আমার দুর্গোৎসব : প্রবন্ধ (প্রশ্ন ও উত্তর)

আমার দুর্গোৎসব প্রবন্ধ হতে প্রশ্ন ও উত্তর নিম্নে দেওয়া হল। Bengali B.A.(General) প্রবন্ধ আমার দুর্গোৎসব হতে প্রশ্ন ও উত্তর।

প্রবন্ধআমার দুর্গোৎসব
গ্রন্থকমলাকান্তের দপ্তর
রচনাবঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
প্রকাশিতবঙ্গদর্শন পত্রিকা

Table of Contents

আমার দুর্গোৎসব প্রবন্ধ হতে প্রশ্ন ও উত্তর

Bengali B.A.(General) প্রবন্ধ আমার দুর্গোৎসব হতে প্রশ্ন ও উত্তর।


প্রবন্ধ আমার দুর্গোৎসব হতে প্রশ্ন মান – ৫

১। চিনিলাম, এই আমার … কালগর্ভে নিহিতা।’ – প্রসঙ্গ সহ ব্যাখ্যা লেখ।

আলোচ্য অংশটি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ গ্রন্থের অন্তর্গত ‘আমার দুর্গোৎসব’ নামক প্রবন্ধ থেকে গৃহীত। এখানে কমলাকান্ত দুর্গা প্রতিমার মধ্যে বঙ্গজননীকে দেখতে পেয়ে এই উক্তি করেছেন। 

সপ্তমী পূজার রাত্রে অধিকমাত্রায় আফিম সেবন করে কমলাকান্ত দুর্গা প্রতিমা দর্শন করতে গিয়েছিলেন। দেবীকে দর্শন করতে করতে তাঁর মনে বিচিত্র ভাবরাশির উদয় হল। দেখতে পেলেন দুর্বার মহাকালস্রোতে সকল কিছু ভেসে চলছে। তিনি নিজেও সেই স্রোতে অসহায়ের মতো ভাসমান। অকস্মাৎ সেই স্রোতে প্রতিভারূপ ভেলা পেয়ে তাতে আরোহণ করে অতীতকে স্পষ্ট দেখতে পেলেন। তিনি দেখলেন, নক্ষত্র-সদৃশ উজ্জ্বল ব্যক্তিগণের প্রতিভার আলোয় বঙ্গজননীর মুখ একবার উজ্জ্বল হচ্ছে পরক্ষণেই নিভে যাচ্ছে। 

সহসা স্বর্গীয় বাদ্যের ধ্বনিতে জ্যোতির্ময় আলোকে তিনি তরঙ্গাসংকুল জলরাশির উপরে সুবর্ণে-মন্ডিত দেবীকে দেখতে পেলেন। তাঁকে দেখে তিনি লোজননী বলে চিনতে পারলেন। অনন্তরত্ন বিভূষিত হয়েও ভাগ্যের দোষে আজ তাঁকে কালসমুদ্রে ডুবে থাকতে হচ্ছে। দেবীরূপা সন্তানজননী অতীতে উজ্জ্বল গৌরবের মধ্যে অধিষ্ঠাতা ছিলেন। কিন্তু বর্তমানে তাঁর সন্তানগণে পারস্পরিক হিংসা বিদ্বেষ কলহের জন্য তিনি পূর্বের গৌরব হারিয়ে মহাকালগর্ভে নিমজ্জিতা হয়েছেন। কমলাকান্ত সত্যদৃষ্টির আলোকে দেবীর স্বরূপ স্পষ্ট উপলব্ধি করতে পেরেছেন।

২। ঐ ছয় কোটি মুণ্ডু…….ভাবনা কি? – প্রসঙ্গ সহ ব্যাখ্যা লেখ।

আলোচ্য অংশটি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ গ্রন্থের অন্তর্গত ‘আমার দুর্গোৎসব’ নামক প্রবন্ধ থেকে গৃহীত। এখানে কমলাকান্ত বঙ্গজননীকে পুনরায় স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করবার বাসনা প্রকাশ প্রসঙ্গে এই উক্তি করেছেন।

