কাব্য কবিতার ধারা: আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ধারা (একাদশ শ্রেণী)

কাব্য কবিতার ধারা- আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ধারা (একাদশ শ্রেণী) (বাঙ্গালীর ভাষা ও সংস্কৃতি (প্রথম পর্ব চতুর্থ অধ্যায়))

Table of Contents

কাব্য কবিতার ধারা -আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ধারা

বাঙ্গালীর ভাষা ও সংস্কৃতি প্রথম পর্ব চতুর্থ অধ্যায়ের অন্তর্গত কাব্য কবিতার ধারা হতে ছোট ও বড় প্রশ্ন


কাব্য কবিতার ধারা (ছোট প্রশ্ন)

১। ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থের প্রকাশকাল ও বিশেষত্ব কী?

‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থের প্রকাশকাল ১৯১০ খ্রিস্টাব্দ।

গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থটির ইংরেজি অনুবাদের জন্য কবি ‘নোবেল’ পুরস্কারে ভূষিত হন।

২। ‘পুনশ্চ’ কাব্যগ্রন্থের বিশষত্ব কী? 

‘পুনশ্চ’ কাব্যগ্রন্থ থেকে কবি গদ্যছন্দের সূচনা করেন।

৩। কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের তিনটি কাব্যগ্রন্থের নাম লেখো।

কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের তিনটি কাব্যগ্রন্থ হল মরীচিকা (১৯২৩), মধুমায়া (১৯৩০), নিশান্তিকা (১৯৫৭)।

৪। রবীন্দ্র-পরবর্তী চারজন কবির নাম লেখো।

রবীন্দ্র-পরবর্তী চারজন কবি হলেন জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অমিয় চক্রবর্তী।

৫। মোহিতলাল মজুমদারের ছদ্মনাম কী?

মোহিতলাল মজুমদারের ছদ্মনাম হল সত্যসুন্দর দাস।

৬। জীবনানন্দ দাশের প্রথম কাব্যগ্রন্থ কোনটি?

জীবনানন্দ দাশের প্রথম কাব্যগ্রন্থটি হল ‘ঝরাপালক’ (১৯২৭)।

৭। জীবনানন্দ দাশের কাব্যবৈশিষ্ট্য সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য লেখো।

রবীন্দ্রনাথ জীবনানন্দ দাশের কাব্যবৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলেছেন চিত্ররূপময়।

৮। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের চারটি কাব্যগ্রন্থের নাম লেখো।

সুধীন্দ্রনাথ দত্তের চারটি কাব্যগ্রন্থ হল ‘অর্কেস্ট্রা’ (১৯৩৫), ‘ক্রন্দসী’ (১৯৩৯), ‘উত্তরফাল্গুনী’ (১৯৪০), ‘সংবর্ত’ (১৯৫৩)।

৯। ‘পদাতিক কবি’ কাকে বলা হয় ?

সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে ‘পদাতিক কবি’ বলা হয়।

১০। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের চারটি কাব্যগ্রন্থের নাম লেখো।

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের চারটি কাব্যগ্রন্থ হল পদাতিক (১৯৪০), ‘যত দূরেই যাই’ (১৯৬২), ‘ছেলে গেছে বনে’ (১৯৭২) ও ‘একটু পা চালিয়ে ভাই (১৯৭৯)।

১১। প্রেমেন্দ্র মিত্রের চারটি কাব্যগ্রন্থের নাম লেখো।

প্রেমেন্দ্র মিত্রের চারটি কাব্যগ্রন্থ হল ‘ফেরারী ফৌজ’ (১৯৪৮), সাগর থেকে ফেরা’ (১৯৫৬), ‘কখনো মেঘ’ (১৯৬০) ও ‘হরিণ-চিতা-চিল’ (১৯৬১)।

১২। বিষ্ণু দে রচিত একটি রূপক কবিতার নাম লেখো। 

বিষ্ণু দে রচিত একটি রূপক কবিতা হল ‘দামিনী’ ও ‘ঘোড়সওয়ার’।

১৩। সমর সেনের চারটি কাব্যগ্রন্থের নাম লেখো।

সমর সেনের চারটি কাব্যগ্রন্থ হল ‘কয়েকটি কবিতা’ (১৯৩৭), ‘গ্রহণ ও অন্যান্য কবিতা’ (১৯৪০), ‘নানা কথা’ (১৯৪২), ‘তিন পুরুষ’ (১৯৪৪)।

১৪। কবি অমিয় চক্রবর্তীর চারটি কাব্যগ্রন্থের নাম লেখো।

কবি অমিয় চক্রবর্তীর চারটি কাব্যগ্রন্থ হল ‘একমুঠো’ (১৯৩৯), ‘মাটির দেয়াল’ (১৯৪২), ‘অভিজ্ঞান বসন্ত’ (১৯৪৩), ‘পারাপার’ (১৯৫৩)।

১৫। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় পদাতিক কবিতায় কাদের অভ্যর্থনা জানিয়েছেন?

কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় ‘পদাতিক’ কবিতায় কৃষক, ছাত্র আর মজুরের উজ্জ্বল মিছিলকে অভ্যর্থনা করেছেন।

১৬। কবি দিনেশ দাসের কবিতায় কোন ছন্দের প্রকাশ বেশি।

কবি দিনেশ দাসের কবিতায় গদ্য কবিতা, শ্বাসাঘাত ও মুক্তক ছন্দের প্রকাশ রয়েছে।

১৭। কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কোথায় কবে জন্মগ্রহণ করেছেন? 

কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে ২ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিক্রমপুরে জন্মগ্রহণ করেন।

১৮। কবি অরুণ মিত্রের চারটি কাব্যগ্রন্থের নাম লেখো।

কবি অরুণ মিত্রের চারটি কাব্যগ্রন্থ হল ‘ঘনিষ্ঠ তাপ’ (১৯৬৩), ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ (১৯৭২), ‘শুধু রাতের শব্দ নয়’ (১৯৭৮) ও ‘এই অমৃত এই গরল’ (১৯৯১)

১৯। কবি মনীশ গুপ্তের চারটি কাব্যগ্রন্থের নাম উল্লেখ করো।

কবি মনীশ গুপ্তের চারটি কাব্যগ্রন্থ হল ‘আমরা তিনজন’ (১৯৪৮), নীলপাথরের আকাশ’ (১৯৬৮), ‘লাল স্কুল বাড়ি’ (১৯৭৮), ‘শরৎ মেঘ ও ঘাসফুলের বন্ধু’ (১৯৯২)।

২০। পূর্ণেন্দু পত্রীর চারটি কাব্যগ্রন্থের নাম লেখো। 

পূর্ণেন্দু পত্রীর চারটি কাব্যগ্রন্থ হল ‘এক মুঠো রোদ’ (১৯৫১), ‘শব্দের বিছানা’ (১৯৭২), ‘তুমি এলে সূর্যোদয় হয়’ (১৯৭৬), ‘আমিই কচ আমিই দেবযানী’ (১৯৭৭)।

২১। কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর চারটি কাব্যগ্রন্থের নাম লেখো।

কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর চারটি কাব্যগ্রন্থ হল ”নক্ষত্র জয়ের জন্য’ (১৯৬৯), ‘কলকাতার যীশু’ (১৯৭০), ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ (১৯৭৬), ‘উলঙ্গ রাজা’ (১৯৭১)।

২২। ‘কেউ কথা রাখে নি’ কবিতাটির রচয়িতা কে?

কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি বিখ্যাত কবিতা ‘কেউ কথা রাখে নি।

২৩। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের দুটি কাব্যগ্রন্থের নাম লেখো। 

শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের দুটি কাব্যগ্রন্থ হল ‘পরশুরামের কুঠার’ (১৯৭৮), ‘যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো’।

২৪। কবি জয় গোস্বামীর চারটি কাব্যগ্রন্থের নাম লেখো।

কবি জয় গোস্বামীর চারটি কাব্যগ্রন্থ হল ‘উন্মাদের পাঠক্রম’ (১৯৮৬), ‘গোল্লা’ (১৯৯১), ‘বজ্রবিদ্যুৎ ভর্তি খাতা’ (১৯৯৫), ‘পাখি হুস’ (১৯৯৫)।

২৫। অশোককুমার মিত্রর দুটি কাব্যগ্রন্থের নাম লেখো।

অশোককুমার মিত্রর দুটি কাব্যগ্রন্থ হল ‘রাম গিয়েছে বনে’ (১৯৮৫), ও ‘জতুগৃহে একা পান্ডব’ (১৯৮৭)।


কাব্য কবিতার ধারা (বড় প্রশ্ন)

১। বাংলা গীতিকবিতার ধারায় কবি বিহারীলালের ভূমিকা আলোচনা করো।

(২০১৫, ২০১৮, ২০২২)

আধুনিক যুগে নব্য কবিদের লেখনীতে গীতিকবিতার ফল্গুধারা নব উচ্ছ্বাসে প্রবাহিত হতে দেখা যায় মধুসূদন দত্তের ‘ব্রজাঙ্গনা কাব্য’, হেমচন্দ্রের কবিতাবলি’ ও নবীনচন্দ্রের ‘অবকাশরঞ্জিনী’ গ্রন্থে। এই সময়ে যিনি মহাকাব্য ধারার ভাসমান পাঠকসমাজকে গীতিকবিতার ধারায় অবগাহন করার ঔৎসুক্য দান করেছিলেন এবং বাংলা কাব্যধারার পালাবদল ঘটিয়ে গীতিকবিতার নব কলেবর দান করেছিলেন তিনি বিহারীলাল চক্রবর্তী।

বিহারীলালের রচনাসম্ভারের মধ্যে রয়েছে ‘সংগীতশতক’ (১৮৬২), ‘বঙ্গসুন্দরী’ (১৮৭০), ‘নিসর্গ সন্দর্শন’ (১৮৭০), ‘বন্ধুবিয়োগ’ (১৮৭০), ‘প্রেমপ্রবাহিনী’ (১৮৭০), সারদামঙ্গল’ (১৮৭১), ‘সাধের আসন’ (১৮৮১)।

বিহারীলালের ‘সংগীতশতক’ সাধারণের কাছে খুব বেশি সমাদৃত নয়। তবে কবির এই গ্রন্থ সম্বন্ধে ড. সুকুমার সেন বলেছেন যে, “বৈষ্ণব পদাবলির মধ্য দিয়া প্রবাহিত হইয়া বাংলার বিশুদ্ধ গীতিকবিতার যে ধারাটি নিধুবাবু, শ্রীধর কথক, রাম বসু প্রমুখের ‘টপ্পায়’ অর্থাৎ ক্ষুদ্র প্রণয় সংগীতে আসিয়া স্তব্ধ হইয়া গিয়াছিল তাহাকে বিহারীলাল নূতন করিয়া প্রবাহিত করিলেন ‘সংগীত শতকে'”।

“মনে যে বিষম সুখ

কয়ে কি জানান যায় ?

কিছু কিছু পারিলেও 

কিবা ফলোদয় তায়।”

কবির “বন্ধুবিয়োগ” গ্রন্থটি তিনবন্ধু ও জীবনসঙ্গিনী সরলাদেবীর উদ্দেশে লেখা। এটি চারটি সর্গ ও পর্যায় ছন্দের বেষ্টনীতে আবদ্ধ। ‘প্রবাহিনী’তে কবির মনের উত্তরণ ঘটেছে, ‘নিসর্গ সন্দর্শন’ কাব্যটিতে প্রকৃতির রূপচিত্র অঙ্কিত হয়েছে, ‘বঙ্গসুন্দরী’ কাব্যে নারীচরিত্রের সংসারজীবনের নানা রূপের মাঝে তাঁর রোমান্টিক ও আইডিয়াল মূর্তির সমন্বয় ঘটিয়েছেন। কবির শ্রেষ্ঠ কীর্তি সারদামঙ্গল’ ও পরিপূরক গ্রন্থ ‘সাধের আসন’।

দেবী সরস্বতীকে সম্বোধন করে কবির উক্তি –

“নয়নে নয়নে মেলা,

মানসে মানসে খেলা,

অধরে প্রেমের হাসি বিষাদে মলিন।

হৃদয় বীণার মাঝে 

ললিত রাগিণী বাজে,

মনের মধুর গান মানেই বিলীন।”

