লোকহিত : প্রবন্ধ (প্রশ্ন ও উত্তর)

লোকহিত প্রবন্ধ হতে প্রশ্ন ও উত্তর নিম্নে দেওয়া হল। Bengali B.A.(General) LOKHITA Question Answer. প্রবন্ধ লোকহিত হতে 2, 5, 10 নং প্রশ্ন ও উত্তরগুলি দেওয়া হল।

প্রবন্ধলোকহিত
গ্রন্থকালান্তর
রচনারবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকাশিতসবুজপত্র পত্রিকা
লোকহিত

Table of Contents

লোকহিত প্রবন্ধ হতে প্রশ্ন ও উত্তর

Bengali B.A.(General) প্রবন্ধ লোকহিত হতে প্রশ্ন ও উত্তর।


প্রবন্ধ লোকহিত হতে প্রশ্ন মান – ২

১। ‘লোকহিত’ প্রবন্ধটি কবে লেখা হয়? এটি কার রচনা ?

‘লোকহিত’ প্রবন্ধটি ভাদ্র, ১৩২১ বঙ্গাব্দে লেখা। এটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা প্রবন্ধ।

২। ‘লোকহিত’ প্রবন্ধটি কবে, কোন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়?

‘লোকহিত’ প্রবন্ধটি ১৩২১ ভাদ্র সংখ্যায় সবুজপত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। 

৩। ‘লোকহিত’ প্রবন্ধটি কোন প্রবন্ধ গ্রন্থের অন্তর্গত? এটি কত সংখ্যক প্রবন্ধ?

  • ‘লোকহিত’ প্রবন্ধটি ‘কালান্তর’ প্রবন্ধ গ্রন্থের অন্তর্গত।
  • ‘লোকহিত’ প্রবন্ধটি ‘কালান্তর’ প্রবন্ধ গ্রন্থের তৃতীয় সংখ্যক প্রবন্ধ।

৪। ‘কালান্তর’ প্রবন্ধ গ্রন্থের প্রকাশকাল উল্লেখ কর? ‘লোকহিত’ প্রবন্ধের মর্মবাণী কি?

  • ‘কালান্তর’ প্রবন্ধ গ্রন্থের প্রকাশকাল ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দ বা বৈশাখ ১৩৪৪ বঙ্গাব্দ।
  • ‘লোকহিত’ প্রবন্ধের মর্মবাণী হল মানুষকে মানুষের মূল্য দেওয়া এবং আত্মশক্তিতে প্রত্যয়ী হওয়া। 

৫। “যাদৃশী ভাবনা যস্য সিদ্ধির্ভবতি তাদৃশী।’ – এই সংস্কৃত বাক্যটি কোন প্রবন্ধে আছে? এর বাংলা গদ্য লেখো।

  • এই সংস্কৃত শ্লোকটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘লোকহিত’ প্রবন্ধে আছে। 
  • এই সংস্কৃত বাক্যটির বাংলা গদ্য হল যার যেমন ভাবনা সে তেমন সাফল্য লাভ করে।

৬। লোকহিত-এর ‘হিত’ বলতে রবীন্দ্রনাথ কী বুঝিয়েছেন?

‘লোকহিত’-এর ‘হিত’ বলতে হিতসাধনের অধিকার একেবারেই ইচ্ছা সাপেক্ষ কোনো ব্যাপার নয়, অন্যের উপকার করারও অধিকার থাকতে হবে। হিত করবার একটামাত্র ঈশ্বরদত্ত অধিকার আছে, সেটা হল প্রীতি।

৭। “এ কথা অনেক সময়েই শোনা যায় যে,” – কোন প্রবন্ধের অন্তর্গত ? ‘এ কথা’ বলতে কী বোঝাতে চেয়েছেন?

  • আলোচ্য অংশটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘লোকহিত’ প্রবন্ধের অন্তর্গত। 
  • ‘এ কথা’ বলতে প্রাবন্ধিক বলেছেন, “মানুষ স্বভাবতই অকৃতজ্ঞ – যাহার কাছে সে ঋণী তাহাকে পরিহার করিবার জন্য তাহার চেষ্টা।”

৮। ‘লোকহিত করার লোকের বিপদ আছে,” – এ কথা প্রাবন্ধিক কেন বলেছেন?

হিতৈষী যা আদায় করে তা হল আত্মসম্মান। এই আত্মসম্মান জ্ঞান ঠিক না থাকলে লোকের উপকার করার সমস্যা আছে। কারণ, সে আর তার ধারপাশ দিয়েও যাবে না।

৯। ‘এ সম্বন্ধে আমাদের একটা শিক্ষা হইয়া গেছে।’ – কোন সম্বন্ধের কথা বলা হয়েছে এখানে? 

যেদিন স্বদেশী ভাবনার প্রতি হিন্দুদের চিত্ত জাগরণ ঘটেছিল সেদিন আরও বেশি সংখ্যক মানুষকে জাগিয়ে তোলার জন্য মুসলমানদের আহ্বান করা হয়েছিল। কিন্তু তাদের সেরকম সাড়া না মেলায় তাদেরকে শয়তান বলে মনে হয়েছিল – এটাই এখানে শিক্ষার কথা বলা হয়েছে।

১০। স্বদেশী যুগে বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলমানের পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে বিচ্ছেদের কারণ কি?

স্বদেশী যুগে বাংলদেশে হিন্দু-মুসলমানের যে সাধারণ সামাজিকতার দরকার সেটা ছিল না। দায়ে পড়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে ভাই বলে বুকে টেনে অভিনয় করেছিল বলেই সেটা সফল না হয়ে বিচ্ছেদে পরিণত হয়েছিল।

১১। বঙ্গ বিচ্ছেদ ব্যাপারটা মানুষের কোথায় আঘাত করেছিল?

বঙ্গ বিচ্ছেদ ব্যাপারটা আমাদের অন্ন বস্ত্রে হাত দেয়নি, আমাদের হৃদয়ে আঘাত করেছিল। সেই হৃদয়টা যত দূর পর্যন্ত অখণ্ড, ততদূর পর্যন্ত তার বেদনা অপরিচ্ছিন্ন ছিল।

১২। এই দেশহিতের ভাবনা আমরা কোথা থেকে পেয়েছি?

প্রকৃতপক্ষে দেশহিত এবং লোকহিত দুই-ই সংশোধিত হয়েছে ইংরেজদের অনুকরণে, অন্তরের তাগিদে নয়। ফলত সমস্ত ব্যাপারটাই হয়ে উঠেছে অনুকরণ সর্বস্ব।

১৩। য়ুরোপে কারা বিশিষ্ট সাধারণ বলে গণ্য হত?

য়ুরোপে ক্ষত্রিয়রা বিশিষ্ট সাধারণ বলে গণ্য হত। সেই সময়ে সেখানকার ক্ষত্রিয়রাই ছিল দেশের রক্ষক।

১৪। য়ুরোপে রাজতন্ত্রের পর কোন তন্ত্র দেখা দিল?

য়ুরোপে রাজতন্ত্রের পর রাষ্ট্রতন্ত্র দেখা দিল এবং সেখানে লড়াইয়ের চেয়ে নীতি কৌশল প্রধান হয়ে উঠল।

১৫। “এখন যোদ্ধার চেয়ে যুদ্ধ বিদ্যা বড়ো;” – এটি কোন প্রবন্ধের অংশ? যোদ্ধা ও যুদ্ধ বিদ্যা বলতে কী বুঝিয়েছেন? 

  • আলোচ্য অংশটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘লোকহিত’ প্রবন্ধের অংশ। 
  • এখানে যোদ্ধা বলতে রাজার লড়াই বা পেশি শক্তির কথা বলা হয়েছে এবং যুদ্ধ বিদ্যা বলতে রাষ্ট্রতন্ত্র বা নীতি কৌশলের কথা বলা হয়েছে।

১৬। পূর্বকালে ক্ষত্রিয় নায়কের সঙ্গে সাধারণ মানুষের কেমন সম্বন্ধ ছিল? 

পূর্বকালে ক্ষত্রিয় নায়কের সঙ্গে সাধারণ মানুষের মানবিক সম্বন্ধ ছিল। দুঃখ কষ্ট অত্যাচার যতই থাক, তবু পরস্পরের মধ্যে হৃদয়ের আদান প্রদান ছিল।

১৭। “ধনের ধর্মই অসাম্য।” – এটি কোন প্রবন্ধের অন্তর্গত? এই কথা বলার কারণ কি? 

  • প্রশ্নে উদ্ধৃত লাইনটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘লোকহিত’ প্রবন্ধের অন্তর্গত। 
  • আসলে ধন জিনিসটাকে পাঁচজনের কাছ থেকে শোষণ করে নিয়ে, পাঁচজনের হাত থেকে তাকে রক্ষা না করলে সে টেকে না। এই জন্য ধনকর্মীরা নিজেদের প্রয়োজনে দারিদ্র সৃষ্টি করে রাখে। তাই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ধনের ধর্মই অসাম্য।

১৮। “সাহিত্য সম্বন্ধেও এই কথা খাটে।” – কোন প্রবন্ধের অন্তর্গত ? সাহিত্য সম্বন্ধে কী কথা বলা আছে?

  • উদ্ধৃত অংশটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘লোকহিত’ প্রবন্ধের অন্তর্গত। 
  • আমাদের দেশে লোক সাধারণ এখন নিজেকে লোক বলে জানে না। তাদের নিজের অভাব ও বেদনা তাদের নিজের কাছে বিচ্ছিন্ন ও ব্যক্তিগত। তাই তাদের দুঃখ সমস্ত সমাজের পক্ষে একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। আসলে পরের ভাবনা ভাবা তখনই সত্য হয়, পর যখন আমাদেরকে ভাবিয়ে তোলে। সাহিত্য সম্বন্ধে এই একই কথা প্রযোজ্য। 

১৯। “আমাদের ভদ্র সমাজ আরামে আছে” – কোন প্রবন্ধের অন্তর্গত ? আমাদের ভদ্র সমাজ কেন আরামে আছে? 

  • আলোচ্য অংশটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘লোকহিত’ প্রবন্ধের অন্তর্গত। 
  • আমাদের ভদ্র সমাজ এই কারণেই আরামে আছে যে, আমাদের লোক-সাধারণ নিজেকেই বোঝে না। আমরা শোষিত হচ্ছি অথচ শোষকের নামে নালিশ করতে পারছি না। 

২০। “আমরা বড়োজোর ধর্মের দোহাই দিয়া জমিদারকে বলি” – কোন প্রবন্ধের অন্তর্গত? প্রাবন্ধিক কী বলার কথা বলেছেন ?

  • আলোচ্য অংশটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘লোকহিত’ প্রবন্ধের অন্তর্গত। 
  • প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ধর্মের দোহাই দিয়ে নিজের দুরাবস্থা এড়িয়ে গেছেন। এই প্রসঙ্গে তিনি একটি সুন্দর উদাহরণ দিয়েছেন, “চালুনিতে করিয়া জল আনাইব আর বাহককে বলিব ‘যতটা পারো তোমার হাত দিয়া ছিন্ন সামলাও’ – সে হয় না; তাহাতে কোনো এক সময়ে এক মুহূর্তের কাজ চলে, কিন্তু চিরকালের এ ব্যবস্থা নয়।”

২১। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই প্রবন্ধে ‘লোকহিত’ বলতে কী বুঝিয়েছেন?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই প্রবন্ধে লোকহিত বলতে বুঝিয়েছেন লোকশিক্ষার কথা। 

২২। রবীন্দ্রনাথ দেশহিতৈষী বলতে কী বুঝিয়েছেন?

রবীন্দ্রনাথ দেশহিতৈষী বলতে বুঝিয়েছেন মানুষের মনে আগে দেশ তারপর তার লোক সাধারণ। দেশের জন্য সমাজের লোক সাধারণের মধ্যে পরস্পরের যোগাযোগ দৃঢ় হওয়া চাই তবেই দেশ উন্নত হবে।

২৩। ‘লোকহিত’ প্রবন্ধের শেষ লাইনটি লেখ ?