সপ্তমী পূজার দিন কমলাকান্ত অধিকমাত্রায় আফিম খেয়ে দেবীদর্শনে বের হয়েছেন। দেবীকে দর্শন করতে করতে তার মনে বিচিত্র ভাবরাশির উদয় হল। তিনি জগৎ ও জীবন সম্পর্কে সত্যদৃষ্টি লাভ করে দেখতে পেলেন, দুর্বার কালস্রোতে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যত সবই ভেসে চলেছে। ঐশ্বর্যশালিনী শারদীয়া দুর্গাপ্রতিমাও মহাকালস্রোতে ভাসমান। কমলাকান্ত তাঁকে অতীতকালের মহামহিমান্বিতা বঙ্গজননী বলে চিনতে পারলেন। 

দেবী দুর্গা অনন্তরত্নভূষিতা হয়েও কালসমুদ্রে নিমজ্জিতা। দেবীকে এই অবস্থায় দেখে কমলাকান্ত দুঃখে বেদনায় উদ্বেল হয়ে পড়লেন। দেখবে পুনরায় অতীত দিনের উজ্জ্বল গৌরবের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য কমলাকান্ত ব্যাকুল অন্তরে তাকে আহ্বান করতে লাগলেন। বঙ্গজননীর ছয়কোটি সন্তান আজ নবচেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে উঠবে। হিংসা, বিদ্বেষ, অন্যায়, অলসতা পরিত্যাগ করে তারা সম্মিলীতভাবে মাতৃ-উদ্ধারের জন্য সচেষ্ট হবে। ছয় কোটি মুখ মাতৃবন্দনায় মুখরিত হবে। 

দেবীরূপিণী বঙ্গজননীকে উদ্ধারের নিমিত্ত তারা প্রাণ বিসর্জন দিয়েও ইতঃস্তত করবে না। মাতার কার্যের জন্য ছয়কোটি দেহ উৎসর্গিত। মাতাকে উদ্ধার করতে না পারলে ছয় কোটি সন্তান দ্বাদশ কোটি চোখে অশ্রু বিসর্জন করবে। এত সন্তান থাকতে মাতৃউদ্ধারের জন্য কোনও চিন্তা নেই।

৩। দ্বেষকে ছাগকে ……… বাদিত হইবে।’ – প্রসঙ্গ সহ ব্যাখ্যা লেখ।

আলোচ্য অংশটি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ গ্রন্থের অন্তর্গত ‘আমার দুর্গোৎসব’ নামক প্ৰবন্ধ থেকে গৃহীত। এখানে কমলাকান্ত দেবীরূপা বঙ্গজননীকে পুনরায় স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করবার উপায় নির্দেশ প্রসঙ্গে এই উক্তি করেছেন।

দেবীরূপা বঙ্গজননী কালস্রোতে নিমজ্জিতা। অতীতের মহামহিমান্বিতা ঐশ্বর্যশালিনী দেবীকে এই অবস্থায় দেখে কমলাকান্ত আকুল হয়ে তাকে আহ্বান করতে লাগলেন। মাতা তবু অতীতের মহিমায় প্রতিষ্ঠিতা হলেন না দেখে কমলাকান্ত উদাত্ত কণ্ঠে ছয়কোটি বঙ্গসন্তানকে মাতৃউদ্ধারার্থে শপথ গ্রহণের জন্য আহ্বান করলেন। ছয় কোটি সন্তান দ্বাদশ কোটি ভুজে বঙ্গজননীকে দুর্বার কালগর্ভ থেকে উদ্ধার করে পূর্বের দীপ্ত গৌরবে প্রতিষ্ঠিত করবার দায়িত্ব গ্রহণ করবে। 

