আমার মন : প্রবন্ধ (প্রশ্ন ও উত্তর)

আমার মন প্রবন্ধ হতে প্রশ্ন ও উত্তর নিম্নে দেওয়া হল। Bengali B.A.(General) amar man question answer.প্রবন্ধ আমার মন হতে 2, 5, 10 নং প্রশ্ন ও উত্তরগুলি দেওয়া হল।

প্রবন্ধআমার মন
গ্রন্থকমলাকান্তের দপ্তর
রচনাবঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যা
প্রকাশিতবঙ্গদর্শন পত্রিকা

Table of Contents

আমার মন প্রবন্ধ হতে প্রশ্ন ও উত্তর

Bengali B.A.(General) প্রবন্ধ আমার মন হতে প্রশ্ন ও উত্তর।


প্রবন্ধ আমার মন হতে প্রশ্ন মান – ৫

১। “পুজারি বামনের জ্বালায় বাগানে ফুল ফুটিতে পায় না – আর নিন্দুকের জ্বালায় প্রসন্নের কাছে আমার মুখ ফুটিতে পায় না – নচেৎ গব্যরসে ও কাব্যরসে বিলক্ষণ বিনিময় চলিত।” – প্রসঙ্গ সহ ব্যাখ্যা লেখ।

আলোচ্য অংশটি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ গ্ৰন্থের অন্তর্গত ‘আমার মন’ শীর্ষক প্রবন্ধের অন্তর্গত। আলোচ্য উক্তিটি রচনার প্রধান চরিত্র কমলাকান্তের। 

কমলাকান্ত একদা আবিষ্কার করেন তার মন চুরি গিয়েছে। তখন সেই মন-চোরের রহস্য সন্ধানে তৎপর হলে তার স্মরণ হল প্রসন্ন গোয়ালিনীর কথা। প্রসন্নের দ্বারা কমলাকান্তের মন চুরি যাওয়া অসম্ভব না। কারণ, উভয়ের মধ্যে বেশ একটা প্রণয় ছিল। প্রণয় বলতে সাধারণত যেরূপ ধারণা জন্মে প্রসন্নের প্রতি কমলাকান্তের প্রণয় সেই জাতীয় নয়। কমলাকান্তের প্রণয় ব্যাপারটা নিছক গব্যরসাত্মক। অর্থাৎ প্রসন্ন এই আফিম সেবী ব্রাহ্মণকে বিনামূল্যে দুধ, দধি, নবনী প্রভৃতি জোগায় বলে প্রসন্নের প্রতি কমলাকান্তর আকর্ষণটা তীব্র। 

উভয় পক্ষের প্রেমের আদান-প্রদান যদি অবাধে চলতে পারত, তবে তার ফলটা হতে পারত অতিশয় মধুর। প্রসন্ন কলমাকান্তের জন্য অফুরন্ত গব্যরসের জোগান দিত, আর কমলাকান্ত ভাবে গদ গদ হয়ে প্রসন্নকে উপহার দিতে পারতেন অফুরন্ত কাব্যরস। কিন্তু নিন্দুকের ভয়ে এই কাব্যরস সৃষ্টি বাধা পেয়েছে। গাছে ফুল ফুটতে না ফুটতে পূজারি ব্রাহ্মণ যেমন তা ছিন্ন করে নেয়, তেমনি কমলাকান্তের মুখ হতে প্রসন্নের উদ্দেশ্যে প্রণয় রসসিক্ত বাক্যগুলি নির্গত হতে না হতেই তারা নিন্দুকের ভয়ে স্তব্ধ হয়ে যেত। একেই বলে ‘বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না’। 

২। গঙ্গা বিষ্ণুপদ হইতে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন বটে, কিন্তু ভগীরথ তাহাকে আনিয়াছেন; মঙ্গলা আমার বিষ্ণুপদ; প্রসন্ন আমার ভগীরথ আমি দুইজনকেই সমান ভালোবাসি।” – প্রসঙ্গ সহ ব্যাখ্যা লেখ।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ গ্ৰন্থের অন্তর্গত ‘আমার মন’ নামক রস-রচনা থেকে গৃহীত আলোচ্য উক্তিটির বক্তা কমলাকান্ত। 

কমলাকান্ত যখন আবিষ্কার করেন তাঁর মনটি চুরি গেছে, তখন একবার ভাবলেন প্রসন্ন গোয়ালিনীই তার মনচোর। এই ধারণাটা নেহাৎ অমূলক নয়। কারণ, প্রসন্নের সহিত তাঁর একটা প্রণয়ের ভাব বর্তমান। তবে কমলাকান্ত সেই সঙ্গে জানিয়েছেন যে, এই প্রণয় নিছক গব্যরসাশ্রিত – এতে বিন্দুমাত্র কামগন্ধ নেই। আর এই গব্যরসাশ্রিত প্রণয়ও শুধুমাত্র প্রসন্নর একার জন্য নয়; আরেকজন ভাগীদারও আছে, সে প্রসন্নর গাই মঙ্গলা। প্রসন্ন ও মঙ্গলাকে কমলাকান্ত কেন সমভাবে ভালোবাসেন, এখানে তারই কারণ প্রদর্শিত।