‘লোকহিত’ প্রবন্ধের শেষ লাইনটি হল “সেই শক্তি দিতে গেলেই তাহাদের হাতে এমন একটি উপায় দিতে হইবে যাহাতে ক্রমে তাহারা পরস্পর সম্মিলিত হইতে পারে – সেই উপায়টিই হল তাহাদের সকলকেই লিখিতে পড়িতে শেখানো।”


প্রবন্ধ লোকহিত হতে প্রশ্ন মান – ৫

১। ‘লোকহিত’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লোকের কী হিত করতে চেয়েছেন? 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মনে সমাজ পরিবর্তনের ভাবনা ছিল গভীর প্রথিত। জমিদারী পরিচালনার কাজে তিনি পূর্ববঙ্গে এসে মাটি ও মানুষের খুব কাছাকাছি থেকে সমাজের নানা অসঙ্গতি ও সাধারণ মানুষের অসহায়ত্ব দূরদশা হৃদয় দিয়ে অনুভব করেন। প্রজাদের অভাব ও দুঃখ দূর করার জন্য নানা প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ ও জীবন ঘন সামাজিক সংস্কারে তিনি হাত দেন। লোক সাধারণের হিতের জন্যই রবীন্দ্রনাথ সাধারণ মানুষকে একত্র করতে চেয়েছেন। তিনি মনে করতেন মানুষ সংগঠিত হলে উন্নয়ন সহজ হয়। সেজন্যই তিনি স্বদেশী সমাজ প্রবন্ধে সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। পরবর্তীকালে শান্তিনিকেতন বিশ্বভারতী সমিতি’, শিলাইদহে ‘পল্লিসমিতি’ পাতিসরে ‘লোকসভা’, ‘মণ্ডলী’, ও ‘হিতৈষাসভা’ সহ বিভিন্ন সংগঠন গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন।

এইসব ভাবনা ও উদ্যোগের পিছনে রবীন্দ্রনাথের লোকসাধারণের হিতসাধনের চিন্তা ছিল একেবারেই মৌলিক ও সৃজনশীল। তাঁর সেই ভাবনার অন্তর্নিহিত সুরটি ধরতে পারলে আমাদের ‘লোকহিত’ প্রবন্ধটি সকল অর্থেই একটি যুগান্তকারী রচনা বলে মনে হয়। রবীন্দ্রনাথ মনে করেন পরের উপকার করার জন্য প্রথমেই অধিকার অর্জন করা চাই – “মানুষ কোনোদিন যথার্থ হিতকে ভিক্ষারূপে গ্রহণ করিবে না, ঋণরূপেও না, কেবলমাত্র প্রাপ্য বলিয়াই গ্রহণ করিতে পারিবে।” 

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে মুসলমানদের ডেকেও ভালো সাড়া না পাওয়ার প্রসঙ্গ টেনে রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছেন যে সেটিই ছিল স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। কারণ, দীর্ঘদিন উপেক্ষিত মুসলমান সমাজকে প্রীতির ডাকে সাধারণ সামাজিকতাটুকুও পালন করেনি সেই সময়ের সমাজের স্থানীয়রা। হৃদয়ে আঘাত প্রাপ্ত মুসলমানকে হঠাৎ ‘ভাই বলিয়া’ ডাকলেও প্রত্যাশিত সাড়া মেলার কথা নয়। এই উদাহরণ শুধু একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের জন্যই প্রযোজ্য নয়। সমাজ আজ যে ভাবে অভিজন ও অভাজনে বিভক্ত হয়ে পড়েছে তাতে আর্থ সামাজিক ভাবে উপেক্ষিত লোক সাধারণকে প্রীতির ডোরে বাঁধতে না পারলে তাদের জন্য বাহ্যিক হিত করার মাধ্যমে সামাজিক শান্তি বজায় রাখা কঠিনই হবে।

২। রবীন্দ্রনাথের ‘লোকহিত’ প্রবন্ধের ভাবনাগুলি উল্লেখ কর ? 

রবীন্দ্রনাথ ‘লোকহিত’ প্রবন্ধে উন্নয়ন মূলক কাজে নিজের উদ্ভাবনী মূলক চিন্তা শক্তির সম্মিলন ঘটান। তিনি বুঝেছিলেন প্রতিটি ক্ষেত্রের মূলে থাকবে মানুষের সম্মিলন। মণ্ডলী, হিতৈষী সভা কিংবা সমবায় সমিতি, যে নামেই আত্মপ্রকাশ করুক না কেন। প্রতিটি উদ্যোগেই থাকবে মানুষের সংগঠিত প্রয়াসের প্রতিফলন। তিনি যে সাধারণের হিতাকাঙ্ক্ষী এবং তাদেরই একজন সে কথা বলতে ভুল করেননি। ‘পরিচয়’ কবিতায় তাই তিনি লিখেছেন, ‘মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি তোমাদেরই লোক / আর কিছু নয়, এই হোক শেষ পরিচয়।”

প্রকৃতপক্ষে যে মানুষ অপর মানুষকে সম্মান করতে পারে না, সে মানুষকে উপকার করতে অক্ষম। আমরা যারা সুবিধালোভী ভদ্র লোকেরা সর্বক্ষণ সুবিধা বঞ্চিতদের শুধুই দান করে, কৃপাকরে মন জয় করতে আগ্রহী তাদের জন্য রবীন্দ্রনাথের ‘লোকহিত’ ভাবনাগুলি খুবই প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়।

রবীন্দ্রনাথ মনে করেন মহাজন ঋণ দিয়ে সুদ গ্রহণ করে থাকে। সেই সুদ অনেক সময় আসলকেও ছাড়িয়ে যায়। সেই মহাজন যদি ঋণ গ্রহীতার কাছে সুদের পাশাপাশি কৃতজ্ঞতাও আদায় করতে চায় তাহলেই মুসকিল। তাকে তিনি ‘মাইলকেরও বাড়া’ বলে মনে করেন। এরাও কখনও হৃদয় দিয়ে পিছনে পড়ে থাকা মানুষগুলোকে কাছে টানেনি। তাই তাদের প্রতি কোনো বিশ্বাস নেই। এভাবে দেশহিতৈষা হয় না। দেশহিতৈষার চেয়ে দেশের অংশ যতক্ষণ বেশি না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত এই সংকট থাকবেই। 

অন্তরের একান্ত তাগিদ থেকে প্রীতির বন্ধনে যতক্ষণ পর্যন্ত সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোকে বাঁধতে না পারছি ততক্ষণ পর্যন্ত লোকহিতের অন্তসার শূন্যতা থেকেই যাবে। আর তাই এখান থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ শিক্ষা, জ্ঞান শিক্ষা নয় লোকশিক্ষা। তাই লোকহিতকর শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারলে সমাজের মধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। তাই রবীন্দ্রনাথ লোকহিতের ভাবনা বলতে নৈতিক মূল্য বোধ সম্পূর্ণ শিক্ষার কথা বলেছেন।

৩। “ধনের ধর্মই অসাম্য।” – ব্যাখ্যা কর। 

রবীন্দ্রনাথ ‘লোকহিত’ প্রবন্ধে লোক সাধারণের কথা বলতে গিয়ে প্রাচ্য-পাশ্চাত্য দুটি দেশের কথাই বলেছেন। য়ুরোপে যারা এক সময় বিশিষ্ট সাধারণ ছিল তারা ক্ষত্রিয় উপাধিধারী, যদিও এখন রাষ্ট্র চালানোর কাজে তাদের আধিপত্য কমে বৈশ্যদের আধিপত্য বেড়েছে। লোক সাধারণের কাঁধের উপর তারা চেপে বসেছে। মানুষকে নিয়ে তারা নিজের ব্যয়সার যন্ত্র বানাচ্ছে। মানুষেরা পেটের জ্বালায় তাদের কলের স্ট্রীম উৎপন্ন করে। তাই তাদের ধন বৃদ্ধি ঘটে, সমাজ এখন ধনের নিরিক্ষে পুরোপুরি বিভক্ত। মানুষের পেটের জ্বালায় আমরা শুধু ব্যবসায়ীর চাহিদার চোখ দেখতে পাই। 

ধন জিনিসটাই যে অসাম্যের বাহন এটা অনেক সময় বুঝতে পারি না। ধনীর ধনই যে দারিদ্র্য সৃষ্টির প্রধানতম হাতিহার সেই কথাটি বুঝেও না বোঝার ভান করি। ধনীর ধনেও যে গরীবের ধন আছে সে কথাটিও আমরা অনেক সময় স্বীকার করি না। যতক্ষণ না পর্যন্ত আমরা গরীবের মনেও আয় রোজগার করে ধনার্জনের অধিকারের বিষয়টি গেঁথে দিতে পারছি ততক্ষণ পর্যন্ত চিন্তার নীতি বাচক দিকটি থেকে আমারা মুক্তি পাব বলে মনে হয় না। 

ধনের বৈষম্য নিয়ে যখন সমাজে পার্থক্য ঘটে তখন ধনীর দল সেই পার্থক্যকে সমূলে ঘোচাতে ইচ্ছে করে না, অথচ সেই পার্থক্যটা যখন বিপদ জনক হয়ে ওঠে তখন বিপদটাকে কোনমতে ঠেকা দিয়ে ঠেকিয়ে রাখতে চায়। বর্তমানে ধনের বৈষম্যর চাপে সাধারণ মানুষ ছটপট করছে তাই আর ভিক্ষা নিয়ে সন্তুষ্ট নয়, বরং তারা এখন দাবি করে। নিতান্ত প্রাণের গরজেই তাদের মনে এই পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। রবীন্দ্রনাথ এই জন্যই আধুনিক যে এমনটি হবে তা শত বৎসর আগে অনুমান করে ছিলেন।

৪। ‘লোকহিত’ প্রবন্ধে বাংলাদেশের লোক সাধারণের উন্নতির জন্য পাশ্চাত্য য়ুরোপের তুলনা প্রাবন্ধিক কেন করেছেন তা আলোচনা কর।

বাংলাদেশে লোক সাধারণের মধ্যে সামাজিকতার ক্ষেত্রে ‘বে আব্রু’ দেখেছেন রবীন্দ্রনাথ সেজন্যই তার মনে পড়েছে আধুনিক য়ুরোপোর কথা। আধুনিক য়ুরোপকে যদি এই প্রেক্ষিত মডেল হিসাবে ধরা যায়, তবে, এও দেখার যে সেখানে লোকশিক্ষা এই অর্থেই ফলপ্রসূ হয়ে উঠেছে হয়তো তা অগভীরে। কিন্তু পাদ্যে পূরণ করেছে ব্যাপ্তি। লোক সাধারণ সেখানে যে নিজের শক্তিতে জাগ্রত হয়ে প্রাপ্যের দাবিতে উচ্চকণ্ঠ হয়েছে তার প্রবর্তন এই লোক শিক্ষাতেই। এমনটা না ঘটলে প্রাবন্ধিকের ধারণা অনুযায়ী সেখানে যা অবারিত হয়ে উঠত তার নাম মানসিক দাসত্ব। তিনি মনে করেন লোকসাধারণকে উদ্ভেধিত করতে হবে, যাতে দয়ার দান নয় তারা তাদের নিজের অধিকার এবং প্রাপ্য সম্পর্কে সচেতন হয়, তাদের মনুষ্যত্বকে মর্যাদা দিতে শেখাই অগ্রণী ভদ্র শ্রেণির কাছ থেকে সব থেকে বেশি প্রত্যাশিত।

নতুন সমাজ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথের মানষিকতায় ধরা পড়েছে য়ুরোপের সমাজ সংস্কৃতির কথা। একটা সময় য়ুরোপে যখন রাজতন্ত্র ছিল তখন য়ুরোপের প্রবল বহিশত্রু ছিল মুসলমান। ক্রমে অবস্থার পরিবর্তন হল, তখন য়ুরোপে খ্রিস্টান মুসলমানের আত্মিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। সমাজের ভদ্র সাধারণের সঙ্গে লোক সাধারণের সুসম্পর্ক এবং তাদের মধ্যে আত্মশক্তির উদ্বোধন দেখা গেছে। 

তাই প্রাবন্ধিক লোকহিতের যথার্থ উপায় ‘লোকশিক্ষা’র কথা বলেছেন। যে কথা বিবেকানন্দের সেই একই কথা রবীন্দ্রনাথেরও। শিক্ষাতেই মুক্তি, অন্য কিছুতেই নয়। এই মুক্তি জড়ত্বের হাত থেকে মুক্তি, অন্ধকার থেকে মুক্তি – যা মানুষকে শুধু কীপায় বন্দি করে নিজের আত্মশক্তিকেই প্রতিষ্ঠা দেয়।


প্রবন্ধ লোকহিত হতে প্রশ্ন মান – ১০ 

১। ‘লোকহিত’ বলতে রবীন্দ্রনাথ কী বুঝিয়েছেন ? প্রকৃত লোকহিত কী উপায়ে করা সম্ভব তা ‘লোকহিত’ প্রবন্ধ অনুসরণে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

উনিশ শতকের স্বদেশি আন্দোলনের সময় আমাদের দেশে এক শ্রেণির ভদ্র ও বিত্তশালী মানুষ লোকসাধারণের মঙ্গলের জন্য উদ্যোগী হয়। এদের কর্ম প্রচেষ্টার পিছনে ছিল আত্ম-অভিমানের অহঙ্কার। তারা তাদের লোকহিতের মাধ্যমে আত্মপ্রচারেরই আকাঙ্ক্ষা পোষণ করত। এদের হিতের পিছনে তাই প্রীতি ছিল না, ছিল অহঙ্কার, ছিল আত্মসম্মান ক্রয়ের হীন প্রচেষ্টা। পরের হিত সাধন করার আগে নিজের যোগ্যতা সম্পর্কে যে ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে তা এরা ভুলে যেত। মানুষকে তারা ভালবাসেনি। তাই সাধারণ ও নিজেদের মধ্যে বিভেদের প্রাচীর গড়ে তোলাই ছিল তথাকথিত লোকহিতের স্বরূপ। 

লোকসাধারণ সম্বন্ধে আমাদের ভদ্র সম্প্রদায়ের আচরণ রীতিসম্মত নয়, আমাদের চিরকালীন অভ্যাস লোক-সাধারণকে অপমান করা। হিতের অভিমানটা আমাদের পর্বতপ্রমাণ বলেই আমাদের দেশহিতের সাধনা ব্যর্থতার পর্যবসিত। মুসলমান সম্প্রদায়কে আমরা সামাজিক ক্ষেত্রে ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করতে পারিনি, তাই রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে আমরা তাদের সহযোগিতা লাভ থেকে বঞ্চিত হয়েছি। যখন তাদের হিতসাধনে আমরা ব্রতী হলাম তখন তারা আমাদের সেই সকল হিত সাধনকে মেকি জেনেই দূরে ফেলে দিলে কারও কিছু বলার থাকে না। লোকহিত ভিক্ষার সামগ্রী নয়, দাবীর বস্তু। উনিশ শতকের লোকহিতের এটাই হল রবীন্দ্র ভাবিত মূল্যায়ন।