কবির সারদা প্রেম করুণা ও সৌন্দর্যের মূর্ত প্রতীক, যাঁর সঙ্গে কবির মিস্টিক সম্পর্ক। রবীন্দ্রনাথ কাব্যটি সম্পর্কে বলেছেন, “সারদামঙ্গল এত অপরূপ কাব্য। …. এমন নির্মল সুন্দর ভাষা, এমন ভাবের আবেগ, কার সহিত এমন সুরের মিশ্রণ আর কোথাও পাওয়া যায় না।” কবি রবীন্দ্রনাথ বিহারীলালকে ‘ভোরের পাখি’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। বাংলা কবিতার জগতে তিনিই প্রথমে ব্যক্তিগত অনুভূতি, কল্পনা, সৌন্দর্য ও সংগীতের আশ্রয়ে এমন সংগীতযুক্ত গীতিকবিতার সৃষ্টি করেছেন।


২। রবীন্দ্রনাথের কাব্যগ্ৰন্থ গুলির কাল অনুসারে বিভাগ কর। প্রতি বিভাগের একটি করে কাব্যগ্ৰন্থের নাম লেখ।

২+৩ (২০১৯)

সার্বভৌম কবি হিসাবে বিশ্বসমাজে রবীন্দ্রনাথের পরিচিতি, তিনি কবিগুরু। কবির কাব্যপ্রতিভার সূচনা থেকে অন্তিনকাল পর্যন্ত বিদগ্ধ পণ্ডিতজন নানা পর্বে ভাগ করে বিষয়ের গুরুত্ব বিশ্লেষণ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের কাব্যগ্ৰন্থ গুলির কাল অনুসারে বিভাগ গুলি হল – সূচনা পর্ব, উন্মেষ পর্ব, ঐশ্বর্য পর্ব, অন্তবর্তী পর্ব, গীতাঞ্জলি পর্ব, বলাকা পর্ব ও অন্ত্য পর্ব।

সূচনা পর্ব (১৮৭৮-১৮৮২) :-

এই পর্বের উল্লেখযোগ্য রচনা হল ‘ভগ্নহৃদয়’ (১৮৮১), ‘শৈশব সংগীত’ (১৮৮১), গাথাকাব্য ‘রুদ্রচণ্ড’ (১৮৮১) গীতিকাব্য ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ (১৮৮১), ‘কালমৃগয়া’ (১৮৮২) প্রভৃতি।

উন্মেষ পর্ব (১৮৮২-১৮৮৬) :-

এই পর্বের উল্লেখযোগ্য রচনা হল ‘সন্ধ্যা সঙ্গীত’ (১৮৮২), ‘প্রভাত সঙ্গীত’ (১৮৮৩), ‘ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী’ (১৮৮৪), ‘ছবি ও গান’ (১৮৮৪) এবং ‘কড়ি ও কোমল’ (১৮৮৬) প্রভৃতি।

ঐশ্বর্য পর্ব (১৮৯০-১৮৯৬) :-

এই পর্বের উল্লেখযোগ্য রচনা হল ‘মানসী’ (১৮৯০), ‘সোনার তরী’ (১৮৯৪), ‘চিত্রা’ (১৮৯৬), ‘চৈতালি’ (১৮৯৬) প্রভৃতি।

অন্তবর্তী পর্ব (১৯০০-১৯১০) :-

এই পর্বের উল্লেখযোগ্য রচনা হল ‘কথা’, ‘কাহিনি’, ‘কল্পনা’, ‘ক্ষণিকা’ (১৯০০), নৈবেদ্য’ (১৯০১), ‘স্মরণ’ (১৯০২-৩), ‘শিশু’ (১৯০৬), ‘খেয়া’ (১৯১০), ‘উৎসর্গ’ (১৯১০) প্রভৃতি।

গীতাঞ্জলি পর্ব (১৯১০-১৯১৫) :-

এই পর্বের উল্লেখযোগ্য রচনা হল ‘গীতাঞ্জলি’ (১৯১০), ‘গীতিমাল্য’ (১৯১৪) ও ‘গীতালি’ (১৯১৫)

বলাকা পর্ব (১৯১৬-১৯২৯) :-

এই পর্বের উল্লেখযোগ্য রচনা হল ‘বলাকা’ (১৯১৬), ‘পলাতকা’ (১৯১৬), ‘পূরবী’ (১৯২৫), ‘মহুয়া’ (১৯২৯) প্রভৃতি।

অন্ত্য পর্ব বা শেষ পর্ব (১৯২৯-১৯৪১) :-

এই পর্বের উল্লেখযোগ্য রচনা হল ‘পুনশ্চ’ (১৯৩২), ‘বিচিত্রিতা’ (১৯৩৩), ‘শেষ সপ্তক’ (১৯৩২), ‘বীথিকা’ (১৯৩৫), ‘পত্রপুট’ (১৯৩৬) ও ‘শ্যামলী’ (১৯৩৬), ‘শেষলেখা’ (১৯৪১) প্রভৃতি।


৩। বাংলা কাব্যসাহিত্যে রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবদান সংক্ষেপে আলোচনা করো।

আধুনিক বাংলা কাব্যের সূচনাপর্বে ঈশ্বরগুপ্ত যে ভূমিকর্ষণ করেছিলেন তাতে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের কাহিনিকাব্যের রোমান্সরস সিঞ্চন করে রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ঐতিহাসিক আখ্যানকাব্যের বীজ পত্তন করেছিলেন।

বাংলা সাহিত্যজগতে রঙ্গলাল বন্দোপাধ্যায়ের প্রবেশদ্বার উন্মুক্ত হয় ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে বিটন সোসাইটির এক সভায় ‘বাংলা কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধ’ শীর্ষক বক্তৃতার মাধ্যমে। তাঁর রচনাসম্ভারের মধ্যে আখ্যানকাব্য গুলি হল ‘পদ্মিনী উপাখ্যান’ (১৮৫৮), ‘কর্মদেবী’ (১৮৬২), ‘শূরসুন্দরী’ (১৮৬৮), ‘কাঞ্চীকাবেরী (১৮৭৯)। তাঁর অনুবাদ গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে কালিদাস রচিত ‘কুমারসম্ভব কাব্যে’র অনুবাদ (১৮৭২), দুইশত সংস্কৃত উদ্ভট শ্লোকের অনুবাদ ‘নীতিকুসুমাঞ্জলী’ নামে বঙ্গদর্শন পত্রিকায় প্রকাশ করেন। এ ছাড়া তিনি পার্নেলের ও গোল্ডস্মিথের ‘হার্মিট’ কাব্য দুটির অনুবাদ করেন।