চতুর্দিকের নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে ভয় পাবার কিছু নেই। অতীতকালের উজ্জ্বল নক্ষত্র-সদৃশ ব্যক্তিগণের মহান আদর্শের আলোকে অন্ধকারের মধ্যে পথ চিনে নেওয়া যাবে। তাদের কীর্তিকলাপ চিহ্নিত পথরেখা অনুসরণ করে পুনরায় গৌরব ও মহিমার দিনগুলিতে পৌঁছান যাবে। ছাগকে যেরূপ হাড়িকাটে ফেলে খড়্গের সাহায্যে বলি দেওয়া হয়, তেমনি বঙ্গসন্তানের পারস্পরিক হিংসাদ্বেষকে হাড়িকাটে ফেলে সৎকীর্তিরূপ খড়্গে বলি দিতে হবে। ভালো ভালো কাজ করে সৎকীর্তির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। 

বঙ্গের ঐতিহাসিক তাদের রচিত ইতিহাস-সাহিত্যের মাধ্যমে বঙ্গজননীর পুনরুভ্যুত্থানের বিবরণ সমগ্র বিশ্বে ঘোষণা করবেন। ঢোল, কাশি, কড়া-নাগরার মাধ্যমে চতুর্দিকে বঙ্গজননীর জয়ধ্বনি শোনা যাবে। 

৪। “বড় পূজার ধুম বাধিবে। কত ব্রাহ্মণপণ্ডিত লুচি মণ্ডার লোভে বঙ্গপূজায় আসিয়া পাতড়া মারিবে—কত দেশী বিদেশী ভদ্রাভদ্র আসিয়া মায়ের চরণে প্রমানি দিবে—কত দীন দুঃখী প্রসাদ খাইয়া উদয় পুরিবে। কত নর্তকী নাচিবে, কত গায়কে মঙ্গল গায়িবে, কত কোটি তত্ত্বে ডাকিবে মা! মা! মা” – কে কোন্ প্রসঙ্গে একথা বলেছেন আলোচনা করো।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ গ্রন্থের অন্তর্গত ‘আমার দুর্গোৎসব’ প্রবন্ধে কমলাকান্ত চক্রবর্তী বঙ্গজননীর আরাধনা প্রসঙ্গে আলোচ্য উক্তিটি করেছেন।

কমলাকান্ত কাতরভাবে জগন্মাতাকে আহ্বান করা সত্ত্বেও তিনি উঠলেন না – পূর্বের অনন্ত কালসমুদ্রে নিমজ্জিতা হলেন। তখন কমলাকান্তের অন্তরে মাতার পুনরুভ্যুত্থান সম্বন্ধে সন্দেহ দেখা দিল। তিনি উদাত্ত কণ্ঠে সকল বঙ্গবাসীকে মাতার উদ্ধারার্থ একত্র কেন্দ্রীভূত হবার জন্য আহ্বান জানালেন। 

মহালগ্ন সমাগত। অন্ধকার মহাকালস্রোতে সকল বঙ্গসন্তানের একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়বার দিন সমাগত। বঙ্গজননীকে দ্বাদশ কোটি বাহুর সাহায্যে উদ্ধার করতে হবে। ছয়কোটি উন্নত মস্তকে তাকে সগৌরবে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। অসংখ্য বলিষ্ঠ বাহুর সাহায্য মহাকাল সমুদ্র মন্থন করে বঙ্গজননীকে উদ্ধার করে তাঁকে জগৎসভার শ্রেষ্ঠ আসনে বসাতে হবে। বঙ্গজননীকে উদ্ধার করতে সক্ষম না হলে তাঁর প্রাণ বিসর্জন দিবেন। এইরূপ আত্মবলিদানের মধ্যে গৌরব আছে। 

কমলাকান্ত সকলকে আহ্বান করে জানিয়ে দিচ্ছেন যে মাতৃউদ্ধারে সফল হতে হলে হিংসাদ্বেষরূপ ছাগকে সংকীর্তিরূপ খড়্গে বলি দিতে হবে। সমস্ত বঙ্গসন্তানকে মহান ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ হয়ে মাতৃপূজায় নিমগ্ন হতে হবে। বঙ্গজননীকে অতি গৌরবের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করা গেলে জগতে মায়ের মহিমা প্রচারিত হবে। ঐতিহাসিকগণ তাঁদের ইতিহাসের মাধ্যমে দেশমাতৃকার মহিমা জগৎসমক্ষে প্রচার করবেন। সমগ্র জগতে তখন মাতার বিজয়ধ্বনি শোনা যাবে। 