রবীন্দ্রনাথের মতে লোকহিতের অধিকার মাত্র একটিই, সেটি প্রীতি। এই অধিকার ঈশ্বরপ্রদত্ত। প্রীতির দানে কোনো অপমান নেই, কিন্তু হিতৈষিতার দানে মানুষ অপমানিত হয়। মানুষকে সকলের চেয়ে নত করবার উপায় – তার হিত করা অথচ তাকে প্রীতি না করা। এই কথা অনেক সময়েই শোনা যায় যে, মানুষ স্বভাবতই অকৃতজ্ঞ যার কাছে সে ঋণী তাকে পরিহার করবার জন্য তার চেষ্টা। ‘মহাজনো যেন গতঃ স পন্থাঃ” – এই উপদেশ পারতপক্ষে কেউ মানে না। তাই মহাজন যে রাস্তা দিয়ে চলে মানুষ সে রাস্তায় চলা একেবারে ছেড়ে দেয়। এর কারণ এই নয় যে মানুষের মনটা স্বভাবতই বিকৃত। এর কারণ এই যে মহাজনকে সুদ দিতে হয়, সেই সুদ আসলকেও ছাড়িয়ে যায়। 

হিতৈষী যে সুদটি আদায় করে সেটি মানুষের আত্মসম্মান ; সেটিও নেবে আবার কৃতজ্ঞতাও দাবি করবে, সে যে শাইলকের বাড়া হল । সে জন্য লোকহিত করায় লোকের বিপদ আছে সে কথা ভুললে চলবে না। লোকের সঙ্গে নিজেকে পৃথক রেখে যদি তার হিত করতে যাই তবে সেই উপদ্রব লোকে সহ্য না করলেই তাদের হিত হবে। সুতরাং প্রকৃত লোকহিতের ক্ষেত্রে জনসাধারণের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রাখাই বাঞ্ছনীয়। ভিন্ন সম্প্রদায়ের লোককে সামাজিক ক্ষেত্রেও মর্যাদা দিতে হবে। ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করতে হবে তাদের। ধনী দরিদ্রের বিভেদ বুঝতে না দিয়ে মানুষের হিতসাধনে উদ্যোগী হতে হবে। 

আমাদের দেশের লোকহিত আমাদের দেশের ঐতিহ্যসম্মত হবে, অন্য কোনো দেশের অনুকরণমূলক নয়। সব চেয়ে মূলকথা, মানুষকে প্রাপ্য মর্যাদা দিতে হবে। লোকসাধারণ যাতে নিজেদের লোক বলে ভাবতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। লোককে সচেতন করে তুলতে পারলে হিতকে সে আর ভিক্ষে হিসেবে কুড়াবে না; দাবী হিসেবেই গ্রহণ করবে এবং এই আন্তরিক লোকহিতই মানুষের যথার্থ হিত সাধন করতে সক্ষম।

আমাদের দেশে প্রথম প্রয়োজন মানুষে মানুষে সম্পর্ক অনুভব করা। এর জন্য প্রয়োজন শিক্ষার বিস্তার। সাধারণ মানুষ যদি লেখাপড়া শেখে তাহলেই সে হয়ে উঠবে আত্ম-সচেতন। লেখাপড়াই মানুষকে দেবে আত্ম-সচেতনতা, দেবে আত্মবিশ্বাস, তাকে করে তুলবে আত্মমর্যাদা জ্ঞানসম্পন্ন। মানুষকে শক্তি দিতে হবে, তাকে বিস্তৃত করতে হবে। আমাদের লোকহিত সাধারণত তখনই সার্থক হবে যখন আমরা মানুষকে তার অধিকার এবং আত্মগরিমা সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে পারব। মানুষকে আত্মশক্তিতে অনুপ্রাণিত করাই প্রকৃত লোকহিত-রবীন্দ্রনাথ সেই হিতই চেয়েছেন।


২। “লেখাপড়া শেখাই সেই রাস্তা” – রবীন্দ্রনাথ যে রাস্তার কথা বলেছেন তার পরিচয় দাও। লেখাপড়া শেখাকে তিনি কী যুক্তিতে লোকহিতের উপায় হিসেবে প্রতিপন্ন করেছেন দেখাও।

কপট বা লোক দেখানো লোকহিতের বিরুদ্ধে লেখনী ধারণ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি তাঁর ‘লোকহিত’ প্রবন্ধে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, তথাকথিত লোকহিত কী ভাবে মানুষের হিতের পরিবর্তে অহিত সাধন করে। হিতৈষী আর লোকসাধারণের মধ্যে হৃদয়ের যোগসূত্র স্থাপিত হলেই সমাজের হিত সাধন সম্ভব। আরও প্রয়োজন জনসাধারণের পরস্পরের মধ্যে যোগসূত্র ও বোঝাপড়া। অজ্ঞ বা নিরক্ষর মানুষ পরস্পর বিচ্ছিন্নতা দোষে ভোগে, মনের সঙ্কীর্ণতা আর অন্ধ কুসংস্কারে হিতের বশবর্তী হওয়ায় মনের ব্যবধান বৃদ্ধি পায়। 

কিন্তু লিখতে পড়তে শিখে মানুষ অন্যের কথা আপনি শুনবে ও আপনার কথা অন্যকে শোনাবে, এমনি করে সে যে আপনার মধ্যে বৃহৎ মানুষকে ও বৃহৎ মানুষের মধ্যে আপনাকে পাবে, তার চেতনার অধিকার যে চারদিকে প্রশস্ত হয়ে যাবে তাই-ই লেখাপড়া শেখার গোড়ার কথা। তবে রবীন্দ্রনাথের মতে লেখাপড়ার অর্থ জ্ঞান শিক্ষা নয়, পল্লিগ্রামে জ্ঞান শিক্ষার, আধ্যাত্মিক জ্ঞান শিক্ষার ব্যবস্থা আছে। যাত্রা-কথকথা প্রভৃতি এই শিক্ষা দিয়ে থাকে। কিন্তু লেখক বিশ্বাস করেন জ্ঞান প্রধানত আধ্যাত্মিক। অতএব মানুষের সাধারণ চাহিদার সঙ্গে তার যোগসূত্র কম। তাদের চাই মৌলিক জ্ঞান বা শিক্ষা।

লোকসাধারণের জন্য যে লেখাপড়া প্রবর্তনের কথা হচ্ছে তা গুরু গম্ভীর কিছু নয়। কারণ, “আমাদের চাষাভুষারা যাত্রার দল ও কথক ঠাকুরের কৃপায় জ্ঞান শিক্ষায় সকল দেশের অগ্রগণ্য।” সুতরাং রবীন্দ্রনাথের মতে “কেবলমাত্র লিখিতে পড়িতে শেখা। তবে তা হবে সর্বস্তরের জন্য ও সকলের উপযোগী। এই নিতান্ত আটপৌরে লেখাপড়ার ব্যবস্থাকে রবীন্দ্রনাথ রাজপথ না বলে গলি রাস্তাই বলতে চেয়েছেন। কিন্তু এই পথ প্রয়োজনীয়। এই পথ না থাকলে মানুষে মানুষে যোগসূত্র স্থাপন সম্ভব নয়।

আমাদের দেশে ধনিক শ্রেণির মানুষ যারা, যাঁরা শিক্ষিত ভদ্র সমাজের মানুষ বলে পরিচয় দেন, তাঁরা সাধারণ মানুষকে নানাভাবে শোষণ করে থাকেন। লোকহিত সাধনের নামে তাঁরা লোকসাধারণের প্রতি অবজ্ঞাই পোষণ করে থাকেন, উপহাস করেন। তাদের আত্মমর্যাদা অর্থমূল্যে ক্রয় করে নিতে চান। সব দেশের সমাজেই দেশের অশিক্ষিত দরিদ্র সাধারণ মানুষকে শোষিত হতে দেখা যায়। কিন্তু লেখাপড়া শেখালে তারা হবে আত্মসচেতন। তারা নিজেদের ভালমন্দ বুঝতে শিখবে ও পীড়নের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াবার প্রেরণা পাবে। শিক্ষাই তাদের দেবে একতার বীজমন্ত্র, তাদের উদ্বুদ্ধ করবে সংহতির শক্তি লাভে।


৩। ‘লোকহিত’ প্রবন্ধে হিন্দু-মুসলমানের পারস্পরিক সম্পর্ক বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য বুঝিয়ে দাও। এই প্রসঙ্গে তাঁর সতর্ক বাণী উল্লেখ করো। 

স্বদেশি আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে দেশের শিক্ষিত মানব লোকহিতের উন্মাদনায় মেতে উঠেছিল, তাতে ছিল না প্রীতির সংযোগ, ছিল না লোকহিতের আন্তরিক সদিচ্ছা পরিবর্তে সেখানে ছিল আত্ম-অভিমানের নির্লজ্জ প্রকাশ, ছিল মনুষ্যত্বকে অপমান করবার প্রবল আকাঙ্ক্ষা। তথাপি তারা দেশে স্বাধীনতা আনয়নের জন্য আন্দোলন শুরু করল। কিন্তু প্রতিপক্ষ প্রবল শক্তিসম্পন্ন ইংরেজ সুতরাং সেই প্রবল রাজশক্তির বিরুদ্ধে দল ভারী হওয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করল তারা। দেশের সেই রাষ্ট্রীয় সংকটের সময় তাদের প্রয়োজন হল দেশের মুসলমান সম্প্রদায়কে স্বাধীনতা সংগ্রামে সামিল করার।

“সেদিন আমরা দেশের মুসলমানদের কিছু অস্বাভাবিক উচ্চস্বরেই আত্মীয় বলিয়া, ভাই বলিয়া ডাকাডাকি শুরু করিয়াছিলাম।” সেই স্নেহের ডাকে তারা অশ্রু গদগদ কণ্ঠে সাড়া দেয়নি। রবীন্দ্রনাথের মতে মুসলমান জাতির এই আচরণ সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ও যুক্তিপূর্ণ। তাদের হিন্দুদের সঙ্গে অসহযোগিতা অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। “দায়ে পড়িয়া রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে ভাই বলিয়া যথোচিত সতর্কতার সহিত তাহাকে বুকে টানিবার নাট্যভঙ্গী করিলে সেটা কখনই সফল হইতে পারে না।”

এক মানুষের সঙ্গে আর এক মানুষের, এক সম্প্রদায়ের সঙ্গে আর এক সম্প্রদায়ের তো পার্থক্য থাকেই, কিন্তু সাধারণ সামাজিকতার কাজই এই, সেই পার্থক্যটিকে রূঢ়ভাবে প্রত্যক্ষ গোচর না করা। ধনী দরিদ্রে পার্থক্য আছে, কিন্তু দরিদ্র তার গৃহে এলে ধনী যদি সেই পার্থক্যকে চাপা না দিয়ে সেটাকেই অত্যুগ্র করে তোলে তবে, আর যাই হোক, দায়ে ঠেকলে সেই দরিদ্রের বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে অশ্রু বর্ষণ করতে যাওয়া ধনীর পক্ষে সত্যও হয় না, শোভনও হয় না।

সামাজিক ক্ষেত্রে হিন্দুরা চিরদিন মুসলমানদের দূরে সরিয়ে রেখেছে। তাদের মর্যাদা দেওয়া হয়নি। দেশাচার ও সংস্কারের ফাঁদে পড়ে হিন্দু সম্প্রদায় মুসলমানদের এড়িয়ে চলেছে। অস্পৃশ্যতার সংস্কারে তারা তাঁদের মনুষ্যত্বকে করেছে অপমান। রবীন্দ্রনাথ একটি লজ্জাজনক ও কলঙ্কময় ঘটনার উল্লেখ করেছেন এই প্রসঙ্গে। “কিছুকাল পূর্বে স্বদেশী অভিযানের দিনে একজন হিন্দু স্বদেশী প্রচারক এক গ্লাস জল খাইবেন বলিয়া তাঁহার মুসলমান সহযোগীকে দাওয়া হইতে নামিয়া যাইতে বলিতে কিছুমাত্র সংকোচ বোধ করেন নাই।” আমরা বিদ্যালয়ে ও অফিসে প্রতিযোগিতায় ভিড়ে মুসলমানকে জোরের সঙ্গে ঠেলা দিয়েছি। সেটা সম্পূর্ণ প্রীতিকর নয়, কিন্তু সেখানকার ঠেলাঠেলি গায়ে লাগতে পারে, হৃদয়ে নয়। কিন্তু সমাজের অপমান গায়ে লাগে না, হৃদয়ে লাগে। কারণ, সমাজের উদ্দেশ্য পরস্পরের পার্থক্যের উপর সুশোভন সামঞ্জস্যের আস্তরণ বিছিয়ে দেওয়া।

বঙ্গ বিচ্ছেদ বিষয়টি আমাদের অন্নবস্ত্রে হাত দেয়নি কিন্তু আমাদের হৃদয়কে আহত করেছিল। সেই হৃদয় যতদূর পর্যন্ত অখণ্ড ততদূর পর্যন্ত তার বেদনা ছিল অপরিচ্ছন্ন। কিন্তু বাংলায় মুসলমান এই বেদনায় আমাদের সঙ্গে এক হয়নি কারণ, তাদের সঙ্গে আমরা আমাদের হৃদয়কে কখনও এক হতে দিইনি।

