করে কিছু বলা হচ্ছে , তাই  ‘মা’ সম্বোধন পদ।

ভাই, একটু সরে দাঁড়ান। এখানে ‘ভাই’ – কে উদ্দেশ্য করে কিছু বলা হচ্ছে , তাই  ‘ভাই’ সম্বোধন পদ।

কারক ও বিভক্তি নির্ণয় করো

১) আমার মনের মধ্যে গান জেগে উঠে।

এই বাক্যটির সঠিক উত্তর ‘কর্ম কারকে’ ‘শূন্য’ বিভক্তি। কারণ  এখানে ‘গান’  শব্দটিকে  ‘কি’ দিয়ে প্রশ্ন করেছে তাই  কর্ম কারক। আর মূল শব্দের সঙ্গে কোন বিভক্তি যোগ নেই বলে ‘শূন্য’ বিভক্তি হয়েছে।

২) আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। 

এই বাক্যটির সঠিক উত্তর ‘কর্তৃকারকে’ ‘শূন্য’ বিভক্তি। কারণ আমি দাঁড়িয়ে রইলাম এখানে আমি বলতে ‘কে’ দিয়ে প্রশ্ন করেছে তাই কর্তৃকারক। আর আমি অর্থাৎ মূল শব্দটির শেষে কোন বিভক্তি যোগ নেয় বলে শূন্য বিভক্তি হয়েছে।

৩) দিন-দুপুরে পাখির ডাকে।

এই বাক্যটির সঠিক উত্তর অধিকরণ কারকে  ‘এ’  বিভক্তি। কারণ  “দিন- দুপুর” একটা সময় বুঝাচ্ছে তাই অধিকরণ  কারক। আর দিন দুপুরে অর্থাৎ মূল শব্দের শেষে ‘এ’ বিভক্তি যোগ আছে তাই ‘এ’ বিভক্তি হয়েছে।

৪) চিনবে তারা ভুবনটাকে।

এই বাক্যটির সঠিক উত্তর কর্তৃকারকে ‘শূন্য’ বিভক্তি। কারণ  তারা বা কারা এগুলো দিয়ে প্রশ্ন করলে যে উত্তরটি পায় তা হল কর্তৃকারক। আর তারা বা মূল শব্দের শেষে কোন বিভক্তি যুক্ত নেয় বলে ‘শূন্য’ বিভক্তি হয়েছে।

৫) রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব তার বিমান থেকে নামলেন।

এই বাক্যটির সঠিক উত্তর অপাদানকারকে ‘থেকে’ অনুসর্গ। কারণ হইতে, থেকে, ‘চেয়ে’ প্রশ্ন করলে যে উত্তর পায় তা হল অপাদান কারক। আর বিমান থেকে বা মূল শব্দ থেকে আমরা ‘থেকে’ অনুসর্গ পেয়েছি।

৬) তল্লাশিতে পাওয়া যায় সাতটা মশার পিস্তল।

এই বাক্যটির সঠিক উত্তর করণ কারকে ‘তে’ বিভক্তি। কারণ তল্লাশিতে অর্থাৎ তল্লাশির দ্বারা পাওয়া গেছে সাতটা মশার পিস্তল । আমরা জানি দ্বারা বা দিয়া (দিয়ে) প্রশ্ন করলে যে উত্তরটি পাই তা হল করণ কারক। আর তল্লাশিতে বা মূল শব্দের শেষে ‘তে’ বিভক্তি যুক্ত আছে বলে ‘তে’ বিভক্তি হয়েছে।

৭) আমি ছিটকে চলে গেলাম খাটের তলায়

এই বাক্যটির সঠিক উত্তর অধিকরণ কারকে ‘য়’ বিভক্তি। কারণ খাটের তলায় একটা ‘স্থান’ দিয়ে প্রশ্ন করেছে । আমরা জানি জায়গা বা স্থান দিয়ে প্রশ্ন করলে যে উত্তর পাই তা হল অধিকরণ কারক। আর খাটের তলায় বা মূল শব্দের শেষে ‘য়’ বিভক্তি যুক্ত আছে বলে ‘য়’ বিভক্তি হয়েছে।

৮) কবি তাঁর ঘরের আসনে বসে টেলিফোনে কবিতা পাঠ  করবেন।

এই বাক্যটির সঠিক উত্তর অধিকরণ কারকে ‘এ’ বিভক্তি। কারণ ঘরের আসনে অর্থাৎ ঘরের একটি স্থান। আমরা জানি কোন জায়গা বা স্থান দিয়ে প্রশ্ন করলে যে উত্তরটি পাই তা হল অধিকরণ কারক। আর ঘরের আসনে বা মূল শব্দের শেষে ‘এ’ বিভক্তি যুক্ত আছে বলে ‘এ’ বিভক্ত হয়েছে।

৯) তিনজন কলেরায় মারা গেছে।

এই বাক্যটির সঠিক উত্তর করণ কারকে ‘য়’ বিভক্তি। কারণ এখানে কলেরার দ্বারা মারা গেছে অর্থাৎ কিসের দ্বারা বা কি দ্বারা প্রশ্ন করলে আমরা যে উত্তরটি পাই তা হল করণকারক। আর কলেরা বা মূল শব্দের শেষে ‘য়’ বিভক্তি যুক্ত আছে বলে ‘য়’ বিভক্তি হয়েছে।

১০) মাধবী বই পড়ছে।

এই বাক্যটির সঠিক উত্তর কর্তৃ কারকে ‘শূন্য’ বিভক্তি। কারণ মাধবীকে ‘কে’ দিয়ে প্রশ্ন করেছে অর্থাৎ কে বা কারা দিয়ে প্রশ্ন করলে আমরা যে উত্তর পাই তা-হল কর্তৃকারক। আর মাধবী বা মূল শব্দের শেষে কোন বিভক্তি যুক্ত নেয় বলে ‘শূন্য’ বিভক্তি হয়েছে।

Leave a Comment