পতিতপাবনী গঙ্গা পৃথিবীতে প্রবাহিত হওয়ায় জীবকূল ধন্য। এই পুণ্য প্রবাহিনীকে লাভ করবার জন্য মানুষ কৃতজ্ঞচিত্তে বিষ্ণুপদ ও ভগীরথকে স্মরণ করে। উভয়েই সকলের চিরপূজ্য। বিষ্ণুপদ হতে উত্থিত না হলে আমরা গঙ্গাকে লাভ করতে পারতাম না; আবার ভগীরথ এই পুণ্যধারাকে স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে না আনলে আমাদের অলভ্য থাকত। কমলাকান্ত ঠিক অনুরূপ যুক্তিতেই মঙ্গলা ও প্রসন্নকে ভ্রমভাবে তার ভালোবাসার পাত্রী করেছেন। কমলাকান্ত যে দুগ্ধ পান করেন সে দুধের উৎপত্তিস্থল মঙ্গলা। সুতরাং মঙ্গলা তার আদরণীয়। আবার মঙ্গলার দুধ প্রসন্ন এনে দেয় বলে কমলাকান্ত তা পান করতে পারেন। নচেৎ দুগ্ধপান তার ভাগ্যে ঘটত না। সেই জন্য প্রসন্নের প্রতি অনুরাগ প্রদর্শন তার পক্ষে মোটেই অস্বাভাবিক নয়। 

৩। বুঝিয়াছি, লঘুচেতাদিগের মনের বন্ধন চাই নাহলে মন উড়িয়া যায়। আমি কখন কিছুতে মন বাঁধি নাই – এজন্য কিছুতেই মন নাই। এ সংসারে আমরা কী করিতে আসি তাহা ঠিক বলতে পারি না – কিন্তু বোধ হয় কেবল মন বাঁধা দিতেই আসি। তাৎপর্য ব্যাখ্যা কর।

উদ্ধৃত উক্তিটির বক্তা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ গ্ৰন্থের অন্তর্গত ‘আমার মন’ প্রবন্ধের নায়ক কমলাকান্ত। 

কমলাকান্ত একদিন আবিষ্কার করলেন তার মন চুরি গেছে। তখন সে-বিষয়ে তার গবেষণা চলল। গবেষণার ধারাটা প্রথম দিকে ছিল লঘু, তরল। কিন্তু শেষের দিকে হল গুরুগম্ভীর ও দার্শনিক। 

কমলাকান্তের বক্তব্য, তিনি সারাজীবন শুধু আপনাকে নিয়ে বিব্রত থাকলেন পৃথিবীতে তার সুখলাভের কোনো সম্ভাবনা নাই। লঘুচেতা মানুষ মন বাঁধতে জানে না, তাই তার মন অস্থিরভাবে ঘুরে বেড়ায়। তার ফলে সুখের পরিবর্তে অশান্তিই লাভ হয়। কিন্তু যাঁরা ধীর, স্থির ও প্রাজ্ঞ তাঁদের সুখলাভের প্রকৃতি সঙ্কেতটি জানা আছে। তারা কোনো কিছুর মধ্যে হৃদয়কে এমনভাবে নিবিষ্ট রাখেন যে, মন উড়বার সুযোগ পায় না। এইভাবে যিনি তদ্গতচিত্তে অপরের মধ্যে নিজেকে বিলীন করতে পেরেছেন, তিনিই নন । প্রকৃত সুখ তার ভাগ্যেই ঘটে। 

কমলাকান্তের বক্তব্য নিজেকে ভুলে অপরকে ভালোবাসতে হবে, ভালোবাসার বন্ধনে নিজের মনকে অপরের সঙ্গে বাঁধিতে হবে এই হল মনুষ্যজীবনের আদর্শ। এতেই আছে স্থায়ী সুখের সন্ধান। লঘুচিত্ত মানুষ ইহা বোঝে না বলে তার মন সৰ্বত্র ঘুরপাক খায় এবং সে মন কোনো স্থায়ী আশ্রয় খুঁজে পায় না। এরূপ মানুষ শুধু বিড়ম্বিত বোঝা বহন করে। 