সংস্কৃত ভাষায় একটি কথা আছে ঘরে যখন আগুন লেগেছে তখন কূপ খুঁড়তে যাওয়ার আয়োজন বৃথা। বঙ্গ বিচ্ছেদের দিনে হঠাৎ যখন মুসলমানকে আমাদের দলে টানবার প্রয়োজন হল তখন আমরা সেই কূপ খননেরও চেষ্টা করিনি। আমরা মনে করেছিলাম মাটির উপরে ঘটি ঠুকলে জল আপনিই উঠবে। হিন্দু মুসলমানের মধ্যে প্রীতির সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা আমরা তাই করিনি। আমরা ভেবেছিলাম ডাক দিলেই তারা আসবে। কিন্তু তারা আমাদের আবেদনে সাড়া দেয়নি। ফলে আমরা বিস্মিত হয়েছিলাম। কিন্তু শিক্ষা হওয়া সত্ত্বেও প্রীতি ও ভালবাসার সম্পর্ক স্থাপনে আমরা উদ্যোগী হতে পারিনি। ফলে স্বদেশী আন্দোলনের ক্ষেত্রে আমাদের সংগ্রাম হয় খণ্ডিত। ইংরেজ সরকার বুঝতে পারল ‘Divide and rule’ নীতি অনুযায়ী এদেশ শাসন করা সহজ।

রবীন্দ্রনাথ হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্কের স্বরূপ বিশ্লেষণ করে আমাদের প্রতি সতর্ক বাণী উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যের উপরেই দেশের স্বাধীনতা, দেশের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ নির্ভর করে। প্রীতি ও ভালোবাসার সূত্রে মুসলমানদের কাছে টানতে না পারলে শুধু যে আমাদের স্বদেশী আন্দোলনই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে তা নয়, আমাদের জাতীয় জীবনেও নেমে আসবে দুর্বিপাক। স্বদেশ সেবাও এক শ্রেণির লোকহিতব্রত। এই লোকহিত কোনো একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের জন্য নয়। যদি তাই-ই হয় তাহলে আমাদের সেই ভ্রান্ত লোকহিতের প্রয়াস ব্যর্থ। ব্রিটিস সরকার হিন্দু-মুসলমানের অনৈক্যের সুযোগ পরিপূর্ণভাবে সদ্ব্যবহার করবে। হিন্দু ও মুসলমানের অনৈক্য ও বিরোধ দেশ ও জাতির পক্ষে চিরকাল বিপদের সূচনাই করবে। এর অন্তিম পরিণাম ভয়াবহ। তাই রবীন্দ্রনাথের সতর্ক বাণী সাম্প্রদায়িকতা, স্বার্থপরতা ও সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে।


৪। ‘লোকহিত’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ য়ুরোপের সামাজিক ও রাষ্ট্রনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে যে সব মন্তব্য করেছেন তা বিবৃত করো। এই মন্তব্যগুলি লোকহিত বিষয়ে কতটা প্রাসঙ্গিক হয়েছে বুঝিয়ে দাও ।

চিন্তানায়ক রবীন্দ্রনাথ অনবদ্য মননশীলতার স্বাক্ষরবাহী প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘কালান্তর’ থেকে সংগৃহীত ‘লোকহিত’ প্রবন্ধে য়ুরোপের সামাজিক ও রাষ্ট্রনৈতিক ব্যবস্থার একটি নিখুঁত চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। য়ুরোপের সামাজিক ও রাষ্ট্রনৈতিক ক্ষেত্রে যে উত্থান-পতন ঘটেছে সামাজিক ও রাষ্ট্রনৈতিক বিবর্তনের ধারায় তার গুরুত্ব কম নয়।

য়ুরোপে যারা একদিন বিশিষ্ট সাধারণ বলে গণ্য হত তারা ছিল সেখানকার ক্ষত্রিয়। তখন কাটাকাটি মারামারির অন্ত ছিল না। তখন য়ুরোপের প্রবল বহিঃশত্রু ছিল মুসলমান। সেই সময়ে সেখানকার ক্ষত্রিয়েরাই ছিল দেশের রক্ষক। “তখন তাহাদের প্রাধান্য স্বাভাবিক ছিল। তখন লোকসাধারণের সঙ্গে তাদের যে সম্বন্ধ ছিল সেটি কৃত্রিম নহে। তাহারা ছিল রক্ষাকর্তা এবং শাসনকর্তা। লোকসাধারণ তাহাদিগকে স্বভাবতই আপনাদের উপরিবর্তী বলিয়া মানিয়া লইত।” 

এর পর অবস্থার পরিবর্তন হল, এল দিন বদলের পালা। রাজতন্ত্রের স্থান দখল করে নিল রাষ্ট্রতন্ত্র। রাজাদের ক্ষমতা হল সঙ্কুচিত, বৃদ্ধি পেল পার্লামেন্টের ক্ষমতা। লড়াই নয়, নীতি কৌশলের প্রভাবে জয়ী হল বণিক শ্রেণি অর্থাৎ বৈশ্যরা। শক্তির ধারা তখন ক্ষত্রিয়কে ছেড়ে বৈশ্যের কুলে রয়েছে। মানুষকে নিয়ে তারা আপনার ব্যবসায়ের যন্ত্র বানাচ্ছে। “মানুষের পেটের জ্বালাই তাদের কলের স্টীম উৎপন্ন করে।” তারা মানুষকে বানালো মজুর। শুরু হল শোষক আর শোষিতের সম্পর্ক। পূর্বে তবু ক্ষত্রিয় ও সাধারণ মানুষের মধ্যে মানব সম্বন্ধীয় সম্পর্ক বজায় ছিল, কিন্তু ধনিক গোষ্ঠী ও লোকসাধারণের মধ্যে সৃষ্টি হল যান্ত্রিক সম্পর্ক।

“ধনের ধর্মই অসাম্য।” জ্ঞান, ধর্মকলা, সৌন্দর্য পাঁচজনের সঙ্গে ভাগ করলে বাড়ে বৈ কমে না। কিন্তু ধন পাঁচজনের কাছ থেকে শোষণ করে নিয়ে পাঁচজনের হাত থেকে রক্ষা না করলে টেকে না। তাই ধনিক শ্রেণির মানুষ নিজের গরজেই সৃষ্টি করে থাকে দারিদ্র্য। তবে তারা ছেলে ভোলানোর মত লোকহিতব্রত গ্রহণ করল। শ্রমিক উন্নয়নের জন্য বিবিধ কার্যাবলী হল শুরু। শিক্ষার জন্য বিদ্যালয় স্থাপিত হল। অবশ্য এক হিসেবে এই সব বিষয় শ্রমিকদের অনুকূলেই গেল। ধনিকের শোষণ নীতির বিরুদ্ধে শ্রমিকেরা আন্দোলনে মেতে উঠল। আর শ্রমিকেরা ধনিক শ্রেণির অনুকম্পার পাত্র নয়। বুদ্ধিজীবীরা তাদের কল্যাণের জন্য মেতে উঠেছে, তারা ভাবছে শ্রমিক কল্যাণের কথা।

রবীন্দ্রনাথ ভারতের লোকহিতব্রত সাধনার প্রসঙ্গে য়ুরোপের সামাজিক ও রাষ্ট্রনৈতিক প্রসঙ্গ এনেছেন একটি বিশেষ কারণেই। ভারতবর্ষে য়ুরোপের অনুকরণে রাষ্ট্রচিন্তা ও সংগ্রামচিন্তা করা হয়। কিন্তু ভারতবর্ষ য়ুরোপ নয়। ইতিহাসের স্বাভাবিক ক্রমবিকাশের ধারানুক্রমে য়ুরোপে রাজতন্ত্রের পরিবর্তে এসেছে রাষ্ট্রতন্ত্র। সেখানে লোকসাধারণেরই মুখ্য ভূমিকা। কালের চক্রান্তে রাষ্ট্রশক্তি আজ বণিক সমাজের কুক্ষিগত। ধনতন্ত্রই তার মর্মকথা। 

রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, আমরা, “ভুলিয়া যাই, ওদেশে কেবলমাত্র আলোচনার নেশায় আলোচনা নহে, তাহা নিতান্তই প্রাণের দায়ে। এই আলোচনার পশ্চাতে নানা উপায় অন্বেষণ আছে। কারণ, সেখানে শক্তির সঙ্গে লড়াই চলিতেছে – যাহারা অক্ষমকে অনুগ্রহ করিয়া চিত্ত বিনোদন ও অবকাশ যাপন করিতে চায়, এ তাহাদের সেই বিলাস কলা নহে।” 

আমাদের দেশে লোকসাধারণ এখনও নিজেকে লোক বলে জানে না। য়ুরোপের জনসাধারণের ইতিহাস, সামাজিক বিবর্তনের ইতিহাস তাই আমাদের জানাতে হবে। তাদের লোকহিতের স্বরূপ আমরা জানতে পারলে আমরা অন্তত তাদের অনুকরণে লোকহিতের অঙ্গভঙ্গি করার হাত থেকে রেহাই পেতে পারি।


৫। “ছোটোর উপকার করিতে হইলে কেবল বড়ো হইলে চলিবে না, ছোটো হইতে হইবে, ছোটোর সমান হইতে হইবে ।” – কাদের ছোটো ও বড়ো বলা হয়েছে? এই ছোটো ও বড়োর সমস্যাকে রবীন্দ্রনাথ কী ভাবে দেখেছেন বুঝিয়ে দাও।

অথবা, “ছোটোর উপকার করিতে হইলে কেবল বড়ো হইলে চলিবে না – ছোটো হইতে হইবে ।” – এখানে ‘ছোটো’ এবং ‘বড়ো’ শব্দ দুটির বিশেষ তাৎপর্য কী ? ছোটোর যথার্থ উপকার করতে হলে ছোটোর সমান হওয়ার উপর রবীন্দ্রনাথ কেন এতখানি গুরুত্ব আরোপ করেছেন তা নিজের ভাষায় আলোচনা করো।

স্বদেশী যুগে এক শ্রেণির ভদ্র ও শিক্ষিত মানুষ সর্বসাধারণের হিত সাধনের ব্রত গ্রহণ করেছিল। এই শ্রেণির মানুষ ধনে-মানে, শিক্ষায়-দীক্ষায় নিজেদের বড় বলেই মনে করত। তাদের ধারণা ছিল তারাই একমাত্র লোকহিত করার পক্ষে উপযুক্ত মানুষ। এরা আত্মাহঙ্কারী। লোকহিত সাধনের নামে আত্মাহঙ্কার প্রকাশই ছিল এদের লক্ষ্য। এই শ্রেণির হিতাকাঙ্ক্ষী মানুষকেই চিন্তানায়ক রবীন্দ্রনাথ ‘বড়ো মানুষ’ বলে আখ্যাত করেছেন তাঁর ‘লোকহিত’ প্রবন্ধে। 

লোকসাধারণের যে অংশ নিরক্ষর, দরিদ্র, অন্যের কৃপাপ্রার্থী তাদেরই রবীন্দ্রনাথ ‘ছোটো’ বলে চিহ্নিত করেছেন। এদের জন্য বড়োদের লোকহিতের চেষ্টা। এরা হিতের বিনিময়ে আত্মবিক্রয় করে। এরা দরিদ্র, এরা শিক্ষার আলোক থেকে বঞ্চিত সুতরাং কুসংস্কার আর অন্ধ বিশ্বাসের শিকার এরা। এরা বড়োদের কাছ থেকে হিত পায়, কিন্তু প্রীতির সম্পর্ক সেখানে নেই। অবজ্ঞা, আত্ম উপেক্ষাই যুগ-যুগান্তর ধরে এদের প্রাপ্য। তাই অন্যের অনুকম্পার পাত্র এরা।

বড়োরা ছোটদের ভালবাসে না, তাদের আপনজন বলে ভাববার মতো মানসিকতাও তাদের নেই অথচ তারা তাদের হিত সাধনে ব্রতী। আসল কথা এদের দারিদ্র্যের সুযোগটুকু নিয়ে, এদের অশিক্ষাটুকুকে সম্বল করে এদের পদানত করে রাখতে চায় তথাকথিত বড়োরা।

লোকসাধারণ কিন্তু একটা বিষয়ে সচেতন – বড়োরা তাদের প্রীতির বাঁধনে বাঁধতে পারে না এই বোধটুকু তাদের আছে। তারা ছোটো হওয়ার জন্য যে মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করে, তাও তারা বোঝে, তাই বড়োর কাছ থেকে এরা হিত গ্রহণ করলেও বিনিময়ে বড়োদের কোনো শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে না। কারণ, শ্রদ্ধা অন্তরের সামগ্রী। আত্মবিক্রয়ই তারা করে কিন্তু কৃতজ্ঞতা তারা জানায় না। এরা তাই হিতসাধনকারীর পথ পরিহার করেই চলে। ‘মহাজনো যেন গতঃ স পন্থাঃ’ – এই উপদেশ পারতপক্ষে কেউ মানে না।

রবীন্দ্রনাথ চিন্তানায়ক। তিনি মনে করেন সমাজে এই ছোটো বড়োর ব্যবধানজনিত যে সমস্যা তা স্বদেশী আন্দোলনের বিঘ্নস্বরূপ। স্বদেশি আন্দোলনের ক্ষেত্রে সর্বস্তরের লোকের সহযোগিতা প্রয়োজন। কিন্তু বড়োর বড়ত্বের অহমিকা ছোটোর মনে পীড়া দেয়। বড়োরা ছোটোকে দূরে ফেলে রাখে। হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও ছোটো বড়োর ব্যবধান সমস্যাই সৃষ্টি করেছে। হিন্দুরা অহঙ্কারে স্ফীত। 

হিন্দুরা বৈষম্যমূলক অমানবিক আচরণ করে মুসলমানদের সামাজিক অপমান করেছে। তাই মুসলমানেরা রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে সাহায্যের ও সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেনি। তাদের মনের পুঞ্জীভূত অভিমানই জাতীয় সঙ্কটের ক্ষেত্রে নিজেদের শামুকের মত গুটিয়ে রাখতেই প্রেরণা দিয়েছে। তাই রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য-লোকের যথাযথ হিতসাধন করতে হলে শুধু বড়ো হলেই চলে না – ছোটোর কাছাকাছি আসতে হয় মনটাকে প্রশস্ত করেই।