ইংরেজ কবি-সাহিত্যিক স্কট, মুর, বায়রন-এর আদর্শে অনুপ্রাণিত বীররস আশ্রয় করে আখ্যানকাব্য রচনায় ব্রতী হয়েছিলেন রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। টডের Annals and Antiquities of Rajasthan নামক গ্রন্থ থেকে আলাউদ্দিন ও চিতোরের মহিষী পদ্মিনীর কাহিনি গ্রহণ করে ‘পদ্মিনী উপাখ্যান’ কাব্যটি রচনা করেন। কাব্যটিতে কবি রাজপুত জাতির শৌর্যবীর্যের পরিচয় প্রদানকালে বীরত্বব্যঞ্জক স্বদেশপ্রেমবিষয়ক যে সমস্ত উৎসাহবাণী রচনা করেছিলেন তা বঙ্গবাসীর প্রাণে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল।

“স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়।

দাসত্ব-শৃঙ্খল বল, কে পরিবে পায় হে, কে পরিবে পায়।।”

কাব্যটির অবয়বে উপমা-রূপক-অনুপ্রাস- যমক-এর উপস্থিতি লক্ষণীয়। কবির কাব্যগুলিতে যুগোপযোগী চিন্তা বিশেষ বৈশিষ্ট্য এবং তিনি যুগের পরিবর্তনে মনকে যুক্ত করে নবযুগের দিকে বাংলা সাহিত্যের গতিপ্রবাহ আনতে চেয়েছিলেন। কবি বিষয়বস্তু গ্রহণের ক্ষেত্রে নবরূপায়ণ ঘটিয়েছেন, নব ধারার প্রবর্তন করেছেন কিন্তু ভাষা, রচনারীতির ক্ষেত্রে পুরাতনকেই আঁকড়ে থেকেছেন। 


৪। মাইকেল মধুসূদন দত্তের চারটি কাব্যগ্রন্থের নাম উল্লেখ করে কবি হিসেবে তাঁর বিশিষ্টতা নির্দেশ করো। 

বাংলা সাহিত্যের উদ্যানে কাব্যের নতুন নতুন পুষ্পবীজ রোপণ করে নানা ধরনের গাছের সমাবেশে ভরিয়ে দিয়েছিলেন অনন্যপ্রতিভার অধিকারী মহাকাব্যের রূপকার মাইকেল মধুসূদন দত্ত।

তাঁর কাব্যসম্ভারের মধ্যে রয়েছে প্রথম ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’ (১৮৬০), ব্রজাঙ্গনা কাব্য’ (১৮৬১), ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ (১৮৬১), ‘বীরাঙ্গানা কাব্য’ (১৮৬২), চতুর্দশপদী কবিতাবলি বা সনেট’ (১৮৬৫)।

মধুসূদন মহাভারত ও ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ থেকে উপাদান সংগ্রহ করে ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’ উপহার দেন। তবে কাব্যের ভাষা, ছন্দ, অলংকার বা চিত্রকল্প রচনার ক্ষেত্রে তেমন কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখতে পারেন নি ঠিকই কিন্তু বাংলা কাব্য ধারাবাহিক ছন্দবেষ্টনী থেকে মুক্তির স্বাদ পায় এই কাব্যেই। 

রামায়ণের কাহিনি নিয়ে বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম আধুনিক কাব্য ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ কবির অমর সৃষ্টি। কাব্যের অমিত্রাক্ষর ছন্দ, চরিত্রের উপস্থাপনা, অলংকার প্রয়োগ সম্পর্কে বাংলার সাহিত্যপ্রেমী মানুষ ভালো চোখে গ্রহণ করেন নি, এমনকি রবীন্দ্রনাথও সমালোচনা করেছিলেন। কিন্তু পরে বিশ্বকবি বলেছেন, “বিদায়কালে কাব্যলক্ষ্মী নিজের অশ্রুসিক্ত মালাখানি তাহারই পরাইয়া দিল।” 

রাধাকৃষ্ণ লীলাবিষয়ক কাহিনিকে উপজীব্য করে ব্রজাঙ্গনা কাব্য রচনা করেছেন। তবে মধুসূদন আধ্যাত্মিক ভাবনা বা অপার্থিব বিষয় রাধাকৃষ্ণের প্রেমের মধ্যে উপস্থাপিত করেন নি, তিনি একান্তভাবে রাধার বিরহের মধ্যে মানবীর আকুতি প্রকাশ করেছেন। গ্রিক প্রশস্তি গীত বা ode জাতীয় গীতিকাব্য এই ব্রজাঙ্গনা কাব্যের ভাষা সহজ সরল ও ছন্দ প্রয়োগে কবির বিশিষ্টতা রয়েছে। 

প্রসিদ্ধ ইতালীয় কবি ওবিদের ‘হেরোইদাই’ পত্রকাব্যের আদর্শে মধুসুদন ভারতীয় পুরাণ, মহাকাব্য ও নাটক থেকে স্ত্রী চরিত্র নিয়ে বীরাঙ্গনা কাব্য রচনা করেন। কাব্যটিতে নাট্যরস, চরিত্রের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, বাস্তবনিষ্ঠ মনোভাব ফুটে উঠেছে। কবির কাব্যশিল্প, গীতিধর্মিতার গুণ যেমন কাব্যে স্পষ্ট তেমনি রয়েছে কবির ভারতাত্মার প্রতি, ঐতিহ্য কৃষ্টির প্রতি শ্রদ্ধা। 

ইতালীয় কবি পেত্রার্ক ও শেকসপিয়ারের অনুসরণে ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’ রচনা করেছেন, যাকে ইংরেজিতে বলা হয় সনেট। মাত্র চোদ্দোটি চরণে ভাবকে সম্পূর্ণ প্রকাশ করতে হয় এই কাব্যে। কবি কারাজীবনের সমাপ্তিকালে বসে যে সৃষ্টিসম্ভার বাংলা কাব্যসাহিত্যকে উপহার দিয়েছেন তার মূল্য অপরিসীম।