দেশী বিদেশী অসংখ্য লোক এসে বঙ্গজননীর চরণে পূজা নিবেদন করবেন। দীনদরিদ্র মনের সাধে আহার করবে। অতীত দিনের মতো বঙ্গদেশের আকাশ বাতাস নর্তকীর নৃত্যে, গায়কের মধুর গানে ও ভক্তের ‘মা’ ‘মা’ ডাকে মুখরিত হয়ে উঠবে।


প্রবন্ধ আমার দুর্গোৎসব হতে প্রশ্ন মান – ১০

১। ‘আমার দুর্গোৎসব’ প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্রের যে স্বদেশপ্রীতি ফুটে উঠেছে তা আলোচনা করো।

ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম অর্ধে যখন বাঙালি স্বদেশ চেতনা ও জাতীয়তাবোধের অস্তিত্ব ছিল নাম মাত্র, তখন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় একজন খাঁটি স্বদেশপ্রেমিক হিসাবে বাঙালিদের মনে স্বদেশপ্রেম ও স্বদেশানুরাণের বাণী সম্ভার করতে চেয়েছিলেন। তিনি তাঁর ‘মৃণালিনী’, ‘রাজসিংহ’, ‘আনন্দমঠ’ প্রভৃতি উপন্যাসে এবং ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ নামক গ্রন্থের বিভিন্ন প্রবন্ধের মাধ্যমে বাঙালিজাতিকে স্বদেশ প্রেমের মন্ত্রে দীক্ষিত করতে চেয়েছিলেন। 

‘কমলাকান্তের দপ্তর’ গ্ৰন্থের যে দুটি প্রবন্ধ বঙ্কিমচন্দ্রের স্বদেশ চেতনা স্পষ্টরূপে প্রকাশিত হয়েছে সে দুটি হল ‘আমার দুর্গোৎসব’ এবং ‘একটি গীত’। পরাধীনতার গ্লানি ও বাঙালিজাতির শোচনীয় অধঃপতন বঙ্কিমের মনে যে দুঃসহ জ্বালা সৃষ্টি করেছিল সেই জ্বালা তিনি প্রকাশ করেছেন উক্ত প্রবন্ধদ্বয়ের মধ্যে কখনও আত্মধিক্কারের মাধ্যমে, কখনও বা হৃদয়ের গভীর আর্তির মধ্যে দিয়ে।

বঙ্কিমের দেশাত্মবোধের স্বরূপ সম্পর্কে বিশিষ্ট সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার বলেছেন, “এই দেশাত্মবোধ তাঁহার প্রতিভার মূল উৎস। এই মন্ত্রে কেহ তাহাকে দীক্ষিত করে নাই, ইহা শিক্ষালব্ধ হয়, সহজাত মনীষার মতো ইহা যেন তাহার প্রাক্তন সম্পদ, জাগ্রতে স্বপ্ননে, ধ্যানে জ্ঞানে, এক মুহূর্ত তিনি উহা হইতে মুক্ত হইতে পারেন নাই। জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চায়, ধর্মতত্ত্বের বিচারে, সাহিত্য সৃষ্টির উন্মাদনায়, যৌবনের স্বপ্নে, প্রৌঢ়ের কর্মজিজ্ঞাসায়, বার্ধক্যের স্মৃতি কল্পনায় এই দেশপ্রেম তাহাকে অভিভূত করিয়াছিল, দেশের নামে তিনি আত্মহারা হইতেন। অতবড় গম্ভীর প্রকৃতিও দেশের কথায় বালকের মতো অধীর হইয়া উঠিত – ক্ষোভে, লজ্জায়, হর্ষে, শোকে, ক্রোধে, ও গর্বে আত্মসংযম হারাইত। এ যেন কোনো মনঃ কল্পিত দেবতা নয় – যেন সাকার বিগ্রহ, এ প্রেম যেন রক্তের ধর্ম – ব্যক্তিগত সম্পর্কের নিবিড় চেতনা। কত ভাবে কত প্রসঙ্গে যে তিনি এই গভীর চেতনা ব্যক্ত করিয়াছেন, তাহার সংখ্যা নেই।”

