অনুবাদ কাব্যধারা: মধ্যযুগে বাংলার সমাজ ও সাহিত্য-বাঙ্গালীর শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
অনুবাদ কাব্যধারা- মধ্যযুগে বাংলার সমাজ ও সাহিত্য-বাঙ্গালীর শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
১। বাংলা ভাষায় রামায়ণের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ অনুবাদক কে ছিলেন?
বাংলা ভাষায় রামায়ণের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ অনুবাদক ছিলেন কৃত্তিবাস ওঝা।
২। কৃত্তিবাসের অনূদিত গ্ৰন্থটির নাম কি?
কৃত্তিবাসের অনূদিত গ্ৰন্থটির নাম শ্রীরাম পাঁচালী।
৩। কৃত্তিবাসের জন্মস্থান কোথায়?
নদীয়া জেলার অন্তর্গত ফুলিয়ায় কবি কৃত্তিবাস ওঝা জন্মগ্ৰহণ করেন।
৪। কবি কৃত্তিবাসের জন্ম সাল কত?
কবি কৃত্তিবাসের জন্ম ১৩৯৯ খ্রিস্টাব্দে
৫। কবি কৃত্তিবাস ওঝা কার রাজসভা অলংকৃত করতেন?
কবি কৃত্তিবাস ওঝা গৌড়ের রাজা দনুজমর্দন কংস গণেশের সভা অথবা তাহিরপুরের রাজা কংস নারায়ণের রাজসভা অলংকৃত করতেন।
৬। কবি কৃত্তিবাস ওঝার রামায়ণের অনুবাদমূলক গ্ৰন্থটি কি নামে প্রচলিত?
কবি কৃত্তিবাস ওঝার রামায়ণের অনুবাদমূলক গ্ৰন্থটি ‘কৃত্তিবাসী রামায়ণ’ নামে প্রচলিত।
৭। অদ্ভূতাচার্যের রামায়ণ কার, কোন সময়ের রচনা?
অদ্ভূতাচার্যের রামায়ণ সাঁতোলের রাজা রামকৃষ্ণের সভাকবি নিত্যানন্দ আচার্যের চৈতন্যোত্তর যুগের রচনা।
৮। বাংলায় রামায়ণ রচনাকারী চারজন কবির নাম লেখ।
বাংলায় রামায়ণ রচনাকারী চারজন কবির নাম হল কৈলাস বসু, দ্বিজ ভবানীদাস, দ্বিজশ্রীলক্ষ্মণ চক্রবর্তী, কবিচন্দ্র।
৯। কে, কাকে গুণরাজ খান উপাধি দেন?
বাংলার সুলতান রুকনুদ্দিন বারবক শাহ মালাধর বসুকে গুণরাজ খান উপাধি দেন।
১০। কোন গ্ৰন্থ রচনার জন্য মালাধর বসু গুণরাজ খান উপাধি পেয়েছিলেন?
ভাগবতের অনুবাদ শ্রীকৃষ্ণবিজয় গ্ৰন্থ রচনার জন্য মালাধর বসু গুণরাজ খান উপাধি পেয়েছিলেন।
১১। কোন কোন শাসক হিন্দু সভাকবিদের দিয়ে মহাভারত অনুবাদ করিয়ে নেন?
চট্টগ্ৰামের শাসনকর্তা পরাগল খাঁ ও তার পুত্র ছুটি খাঁ তাদের হিন্দু সভাকবিদের দিয়ে মহাভারত অনুবাদ করিয়ে নেন।
১২। বাংলায় মহাভারতের প্রথম কবি কে? তার উপাধি কি ছিল?
বাংলায় মহাভারতের প্রথম কবি হলেন পরমেশ্বর দাস।
তার উপাধি ছিল কবীন্দ্র।
১৩। পাণ্ডববিজয় পাঞ্চালিকা কাব্যের রচয়িতা কে ছিলেন?
পাণ্ডববিজয় পাঞ্চালিকা কাব্যের রচয়িতা ছিলেন পরমেশ্বর দাস।
১৪। কার রাজত্বকালে কার আদেশে পরাগলী মহাভারত রচিত হয়?
বাংলার শাসনকর্তা হুসেন শাহের রাজত্বকালে তার সেনাপতি চট্টগ্ৰামের শাসনকর্তা লস্কর পরাগল খানের আদেশে পরাগলী মহাভারত রচিত হয়।
১৫। মহাভারতের অশ্বমেধ পর্বের বিস্তৃত অনুবাদ করেন কে? তিনি কার সভাকবি ছিলেন?
মহাভারতের অশ্বমেধ পর্বের বিস্তৃত অনুবাদ করেন শ্রীকর নন্দী।
তিনি নসরৎ খান বা ছুটি খান বা ছোটে খানের সভাকবি ছিলেন।
১৬। বাংলা ভাষায় মহাভারতের শ্রেষ্ঠ অনুবাদক কে ছিলেন?