৫। মাইকেল মধুসূদন দত্তের লেখা কাব্যগুলির নাম লেখো। তাঁর লেখা শ্রেষ্ঠ কাব্যটির বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করো।

মহাকাব্যের রূপকার মাইকেল মধুসূদন দত্তের লেখা কাব্যগুলির মধ্যে রয়েছে ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’ (১৮৬০) ‘ব্রজাঙ্গনা কাব্য’ (১৮৬১), ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ (১৮৬১), ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’ (১৮৬২), ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলি বা সনেট’ (১৮৬৬)।

মাইকেল মধুসুদন দত্তের প্রথম আধুনিক কাব্য ও শ্রেষ্ঠ কাব্য রামায়ণের লঙ্কাকান্ডের অন্তর্গত মেঘনাদবধের ঘটনার উপজীব্য করে সৃষ্ট ‘মেঘনাদবধ কাব্য’। মেঘনাদবধ কাব্য ন-টি সর্গে রচিত। কবি পাশ্চাত্য মহাকবি হোমারের ইলিয়াড -এর আদর্শে কাহিনি এবং চরিত্রগুলি বিন্যস্ত করেছেন। বাল্মীকি রামায়ণের কাহিনিকে কবি অনেক ক্ষেত্রে ওলট-পালট করে উপস্থাপিত করেছেন। তবে কাব্যালংকার ও ভাষাভঙ্গিমায় তিনি বাল্মীকি কালিদাস ভবভূতি প্রমুখ কবিদের ধারা শ্রদ্ধার সঙ্গে অনুসরণ করেছেন।

মধুসূদন বীররসে ভেসে মহাগীত গাইতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বীররসের ধারা বীরবাহুর মৃত্যুতে, চিত্রাঙ্গদার বিলাপে, রাবণ প্রমীলার শোকে করুণরসে পরিণত হয়েছে। ড. অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, “মেঘনাদবধ কাব্যে মধুসূদন একই সঙ্গে বীররসের উর্জস্বল উত্তাপ এবং স্নিগ্ধ মধুর লিরিক রস সৃষ্টি করতে পেরেছেন। এ দিক থেকে তিনি যথার্থই সব্যসাচী”। 

মেঘনাদবধ কাব্যের মধ্যে মধুসূদন সংস্কৃত শব্দের প্রয়োগ মাত্রাতিরিক্তভাবে প্রয়োগ করেছেন। এতে কাব্যমাধুর্য অনেক ক্ষেত্রে নষ্ট হয়েছে তবে অনেক জায়গায় এরূপ শব্দপ্রয়োগের জন্য ভাবের গাম্ভীর্য প্রকাশ পেয়েছে। এই বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের বলেছেন, “ছত্রটিতে ভাবের অনুযায়ী কথা বসিয়াছে, ঠিক বোধ হইতেছে যেন তরঙ্গ বার বার আসিয়া তটভাগে আঘাত করিতেছে।”


৬। গীতিকবিতা বলতে কী বোঝায়? এর বৈশিষ্ট্য কী?

‘গীতিকবিতা’ শব্দটি বিশ্লেষণ করলে সহজভাবে ধরা পড়ে যে, কবিতা যেখানে গীতিমুখর হয়ে ওঠে, তাই ‘গীতিকবিতা’। কবির আন্তরিক ব্যক্তিগত অনুভূতি থেকে যে কবিতার জন্ম হয়, তাই ‘গীতিকবিতা’। ড. অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, “কবির ব্যক্তিগত অনুভূতি কল্পনা, সৌন্দর্য ও সংগীতের পাখায় ভর করে একটি নিটোল রসমূর্তি ধারণ করে, সেই সংগীতময় বাকমূর্তির নাম ‘গীতিকবিতা (Lyric poetry)।” আর একটু বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, গীতিকবিতা’ শব্দটি এসেছে ইংরেজি lyric শব্দ থেকে। Lyre’ নামক বীণাযন্ত্র সহযোগে এই শ্রেণির কবিতা গীত হত বলে একে ‘গীতিকবিতা’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে।

গান ও গীতিকবিতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। শব্দচয়ন বিষয়ে গান রচয়িতার স্বাধীনতা নাই, গানে ছন্দেবৈচিত্র্য সম্ভব নয়। গানে সুরের প্রাধান্য, গীতিকবিতায় কথা ও সুরের সমন্বয়, গানে একাধিক ভাব কল্পনা সম্ভব নয়, গীতিকবিতায় ভাব-কল্পনার বিচিত্রতা ও সুর-সংগতি শুধু সম্ভবপর সুসাধ্যও বটে।

গীতিকবিতা কবির আত্মানুভূতি বা একান্ত ব্যক্তিগত বাসনা-কামনা ও আনন্দ-বেদনার আত্মপ্রকাশ, এখানে কোনো পরিপূর্ণ মানবজীবনের ইঙ্গিত নাই। রবীন্দ্রনাথ বলেন, “যাহাকে আমরা গীতিকাব্য বলিয়া থাকি অর্থাৎ যাহা একটুখানির মধ্যে একটিমাত্র ভাবের বিকাশ, ঐ যেমন বিদ্যাপতির –

ভরা বাদর মাহ ভাদর 

শূন্য মন্দির মোর –

সেও আমাদের মনের বহুদিনের অব্যক্ত ভাবের একটি কোনো সুযোগ আশ্রয় করিয়া ফুটিয়া ওঠা।” 

গীতিকবিতার মধ্যে আন্তরিকতাপূর্ণ অনুভূতি, অবয়বের স্বল্পতা, সংগীতমাধুর্য ও গতিস্বাচ্ছন্দ্য – এই কয়টি জিনিস অবশ্যই থাকা উচিত। তবে প্রাচীনকালের গীতিকবিতায় প্রেম ও ভক্তিই ছিল প্রধান উপজীব্য, বর্তমানে যুক্ত হয়েছে দেশভক্তি, নারীপ্রেম ও প্রকৃতি। উনিশ শতকের সমগ্র গীতিকাব্যের মধ্যে ‘An extraordinary development of imaginative sensibility’ অর্থাৎ কল্পনাপ্রধান চিত্তবৃত্তির অসাধারণ উৎসার লক্ষ্য করা যাবে।


