উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর জীবনী

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর জীবনী ।

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী

বাংলা সাহিত্যের এক প্রবাদপ্রতিম পুরুষ এবং বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। তিনি  ছিলেন একাধারে শিশু সাহিত্যিক , সংগীতজ্ঞ, আলোকশিল্পী, মুদ্রণ গবেষক, মুদ্রক এবং একজন কালজয়ী প্রকাশক। বিশেষ করে শিশু সাহিত্যের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিভা রূপে বিবেচিত হয়। শিশুসাহিত্যের অঙ্গনে তিনি যে ধারার সূচনা করেছিলেন তা আজও সমানভাবে সমাদৃত ও জনপ্রিয়। মুদ্রণ শিল্পের ক্ষেত্রেও তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। মুদ্রণের ক্ষেত্রে তাঁর বিভিন্ন গবেষণা, ইউ রায় অ্যান্ড সন্স গড়ে তোলা, হাফটোন ব্লকের ব্যবহার ইত্যাদি ভারতীয় মুদ্রণ শিল্পকে এক নতুন পথের সন্ধান দেয়। তবে শিশুসাহিত্যিক হিসাবেই তার সর্বাধিক জনপ্রিয়তা। শিশুদের জন্য লেখা তাঁর বিভিন্ন গল্প ও উপন্যাসগুলি ছোট-বড়ো সকলের কাছে আজও সমান জনপ্রিয়। 

জন্ম :-

১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দের ১২ই মে অথবা ১২৭০ বঙ্গাব্দের ২৭শে বৈশাখ ব্রিটিশ ভারতে অবিভক্ত বাংলার ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ মহকুমার অন্তর্গত মসুয়া গ্রামে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী জন্মগ্রহণ করেন। 

বংশপরিচয় :-

তাঁর পিতা কালিনাথ রায় ছিলেন আরবি, ফারসি ও সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে সুপন্ডিত ব্যক্তি। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর মায়ের নাম জয়তারা দেবী। ছিলেন আটজন পুত্রসন্তানের মধ্যে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী তৃতীয়। তাঁর পিতৃদত্ত নাম ছিল কামদারঞ্জন রায়। তাঁর পিতার এক অপুত্রক আত্মীয় জমিদার হরিকিশোর রায়চৌধুরী তাঁকে দত্তক নেন এবং তার নতুন নাম দেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। 

শিক্ষাজীবন :-

ছেলেবেলা থেকেই উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ছিলেন মেধাবী ছাত্র। প্রতিটি পরীক্ষাতেই তিনি ভালো ফল করতেন। ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে তিনি অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বৃত্তিলাভ করেন। এরপর কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে তিনি ভর্তি হন এবং প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যয়নের পর মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন। ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে ২১ বছর বয়সে তিনি স্নাতক হন।

সাহিত্যিক রূপে আত্মপ্রকাশ :-

শৈশব থেকেই পড়াশোনার তুলনায় সংগীত, তবলা, বেহালা ও সাহিত্যচর্চার প্রতি তিনি অধিক আগ্রহী ছিলেন। তৎকালীন শিশুকিশোর পত্রিকা সখা, বালক, সখা ও সাথী, মুকুল ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৮৮৩ সালে ছাত্রাবস্থায় থাকাকালীন সখা পত্রিকায় তাঁর প্রথম রচনা প্রকাশিত হয়। যোগীন্দ্রনাথ সরকারের সিটি বুক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত হয় তার প্রথম বই ‘ছেলেদের রামায়ণ’।

সাহিত্যসৃষ্টি :-

উপেন্দ্রকিশোরের সাহিত্য সম্ভারের বিভিন্ন দিক গুলি হল :- 

(১) গল্প :-

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ছোটদের জন্য অগণিত গল্প লিখেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ছেলেদের রামায়ণ (১৮৯৬), সেকালের কথা (১৯০৩), ছেলেদের মহাভারত(১৯০৮), মহাভারতের গল্প (১৯০৯), টুনটুনির বই(১৯১০), ছোট্ট রামায়ণ(১৯১১), গুপি গাইন বাঘা বাইন(১৯১৫)। এর মধ্যে অন্যতম হল টুনটুনির বই। এই বইটিতে রয়েছে বিচিত্র স্বাদের ২৭টি গল্প সংকলন।  

(২) প্রবন্ধ :-

মুদ্রণ বিষয়ে তিনি বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ রচনা করেন। এই প্রবন্ধগুলি হল ফোকাসিং দ্য স্ক্রিন (১৮৯৭), দ্য থিওরি অব হাফটোন ডট (১৮৯৮), দ্য হাফটোন থিওরি গ্র‍্যাফিক্যালি এক্সপ্লেইনড(১৮৯৯), অটোম্যাটিক অ্যাডজাস্টমেন্ট অব দ্য হাফটোন স্ক্রিন (১৯০১), ডিফ্র‍্যাকশান ইন হাফটোন (১৯০২-০৩), মোর অ্যাবাউট হাফটোন থিওরি (১৯০৩-০৪), দ্য সিক্সটি ডিগ্রি ক্রস লাইন স্ক্রিন (১৯০৫-০৬), মালটিপল স্টপস (১৯১১-১২)।

(৩) বাদ্যযন্ত্র বিষয়ক গ্ৰন্থ :-

তিনি বাদ্যযন্ত্র বিষয়েও কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এই বাদ্যযন্ত্র বিষয়ক গ্রন্থগুলি হল শিক্ষক ব্যতিরেকে হারমোনিয়াম শিক্ষা (১৮৮৮), বেহালা শিক্ষার বই (১৯০৪), ভারতীয় সংগীত।