৬। “সেখানে শক্তির সঙ্গে শক্তির লড়াই চলিতেছে।” – সেখানে বলতে কোন স্থানের কথা বলা হয়েছে ? দুই শক্তির মধ্যে কীরূপ লড়াই চলছে ‘লোকহিত’ প্রবন্ধ অবলম্বনে দেখাও।

চিন্তানায়ক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘লোকহিত’ প্রবন্ধে ‘সেখানে’ বলতে য়ুরোপের কথা বলেছেন। য়ুরোপে একদিন যারা বিশিষ্ট সাধারণ বলে গণ্য হত তারা ছিল সেখানকার ক্ষত্রিয়। সেই সময়ে এরাই দেশের রক্ষক। তাই তাদের প্রাধান্য ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু তার পরে ক্রমে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। শুরু হল দিন বদল। রাজার জায়গাটা রাষ্ট্রতন্ত্র দখল করে নিল। জনমতে গঠিত হল পার্লামেন্ট। রাজার ক্ষমতা হল সঙ্কীর্ণ। বৃদ্ধি পেল পার্লামেন্টের ক্ষমতা। এই হল গণতন্ত্র। কিন্তু তখনও সমাজে ধনিক গোষ্ঠীরই প্রভাব বর্তমান। দেশের নির্বাচনও তাদের নিয়ন্ত্রিত। সুতরাং শক্তির ধারাটা ক্ষত্রিয়কে ছেড়ে বৈশ্যের কুলে বইতে থাকে, বৈশ্যরাই হয়ে উঠল প্রবল।

দেশের ধন বৈষম্যের বাধা বা সমস্যা দূরীকরণের জন্য ধনিক গোষ্ঠীর প্রচেষ্টা সীমাহীন। তারা শ্রমিক গোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য উদ্যোগী হয়। শিক্ষা-দীক্ষা বিস্তারে তারা হয় বিশেষ সচেষ্ট। এর ফল অবশ্যই শ্রমিকের অনুকূলে আসে। শিক্ষার আলোকে আলোকিত হয়ে এরা মানবিকতাবোধ সচেতন হয়ে ওঠে। তাদের জাগরণ ঘটে। ধনিকের শোষণ আর শ্রেণিবৈষম্য দূরীকরণে ধনিক শ্রেণির প্রচেষ্টা য়ুরোপে ধনিকের সঙ্গে শ্রমিকের সংঘর্ষকে জোরদার করে। সেখানে দুপক্ষই সমান শক্তিশালী। রবীন্দ্রনাথ মনে করেন তা সেয়ানে সেয়ানে লড়াই। 

ভারতবর্ষের তুলনায় য়ুরোপে জনজাগরণ ঘটেছে বহুপূর্বেই। রবীন্দ্রনাথ য়ুরোপে গিয়ে তা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছেন। য়ুরোপের ইতিহাস সংগ্রামের ইতিহাস, এখানে সর্বক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, রেষারেষি। মানুষের মনে ভাবাবেগের কোনও স্থান নেই। শোষণ যত তীব্র হয়েছে সেখানে জনজাগরণও ঘটেছে তত বেশি, কোথাও কোথাও তা গণ-বিপ্লবে রূপান্তরিত।

দেশের বুদ্ধিজীবিরা নিছক প্রাণের দায়ে লোকহিত সাধন ব্রত গ্রহণ করে। কিন্তু সেখানে গণ-চেতনার বিকাশ ঘটেছে। দেশের বণিক সমাজ নিজেদের শোষণ অব্যাহত রাখার জন্য পরিকল্পনা রচনায় ব্যস্ত এবং সেই মত কার্য সাধনে ব্যাপৃত। শ্রেণি-সংগ্রামকে রোধ করতে তাই নানা পরিকল্পনা গ্রহণ। কিন্তু শ্রমিকদেরও চেতনা বাড়ছে, বোধশক্তি, বিচারশক্তি বাড়ছে। তারা ধনিক গোষ্ঠীর কার্যধারার মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত। ফলে দুই সবল পক্ষের মধ্যেই সেখানে জোরদার লড়াই শুরু হয়েছে। এই লড়াই শুধু বেঁচে থাকার জন্য লড়াই নয়, নিজ নিজ মর্যাদা আদায়ের জন্যও লড়াই।


৭। ‘ধনের ধর্মই অসাম্য’ – লেখকের অনুসরণে ধনের এই অসাম্য ধর্মের পরিচয় দাও। ধনের বৈষম্যের বাধা ধনকামীরা কীভাবে অতিক্রম করার চেষ্টা করেন তা লেখকের অনুসরণে ব্যক্ত করো।

চিন্তানায়ক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনবদ্য মননশীলতার স্বাক্ষরবাহী প্রবন্ধগ্রন্থ ‘কালান্তর’ থেকে সংগৃহীত ‘লোকহিত’ প্রবন্ধে ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার মূল তত্ত্বটি সামান্য কথার আঁচড়ে তিনি সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। পৃথিবীর সম্পদ সীমাহীন নয়। তাই এক শ্রেণির মানুষ যখন লোভের বশবর্তী হয়ে এই ধন কুক্ষিগত করে তখন অন্যদিকে আর এক শ্রেণির মানুষ সেই ধন থেকে বঞ্চিত হয়। তারা নিক্ষিপ্ত হয় দারিদ্রের করাল গহ্বরে। যার ধন আছে সেই-ই ধনী, আর যার তা নেই সে-ই নিঃস্ব দরিদ্র। ধনই মানুষের অসাম্য সৃষ্টির মূল। আর শ্রেণিগত বৈষম্যই শ্রেণিসংগ্রামের জন্য দায়ী। যারা সমাজের ধন আহরণ করে এবং তার সিংহভাগ নিজের জন্য নেয় তাদের ধনশিক্ষা কমে না বরং বাড়ে। তারা আরও বেশি করে দরিদ্র মানুষের অসহায়তার সুযোগ গ্রহণ করে। কলকারখানায় তৈরী হয় ক্ষুধার্ত শ্রমিক। তাদের ক্ষুধানল তৈরি করে কলকারখানা পরিচালনার বাষ্প।

জ্ঞান, ধর্ম, কলা, সৌন্দর্য পাঁচজনের সঙ্গে ভাগ করলে বাড়ে বৈ কমে না। কিন্তু ধন জিনিসটাকে পাঁচজনের কাছ থেকে শোষণ করে নিয়ে পাঁচজনের হাত থেকে রক্ষা না করলে টেকে না। তাই ধনকামী নিজের গরজেই দারিদ্র্য সৃষ্টি করে থাকে। তাই ধনিকগোষ্ঠী প্রতিনিয়ত চালিয়ে যায় শোষণের রথ। ধনী দরিদ্রের ব্যবধানটাকে জিইয়ে রাখে। সে জানে তাতে তারই লাভ ষোলো আনা।

ধনকামী এজন্যই নিজের গরজে দারিদ্র্য সৃষ্টি করে চলে। শোষণ ভিত্তিক সমাজের এটাই মূলকথা। অতিরিক্ত শোষণের ফলে দেশে সৃষ্টি হয় শ্রেণিবৈষম্যের, সমাজে দেখা যায় চরম অসঙ্গতি – ধনীরা তা ভালভাবেই জানে। তাই তারা নিষ্ঠার সঙ্গে সামাজিক অসাম্যকেই মদৎ দেয়, নিজেদের ধনাগমের পথটিকে করে রাখে সুগম।

কিন্তু ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য ক্রমশ অতিরিক্তভাবে বেড়ে গেলে শ্রেণিসংগ্রাম শুরু হতে বাধ্য। বিক্ষুদ্ধ শ্রমিক গোষ্ঠী তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে। এই বিপদের সম্ভাবনাটুকু ধনীরা এড়িয়ে যায় না বরং সে সম্পর্কে তারা সচেতনই থাকে। ধনবৈষম্যের বিরাট বাধা যে এই শ্রেণিসংগ্রাম তা তারা জানে। তাই শ্রেণীসংগ্রাম এড়িয়ে চলার নানা পরিকল্পনা। সমূহ বিপদ উপস্থিত হওয়ার পূর্বেই ধনীরা রাতারাতি লোকহিত ব্রত গ্রহণ করে। শ্রমিকদের তারা কিছু সুযোগ সুবিধা দান করে; যাতে শ্রমিকরা ‘দুচামচ সুপ’ খেয়ে কাজে যেতে পারে তার কিঞ্চিৎ ব্যবস্থার দিকে মন দেয়। কেউ বা তাদের বাড়ীতে গিয়ে মিষ্টমুখে কুশল জিজ্ঞাসা করে, শীতের দিনে কেউ বা আপন উদ্বৃত্ত গরম কাপড়টা তাদের পাঠিয়ে দেয় – এ তো ছেলে ভোলানোর প্রচেষ্টা। 

রবীন্দ্রনাথের মতে, “ওদেশে শ্রমজীবীর দল যতই গুমরিয়া গুমরিয়া উঠিতেছে ততই তাহাদিগকে ক্ষুধার অন্ন না দিয়া ঘুম পাড়াইবার গান গাওয়া হইতেছে।” ধনীর ধনবৈষম্যের বাধা দূরীকরণের একটি হাস্যকর প্রচেষ্টা ছাড়া এটি আর কী ?


৮। ‘লোকহিত’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ তথাকথিত লোকহিতৈষীদের লোকহিত কর্মের সমালোচনা করে বলেছেন, ‘এমনস্থলে উহাদেরও অহিত করি, নিজেদেরও হিত করি না। – লোকহিতৈষী ব্যক্তিদের হিতকর্ম কীরূপে উভয় দিক থেকে অহিতকর বিশ্লেষণ করে বুঝিয়ে দাও।

মানবতার শ্রেষ্ঠ পূজারী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানুষের মহত্বে গভীর আস্থাশীল। তাই মানবতার পরাভব বা মনুষ্যত্বের অবমাননা সহ্য করতে পারেননি তিনি। তিনি নিজেই বলেছেন, “মানুষকে মানুষ বলে দেখতে না পারার মতো এতবড়ো সর্বনেশে অন্ধতা আর নেই।” তাই যেখানেই তিনি লক্ষ্য করেছেন মনুষ্যত্বের অপমান সেখানেই তিনি সমালোচনায়, প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন।

বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে সোচ্চার সমগ্র বাঙালি জাতি। স্বদেশপ্রেমের উচ্ছ্বাসে মাতাল বাঙালি। দেশসেবা আর লোকহিতৈষণার প্রবল উন্মাদনায় দেশের শিক্ষিত মানুষ তখন চঞ্চল, অস্থিরতার সেই উম্মত্ত পরিবেশে রবীন্দ্রনাথ ভবিষ্যৎদ্রষ্টা ঋষির মতো সেই আত্মাভিমান-প্রমত্ত, অন্তঃসারশূন্য, প্রীতিহীন নিষ্ফল লোকহিতৈষণার কল্যাণ-হীনতার প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন, “মানুষ কোনো দিন কোনো যথার্থ হিতকে ভিক্ষা রূপে গ্রহণ করিবে না, ঋণ রূপেও না।”

লোকহিত একটি মহত্বপূর্ণ মানবিক অনুষ্ঠান একথা কোনো প্রশ্নের অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু লোকহিতের জন্য প্রয়োজন লোকহিতের অধিকার, দয়া বা করুণা নয়, এমনকি ঋণও নয়। লোকসাধারণকে যা কিছু দেয়, সবকিছু তাদের অধিকার ও প্রাপ্য হিসেবেই দিতে হবে। আর এই দেওয়ার মধ্যেও থাকবে প্রীতি-মধুর একাত্মতা। তবেই তা হবে যথার্থ লোকহিত। অনেক ক্ষেত্রে লোকহিতের উচ্ছ্বাসের মধ্যে প্রকাশ পায় আত্মাভিমানের মাদকতা। এই উচ্চ মর্যাদাবোধ থেকে উদ্ভূত হিতৈষণার অপমানে অপমানিত হয় মানুষের আত্মা, মানুষের অন্তর্নিহিত মনুষ্যত্ব। 

অনেকে অপরকে কৃতজ্ঞতা-পাশে বন্দী করে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত করার জন্য এবং তার মনুষ্যত্বকে খর্ব করার সঙ্কল্প নিয়ে উদ্যোগী হয় লোকহিতে। তাতে সে যেমন নিজেকে স্থাপন করে শ্রেষ্ঠতার উচ্চমঞ্চে, তেমনি অপরের মনুষ্যত্বকে করে ধূল্যবলুণ্ঠিত। সেই করুণা বর্ষণের মধ্যস্থতায় সে মানুষের আত্মার, তার অন্তরতম মনুষ্যত্বের করে চরম অপমান। এই মানসিকতা কোনো কারণেই সুস্থতার পরিচায়ক হতে পারে না। তা এক ধরনের বিকৃত মানসিকতা মাত্র। আত্মাভিমানে মগ্ন থেকে হিতকর্মে ব্রতী হলে অপরের মনুষ্যত্বকে অপমান করা হয় এবং সেখানে থাকে না প্রকৃত হিত আকাঙ্ক্ষার পবিত্রতা, থাকে হিতসাধনের কপট অভিনয়, থাকে ভণ্ডামিতে পরিপূর্ণ এক বিশেষ ধরনের নীচতা ও ক্ষুদ্রতা।