স্বদেশের দুর্গতি ও দুর্দশা বঙ্কিমের হৃদয়ে যে কি গভীর ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল তা ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ গ্ৰন্থের বিভিন্ন প্রবন্ধ পাঠ করলে সহজেই অনুভব করা যায়। ‘পলিটিক্‌স’ নামক প্রবন্ধে বঙ্কিম সমকালীন দেশীয় রাজনীতির স্বরূপ তুলে ধরেছেন এবং সেই সঙ্গে বাঙালির আবেদন নিবেদন ভিত্তিক রাজনীতির প্রতি তাঁর তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করেছেন। রাজনীতি সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন “দুই রকমের পলিটিক্‌স্ দেখিলান – এক কুক্কুরজাতীয় আর এক বৃষ-জাতীয়”। বিসমার্ক ও গণকিফ বৃষজাতীয় পলিটিশিয়ান, কিন্তু বাঙালিরা কুক্কুরজাতীয় পলিটিকস্ -এ অভ্যস্ত। আত্মশক্তির বলে বলীয়ান হয়ে অত্যাচারী রাজশক্তির কাছ থেকে অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার সাধনা ও চেষ্টা বাঙালিরা করে না। জয় রাধে কৃষ্ণ! ভিক্ষ দাও গো। ইহাই তাহাদের পলিটিক্‌স।’ শক্তিমান প্রভুর কাছে আবেদন ও ভিক্ষা প্রার্থনাতেই বাঙালি জাতি ব্যস্ত; আপনার বাহুবল ও আত্মশক্তির ওপর নির্ভর করে সংগ্রাম মুখর রাজনীতির কথা তারা কল্পনা করতে পারে না।

দেশীয় রাজনীতিকদের প্রতি বঙ্কিমের বিরূপ মনোভাব ফুটে উঠেছে ‘বাঙালির মনুষ্যত্ব’ প্রবন্ধেও। বাঙালি জাতির বাঙালিপনা ও তোষামোদপ্রিয়তার প্রতি তিনি করেছেন ঈশ্বর প্রীতির সঙ্গে। তাঁর দৃষ্টিতে মানবপ্রীতি এবং ঈশ্বরপ্রীতি এক এবং অভিন্ন। মানব কল্যাণের মধ্যে দিয়েই ঈশ্বর উপাসনা সম্ভব বলে তিনি মনে করতেন। সেজন্য অবাঙমানসগোচর পরম ব্রহ্মের উপাসনা না করে তিনি পরহিত-ব্রতে জীবনকে সঁপে দেওয়াই শ্রেয় বলে মনে করতেন। বস্তুতঃ বঙ্কিম ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতার ধূসর পথে যাত্রা না করে ইহকেন্দ্রিক ও মানবকেন্দ্রিক কল্যাণ চিন্তায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন।

ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে নব-জাগরণের ফলে যে মানবতাবাদের জন্ম হয়েছিল তা বঙ্কিমচন্দ্রের চিন্তাধারাকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করেছিল। আর এই কারণেই তিনি বলিষ্ঠ কন্ঠে বলতে পেরেছিলেন “মনুষ্যজাতির উপর যদি আমার প্রীতি থাকে, তবে আমি অন্য সুখ চাইনা।’ স্পষ্টতই বোঝা যায় মানব-প্রীতিকেই তিনি তাঁর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ বলে মনে করতেন। আর তার জীবন দর্শন এই শ্রেষ্ঠতম সম্পদকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে।

২। ‘আমার দুর্গোৎসব’ প্রবন্ধে কমলাকান্তের চক্ষে দেবী দুর্গা কিরূপে বঙ্গজননীরূপে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছেন এবং তাঁকে কেন্দ্র করে কমলাকান্তের অন্তরে যে আশাবাদ ধ্বনিত হয়েছে তা আলোচনা করো।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ গ্ৰন্থের অন্তর্গত ‘আমার দুর্গোৎসব’ প্রবন্ধে কমলাকান্ত চক্রবর্তী বঙ্গজননীর আরাধনা প্রসঙ্গে এই উক্তি করেছেন। 