৭। রবীন্দ্রকাব্যপ্রবাহকে কয়টি পর্বে ভাগ করা যেতে পারে তার নাম লেখো। রবীন্দ্রকাব্যের সূচনাপর্বের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

সার্বভৌম কবি হিসাবে বিশ্বসমাজে রবীন্দ্রনাথের পরিচিতি, তিনি কবিগুরু। কবির কাব্যপ্রতিভার সূচনা থেকে অন্তিমকাল পর্যন্ত বিদগ্ধ পণ্ডিতজন নানা পর্বে ভাগ করে বিষয়ের গুরুত্ব বিশ্লেষণ করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে সূচনা পর্ব, উম্মেষ পর্ব, ঐশ্বর্য পর্ব, অন্তর্বর্তঈ পর্ব, গীতাঞ্জলি পর্ব, বলাকা পর্ব ও অন্ত্য পর্ব।

সূচনা পর্ব – দেবতুল্য পিতা, রুচিসম্মত গৃহপরিবেশ, গুরুকুল শিক্ষার মোহময় পরিবেশ, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা, বন্ধুদের উৎসাহ ও প্রেরণায় কবির শিল্পীমানস ও কবিমানস বিকশিত হয়েছিল অল্প বয়সেই। কবির প্রথম জীবনের রচনা ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘অভিলাষ’ই প্রথম মুদ্রিত কবিতা বলে গবেষকগণ দাবি করেন। তবে কবির নামাঙ্কিত সর্বপ্রথম রচনাটি ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে হিন্দুমেলায় পঠিত কাব্য হেমচন্দ্রের “ভারতসংগীতের অনুকরণে রচিত ‘হিন্দুমেলার উপহার’ নামক কবিতাটি। 

কবির সর্বপ্রথম সম্পূর্ণ কাব্যগ্রন্থ ‘বনফুল’ (১৮৭৫) আখ্যায়িকা কাব্যটিতে কবিমানসের বিচারে অপরিণত ছাপ রয়েছে। এই সময়ের রচনাগুলির মধ্যে রয়েছে ‘ভগ্নহৃদয় (১৮৮১), শৈশবসংগীত (১৮৮৪), ‘রুদ্রচণ্ড’ (১৮৮১), গীতিকাব্য ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ (১৮৮০) গীতিনাট্য কালমৃগয়া’ (১৮৮২) নাট্যকাব্য। 

কবির অপরিণত রচনাগুলি প্রসঙ্গে অধ্যাপক অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন , “এই অপরিণত রচনাগুলির মধ্যে ভাবের মেঘ জমে উঠেছিল, কিন্তু তখনও রসের বর্ষণ শুরু হয় নি। তবু দেখা যাচ্ছে নাগরিক জীবন-বহির্ভূত উদার পল্লিপ্রকৃতির মধ্যে ফিরে গিয়ে মুক্তির স্বাদগ্রহণের আকাঙ্ক্ষা কিশোর কবিকে যে অধরার পিছনে ধাবিত করেছিল, সেই বৈশিষ্ট্যটি উত্তরকালে প্রকৃতিপ্রেম ও মানবের মধ্য দিয়ে পরিপূর্ণ রোমান্টিকতার তুরীয় লোকে উত্থিত হয়েছে।”


৮। প্রবণতা অনুযায়ী রবীন্দ্রকাব্যের পর্ব বিভাগ করো এবং শেষ পর্বের কাব্যধারার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি সূত্রাকারে লেখো।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাব্যপ্রতিভার সূচনা থেকে অন্তিমকাল পর্যন্ত সুদীর্ঘ কাব্যপ্রবাহকে মোটামুটি সাতটি পর্বে ভাগ করা যায়। – সূচনা পর্ব, উন্মেষ পর্ব, ঐশ্বর্য পর্ব, অন্তবর্তী পর্ব, গীতাঞ্জলি পর্ব, বলাকা পর্ব ও অন্ত্যপর্ব।

অন্ত্যপর্বের প্রথম দিকের কয়েকটি কাব্য যেমন- ‘পুনশ্চ’ (১৯৩২), ‘বিচিত্রিতা’ (১৯৩৩), ‘শেষ সপ্তক’ (১৯৩৫), ‘বীথিকা’ (১৯৩৫), পত্রপুট’ (১৯৩৬) ও ‘শ্যামলী’ (১৯৩৬)-কে ‘পুনশ্চ’ বর্গের কাব্য হিসাবে চিহ্নিত করা যায়। এই ‘পুনশ্চ’ থেকেই শুরু হয় গদ্যকবিতা এবং শ্যামলী পর্যন্ত গদ্যছন্দই রবীন্দ্রনাথের আত্মপ্রকাশের বাণীবাহক হয়েছে, যাতে রয়েছে দৈনন্দিন জীবনের হাসিকান্নার সুর।

‘পুনশ্চ’ কাব্যের ঠিক পরে কবি কয়েকটি কৌতুকরস সৃষ্টিকারক কাব্যগ্রন্থ উপহার দিয়েছেন। ‘খাপছাড়া’ (১৯৩৭), ‘ছড়া ও ছবি’ (১৯৩৭) এবং ‘প্রহাসিনা’ (১৯৩৯) এর মধ্যে পড়ে। অন্ত্যপর্বের শেষ পর্যায়ে কবির কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ হল ‘প্রান্তিক’ (১৯৩৮), ‘সেঁজুতি’ (১৯৩৮), ‘আকাশপ্রদীপ’ (১৯৩১), ‘নবজাতক’ (১৯৪০), ‘সানাই’ (১৯৪০), ‘রোগশয্যায়’ (১৯৪০), ‘আরোগ্য’ (১৯৪১), ‘জন্মদিনে’ (১৯৪১), ‘শেষ লেখা’ (১৯৪১)। 

কবির অন্ত্য পর্বের রচনাকাল মাত্র তিন বৎসর। এখানে কবি পৃথিবীর মাটি টানে মাটির মানুষের সাথে নিজেকে যুক্ত করতে চেয়েছেন, মানুষের কবি হয়ে মানুষের গান রচনা করতে চেয়েছেন। 