৪। “মাতৃস্তন্যদুগ্ধের সঙ্গে সঙ্গে ধনমানাদির সর্ব্বসারবত্তায় বিশ্বাস শিশুর হৃদয়ে প্রবেশ করিতে থাকে – শিশু দেখে রাত্রিদিন পিতা-মাতা ভ্রাতাভগিনী গুরুভৃত্য প্রতিবেশি শত্রুমিত্র সকলেই প্রাণপণে হা অর্থ, হা যশ, হি মন, হা সম্ভ্রম করিয়া বেড়াইতেছে। সুতরাং শিশু কথা ফুটিবার আগেই সেই পথে গমন করিতে শিখে। কবে মনুষ্য নিত্যসুখের একমাত্র মূল অনুসন্ধান করিয়া দেখিবে ?” তাৎপর্য লেখ।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘আমার মন’ নামক রচনার নায়ক কমলাকান্তের দ্বারা উদ্ধৃত উক্তিটি ব্যবহৃত হয়েছে। উক্তিটির মধ্যে বক্তার সুগভীর চিন্তাশক্তির পরিচয় পাওয়া যায়।

কমলাকান্ত ভোগবাদে বিশ্বাসী নন। পার্থিব ভোগসুখ অথবা ঐশ্বর্য-সম্মান যে মানুষকে স্থায়ী সুখ দিতে পারে, তা তিনি বিশ্বাস করেন। ব্যক্তিগত সুখের কথা ভুলে মানুষ যখন অপরের সুখবন্ধনের জন্য চেষ্টিত হয়, তখনই সে প্রকৃত সুখলাভের অধিকারী হয়। তথাপি মানুষ যে স্বার্থপরতার প্রতি বাধিত হয়, তার কারণ শৈশব হতেই সে স্বার্থপরতার পরিবেশে অভ্যস্ত। সে যাদের নিকট সংস্পর্শে আসে, তাদের মুখ থেকে সর্বদা ধন-মান, সম্ভ্রম-প্রতিপত্তির জয়গান শুনতে শুনতে সে ওইসবে বিশ্বাসী হয়ে পড়ে। প্রবঞ্চকালে নিজেও ওইসব আত্মসুখকর জিনিস আয়ত্ত করতে চেষ্টা করে। 

এইভাবে সে সত্যকারের আনন্দের পথ পরিত্যাগ করে জন্মাবদি ভুল পথে চালিত হয় এবং পরিণামে দুঃখ ভোগ করে। মানুষ যদি স্বার্থপরতার প্রভাব হতে মুক্ত থাকতে পারত, তবে বোধ করি এমন হতে পারত না। কমলাকান্তে কথাটি ভেবে দেখবার মতো। কারণ, মানুষ যে সত্যই অভ্যাসের দাস, সে বিষয় দ্বিমত থাকে পারে না। 

৫। এ পূজার তাম্রশ্মশ্রুধারী ইংরেজ নামে ঋষিগণ পুরোহিত: এডাম স্মিথ পুরাণ এবং মিল তন্ত্র হইতে এ পূজার মন্ত্র পড়িতে হয়; এ উৎসবে ইংরেজি সংবাদপত্রসকল ঢাকঢোল, বাঙ্গালা সংবাদপত্র কাঁসিদার; শিক্ষা এবং উৎসাহ ইহাতে নৈবেদ্য এবং হৃদয় ইহাতে ছাগ বলি।

উদ্ধৃত অংশটি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘আমার মন’ নামক প্রবন্ধ থেকে গৃহীত। কমলাকান্তের এই উক্তিটির মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষে ইংরেজের আমদানি করা বাহ্য সম্পদপ্রীতির প্রতি বক্তার তীব্র প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে। 

ভারতবর্ষ এক সময়ে দেব-দেবীর পূজার স্থান ছিল। কিন্তু ইংরেজ রাজত্বের সূত্রপাত হতে সেই দেশে বাহ্য সম্পদের পূজা চলছে। পূর্বে পুরাণ, তন্ত্র প্রভৃতি শাস্ত্রের নির্দেশ অনুযায়ী পূজা হত, পুতচরিত্র পুরোহিত দ্বারা পূজা নির্বাহিত হত। পুজাস্থানে ঢাক-ঢোল প্রভৃতির মঙ্গলবাদ্য বাজিত, উৎকৃষ্ট ভোজ্যসামগ্রী দ্বারা নৈবেদ্য সাজানো হত এবং দেবতার তৃপ্তির জন্য ছাগবলি দেওয়া হত। 

কিন্তু সে পূজার স্থান এখন বাহ্যসম্পদ-পূজা অধিকার করেছে তাই পূজাব্যবস্থাও পরিবর্তিত। এখন পুরাণ-তন্ত্রের দ্বারা পূজা হয় না। বিলাতি অর্থনৈতিক পণ্ডিত এডাম স্মিথ অথবা মিল যেসব মোটা মোটা বই লিখে গেছেন তাহা হতে উদ্ধৃত উক্তিগুলি এখন মন্ত্রের কাজ করে। প্রাচীন পুরোহিতদিগের জায়গায় এখন অধিষ্ঠিত তামাটে রংয়ের দাড়িওয়ালা সাহেবেরা। বিলাতি কাগজগুলি অর্থনৈতিক ঢাক পিটাতে ব্যস্ত, আর দেশি কাগজগুলি কাঁসির ন্যায় সেই ঢাকের শব্দের অনুকরণ করে চলে। 