সপ্তমী পূজার দিন অধিকমাত্রায় আফিম খেয়ে কমলাকান্ত পূজা দেখতে বের হলেন। আফিম-এর প্রভাবে তিনি সাধারণত দেশ এবং জাতির সামাজিক ত্রুটি-বিচ্যুতি ও অসঙ্গতির দিকটাই দেখতে পেতেন। কিন্তু এবার তিনি এক গভীর ভাবদৃষ্টির অধিকারী হলেন। তিনি দুর্গাপ্রতিমার মধ্যে দেখতে পেলেন দেশমাতাকে। তিনি আরও দেখতে পেলেন যে কালের দুর্বার স্রোতে পুরাতনের অস্তিত্ব লোপ পেয়েছে। তিনি নিজেও সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন কালস্রোতে অসহায়ভাবে ভেসে চলেছেন। সেইকালে ভগবৎপ্রদত্ত প্রতিভারূপ একটি ভেলায় আরোহণ করে তিনি বঙ্গভূমির সমস্ত অতীতকে দেখতে পেলেন।

তিনি দেখতে পেলেন অসংখ্য উজ্জ্বল নক্ষত্রসদৃশ বঙ্গসন্তান কালে কালে আবির্ভূত হয়ে প্রাচীন বঙ্গে আকাশকে পবিত্র আলোকে আলোকিত করেছেন এবং পুনরায় সেই অন্ধকারের মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছেন। বঙ্গজননীও যেন নিমজ্জিতা হলেন। এতে তিনি ভীত হয়ে ‘মা’ ‘মা’ বলে ডাকতে লাগলেন। তখন বঙ্গজনীন সন্তানসহ পুনরায় আবির্ভূতা হলেন। পৃথিবী দিব্য আলোকে দিব্যসৌরভে আমোদিত হয়ে উঠল। দূরে শারদীয়া প্রতিমা দেখে কমলাকান্ত চিনতে পারলেন যে এই মৃন্ময়ী প্রতিমাই তার জননী বঙ্গভূমি। তিনি সহস্ররত্ন ভূষিতা হয়েও কালসমুদ্রে নিমজ্জিতা। তাঁর প্রসারিত দশ বাহুতে শোভা পাচ্ছে দশ অস্ত্র। তাঁর পদতলে শত্রু বিমর্দিত। কিন্তু বঙ্গজননীর এই রূপ এখন অতীতের রূপ। কালের স্রোতে ভাসতে ভাসতে তিনি পুনরায় মহামহিমান্বিত মূর্তিতে আবির্ভূতা হবেন।

অতঃপর কমলাকান্ত কোথা থেকে ফুল সংগ্রহ করে তা দিয়ে প্রতিমার চরণ বন্দনা করলেন। তারপর তাঁর নিকট প্রার্থনা করতে লাগলেন। তিনি ভক্তি প্রীতি বৃত্তি শক্তি নিয়ে দেবী দুর্গাকে আরাধনা করছেন। দেবী যেন এবার অনন্তকালস্রোত পরিত্যাগ করে বিশ্ববিমোহিনী মূর্তিতে জগৎ সমীপে আত্মপ্রকাশ করেন। কমলাকান্ত কাতর কণ্ঠে নবরাগরঙ্গিণী নববলধারিণী দেবী দুর্গাকে আহ্বান করতে লাগলেন। তিনি ছয়কোটি বঙ্গসন্তানের সঙ্গে মাকে আরাধনা করবেন। দ্বাদশকোটি হস্ত মাকে অঞ্জলি উৎসর্গ করবে। ছয়কোটি বঙ্গসন্তান কায়মনোবাক্যে বঙ্গজননীরূপ দেবী দুর্গাকে পূজা করবার জন্য প্রস্তুত থাকবে। বঙ্গজননীর যখন এতগুলি সন্তান, তখন তাঁর চিন্তা নাই।