৯। প্রবণতা অনুসারে রবীন্দ্র কাব্যধারার পর্ববিভাগ করো।

সার্বভৌম কবি হিসাবে বিশ্বসমাজে রবীন্দ্রনাথের পরিচিতি, তিনি কবিগুরু। কবির কাব্যপ্রতিভার সূচনা থেকে অন্তিনকাল পর্যন্ত বিদগ্ধ পণ্ডিতজন নানা পর্বে ভাগ করে বিষয়ের গুরুত্ব বিশ্লেষণ করেছেন, যার মাধ্যে রয়েছে সাতটি পর্ব – সূচনা পর্ব, উন্মেষ পর্ব, ঐশ্বর্য পর্ব, অন্তবর্তী পর্ব, গীতাঞ্জলি পর্ব, বলাকা পর্ব ও অন্ত্য পর্ব। 

সূচনা পর্বের রচনাগুলির মধ্যে রয়েছে ‘ভগ্নহৃদয়’ (১৮৮১), ‘শৈশব সংগীত’ (১৮৮১) গাথাকাব্য ‘রুদ্রচণ্ড’ (১৮৮১) গীতিকাব্য ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ (১৮৮০), গীতিনাট্য ‘কালমৃগয়া’ (১৮৮২) নাট্যকাব্য। এই রচনাগুলি কবির কুড়ি একুশ বছর বয়সে রচিত এবং সব কিছুই অপরিণত রচনা হলেও এরই ফাঁকে পরিণত লেখার সূচনা হয়ে গিয়েছিল। 

উন্মেষ পর্বের রচনাগুলি হল ‘সন্ধ্যা সঙ্গীত’ (১৮৮১), ‘প্রভাত সঙ্গীত’ (১৮৮৩), ‘ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী’ (১৮৮৪), ‘ছবি ও গান’ (১৮৮৪) এবং ‘কড়ি ও কোমল’ (১৮৮৬)। এটিই কবির প্রতিভা-শতদলের প্রথম উন্মেষকাল। তাইতো কবি বলেছেন, “আমার হৃদয়ে স্তরে স্তরে যে একটা বিষাদের আচ্ছাদন ছিল তাহা এক নিমেষেই ভেদ করিয়া আমার সমস্ত ভিতরটাতে বিশ্বের আলোক একেবারে বিচ্ছুরিত হইয়া পড়িল।”

ঐশ্বর্য পর্বের রচনা ‘মানসী’ (১৮৯০), ‘সোনার তরী’ (১৮৯৪), ‘চিত্রা’ (১৮৯৬), ‘চৈতালি’ (১৮১৬)-র মধ্যে মানসীতে কবির মর্ত্য বাসনার বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে ভালোবাসা দিয়ে বিশ্ব আত্মার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার বাসনা, ‘সোনার তরী’তে কবির মানসসুন্দরীর সঙ্গে মিলনের সূচনা, ‘চিত্রা’তে মানসসুন্দরীর পরিপূর্ণ উপলব্ধি ও ‘চৈতালি’ সনেটগুলিতে কবি প্রাচীন ভারতের সৌন্দর্য সন্ধান করেছেন।

অন্তবর্তী পর্বের ‘কথা’, ‘কাহিনি’, ‘কল্পনা’, ‘ক্ষণিকা’ (১৯০০), নৈবেদ্য’ (১৯০১), ‘স্মরণ’ (১৯০২-৩), ‘শিশু’ (১৯০৬), ‘খেয়া’ (১৯১০), ‘উৎসর্গ’ (১৯১০) রচনাগুলির মধ্যে কথা ও কাহিনিতে মহৎ ত্যাগের মহিমা-ভাবনা, ‘ক্ষণিকা’য় পল্লিপ্রকৃতির সৌরভ ও অতীত জীবনকথা, ‘নৈবেদ্য’ কাব্যে ধর্মীয়বোধের প্রকাশ ও কবির প্রাণেশ্বরের সঙ্গে কবির নিবিড়তর আসক্তির কথা, ‘শিশু’ কাব্যে শিশুমনের কল্পনা ও খেয়ালিপনা এবং উৎসর্গ’ কাব্যে কবির ব্যথাতুর মনের কথা প্রকাশ পেয়েছে।

‘গীতাঞ্জলি’ (১৯১০), ‘গীতিমাল্য’ (১৯১৪) ও ‘গীতালি’ (১৯১৫) নিয়ে গীতাঞ্জলি পর্ব, যেখানে গানের মধ্য দিয়ে আধ্যাত্মচেতনা প্রকাশ পেয়েছে।

বলাকা পর্বের ‘বলাকা’ (১৯১৬), ‘পলাতকা’ (১৯১৬), ‘পূরবী’ (১৯২৫), ‘মহুয়া’ (১৯২৯) রচনায় কবি গতিময় জীবন এবং এগিয়ে চলার কথা বলেছেন। 

অন্ত্য পর্বে ‘পুনশ্চ’ (১৯৩২), ‘বিচিত্রিতা’ (১৯৩৩), ‘শেষ সপ্তক’ (১৯৩২), ‘বীথিকা’ (১৯৩৫), ‘পত্রপুট’ (১৯৩৬) ও ‘শ্যামলী’ (১৯৩৬)- কে পুনশ্চ বর্গের কাব্য হিসাবে চিহ্নিত করা যায়। এই পুনশ্চ থেকে শুরু করে গদ্য কবিতা এবং শ্যামলী পর্যন্ত গদ্যছন্দেই রবীন্দ্রনাথের আত্মপ্রকাশের বাণীবাহক। এই পর্বে ‘খাপছাড়া’ (১৯৩৭), ‘ছড়া ও ছবি’ (১৯৩৭), ‘প্রহাসিনী’ (১৯৩৯)-তে কৌতুকরস সৃষ্টিকারক গ্রন্থ রয়েছে এবং শেষ পর্যায়ে প্রান্তিক (১৯৩৮), ‘সেঁজুতি’ (১৯৩৮), ‘আকাশ প্রদীপ’ (১৯৩৯), ‘নবজাতক’ (১৯৪০), ‘সানাই’ (১৯৪০), ‘রোগশয্যায়’ (১৯৪০), ‘আরোগ্য’ (১৯৪১), ‘জন্মদিনে’ (১৯৪১), ‘শেষ লেখা’ (১৯৪১) রচনাগুলিতে কবি পৃথিবীর মাটির টানে মাটির মানুষের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করতে চেয়েছেন।