আমাদের উৎসাহ-উদ্দীপনা ওই সমস্ত বাহ্য সম্পদ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে নিয়োজিত বলে কমলাকান্ত তাদের পূজার নৈবেদ্য বলে বর্ণনা করেন। আর বাকি থাকল ছাগ বলির ব্যবস্থা। মানুষ যখন বাহ্য সম্পদের কৃপায় বিষয়টি পরিণত হয়, তখন আর তার হৃদয় বলে কিছু থাকে না। তাই কমলাকান্ত বাহ্যসম্পৎ-পূজায় হৃদয়ের উদারতা প্রভৃতি গুণগুলিকেই ছাগবলির স্থান দিয়েছে।


প্রবন্ধ আমার মন হতে প্রশ্ন মান – ১০

১। আমার মন প্রবন্ধটির বিষয়বস্তুর পরিচয় প্রদান কর এবং এই প্রবন্ধ রচনায় লেখক যে সাহিত্য কুশলতার পরিচয় দিয়েছেন তা আলোচনা কর।

অহিফেনসেবী কমলাকান্ত হঠাৎ আবিষ্কার করলেন যে তার মন চুরি হয়ে গেছে। কে তার মন চুরি করল তা স্থির করতে না পেরে হারানো মনের সন্ধানে তিনি প্রথমে রন্ধনশালায় গমন করলেন। লুচি, কোরমা-কোফতা-পলান্নের লোভে মনের সেখানে যাওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু সেখানে মনের সন্ধান মিলল না।

অতঃপর কমলাকান্ত হারানো মনের সন্ধানে গেলেন প্রসন্ন গোয়ালিনীর নিকট। প্রসন্ন গোয়ালিনীর সাথে কমলাকান্তের প্রণয় অতিশয় পুরাতন। এই প্রণয় গব্যরসাত্মক ও কাব্যরসাত্মক। কমলাকান্ত অহিফেনসেবী তাই গব্যরসের প্রতি তার আসক্তি অতিশয় তীব্র। আর প্রসন্ন সেই আসক্তির পরিতৃপ্তির জন্য তাকে নিষ্ফলা খাঁটি দুগ্ধ জোগাত। এ ছাড়া বিনামূল্যে ক্ষীর-সর-নবনীও দিত। প্রসন্নর আরেকটা গুণ ছিল। সে অশেষ ধৈর্যসহকারে কমলাকান্তের রচনাবলি শ্রবণ করত। কিন্তু এই প্রসন্নর নিকটও কমলাকান্তের মনের সন্ধান মিলল না। 

অতঃপর পথে একটি সুন্দর যুবতী দর্শনে কমলাকান্তের ধারণা হল হয়তো ওই যুবতীই তার মনচোর। কিন্তু যুবতীর কটূক্তিতে তার সে ভুল ভাঙল। তখন কমলাকান্ত গভীরভাবে চিন্তা করতে বসলেন। অনেক ভেবে দেখতে পেলেন শারীরিক সুখসুবিধায়, হাস্যপরিহাসে, অধ্যয়নে কোথাও তার মন নেই। অর্থসংগ্রহে তার মন চিরদিনই উদাসীন।

এরপর অনুসন্ধান চলল আরও গুরুগম্ভীরভাবে। 

কমলাকান্ত চিন্তা করে দেখতে পেলেন লঘুচেতা মানুষের পক্ষে কোনো না কোনো বন্ধন আবশ্যক। মনকে এইভাবে বেঁধে রাখতে না পারলে সে সহজেই উড়ে যায়। মানুষ এই সংসারে শুধু মনকে বাঁধা দেবার জন্য আসে। মনের এই বন্ধন নিজের জন্য নয়, পরের জন্য। কমলাকান্ত চিরদিন শুধু নিজের জন্যই বিব্রত। পরের কথা চিন্তা করবার অবকাশ হল না, তার পক্ষে সুখ অন্বেষণের চেষ্টা বৃথা। 

ক্ষুদ্র স্বার্থকে পরার্থে বিসর্জন দেওয়াই স্থায়ী সুখের উপায়। ধন-যশ-মান প্রভৃতি মানুষকে স্থায়ী সুখ দিতে পারে না। কারণ, তারও আকাঙ্ক্ষার নিবৃত্তি না হয়ে তা উত্তরোত্তর বর্ধিত হতে থাকে। তার ফলেই আসে অতৃপ্তি বা অশান্তি। সুখলাভের সুনিশ্চিত উপায় অপরের সুখবন্ধন। মানুষ যে এই সত্য জেনেও ভোগসর্বস্ব জীবনের প্রতি ধাবিত হয় তা তার মোহগ্রস্ত অবস্থারই পরিচায়ক। কমলাকান্তের নিশ্চিত বিশ্বাস একদিন মানুষের এই মোহাবসান ঘটবে।