কমলাকান্ত যখন ঐশ্বর্যশালিনী দেবীর আহ্বানে নিমগ্ন ছিলেন, তখন দেবী অকস্মাৎ পূনর্বার কালসমুদ্রে নিমজ্জিত হয়ে গেলেন। কমলাকান্ত সেই অন্ধকারে দণ্ডায়মান। চোখে অশ্রুধারার প্রবাহ। তিনি দেবীকে কাতর কণ্ঠে পুনরায় আহ্বান করতে লাগলেন। সকলে আবার বঙ্গমাতার সুসস্তান হয়ে সৎপথে চলবার শপথ গ্রহণ করবেন। মায়ের যাতে গৌরব রক্ষা হয় সেদিকে তাদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি থাকবে। হিংসা-দ্বেষ-স্বার্থ ভুলে সকলে ভ্রাতৃবৎসল হবেন। পরের কল্যাণে জীবন উৎসর্গ করতে সর্বদা প্রস্তুত থাকবেন। অধর্থ, অলস্য, ইন্দ্রিয়াসক্তি প্রভৃতি সকল দোষ পরিত্যাগ করে নবচেতনায় মনুষ্যত্ব লাভ করবেন। জন্মমাতা পুনরায় জাগ্রত হোন।

কমলাকান্ত কাতরভাবে জগন্মাতাকে আহ্বান করা সত্ত্বেও তিনি উঠলেন না পূর্বের অনন্ত কালসমুদ্রে নিমজ্জিতা হলেন। তখন কমলাকান্তের অন্তরে মাতার পুনরুভ্যুত্থান সম্বন্ধে সন্দেহ দেখা দিল। তিনি উদাত্ত কণ্ঠে সকল বঙ্গবাসীকে মাতার উদ্ধারার্থ একত্র কেন্দ্রীভূত হবার জন্য আহবান জানালেন। মহালগ্ন সমাগত। অন্ধকার মহাকালস্রোতে সকল বঙ্গসন্তানের একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়বার দিন সমাগত। বঙ্গজননীকে দ্বাদশকোটি বাহুর সাহায্যে উদ্ধার করতে হবে। ছয়কোটি উন্নত মস্তকে তাকে সগৌরবে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। 

অতীতকালের নক্ষত্রসদৃশ মহান ব্যক্তিগণের উচ্চ আদর্শের আলোকে তারা অন্ধকারের মধ্যে পথ দেখে নেবেন। অসংখ্য বলিষ্ঠ বাহুর সাহায্য মহাকাল সমুদ্র মন্থন করে বঙ্গজননীকে উদ্ধার করে তাঁকে জগৎসভার শ্রেষ্ঠ আসনে বসাতে হবে। বঙ্গজননীকে উদ্ধার করতে সক্ষম না হলে তাঁরা প্রাণ বিসর্জন দিবেন। এইরূপ আত্মবলিদানের মধ্যে গৌরব আছে। কমলাকান্ত সকলকে আহ্বান করে জানিয়ে দিচ্ছেন যে মাতৃউদ্ধারে সফল হতে হলে হিংসাদ্বেষরূপ ছাগকে সৎকীর্তিরূপ খড়্গে বলি দিতে হবে। সমস্ত বঙ্গসন্তানকে মহান ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ হয়ে মাতৃপূজায় নিমগ্ন হতে হবে। বঙ্গজননীকে অতি গৌরবের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করা গেলে জগতে মায়ের মহিমা প্রচারিত হবে। 

ঐতিহাসিকগণ তাদের ইতিহাসের মাধ্যমে দেশমাতৃকার মহিমা জনসমক্ষে প্রচার করবেন। সমগ্র জগতে তখন মাতার বিজয়ধ্বনি শোনা যাবে। দেশী বিদেশী অসংখ্য লোক এসে বঙ্গজননীর চরণে পূজা নিবেদন করবেন। দীনদরিদ্র মনের সাধে আহার করবে। অতীত দিনের মতো বঙ্গদেশের আকাশ বাতাস নর্তকীর নৃত্যে, গায়কের মধুর গানে ও ভক্তের ‘মা’ ‘মা’ ডাকে মুখরিত হয়ে উঠবে।


Leave a Comment