১০। রবীন্দ্রেতর কবি বলতে কী বোঝায়। এই সূত্রে কবি নজরুলের সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

রবীন্দ্রেতর শব্দের অর্থ হল রবীন্দ্রনাথ হতে ‘ভিন্ন’। রবীন্দ্রযুগে আবির্ভূত হয়েও রবীন্দ্রকাব্য প্রভাবে প্রভাবিত না হয়ে নিজস্ব ধারায় প্রভাবিত হয়েছিল নজরুলের কাব্যধারা, সেই অর্থে নজরুলের কাব্যকে রবীন্দ্রেতর কাব্য ও নজরুলকে রবীন্দ্রেতর কবি বলা হয়।

বাংলা কাব্যজগতে বিদ্রোহের ধ্বজা তুলে, পৌরুষের আস্ফালনে দিগন্ত কাঁপিয়ে কবি কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাব। লেটোর দলে গান রচনা করে যাঁর লেখনী শুরু হয়েছিল সেই মানুষটির কবিতাতেই বিদ্রোহী সত্তার জাগরণ ঘটে। কবির বিদ্রোহ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নির্লজ্জ শোষণের বিরুদ্ধে, ধর্মের নামে ভণ্ডামির বিরুদ্ধে, জাতের নামে বজ্জাতির বিরুদ্ধে। আসলে কবি ছিলেন মানবতাবাদী কবি, নবীন যৌবনের কবি। তাঁর ‘জীবনবন্দনা’ ‘ছাত্রদলের গান’, ‘বিদ্রোহী’ প্রভৃতি কবিতা যৌবনেরই বন্দনাগীতি। 

কবি শত দৈন্য, অভাব-অভিযোগ সত্ত্বেও রুঢ় বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়াতে চেয়েছেন। কবির ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় শোনা গেল সর্বজয়ী মানুষের অভ্রভেদী মহিমা গাথা –

“বল বীর 

বল উন্নত মম শির।

শির নেহারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির।”

নজরুলের কবিতায় যে প্রচন্ড জীবনবেগের ও যৌবনধর্মের পরিচয় পাওয়া যায় তা পাশ্চাত্যের কবি জন ডান, রসেটি, সুইনবার্নের অনুসারী। কবির প্রথম কাব্য ‘অগ্নিবীণা’ (১৯২২), এ ছাড়া রয়েছে ‘দোলনচাপা’ (১৯২৩), ‘বিষের বাঁশি’ (১৯২৪), ‘ছায়ানট’ (১৯২৪), ‘সাম্যবাদী’ (১৯২৫), ‘সর্বহারা’ (১৯২৬), ‘ফণিমনসা’ (১৯২৭), ‘প্রলয় শিখা’ (১৯৩০) প্রভৃতি।


১১। জীবনানন্দ দাশের দুটি কাব্যগ্ৰন্থের নাম উল্লেখ করে তাঁর কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য গুলি আলোচনা করা।

রবীন্দ্র-সমকালে আধুনিক বাংলা কাব্য যাঁদের স্পর্শে যথার্থ ব্যক্তিস্বারূপ্য লাভ করেছিল, একটা নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে একজন হলেন জীবনানন্দ দাশ।

কবির উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে ‘ঝরা পালক’ (১৯২৭), ধূসর পাণ্ডুলিপি (১৯৩৬), ‘বনলতা সেন’ (১৯৪২), ‘মহাপৃথিবী’ (১৯৪৪), ‘সাতটি তারার তিমির’ (১৯৪৮), ‘রূপসী বাংলা’ (১৯৫৭), ‘বেলা অবেলা কালবেলা’ (১৯৬১) প্রভৃতি।

কবি জীবনানন্দ ছিলেন আপনভোলা, বড়ো যন্ত্রণার ছিল তার একাকিত্ববোধ। তবে কবি জীবন পলাতক মানুষ নন, তাঁর মনে পড়েছিল তিনিও এই সাধারণ মানুষের মতোই কাজ করেছেন, কত জমি চষেছেন লাঙল দিয়ে, কাস্তে হাতে গিয়েছেন মাঠের ফসল কাটতে – এই সাধারণ জীবনের স্বাদও তার অজানা ছিল না। কবির ‘বনলতা সেন’ কাব্যের বহু কবিতায় যেমন তাঁর ইতিহাস চেতনার প্রকাশ ঘটেছে, তেমনি একালের সমন্বয় সার্থক ঘটেছে এই কবিতায়। 

ঈশ্বর, প্রকৃতি এবং প্রেম – এই তিন ভাবনার ও অনুভবের নিবিড়তায় কবিদের কাব্য পরিক্রমার জগৎ অনন্য হয়ে ওঠে। কবির কবিতায় পাওয়া যায় সোনালি চিল, ঘাসের বুকে হিজলের ছায়া, খই, ফুল ইত্যাদিতে প্রকৃতির রূপ এত চিত্রিত যে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ কবির কবিতাকে বলেছেন ‘চিত্ররূপময়’। কবির কাব্যে প্রকৃতি কোথাও কোথাও মৃত্যুচেতনারও পরিচয়বাহী, বিশেষত, রূপসী বাংলার কবিতাগুলিতে। জীবনানন্দের কবিধর্মের অপর একটি বৈশিষ্ট্য হল তাঁর নাটকীয়তা সৃষ্টি প্রবণতা। ‘ঝরা পালক’, ‘মহাপৃথিবী’ ও ‘বেলা অবেলা কালবেলা’ প্রভৃতি কাব্যের কবিতায় রয়েছে গল্পের উপাদান। 

কবিতার স্তবক বন্ধনে, ছন্দবন্ধনে, শব্দব্যবহারে, অলংকার প্রয়োগে, চিত্রকৌশলে জীবনানন্দ অনন্য। গদ্যছন্দ, পয়ার, মহাপয়ার ছন্দের প্রয়োগ সমধিক, আবার পাশাপাশি শব্দদ্বৈত মুখের ভাষা প্রয়োগে কবি সিদ্ধহস্ত। রবীন্দ্রনাথকে যদি সমগ্র বিংশ শতাব্দীর কাব্য প্রতিনিধি বলা যায়, জীবনানন্দকে তাহলে বলতে হয় শেষ অর্ধশতাব্দীর অন্যতন প্রতিনিধি।


Leave a Comment