প্রাচীন ভারত মানুষকে এই শিক্ষাই দিয়েছে। আড়াই হাজার বৎসর পূর্বে ভগবান বুদ্ধ মানুষের সম্মুখে এই আদর্শই তুলে ধরেছিলেন। তথাপি মানুষের মোহগ্রস্থ অবস্থা দূর হল না। আধুনিক যুগে ভারতবর্ষীয় মানুষকে এই মোহ দৃঢ়ভাবে অধিকার করে বসেছে। তার কারণ ইংরাজ-প্রস্তাব। এই প্রভাবের ফলেই আধুনিক ভারতীয় সমাজে দেখা দিয়েছে “মেটিরিয়াল প্রস্পেরিটি” বা বাহ্যসম্পদের পূজা। এই পূজা এখন প্রাচীন দেবদেবীর পূজাকেও ম্লান করে দিয়েছে। 

কিন্তু এই বাহ্য সম্পদপূজারিদের কাছে কমলাকান্তের প্রশ্ন, “দেশে বাণিজ্যবিস্তার, রেলওয়ে, টেলিগ্রাফ তো হইতেছে, কিন্তু তাতে মনের শান্তি বৃদ্ধি পাইবে কি” ? তাই যদি না হল তবে ওইসব উপকরণগুলিকে জঞ্জাল ব্যতীত আর কী বলা চলে? তথাপি সেই বাহ্যসম্পদ পুজার আয়োজন। এখন টাকাই মানুষের একমাত্র উপাস্য দেবতা – ধৰ্ম্ম অর্থ, কাম, মোক্ষ, সবকিছুই লাভের উপায়। এডাম স্মিথ, মিল প্রমুখ পণ্ডিতরা যা শেখাচ্ছেন আমরা তা বেদবাক্য বলে ধরে নিচ্ছি। এই পাশ্চাত্য শিক্ষার ফলেই আমরা সবকিছুকে ইউটিলিটেরিয়ান দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করতে চাই।

কমলাকান্তের মনে এই বিষয়ে কোনো সংশয় নেই যে এই বাহ্যসম্পদের পূজায় মানুষের স্থায়ী সুখশান্তির সন্ধান মিলবে না। এই পূজা শুধু মানুষের উদরগহ্বরটির বুঁজাইবার কাজে লাগে। শুধুমাত্র উদরপূর্তিতে মানুষের স্থায়ী সুখের আশা দুরাশা মাত্র – অপর মানুষের প্রতি ভালোবাসার বিস্তারেই সে মুখ লভ্য। যে লোক নিজের কথা চিন্তা করতেই ব্যস্ত, অপরের কথা যার চিন্তায় স্থান পায় না, তাকে কমলাকান্তের মতো সর্ব্বস্ব হারাতে হয়, সুখলাভ তার ভাগ্যে ঘটে না। পরকে আপন করবার একটা উপায় বিবাহ। কিন্তু বিবাহিত হলেই সেই গুণটি যে আয়ত্ত করা গেল, তা বলা চলে না। যে বিবাহে মনের মালিন্য দূর হয় না, চিত্তের ঔদার্য্য দেখা যায় না, অপরের প্রতি প্রীতি ভালোবাসা বিস্তৃত হয় না, সে বিবাহ প্রকৃত বিবাহ নয়।

কমলাকান্ত নামক কাল্পনিক পুরুষটির বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের নিজস্ব চিন্তাভাবনাই প্রকাশিত। বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্রই নির্মলশুভ্র হাস্যরসের প্রবর্তক। ‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এ সেই হাস্যরসের উজ্জ্বল প্রকাশ। মনে রাখতে হবে এই হাস্যরস লঘুচেতা ব্যক্তির সাধারণ হাস্যপরিহাস নয়। এতে রহস্য আছে, বিদ্রুপ আছে এবং সর্বোপরি আছে এক দার্শনিক অনুভূতির স্বাদ। হাস্যপরিহাসের মধ্যে দিয়েই জীবন ও জগৎ সম্বন্ধে অনেক সুগভীর তত্ত্ব ব্যক্ত। 

আফিমখোর কমলাকান্তের মেজাজের সঙ্গে একমাত্র De Quincey রচিত “The Confessions of an English Opuium-eater’ -এরই তুলনা চলে। কমলাকান্ত যেন নেশার ঘোরে তাঁর মনের কথা উজাড় করে বলেছেন। সে কথার বাইরের রূপটি হাস্যরসাত্মক, কিন্তু ভিতরের রূপটি দর্শনাত্মক। আবার কথার অনেক স্থলে প্রকাশ পেয়েছে অপূর্ব্ব গীতিময়তা – এই সব স্থানে হয়ে উঠেছে গদ্য রচনা, গানের সুরে বাঁধা গদ্য।