ভালবাসা সে তো ভগবানের দান। স্বতঃস্ফূর্ত ভালবাসার আকর্ষণে যে হিতকর্ম অনুষ্ঠিত হয়, তাতেই আছে মানুষের পূর্ণ অধিকার। সেখানে থাকে না স্বার্থসিদ্ধির প্রত্যাশা, থাকে না অন্য কাউকে আঘাত করার কিংবা লাঞ্ছিত করার কোনোরূপ গোপন বাসনা। রবীন্দ্রনাথের মতে হিতকর্মে প্রকৃত হিতৈষীকে হতে হয় অপরের সমান – ছোটোর সঙ্গে ছোটো, দীনের সঙ্গে দীন। নতুবা অহংকারে মত্ত হয়ে হিতকর্মে প্রবৃত্ত হলে অপরের মনুষ্যত্বকে অপমান করা হয়, আর এতে তার হিতের পরিবর্তে অহিতই সাধন করা হয়। নিজের ক্ষুদ্রতা এবং হিতৈষেণার ভন্ডামি প্রকাশ করে প্রকটিত করা হয় নিজের আত্মিক দৈন্য। এভাবে তা হয়ে ওঠে উপকারী ও উপকৃত – উভয়ের পক্ষেই ক্ষতিকর, অহিতকর।

তথাকথিত লোকহিতৈষীরা শ্রেষ্ঠত্বের উচ্চমঞ্চ থেকে লোকহিতের নামে যে সামান্য করুণাবিন্দু বর্ষণ করে তাতে তারা অসামান্য অহংকারে গর্বিত হয়ে ওঠে। কুসীদজীবী মহাজনদের মতোই এরা নিজেদের কৃত উপকারের সুদ আদায়ে হয়ে ওঠে তৎপর। হিতৈষেণার সুযোগে এরা প্রথমেই আদায় করে উপকৃতের কাছ থেকে তার আত্মসম্মান। উপকৃত ব্যক্তি তাদের সম্মান করে কিন্তু এরও অতিরিক্ত কিছু পেতে চায় উপকারী ব্যক্তি। তারা চায় চিরকৃতজ্ঞতা, এই চিরকৃতজ্ঞতাটুকু আদায় করতে গিয়ে এরা নিষ্ঠুর, নির্মম হয়ে ওঠে। এই নিষ্ঠুর তথা নির্লজ্জ হিতৈষণার হাত থেকে দেশের লোকসাধারণকে মুক্তি দেওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন মনুষ্যত্বের পূজারী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

স্বদেশি আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে দেশের শিক্ষিত মানুষ লোকহিতের উন্মাদনায় মেতে উঠেছিল, তাতে ছিল না প্রীতির সংযোগ, ছিল না লোকহিতের আন্তরিক সদিচ্ছা, পরিবর্তে সেখানে ছিল আত্মাভিমানের নির্লজ্জ প্রকাশ, ছিল মনুষ্যত্বকে অপমান করবার প্রবল আকাঙ্ক্ষা। মানুষের মনুষ্যত্বে শ্রদ্ধাশীল কবি উপকারী ও উপকৃত – উভয়ের পক্ষে অহিতকর এই হিতকর্ম থেকে বিরত থাকার জন্য কঠোরভাবে নির্দেশ দিয়েছেন।


৯। ‘লোকহিত’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ হিন্দু-মুসলমানদের অনৈক্যের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন কেন? তিনি অনৈক্যের কী কারণ নির্দেশ করেছেন ? সেই অনৈক্যের পরিণাম কি হয়েছিল? 

হিন্দু এবং মুসলমান – দুটি স্বতন্ত্র সভ্যতা, দুটি স্বতন্ত্র মানবগোষ্ঠী ভারতবর্ষে দীর্ঘকাল ধরে সহাবস্থান করেছে। এদের মধ্যে পারস্পরিক ভাব বিনিময় হয়নি তাও নয়। ইতিহাস জানায় এরা পরস্পরের পাশাপাশি এসেছে, কিন্তু একে অন্যের সঙ্গে সম্মিলিত হয়নি। এই কঠিন সত্য মর্মে মর্মে উপলব্ধ হয়েছে বঙ্গভঙ্গের দুর্যোগময় মুহূর্তে। সত্যানুসন্ধানী কবি রবীন্দ্রনাথ ইতিহাসের ধারা পর্যালোচনা প্রসঙ্গে ‘কালান্তর’ প্রবন্ধগ্রন্থে ব্যথাক্ষুদ্ধ অন্তরে লিপিবদ্ধ করলেন, “তখনকার কালে দুই সনাতন বেড়া দেওয়া সভ্যতা ভারতবর্ষে পাশাপাশি দাঁড়িয়েছে পরস্পরের প্রতি মুখ ফিরিয়ে। 

‘লোকহিত’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ হিন্দু-মুসলমান সমস্যার মনগভীরে প্রবেশ করেছেন। কুটকুশলী বড়লাট লর্ড কার্জন বাংলাদেশকে বিভক্ত করে দিলেন। উদ্দেশ্য হিন্দু মুসলমানের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টির। তিনি সফল হলেন। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের অগ্নি পরীক্ষায় বাঙালি উত্তীর্ণ হতে পারল না। সেদিন অধিকাংশ মুসলমান হিন্দুদের সঙ্গে সমকণ্ঠে বা বিচ্ছেদের প্রতিবাদ জানালেও কিছু সংখ্যক মুসলমান বা বিচ্ছেদকে সমর্থন জানিয়েছিল। 

জাতির সংকটময় মুহূর্তে হিন্দু-মুসলমানের অনক্যের দৃষ্টান্তে আমাদের জাতীয় চেতনা আহত হয়েছিল। কিন্তু আহত হওয়ার কোনও কারণ নেই, যা সত্য তা সত্যই। বাংলাদেশে সুদীর্ঘকালে সহাবস্থান সত্ত্বেও হিন্দু-মুসলমান ঐক্য সম্ভব হয়নি বলেই বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে মুসলমান হিন্দুদের পাশাপাশি সম্পূর্ণ সমর্থন নিয়ে দাঁড়ায়নি।

সমাজে মানুষে মানুষে, সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে পার্থক্য থাকে। সমাজের কর্তব্য সেই পার্থক্যকে নির্লজ্জভাবে প্রকটিত না করে তার ওপর সুশোভন সামরস্যের একটি আস্তরণ বিছিয়ে দেওয়া। কিন্তু তা না করে সংকট কালে নিম্নের বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে উচ্চের অশ্রুমোচন যেমন মিথ্যা তেমনি অশোভন এবং ন্যাক্কারজনক। চিরকাল মুসলমানদের সামাজিক ক্ষেত্রে নিম্নাসনে বসিয়ে হিন্দু-মুসলমানের পার্থক্যটাকে আমরা কুশ্রীভাবে বে-আব্রু করে রেখেছি – একথা অস্বীকার করে লাভ নেই। সেই সামাজিক অপমানে বিধ্বস্ত হয়েছে মুসলমানের হৃদয়।

ব্যবচ্ছেদ আমাদের অন্নবস্ত্রে হাত দেয়নি, আঘাত করেছে আমাদের হৃদয়কে, এবং তাতে প্রমাণিত হয়েছে, হৃদয়ের ক্ষেত্রে আমাদের ঐক্য আসেনি। শতাব্দীর পর শতাব্দী কেটে গেছে, তবু মুসলমান সম্প্রদায়কে সামাজিক ক্ষেত্রে দেওয়া হয়নি কোনও সম্মানজনক স্বীকৃতি। ফলে যা হবার তাই-ই হয়েছে। সংকটের মুহূর্তে অশ্রু গদ্‌গদ ব্যাকুল আহ্বানে তাদের সাড়া পাওয়া যায়নি। সংস্কৃত প্রবাদানুসারে, অগ্নিকাণ্ড নির্বাপণের উদ্দেশ্যে জলের জন্য আগে থেকেই কূপ খনন করে রাখা প্রয়োজন। অগ্নিকাণ্ড সংঘটনের পর কূপ খননে থাকে মূঢ়তার পরিচয়। কারণ তাতে প্রয়োজনের মুহূর্তে জল পাওয়া যায় না। অগ্নিকাণ্ডও প্রতিরুদ্ধ হয় না। 

একই ভাবে দীর্ঘকাল হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সামাজিক সম্প্রীতি স্থাপনের কোনো চেষ্টা না করে বা ব্যবচ্ছেদের সংকটময় মুহূর্তে মুসলমান সম্প্রদায়কে উচ্চকণ্ঠে আত্মীয় বলে, ভাই বলে, আহ্বান জানিয়ে কোনো ফল হয়নি। সেই অগ্নিকাণ্ডের মুহুর্তেও আমরা কূপ খননের চেষ্টা না করে মাটির ওপর কেবল ঘটি ঠুকেছি। জল ওঠেনি, কেবল ধুলো উড়েছে। পরে সেই ঘটি ঠুকেছি নিজের কপালে। রক্ত ঝরেছে কিন্তু অগ্নি নির্বাপনের জল জোটেনি।

এই-ই হল ভারতবর্ষের চিরন্তন রূপ। বাংলা দেশে নিম্ন শ্রেণির মধ্যে মুসলমানের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণ তার মধ্যেই নিহিত। রবীন্দ্রনাথ অন্যত্র বলেছেন, সমস্যা তো এই, কিন্তু সমাধান কোথায়? মনের পরিবর্তন যুগের পরিবর্তনে। মনের পরিবর্তন – হৃদয়ের পরিবর্তন না ঘটিয়ে তাদের আত্মীয় বলে, ভাই বলে অতিনাটকীয় আহ্বানের মধ্যে আমরা কেবল বৃদ্ধি করেছি তাদের অপমানের মাত্রা এবং প্রকাশ করেছি আমাদের প্রীতিহীন, আন্তরিকতাহীন, মাত্রাহীন ভণ্ডামি।


১০। ‘লোকহিত’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লোকসাধারণের হিত করার যে পথ নির্দেশ করেছেন, তার পরিচয় দাও।

অথবা, ‘আমরা পরের উপকার করিব মনে করিলেই উপকার করিতে পারি না। উপকার করিবার অধিকার থাকা চাই।’ – ‘লোকহিত’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ নানা প্রসঙ্গের উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে কী ভাবে তাঁর এই মন্তব্যটিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন তা আলোচনা করো। 

অথবা, ‘লোকহিত’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের দেশপ্রীতি, সমাজ-সচেতনতা, উদার মনুষ্যত্ববোধ এবং প্রগতিশীল চিন্তাধারার যে পরিচয় পাও তা নিজের ভাষায় বিবৃত করো।

“কালান্তর” প্রবন্ধ গ্রন্থের অন্তর্গত ‘লোকহিত’ প্রবন্ধ রবীন্দ্রনাথের গভীর মনস্বিতাপূর্ণ স্বদেশ চিন্তা ও সমাজ-চিন্তার অনবদ্য উপহার। ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, বঙ্গভঙ্গ যুগে এবং তারপর সন্ত্রাসবাদী যুগে নানা প্রবন্ধে, রাষ্ট্র, সমাজ, শিক্ষা – সর্বত্র তিনি মানবধর্মকে জয়যুক্ত দেখতে চেয়েছেন, এবং আশু ফল লাভের জন্য ভাবী মনুষ্যত্বকে অবহেলা করতে চাননি। এই সমস্ত কথা যা আজকের দিনের রাষ্ট্রনেতা ও সমাজ নেতাদেরও বিচলিত করে তুলেছে, অর্ধ শতাব্দীরও পূর্বে নানা প্রবন্ধে তিনি তার পূর্বসঙ্কেত দিয়ে গিয়েছেন। এদিক দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে প্রফেট রূপেই গণ্য করা যায়।

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনোত্তর উত্তপ্ত বাংলা দেশ স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ শিক্ষিত বাঙালি দেশহিতৈষণার উন্মাদনায় চঞ্চল হয়ে উঠেছিল। ভবিষ্যদ্রষ্টা ঋষি রবীন্দ্রনাথ এদের সতর্ক করে দিয়েছিলেন এই বলে যে দয়া বা করুণা বা ঋণ নয়, লোক-সাধারণকে তাদের প্রাপ্য হিসেবেই দিতে হবে। লোকহিতের উচ্ছ্বাসের মধ্যে যে আত্মাভিমানের মত্ততা থাকে তা বিসর্জন দিতে হবে। কারণ সমাজের উচ্চ স্থান হতে নিম্নস্থানের মানুষকে কিছু করুণা ছুঁড়ে দেওয়া মানুষের প্রতি চরম অবমাননা প্রকাশ। মনে রাখা প্রয়োজন প্রীতি লোকহিতের প্রেরণা ভূমি। উপকৃতের কাছ হতে কৃতজ্ঞতা বা আত্মসম্মান দাবী করা সমীচীন নয়।

সমাজে প্রীতিহীনতা ও শ্রেণিগত আত্মাভিমান বিষময় পরিণামই সৃষ্টি করে থাকে। তাই স্বদেশি আন্দোলনের কালে মুসলমানদের সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। স্বদেশি আন্দোলনের তাগিদে তাদের ভাই বলে আহ্বান জানালেও সে আহ্বানে তারা সাড়া দেয়নি। আসল কথা আমরা সুদীর্ঘকাল ধরে সমাজে মানুষে মানুষে, সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে যে বৈষম্য সৃষ্টি করেছি, তাতে মুসলমানদের হৃদয় সামাজিক অপমানে বিধ্বস্ত হয়েছে। সুতরাং বঙ্গভঙ্গের সংকটময় মুহূর্তে তাদের কাছ থেকে স্বাভাবিক কারণেই পুরোপুরি ভাবে সাড়া পাওয়া যায় নি।