বাংলা ভাষায় মহাভারতের শ্রেষ্ঠ অনুবাদক ছিলেন কাশীরাম দাস।
১৭। কাশীরাম দাস মহাভারতের কতগুলি পর্ব অনুবাদ করেন?
কাশীরাম দাস মহাভারতের ৪ টি পর্ব অনুবাদ করেন।
১৮। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু কোন গ্ৰন্থ পাঠ করে তার রসাস্বাদন করতেন?
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ গ্ৰন্থ পাঠ করে তার রসাস্বাদন করতেন।
১৯। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু মে ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ গ্ৰন্থ পাঠ করেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় কোথায়?
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু মে ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ গ্ৰন্থ পাঠ করেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ গ্ৰন্থে।
২০। সন-তারিখ যুক্ত প্রথম প্রথম বাংলা কাব্য কোনটি?
সন-তারিখ যুক্ত প্রথম প্রথম বাংলা কাব্য হল ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’।
১। শ্রীকৃষ্ণবিজয় কাব্যটির রচয়িতা কে ? তিনি কী উপাধি পেয়েছিলেন? তাঁর কাব্যটির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।
১+১+৩ (২০১৬)
শ্রীকৃষ্ণবিজয় কাব্যটির রচয়িতা হলেন চৈতন্য পূর্ব যুগের কবি মালাধর বসু।
মালাধর বসু গুণরাজ খান উপাধি পেয়েছিলেন। শ্রীকৃষ্ণবিজয় কাব্যটি রচনার জন্য বাংলার সুলতান রুকনুদ্দিন বারবক শাহ কবিকে এই উপাধি দিয়েছিলেন।
বাংলায় ভাগবত অনুবাদের প্রথম পথিক মালাধর বসু। তিনি শ্রীকৃষ্ণবিজয় কাব্যে খুব নিষ্ঠার সঙ্গে কৃষ্ণের বৃন্দাবন লীলা, মথুরা লীলা ও দ্বারকালীলা বর্ণনা করেছেন। ভূভারহরণের জন্য বিষ্ণুর বৃন্দাবনে কৃষ্ণরূপে জন্মগ্রহণ থেকে মথুরা যাত্রা বৃন্দাবন লীলার অন্তর্ভুক্ত। কংসের নিধন বর্ণিত হয়েছে মথুরালীলায়। দ্বারকাপুরী নির্মাণ থেকে কৃষ্ণের তনুত্যাগ পর্যন্ত কাহিনির ধারাবাহিক বর্ণনা রয়েছে দ্বারকালীলায়। মালাধর বসু কৃষ্ণের গোপীপ্রসঙ্গ ও রাসলীলা সংক্ষিপ্ত করে কৃষ্ণের বলবীর্যের কাহিনি বিবৃত করেছেন।
কবি মূলত কৃষ্ণের ঈশ্বর সত্তার শক্তি প্রাচুর্যের বিজয় গাথা রচনা করেছেন। এর মাধ্যমে তাঁর সমকালীন যুগ বাসনার চিত্রই প্রতিফলিত হয়েছে। কাব্যটির ভাষা সহজ, সরল নিরলংকৃত। আসলে যুগধর্মের চাহিদা পুরণের জন্য কবি কৃষ্ণের সহজ সরল জীবনকাব্য রচনায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। তাই অচিরেই তাঁর কাব্য কৃষ্ণলীলা প্রচারের ক্ষেত্রে বিশেষ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
সর্বোপরি বলতে হয়, বাংলাদেশের জন জীবনে কৃষ্ণ কাহিনি প্রচারের প্রথম ও প্রধান কাব্যগ্রন্থ মালাধর বসু রচিত ও শ্রীচৈতন্যদেব প্রশংসিত ‘শ্ৰীকৃষ্ণবিজয়’ কাব্য। কবির কৃষ্ণ নিষ্ঠা এবং তাঁর কাব্যের রস পরিণাম বাঙালির অন্তর্লোকে যে কৃষ্ণভক্তির ঐশ্বর্য সঞ্চারিত করেছিল পরবর্তীতে সেই ঐশ্বর্য দিয়েই – ‘বাঙালির হিয়া অমিয় মথিয়া নিমাই কায়া পরিগ্রহ করেন।’
২। বাংলা ভাষায় রামায়ণের শ্রেষ্ঠ অনুবাদক কে? তাঁর অনূদিত গ্ৰন্থটির নাম কি? তাঁর কাব্যের জনপ্রিয়তার কারণ কি?