২। “বঙ্কিমচন্দ্র যে জীবনদর্শন তত্ত্বকারে ধর্মতত্ত্বে, কৃষ্ণচরিত্রে ও ভগবদ্গীতার টীকায় ব্যাখ্যা করিয়াছেন, তাহাই রসসাহিত্য আকারে কমলাকান্তের মুখে দিয়েছেন; এদিক হইতে বিচার করলে কমলাকান্তকে বঙ্কিমচন্দ্রের মুখপাত্র বলা যায়” – উক্তিটির আলোচনা কর।

ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র, ধর্মতত্ত্ব, কৃষ্ণচরিত্র, শ্রীমদ্গীতা রচয়িতা বঙ্কিমচন্দ্র এবং লোকরহস্য ও বিবিধ প্রবন্ধের লেখক বঙ্কিমচন্দ্র আপাতদৃষ্টিতে বিভিন্ন প্রতিভাধর মানুষ। রচনার বিষয়বস্তু ও তার পরিবেশণ রীতি-বৈচিত্র্যই বঙ্কিমচন্দ্রকে এইরূপ বহুরূপী করে তুলেছে। কিন্তু এই বহুরূপী মানুষটিরই অন্তরে একটি অখণ্ড ঐক্যবোধ বিরাজ করত। ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ই বঙ্কিমচন্দ্রের একমাত্র রচনা যেখানে তার বিচিত্র সংশ্লেষণ ঘটছে। কমলাকান্তের বিভিন্ন উক্তির মধ্য দিয়ে তার যে মানবপ্রেমিক রূপটি পরিস্ফুট তা প্রকৃতপক্ষে বঙ্কিমচন্দ্রের নিজের অন্তরের রূপ। এই মানব-হিতৈষণার বাণীই তার ধর্ম্মতত্ত্ব, কৃষ্ণচরিত্র ও ভগবদগীতার টীকায় ব্যাখ্যাত।

‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এ কমলাকান্তের ভাব, চিন্তা, কল্পনার সাথে বঙ্কিমচন্দ্রের ভাব চিন্তা কল্পনা মিলে গেছে। জীবন ও জগৎ সম্বন্ধে কমলাকান্তের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকৃতপক্ষে বঙ্কিমেরই নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি। মানবপ্রেমিক বঙ্কিমচন্দ্রের মানবলোকে বিশ্বহিতের কামনা বিরাজ করত, সে কামনা কমলাকান্তের মনেও বিরাজমান ছিল।

‘আমার মন’ প্রবন্ধেও কমলাকান্ত রঙ্গরসিকতা পরিহার করে জীবনকে গভীরভাবে দেখবার চেষ্টা করেছেন। এখানে তার এই স্বার্থলেশহীন নৈর্ব্যক্তিক মানবহিতৈষণার আদর্শই পরিস্ফুট। এই আদর্শের উপলব্ধিতেই কমলাকান্তের মুখ থেকে উচ্চারিত হয়েছে “বুঝিয়াছি, লঘুচেতাদিগের মনের বন্ধন নেই; নহিলে মন উড়িয়া যায়। আমি কখন কিছুতে মন বাঁধি নাই – এজন্য কিছুতেই মন নাই। এ সংসারে আমরা কী করিতে আসি, ঠিক বলিতে পারি না – কিন্তু বোধ হয়, কেবল মন বাঁধা দিতেই আসি।” 

আত্মবিসর্জন ভিন্ন যে পৃথিবীতে স্থায়ী সুখের কোনো মূল্য নেই, তার প্রতিপাদনকল্পে কমলাকান্ত কোনো তত্ত্ব উপস্থিত করেন নি। শুধু অন্তরের অকৃত্রিম সরল বিশ্বাস দ্বারাই তিনি এই অভিমত প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। “আমি মরিয়া ছাই হইব, কিন্তু আমার এ আশা একদিন ফলিবে। ফলিবে, কিন্তু কত দিনে! হায়, কে বলিবে কত দিনে।” কমলাকান্তের মনে এই ব্যাকুলতা প্রকৃতপক্ষে মানবপ্রেমিক বঙ্কিমচন্দ্রেরই আন্তরিক ব্যাকুলতা।