আমরা দেশহিতের ক্ষেত্রে য়ুরোপের অন্ধ অনুকরণ করেছি। কিন্তু ভারতবর্ষ য়ুরোপ নয়। য়ুরোপে ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় ধনবৈষম্য অনিবার্য। ফলে সেখানে শ্রমিক নিষ্পেশিত হয়েছে। কিন্তু এর একটা সুফলও দেখা দিয়েছে – শ্রমিক সাধারণের মধ্যে গড়ে উঠেছে সুদৃঢ় ঐক্য। ঐক্যবদ্ধ শ্রমিকসমাজ সার্বজনীন সাক্ষরতার মধ্যস্থতায় সুসংহত শ্রমশক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে। সুতরাং ধনশক্তির প্রতিদ্বন্দ্বী এই শ্রমশক্তি উপেক্ষণীয় নয়। আত্মসচেতন, সুসংহত শ্রমিক শ্রেণি মালিকের করুণার মুখাপেক্ষী হয় না, নিজেদের দাবি আদায় করে নেয়। য়ুরোপের শ্রমশক্তির জাগরণের ইতিকথা ভুলে গিয়ে আমরা শুধু লড়াইয়ের অঙ্গভঙ্গির করেছি ব্যর্থ অনুকরণ।

আসল কথা, য়ুরোপের সাধারণ লোক আজ সুসংগঠিত, কিন্তু আমাদের দেশের লোকসাধারণ এখনও অসংগঠিত। তাই তারা জমিদার, মহাজন, মনিব, পুলিশ, গুরু ঠাকুর, উকিল, মোক্তার প্রমুখের দ্বারা শোষিত হয়ে নালিশ জানায় শুধু ভাগ্যের বিরুদ্ধে, যার বিরুদ্ধে কোনও সমনজারি চলে না। আসল সমস্যা নিরক্ষরতা। য়ুরোপের সার্বজনীন সাক্ষরতার মধ্যস্থতায় আত্মচেতনতা ও গোষ্ঠী সচেতনতা এসেছে, এসেছে বাঞ্ছিত সংঘবদ্ধতা। আমাদের দেশের সাধারণকে লোকশক্তিতে পরিণত করার প্রয়োজনে সর্বাগ্রে চাই রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে দেশময় সার্বজনীন সাক্ষরতার আয়োজন। সেই পথই লোকহিতের প্রকৃষ্ট পথ।

এই দায়িত্ব সাহিত্যের উপর দেওয়া যায় না। এমনকি শিক্ষিত মানুষের রচিত কৃত্রিম লোকসাহিত্যের উপরেও নয়। কারণ, সাহিত্য জীবনের স্বাভাবিক প্রকাশ। তা প্রয়োজনের সৃষ্টি নয়। লোকসাহিত্যের স্রষ্টা তো চিরদিনই লোকসাধারণ। সে দায়িত্ব তাদের উপর থাকাই বাঞ্ছনীয়। তা না হলে সাহিত্যের উপরে লোকসাহিত্যের দায়িত্ব চাপিয়ে দিলে তাতে সাহিত্যের ব্রতচ্যুতি অবশ্যম্ভাবী। সার্বজনীন সাক্ষরতাই সমাধানের একমাত্র পথ। এই পথই লোকসাধারণের মিলনের পথ – ঐক্যের পথ – মুক্তির পথ।


১১। “দূরের সঙ্গে নিকটের, অনুপস্থিতের সঙ্গে উপস্থিতের সম্বন্ধ-পথটা সমস্ত দেশের মধ্যে অবাধে বিস্তীর্ণ হইলে তবেই তো দেশের অনুভব শক্তিটা ব্যাপ্ত হইয়া উঠিবে। মনের চলাচল যতখানি, মানুষ ততোখানি বড়ো। মানুষকে শক্তি দিতে হইলে মানুষকে বিস্তৃত করা চাই।” – এদেশের সাধারণ মানুষের চলাচলের ব্যাঘাত কোথায় ? এখানে লোক হিতৈষীরা কি দৃষ্টিভঙ্গীতে মানুষের হিত করতে যায়। মানুষকে শক্তি দেবার জন্য মানুষকে বিস্তৃত করার কোন পথ রবীন্দ্রনাথ ‘লোকহিত’ প্রবন্ধে দেখিয়েছেন, বিশদভাবে বুঝিয়ে দাও।

মানুষ সমাজবদ্ধ জীব হলেও, যখন সে একক তখন শক্তিহীন। যখন মানুষ পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত থাকে তখন তার শক্তি সীমাহীন। মানুষের মনের শক্তি নির্ভর করে মানুষের শিক্ষার উপরে। শিক্ষা মানুষকে করে নিকটবর্তী, শিক্ষার মাধ্যমেই দূরের সঙ্গে নিকটের, অনুপস্থিতের সঙ্গে উপস্থিতের সম্বন্ধ পথ স্থাপিত হয়। মানুষে মানুষে সম্পর্ক ব্যাপ্ত হলেই মানুষ হয় বিস্তৃত, মানুষ হয় শক্তিশালী আর মানুষের এই বিস্তারই মানুষের আসল শক্তি। মনুষ্যত্বের উদ্বোধনের জন্য প্রথমেই প্রয়োজন শিক্ষার। শিক্ষাই মানুষের শক্তি, মানুষের ঐক্য। 

শিক্ষা মানুষকে জড়ত্ব মুক্ত করে এবং শক্তির আধারে পরিণত করতে পারে। শিক্ষার অভাবই দেশের সাধারণ মানুষের মনের চলাচলের ব্যাঘাত সৃষ্টির কারণ অর্থাৎ সাধারণ মানুষের অনুভব শক্তি শিক্ষাহীনতায় নিতান্ত গণ্ডীবদ্ধ। শিক্ষার অভাবে তারা ভৌগোলিক স্থানগত, কালগত, জাতিগত যে দূরত্ব সেই দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে না। তাই শিক্ষার আলোকহীনতায় মানুষ প্রায় পশু পর্যায়ের মানসিক অন্ধতায় সীমাবদ্ধ ও আচ্ছন্ন থাকে।

ঊনিশ শতকের স্বদেশি আন্দোলনের কালে আমাদের দেশে এক শ্রেণির ভদ্র ও বিত্তশালী মানুষ লোকসাধারণের মঙ্গলের জন্য উদ্যোগী হয়। এদের কর্ম প্রচেষ্টার পিছনে ছিল আত্ম-অভিমানের অহঙ্কার। তারা তাদের লোকহিতের মাধ্যমে আত্ম প্রচারেই আকাঙ্ক্ষা পোষণ করত। এদের হিতের পিছনে তাই প্রীতি ছিল না, ছিল অহঙ্কার, ছিল আত্মসম্মান ক্রয়ের হীন প্রচেষ্টা। পরে হিতসাধন করার আগে নিজের যোগ্যতা সম্পর্কে যে ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে তা এরা ভুলে যেত। মানুষকে তারা ভালবাসেনি। তাই সাধারণ ও নিজেদের মধ্যে বিভেদের প্রাচীর গড়ে তোলাই ছিল তাদের তথাকথিত লোকহিতের স্বরূপ। এই লোকহিতের উদ্দেশ্য অপরকে ছোট করে নিজেকে বড় প্রতিপন্ন করার ব্যর্থ চেষ্টা। 

লোকসাধারণ সম্বন্ধে আমাদের ভদ্র সম্প্রদায়ের আচরণ রীতি সম্মত নয়, আমাদের চিরকালীন অভ্যিস লোকসাধারণকে অপমান করা। হিতের অভিমানটা আমাদের পর্বতপ্রমাণ বলেই  আমাদের দেশহিতের সাধনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত। মুসলমান সম্প্রদায়কে আমরা সামাজিক ক্ষেত্রে ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করতে পারিনি। তাই, রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে আমরা তাদের সহযোগিতা লাভে বঞ্চিত হয়েছি। যখন তাদের হিতসাধনে আমরা ব্রতী হলাম তখন তারা আমাদের সেই সকল হিতসাধনকে মেকি জেনেই দূরে ফেলে দিলে কারও কিছু বলার থাকে না। ‘লোকহিত’ ভিক্ষার সামগ্রী নয়, দাবীর বস্তু। লোকহিতৈষীরা যে দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে মানুষের হিত করতে যান সে সম্বন্ধে রবীন্দ্র-ভাবিত মূল্যায়ন এটিই।

কপট বা লোক দেখানো লোকহিতের বিরুদ্ধে লেখনী ধারণ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি তাঁর ‘লোকহিত’ প্রবন্ধে বলেছেন, হিতৈষী আর লোকসাধারণের মধ্যে হৃদয়ের যোগসূত্র স্থাপিত হলেই সমাজের হিত সাধন সম্ভব। আরও প্রয়োজন জনসাধারণের পরস্পরের মধ্যে যোগসূত্র ও বোঝাপড়া। অল্প বা নিরক্ষর মানুষ পরস্পর বিচ্ছিন্নতা দোষে ভোগে। মনের সঙ্কীর্ণতা আর অন্ধ কুসংস্কারের বশবর্তী হওয়ায় মনের ব্যবধান বৃদ্ধি পায়। কিন্তু লিখতে পড়তে শিখে মানুষ অন্যের কথা আপনি শুনবে ও আপনার কথা অন্যকে শোনাবে, এমনি করে সে যে আপনার মধ্যে বৃহৎ মানুষকে ও বৃহৎ মানুষের মধ্যে আপনাকে পাবে, তার চেতনার অধিকার যে চারদিকে প্রশস্ত হয়ে যাবে তাই-ই লেখাপড়া শেখার গোড়ার কথা। 

রবীন্দ্রনাথের মতে লেখাপড়ার অর্থ জ্ঞান শিক্ষা নয়, পল্লীগ্রামে জ্ঞান শিক্ষার, আধ্যাত্মিক জ্ঞান শিক্ষার ব্যবস্থা আছে। যাত্ৰা, কথকতা প্রভৃতি এই শিক্ষা দিয়ে থাকে। কিন্তু লেখক বিশ্বাস করেন এই জ্ঞান প্রধানত আধ্যাত্মিক। অতএব মানুষের সাধারণ চাহিদার সঙ্গে তার যোগসূত্র কম। তাদের চাই মৌখিক জ্ঞান বা শিক্ষা। লোকসাধারণের জন্য গুরুগম্ভীর কোনও শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন করার প্রয়োজন নেই কারণ সেজন্য রয়েছে যাত্রার দল বা কথক ঠাকুরের কৃপা। সুতরাং রবীন্দ্রনাথের মতে কেবলমাত্র লিখিতে পড়িতে শেখারই প্রয়োজন এবং তা হবে সর্বস্তরের জন্য ও সকলের উপযোগী। 

এই নিতান্ত আটপৌরে লেখাপড়ার ব্যবস্থাকে রবীন্দ্রনাথ রাজপথ না বলে গলি রাস্তা বলতে চেয়েছেন। কিন্তু এই পথ প্রয়োজনীয়। এই পথ না থাকলে মানুষে মানুষে যোগসূত্র স্থাপন সম্ভব নয়। সবদেশের সমাজেই অশিক্ষিত দরিদ্র সাধারণ মানুষ হত শোষিত। কিন্তু লেখাপড়া শেখালে তারা হবে আত্মসচেতন। তারা নিজেদের ভালমন্দ বুঝতে শিখবে, তারা শোষণ ও পীড়নের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে। রবীন্দ্রনাথের মতে শিক্ষাই মানুষকে দেবে শক্তি সংগ্রহের বীজমন্ত্র। তাদের বিস্তৃত করতে সাহায্য করবে, উদ্বুদ্ধ করবে সংহতির শক্তি লাভে। অনুপস্থিতের সঙ্গে যোগাযোগের অনুভব শক্তি হবে প্রসারিত।


১২। ‘দয়ালু বাবুদের উপর বরাত দিয়া সে আমাদের কলেজের দোতলার ঘরের দিকে হাঁ করিয়া তাকাইয়া বসিয়া নাই” – কে কোন প্রসঙ্গে এরূপ উক্তি করেছেন ? দয়ালু বাবুদের উপর কিসের বরাত দেবার কথা বলা হয়েছে ? দয়ালু বাবু বলতে কাদের বোঝানো হয়েছে ? কলেজের দোতলার ঘরের উল্লেখের প্রাসঙ্গিকতা বুঝিয়ে লেখ। বসে না থেকে ‘সে’ কী করে ? যা করে তার সংজ্ঞা ও স্বরূপ নির্ণয় করো।  

  • আলোচ্য অংশের বক্তা ‘লোকহিত’ প্রবন্ধের লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। লোকসাহিত্য রচনা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ এরূপ উক্তি করেছেন। 
  • দয়ালু বাবুদের উপর লোকসাহিত্য রচনার বরাত দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। 
  • লোকসাধারণের হিতসাধনের সঙ্কল্প নিয়ে লোকাসাহিত্য রচনায় যে সকল শহুরে শিক্ষিত বাবু মেতে উঠেছিলেন তাদেরই দয়ালু বাবু হিসেবে চিহ্নিত করেছেন রবীন্দ্রনাথ। 
  • লোকসাহিত্য রচনা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ কলেজের দোতলার ঘরের কথা উল্লেখ করেছেন।

লোকসাহিত্য জনসাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত সৃষ্টি। তা কৃত্রিমভাবে রচনা করা যায় না। কলেজী শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে যে সকল শিক্ষাভিমানী পণ্ডিত ব্যক্তি লোকসাহিত্যের উপর মুরুব্বিয়ানা করেছিলেন তাদের প্রতি কটাক্ষপাত করেছেন রবীন্দ্রনাথ। কলেজের দোতলার ঘরে বসে অর্থাৎ ডিগ্রি অর্জন করে গজদন্ত মিনারের বাসিন্দা হয়ে লোকসাহিত্য রচনা করা সম্ভব নয়, সম্ভব নয় লোকসাহিত্যের উৎকর্ষ সাধন। লোকসাহিত্যের অপমৃত্যু ঘটার সম্ভাবনা লক্ষ্য করেই কবি ব্যথিত চিত্তে কলেজের দোতলা ঘরের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন। 