বাংলা ভাষায় রামায়ণের শ্রেষ্ঠ অনুবাদক কৃত্তিবাস ওঝা।
কৃত্তিবাসের অনূদিত গ্ৰন্থের নাম ‘শ্রীরাম পাঁচালি’
‘কৃত্তিবাসী রামায়ণ’ বা ‘শ্রীরাম পাঁচালি’ বাঙালির পরম আদরের কাব্যগ্রন্থ। এর জনপ্রিয়তার কারণ ছিল নিম্নরূপ –
কবি কৃত্তিবাস তাঁর কাব্যে বাল্মীকি রামায়ণ’-এর কাহিনিকে পুরোপুরি অনুসরণ করেন নি। তিনি ‘রামায়ণ’-এর মূল কাহিনির সঙ্গে অন্য কাহিনিও যুক্ত করেছেন। তাঁর সংযোজিত কাহিনী ছিল একেবারে বাঙালি-মানসিকতার প্রতিফলন।
বাল্মীকির ‘রামায়ণ’-এর ক্ষত্রিয় বীর রামচন্দ্র কৃত্তিবাসের কাব্যে হয়ে উঠেছেন ভক্তের ভগবান, সীতা চিত্রিত হয়েছেন সহনশীলা বাঙালি ঘরণী রূপে। কৃত্তিবাসের কাব্যে ভরত ও লক্ষ্মণের মধ্যে অনুগত বাঙালি ভাইকে খুঁজে পাওয়া যায়; আর রামভক্ত বীর হনুমান যেন প্রভুভক্ত পুরাতন ভূত্যেরই প্রতিরূপ। কৃত্তিবাসী রামায়ণের চরিত্রগুলির মধ্যে বাঙালির স্বভাব বৈশিষ্ট্য সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। তাই বাঙালির কাছে কাব্যটি এত জনপ্রিয় হতে পেরেছে।
কৃত্তিবাসের রামায়ণে নারকেল, সুপারি, কাক, কাদাখোঁচা পাখি, সারস প্রভৃতি পল্লিবাংলার প্রকৃতিগত উপাদান যেমন আছে, তেমনই আছে বাঙালির সমাজজীবনের নানা অন্তরঙ্গ ছবি।
কাব্যের ভক্তিবাদ এবং করুণরস প্রবণতার জন্যই কৃত্তিবাসী রামায়ণ বাঙালির কাছে আরও বেশি গ্রহণীয় হয়ে উঠেছে।
সাধারণ মানুষের আস্বাদনের উপযােগী করে পাঁচালির ঢঙে কবি কৃত্তিবাস রামায়ণ কথা পরিবেশন করেছিলেন। তাই বাঙালি জনসাধারণ সহজেই কৃত্তিবাসী ‘রামায়ণ’-এর কাহিনির রসাস্বাদন করতে পেরেছে।
৩। মহাভারতের শ্রেষ্ঠ বাংলা অনুবাদক কে? তার কবি প্রতিভার পরিচয় দাও।
বাংলা ভাষায় মহাভারতের শ্রেষ্ঠ অনুবাদক হলেন কাশীরাম দাস। সপ্তদশ শতকের প্রথমার্ধে তিনি এই কাব্যটি অনুবাদ করেন।
কাশীরাম দাস সমগ্র মহাভারত অনুবাদ করেন নি। আদি, সভা, বিরাট ও বন পর্বের কিছুটা রচনা করে তিনি পরলোক গমন করেন। গ্ৰন্থের অবশিষ্ট অংশ তার ভাই ও জামাতা রচনা করেন। কাশীরাম দাস রচিত কাব্যাংশ যতখানি কাব্যগুন সম্পন্ন বাকি অংশ ততখানি নয়। সে কারনেই কাশীরাম দাসের নামে কাব্যটি পরিচিত হয়।
কাশীরাম দাস সংস্কৃত মহাভারতের হুবুহু ভাবানুবাদ করেন নি। তিনি মহাভারতের কাহিনি ও পুরানের উপাখ্যানের সঙ্গে নিজের কল্পনা যুক্ত করেছিলেন।
কাশীরাম দাস তার রচিত কাব্যটিকে বাঙালির করে গড়ে তুলতে চান নি। দু-এক জায়গায় বাঙালিয়ানার দাগ থেকে থাকলেও তা কৃত্তিবাসের তুলনায় একেবারেই নগণ্য।
কবি দক্ষতার সঙ্গে সংস্কৃত ছন্দ, অলংকার প্রয়োগ করেছেন। এছাড়াও গম্ভীর তাৎপর্যবাহী অনেক তৎসম শব্দ ব্যবহার করেছেন। এই কারণে তার কাব্যে মহাকাব্যিক ভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে।
সংস্কৃত মাহাভারতের দর্শন ও ধর্মীয় ব্যাখ্যাকে কবি কাশীরাম দাস ততটা গুরুত্ব দেন নি। বরং অনুমিত হয় যে, লোকশিক্ষার জন্যই কবি লেখনী ধারন করেছিলেন। কবি সামাজিক ও পারিবারিক আদর্শ, ন্যায়, ধর্ম প্রভৃতির উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন।
সর্বোপরি বলা যায় যে, অষ্টাদশ পর্বের মহাভারতের মাত্র ৪ টি পর্ব অনুবাদ করেও কাশীরাম দাস বাংলা মহাভারতের অমর কবির স্থান লাভ করেছেন।