৩। ‘আমার মন’ প্রবন্ধ হইতে হাস্যরসিক বঙ্কিমচন্দ্র সম্বন্ধে তোমার ধারণা লিপিবদ্ধ কর।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের হাস্যরস পরিবেশণের কৃতিত্বের পরিচয় দিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন যে, “নিৰ্ম্মল শুভ্র সংযত হাস্য বঙ্কিমই সর্বপ্রথম বঙ্গসাহিত্যে আনয়ন করেন। তৎপূর্ব্বে বঙ্গসাহিত্যে হাস্যরসকে অন্য রসের সাথে এক পংক্তিতে বসিতে দেওয়া হইত না। সে নিম্নাসনে বসিয়া শ্রাব্য অশ্রাব্য ভাষায় ভাঁড়ামি করিয়া সত্যজনের মনোরঞ্জন করিত। এই প্রগলভ বিদূষটি যতই প্রিয়পাত্র থাক কখনও সম্মানের অধিকারী ছিল না। যেখানে গম্ভীরভাবে কোনো বিষয়ে আলোচনা হত, সেখানে হাস্যের চপলতা সর্বপ্রথমে পরিহার করা হইত। বঙ্কিম সর্ব্বপ্রথমে হাস্যরসকে উচ্চশ্রেণিতে উন্নীত করেন। তিনিই প্রথম দেখাইয়া দেন যে, কেবল প্রহসনের সীমার মধ্যে হাস্যরস বদ্ধ নহে; উজ্জ্বল শুভ্র হাস্য সকল বিষয়কে আলোড়িত করিতে পারে। তিনিই প্রথম দৃষ্টান্তের দ্বারা প্রমাণ করিয়াছেন যে, হাস্যজ্যোতির সংস্পর্শেই কোনো বিষয়ের গভীরতার গৌরব হ্রাস হয় না, কেবল তাহার সৌন্দর্য এবং রমণীয়তার বৃদ্ধি হয়, তাহার সর্ব্বাংশের প্রাণ এবং গতি যেন সুস্পষ্টরূপে দীপ্যমান হইয়া উঠে।”

‘আমার মন’ প্রবন্ধেও বঙ্কিমচন্দ্রের এই শুভ্র সমুজ্জ্বল অনাবিল হাস্যের প্রকাশ ঘটেছে। প্রবন্ধটির সূচনা থেকে শেষ পর্যন্ত হাস্যরসের অবতরণার ফলে রচনাটি সরস ও উপভোগ্য হয়ে উঠেছে। প্রবন্ধের আরম্ভেই আমরা শুনিতে পাই একটি অদ্ভুত ও কৌতুকাবাহ প্রশ্ন, “আমার মন কোথায় গেল? কে লইল ?” তারপর এই প্রশ্নেরই সমাধান খুঁজতে খুঁজতে দেখা দিয়েছে একের পর এক হাস্যরসের হিল্লোল। 

প্রথমে হারানো মনের সন্ধান চলল রন্ধনশালায়। কারণ, ইলিশ মাছের লোভে, সদ্যকর্তিত ছাগমাংসের সুরভিত ব্যঞ্জনের লোভে, লুচি-কোপ্তা-কোর্মা-সন্দেশের লোভে মনের পাকশালায় গমন অসম্ভব নয়। কিন্তু অনুসন্ধান করে দেখা গেল সেখানে মন যায় নি। তবে কি মন প্রসন্ন গোয়ালিনী চুরি করেছে ? তাও বিচিত্র নয়। কারণ, তার সঙ্গে কমলাকান্তের যে রসের সম্বন্ধ, সে কথাও সকলে বলাবলি করে। প্রসন্নের সঙ্গে কমলাকান্তের যে গদ্যরস ও কাব্যরসঘটিত নিবিড় সম্পর্ক আছে, তাও কমলাকান্ত অস্বীকার করে না। কিন্তু হারানো মনকে প্রসন্নের নিকটেও পাওয়া গেল না। তার পর সন্দেহ হল পথচারিণী কোনো সুন্দরী যুবতী হয়তো তার মনটি চুরি করে থাকবে। কিন্তু যুবতীর মুখনাড়া খেয়ে কমলাকান্তের সে ভুল ভাঙল। 

অতঃপর গভীর দার্শনিক চিন্তার জগতে যাওয়াই কমলাকান্তের আসল উদ্দেশ্য। তার এতক্ষণের রসিকতা এই গভীর চিন্তার প্রস্তাবনাস্বরূপ। হাল্কা রমণীর পরিসমাপ্তিতেই তিনি জমিয়ে তুলতে চান গম্ভীর রাগের গুঞ্জন। এই সুগভীর তত্ত্বের আসল কথা এই যে সুখ আত্মসুখকাঙ্ক্ষাতে নয়, পরসুখবর্ধনেই প্রকৃত সুখ। নিজেকে না ভালোবেসে, যে অপরকে ভালোবাসতে শেখে সে-ই ভালোবাসার প্রকৃত মর্ম উপলব্ধি করে। এই ভালোবাসার কথাতেই প্রবন্ধের পরিসমাপ্তি। কিন্তু সেখানেও পুনরায় মধুর হাস্যরসের অবতারণা। ভালোবাসার প্রয়োজনেই বিবাহ। কমলাকান্তও বিবাহ করে সুখি হতে চান। তাই বৃদ্ধ কমলাকান্ত যুক্ত-করে সকলের নিকট নিবেদন করেছেন, “ তোমরা কেহ কমলাকান্তের বিবাহ দিতে পার।”