(৪) ব্রহ্মসঙ্গীত রচনা :-

রামমোহন রায় প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মসমাজের সংস্পর্শে আসার পর ব্রাহ্মধর্ম সম্পর্কে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী গভীর জ্ঞান লাভ করেন এবং কয়েকটি ব্রহ্মসঙ্গীত রচনা করেন। এগুলি হল কে ঘুচায় হায় প্রাণের কালিমারাশি, জয় দিন দয়াময় নিখিল ভুবনপতি, বল দেখি ভাই এমন করে ভুবন কে বা গড়িল, যাব পুরবাসী ভাগবত প্রেম পিয়াসি।

রচনাশৈলীর স্বতন্ত্রতা বিশ্লেষণ :-

শিশু সাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর লেখনী ছিল স্বতন্ত্র ও মৌলিক বৈশিষ্ট্যে পূর্ণ। তাঁর লেখনীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট গুলি হল –

  • (১) সহজসরল শব্দ চয়ন ও সাবলীল রচনারীতি। 
  • (২) প্রাঞ্জল ও গতিশীল ঘটনাক্রমের উপস্থাপনা। 
  • (৩) শিশুদের মনকে ছুঁয়ে যায় এমন চরিত্র, ঘটনা ও বিষয়বস্তুর সংযোজন। 
  • (৪) উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী তার গ্রন্থগুলির প্রচ্ছদ ও গল্পগুলিতে চিত্রের বহুল ব্যবহার করতেন। 
  • (৫) কোনো কোনো গল্পে তিনি বিচিত্র ও অলীক চরিত্রের সমাবেশ ঘটিয়ে লেখনীর গুণে সেই অলীক চরিত্রগুলিকেও বাস্তবতার রঙে রাঙিয়ে তুলেছেন। 
  • (৬) গল্পগুলির মধ্যে এমন সকল উপাদানের সংমিশ্রণ তিনি ঘটিয়েছেন যা পাঠকদেরকে ভাবুক করে তোলে। 
  • (৭) উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর সৃষ্ট গল্প ও গল্পের চরিত্রগুলি সম্পূর্ণভাবে মৌলিক। বাংলা সাহিত্যে এই ধরণের চরিত্রের উদ্ভাবন ইতিপূর্বে ঘটে নি। 
  • (৮) তাঁর নিজের আঁকা প্রচ্ছদ ও অন্যান্য ছবিগুলি গল্পগুলিকে প্রাণবন্ত করে তুলেছে ও শিশুমনে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে। 
  • (৯) তাঁর রচিত প্রতিটি গল্পই বৈচিত্রপূর্ণ। কোনো গল্পেই একই ধরণের ঘটনাক্রম, প্রেক্ষাপট কিছুই অনুসরণ করা হয় নি। 

বর্তমান কালের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাসঙ্গিকতা :-

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর সাহিত্য সৃষ্টি বর্তমান কালের পরিপ্রক্ষিতেও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। আজও শিশু থেকে শুরু করে বয়ঃজ্যেষ্ঠ সকলেই উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর গল্পগুলির গুণমুগ্ধ ভক্ত। শিশু ও কিশোরদের নিষ্পাপ ও ভাবুক মনে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর গল্পগুলি তাদেরকে কল্পনার অনাবিল আনন্দের জগতে ডানা মেলে উড়ে যেতে সাহায্য করে। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় উপেন্দ্রকিশোরের ‘গুপী গায়েন বাঘা বাইন’ গল্পটি। এই গল্পটি নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন সত্যজিত রায়। আজও চলচ্চিত্রটি শিশু, কিশোর, বয়ঃজ্যেষ্ঠ সকলের কাছেই সর্বাধিক জনপ্রিয় একটি চলচ্চিত্র। 

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বিশেষ অবদান :-

বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর অপর উল্লেখযোগ্য অবদান হল ‘সন্দেশ’ পত্রিকার সম্পাদনা। শিশু ও কিশোরদের জগতে সন্দেশ পত্রিকাটি বিশেষ ভাবে কৃতিত্বের দাবিদার। সন্দেশ পত্রিকার প্রকাশনা শুরু হয় উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর হাতে। এরপর পুত্র সুকুমার রায়, তারপর সুকুমার রায়ের পুত্র সত্যজিৎ রায় এবং সত্যজিৎ রায়ের পুত্র সন্দীপ রায়ও পত্রিকাটির সম্পাদনা করেন। সন্দেশ পত্রিকাটি আজও প্রচলিত ও সমানভাবে জনপ্রিয়। শিশু ও কিশোর চিত্তকে সুকুমার লালিত্যে পরিপূর্ণ করে তুলতে সন্দেশ পত্রিকাটি বিশেষ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। 

উপসংহার :-

বাংলা সাহিত্যে এক বিরল প্রতিভা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। তিনি বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে যে ধারার সূচনা করেছিলেন তা সর্বকালে সবার কাছে প্রশংসিত ও জনপ্রিয়। তাঁর মৃত্যুর এত বছর পরেও তাঁর রচনাগুলি পাঠক কুলের হৃদয়ে আজও উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের ন্যায় বিরাজমান। তাঁর রচিত গল্প গুলি শিশু ও কিশোর মনকে সযত্নে সুকুমার লালিত্যে লালন করে – এখানেই তাঁর বিশিষ্টতা, অনন্যতা।     

Leave a Comment