৪। “পরিহাসের আবরণে সুগভীর তত্ত্ব পরিবেশণই কমলাকান্তের আসল উদ্দেশ্য” – ‘আমার মন’ প্রবন্ধে কমলাকান্তের এই আসল উদ্দেশ্যটি কীরূপে ব্যক্ত হয়েছে তার পরিচয় দাও।

‘আমার মন’ প্রবন্ধে কমলাকান্তের সরস বাচনভঙ্গির ভিতর থেকে উৎসারিত হয়েছে এক সুগম্ভীর জীবনজিজ্ঞাসা। আমরা সকলেই সুখী হতে চাই, কিন্তু দেখা যায় সুখ আমাদের চির অনায়ত্ত। যে বিষয় নিয়ে সুখের সন্ধানে আমরা মনকে নিবিষ্ট করতে চাই দেখা যায় সেখান হতে মন উধাও। ভেগাবাসনা, বিষয়লিপ্পা বহু কিছুতেই তো আমাদের মনকে বেঁধে রাখতে চাই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বেঁধে রাখতে পারি না। মন কখন কীভাবে, কার দ্বারা যে সেই বাসনার কারাগার থেকে অপহূত হয় তা কেউ বলতে পারে না। আত্মসুখের বাসনা মনকে চির অনায়ত্ত করে রাখে। তবে মনকে ধরে রাখবার উপায় আছে। সে উপায় হল পরসুখবর্ধনের জন্য আন্তরিক চেষ্টা। পরসুখের জন্য যে ক্ষুদ্র আত্মসুখ বিসর্জন দিতে প্রস্তুত, শুধু সেই মানসিক সুখশান্তিলাভের অধিকারী। এই সত্য মানুষ যেদিন বুঝবে সেদিন সে ভোগবিলাসের আকর্ষণ ত্যাগ করে পরের সুখবিধানের জন্য ব্রতী হবে।

এই সত্য ভারতবাসীর নিকট নুতন নয়। আড়াই হাজার বছর পূর্বে শাক্যসিংহ মনুষ্যজাতির উদ্দেশ্যে এই শিক্ষা প্রচার করেছিলেন। তারপর আরও কত মহামানব এই শিক্ষা দিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু তথাপি মানুষের চৈতন্য হয়নি। বর্তমানে ভারতবাসীর মনে যে অশান্তি ও অস্থিরতার লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে তার মূলে আছে পাশ্চাত্যের ভোগবাদী আদর্শের অনুসরণ। পাশ্চাত্যের এই ভোগবাদই আমাদের মানসিক সুখ-শান্তি অপহরণ করেছে। তাই কমলাকান্তের মুখে তীব্র বিদ্রুপ শুনতে পাওয়া যায়, “কী ইংরেজি, কী বাঙ্গালা সংবাদপত্র, সাময়িক পত্র, স্পীচ, ডিবেট, লেকচর যাহা কিছু পড়ি বা শুনি, তাহাতে এই বাহ্যসম্পদ ভিন্ন আর কোনো বিষয়ের কোনো কথা দেখিতে পাই না। হর হর বম বম। বাহ্যসম্পদের পূজা করো। হর হর বম বম। টাকার রাশির উপর টাকা ঢাল। টাকা ভক্তি, টাকা মুক্তি, টাকা মাটি, টাকা গতি! টাকা ধর্ম, টাকা অর্থ, টাকা কাম, টাকা মোক্ষ !……এ পূজার তাম্রশ্মশ্রুধারী ইংরেজ নামে ঋষিগণ পুরোহিত; এডাম স্মিথ পুরাণ এবং মিল তন্ত্র হইতে এ পূজার মন্ত্র পড়িতে হয় ; এ উৎসবে ইংরেজি সংবাদপত্র সকল ঢাক-ঢোল, বাঙ্গালা সংবাদপত্র কাঁসিদার, শিক্ষা এবং উৎসাহ ইহাতে নৈবদ্য এবং হৃদয় ইহাতে ছাগবলি। এ পূজার ফল, ইহলোকে ও পরলোকে অনত্ব নরক।” 

এই বিদ্রূপের কশাঘাতের দ্বারাই কমলাকান্ত বোঝাতে চেয়েছেন যে এই বাহ্যসম্পদপূজা, এই ভোগ- বিলাসসর্বস্ব জীবনযাপন মনুষ্যত্বহীনতারই পরিচায়ক। পরের মঙ্গলের কথা চিন্তা করতে না শিখলে মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা বৃদ্ধি না পেলে সুখশান্তি লাভের আশা দুরাশামাত্র। গার্হস্থ্যজীবনও আমাদের এই আদর্শই অবলম্বন করতে শিক্ষা দেয়। বিবাহ করে যদি সুখি হতে চাও তবে নিজেকে ভুলে আরেকজনকে ভালোবাসতে প্রস্তুত হতে হবে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে কমলাকান্তের আসল রূপটি তত্ত্বজ্ঞ পন্ডিতের রূপ।


Leave a Comment