লোকসাধারণ লোকসাহিত্য রচনার দায়িত্ব তাই শিক্ষিত সম্প্রদায়ের হাতে ছেড়ে দেয় নি, লোকসাধারণ লোকসাহিত্য রচনার দায়িত্ব নিজেই গ্রহণ করেছে।

লোকসাহিত্য লোক জীবনের প্রতিচ্ছবি। জাতির হৃদয়ের অন্তরতম পরিচয় লোকসাহিত্যের দর্পণেই মেলা সম্ভব। জাতির যুগ যুগান্তের আশা-আকাঙ্ক্ষা, ধ্যান-ধারণা, কাব্য-কল্পনা ও সুখ-দুঃখ লোকসাহিত্যের স্বর্ণরশ্মিতে বিচ্ছুরিত হয়ে অমরত্ব লাভ করে। লোকসাধারণই লোকসাহিত্যের চিরন্তন রূপকার।


১৩। ‘ছোটোর উপকার করিতে হইলে কেবল বড়ো হইলে চলিবে না – ছোটো হইতে হইবে।” – বক্তা কোন প্রসঙ্গে এই মন্তব্য করেছেন ? ছোটো ও বড়ো বলতে রবীন্দ্রনাথ কাদের বুঝিয়েছেন ? ছোটোর যথার্থ উপকার করবার জন্য ছোটোর সমান হওয়ার উপর রবীন্দ্রনাথ কতখানি গুরুত্ব আরোপ করেছেন তা নিজের ভাষায় আলোচনা করো। 

স্বদেশি যুগে একশ্রেণির ভদ্র ও শিক্ষিত মানুষ সর্বসাধারণের হিত সাধনের ব্রত গ্রহণ করেছিল সেই প্রসঙ্গেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘লোকহিত’ প্রবন্ধে আলোচ্য মন্তব্য করেছেন। 

যে ভদ্র ও শিক্ষিত শ্রেণির মানুষ সাধারণের হিতসাধনে ব্রতী হত তারা নিজেদের শিক্ষায়-দীক্ষায় বড় বলেই মনে করত। তাদের ধারণা ছিল তারাই একমাত্র লোকহিত করার পক্ষে উপযুক্ত মানুষ। এরা আত্মাহঙ্কারী। লোকহিত সাধনের নামে আত্মাহঙ্কার প্রকাশই ছিল এদের লক্ষ্য। এই শ্রেণির হিতাকাঙ্ক্ষী মানুষকেই চিন্তা নায়ক রবীন্দ্রনাথ বড়ো মানুষ বলে আখ্যাত করেছেন তাঁর লোকহিত প্রবন্ধে।

লোকসাধারণের যে অংশ নিরক্ষর, দরিদ্র, অন্যের কৃপাপ্রার্থী তাদেরই রবীন্দ্রনাথ ছোটো বলে চিহ্নিত করেছেন। এরা হিতের বিনিময়ে আত্মবিক্রয় করে। এদের জন্য বড়োদের লোকহিতের চেষ্টা। এরা দরিদ্র, এরা শিক্ষার আলোক থেকে বঞ্চিত সুতরাং কুসংস্কার আর অন্ধ বিশ্বাসের শিকার এরা। এরা বড়োদের কাছ থেকে হিত পায়, কিন্তু প্রীতির সম্পর্ক সেখানে নেই। অবজ্ঞা আর উপেক্ষাই যুগ যুগান্তর ধরে এদের প্রাপ্য। তাই অন্যের অনুকম্পার পাত্র এরা।

বড়োরা ছোটদের ভালবাসে না, তাদের আপনজন বলে ভাববার মতো মানসিকতাও তাদের নেই, অথচ তারা তাদের হিতসাধনের ব্রতী। আসল কথা এদের দারিদ্র্যের সুযোগটুকু নিয়ে, এদের অশিক্ষাটুকু সম্বল করে এদের পদানত করে রাখতে চায় তথাকথিত বড়োরা।

লোক সাধারণ কিন্তু একটা বিষয়ে সচেতন – বড়োরা তাদের প্রীতির বাঁধনে বাঁধতে পারে না, এই বোধটুকু তাদের আছে। তারা ছোটো হওয়ার জন্য যে মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করে, তাও তারা বোঝে, তাই বড়োর কাছ থেকে এরা হিতগ্রহণ করলেও বিনিময়ে বড়োদের কোনো শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে না। কারণ শ্রদ্ধা অন্তরের সামগ্রী। আত্মবিক্রয়ই তারা করে কিন্তু কৃতজ্ঞতা তারা জানায় না। এরা তাই হিতসাধনকারীর পথ পরিহার করেই চলে। ‘মহাজনো যেন গতঃ স পন্থাঃ’ – এই উপদেশ পারত পক্ষে কেউ মানে না।

রবীন্দ্রনাথ চিন্তা নায়ক। তিনি মনে করেন সমাজে এই ছোটো বড়োর ব্যবধানজনিত যে সমস্যা তা স্বদেশি আন্দোলনের ক্ষেত্রে সর্বস্তরের লোকের সহযোগিতা প্রয়োজন। কিন্তু বড়োর বড়ত্বের অহমিকা ছোটোর মনে পীড়া দেয়। বড়োরা ছোটোকে দূরে ফেলে রাখে। হিন্দু মুসলমানের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও ছোটো বড়োর ব্যবধান সমস্যাই সৃষ্টি করেছে। 

হিন্দুরা অহঙ্কারে স্ফীত। তারা বৈষম্যমূলক অমানবিক আচরণ করে মুসলমানদের সামাজিক অপমান করেছে। তাই মুসলমানেরা রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে সাহায্যের ও সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে নি। তাদের মনের পুঞ্জীভূত অভিমানই জাতীয় সঙ্কটের ক্ষেত্রে নিজেদের শামুখের মত গুটিয়ে রাখতেই প্রেরণা দিয়েছে। তাই রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য লোকের যথাযথ হিতসাধন করতে হলে শুধু বড়ো হলেই চলে না – ছোটোর কাছাকাছি আসতে হয় মনটাকে প্রশস্ত করেই।


১৪। লোকহিত বলতে কি বোঝায় ? রবীন্দ্রনাথ লোকহিতের প্রচলিত ধারণাকে সমর্থন করেন নি কেন? তাঁর মতে লোকহিত করার অধিকার কার আছে? তিনি ভারতবর্ষের দরিদ্র অশিক্ষিত মানুষের হিত সাধনের যে উপায় নির্দেশ করেছেন তা আলোচনা করো।

স্বদেশানুরাগের উত্তেজনার আগুন পোহাতে গিয়ে বেশ কিছু দেশ হিতৈষী মানুষ হঠাৎ সাধারণ মানুষের হিত সাধনের নিমিত্ত আকুল হয়ে পড়ে। আমাদের দেশের যারা সাধারণ মানুষ তারা চিরকালই অবহেলিত, উপেক্ষিত, বঞ্চিত। উচ্চবর্ণের আভিজাত্য গৌরবে গৌরবান্বিত এঁরা সকল সময় নিম্নবর্ণের মানুষকে করেছে বঞ্চনা। 

স্বদেশি আন্দোলনের উত্তেজনার মুহূর্তে হঠাৎ যখন দেশপ্রেমিকের মুখোশ পরে একশ্রেণির মানুষ অন্যের উপকারের জন্য সচেষ্ট হন তখন থাকে অনেক ফাঁক, থাকে অনেক ফাঁকি। তাই তাদের উপকার করবার প্রয়াস হয় হাস্যকর। কারণ, উপকার করবার অধিকার বা দাবী কোনটিই তাদের নেই। রবীন্দ্রনাথ এই প্রসঙ্গেই এই মন্তব্য করেছেন। 

প্রবন্ধকার রবীন্দ্রনাথ ‘অধিকার’ বলতে মানুষের উপকার করবার মহৎ প্রবৃত্তিকে বুঝিয়েছেন। যারা উপকার করেন তাঁরা সকলের শ্রদ্ধা ও সম্মানের পাত্র। সুতরাং উপকার করবার অধিকার থাকা চাই বলে ঘোষণা করেছেন লেখক। 

ছোটোর উপকার করতে হলে ছোটোর সমান হতে হবে। উপকার করার কালে যদি অহঙ্কার, যদি প্রীতি পূর্ণ হৃদয়ের অভাব থাকে তাহলে উপকার করার অধিকার অর্জন করা যায় না। 

লোকহিত একটি মহত্ত্বপূর্ণ মানবিক অনুষ্ঠান একথা কোনো প্রশ্নের অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু লোকহিতের জন্য প্রয়োজন লোকহিতের অধিকার, দয়া বা করুণা নয়, এমনকি ঋণও নয় – লোকসাধারণকে যা কিছু দেয় সবকিছু তাদের অধিকার ও প্রাপ্য হিসেবেই দিতে হবে। এ দেওয়ার মধ্যেও থাকবে প্রীতি-মধুর একাত্মতা। তবেই তা হবে যথার্থ লোকহিত। অনেকক্ষেত্রে লোকহিতের উচ্ছ্বাসের মধ্যে প্রকাশ পায় আত্মাভিমানের মাদকতা। উচ্চ মর্যাদাবোধ থেকে উদ্ভূত হিতৈষণার অপমানে অপমানিত হয় মানুষের আত্মা, মানুষের অন্তনির্হিত মনুষ্যত্ব। 

অনেকে অপরকে কৃতজ্ঞতাপাশে বন্দী করে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত করার জন্য এবং তার মনুষ্যত্বকে খর্ব করার সংকল্প নিয়ে উদ্যোগী হয় লোকহিতে। তাতে সে যেমন নিজেকে স্থাপন করে শ্রেষ্ঠতার উচ্চ মঞ্চে, তেমনি অপরের মনুষ্যত্বকে করে ধুল্যবলুণ্ঠিত। সেই করুণা বর্ষণের মধ্যস্থতায় সে মানুষের আত্মার – তার অন্তরতর মনুষ্যত্বের করে চরম অপমান। এই মানসিকতা কোনো কারণেই সুস্থতার পরিচায়ক হতে পারে না। তা এক ধরনের বিকৃত মানসিকতা মাত্র। আত্মাভিমানে মগ্ন থেকে হিত কর্মে ব্রতী হলে অপরের মনুষ্যত্বকে অপমান করা হয় এবং সেখানে থাকে না প্রকৃত হিত আকাঙ্ক্ষার পবিত্রতা, থাকে হিতসাধনের কপট অভিনয়, থাকে ভণ্ডামিতে পরিপূর্ণ এক বিশেষ ধরণের নীচতা ও ক্ষুদ্রতা।

ভালবাসা সে তো ভগবানের দান। স্বতঃস্ফূর্ত ভালবাসার আকর্ষণে যে হিতকর্ম অনুষ্ঠিত হয়, তাতেই আছে মানুষের পূর্ণ অধিকার। সেখানে থাকে না স্বার্থসিদ্ধির প্রত্যাশা, থাকে না অন্য কাউকে আঘাত করার কিংবা লাঞ্ছিত করার কোনোরূপ গোপন বাসনা। রবীন্দ্রনাথের মতে হিত কর্মে প্রবৃত্ত হিতৈষীকে হতে হয়, অপরের সমান – ছোটোর সঙ্গে ছোটো, দীনের সঙ্গে দীন, নতুবা অহঙ্কারে মত্ত হয়ে হিতকর্মে প্রবৃত্ত হলে অপরের মনুষ্যত্বকে অপমান করা হয় আর এতে তার হিতের পরিবর্তে অহিতই সাধন করা হয়, নিজের ক্ষুদ্রতা এবং হিতৈষণার ভণ্ডামি প্রকাশ করে প্রকটিত করা হয় নিজের আত্মিক দৈন্য। এভাবে তা হয়ে ওঠে উপকারী ও উপকৃত – উভয়ের পক্ষেই ক্ষতিকর, অহিতকর। 

তথাকথিত লোকহিতৈষীরা শ্রেষ্ঠত্বের উচ্চমঞ্চ থেকে লোকহিতের নামে যে সামান্য করুণা বিন্দু বর্ষণ করে তাতে তারা অসামান্য অহঙ্কারে গর্বিত হয়ে ওঠে। কুসীদজীবী মহাজনদের মতোই এরা নিজেদের কৃত উপকারের সুদ আদায়ে হয়ে ওঠে তৎপর। হিতৈষণার সুযোগে এরা প্রথমেই আদায় করে উপকৃতের কাছ থেকে আত্মসম্মান, উপকৃত ব্যক্তি তাদের সম্মান করে কিন্তু এরও অতিরিক্ত কিছু পেতে চায় উপকারী ব্যক্তি। তারা চায় চিরকৃতজ্ঞতা, এই চিরকৃতজ্ঞতাটুকু আদায় করতে গিয়ে এরা নিষ্ঠুর নির্মম হয়ে ওঠে। এই নিষ্ঠুর তথা নির্লজ্জ হিতৈষণার হাত থেকে দেশের লোক সাধারণকে মুক্তি দেওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন মনুষ্যত্বের পূজারী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

স্বদেশি আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে দেশের শিক্ষিত মানস লোকহিতের উন্মাদনায় মেতে উঠেছিল। তাতে ছিল না প্রীতির সংযোগ, ছিল না লোকহিতের আন্তরিক সদিচ্ছা, পরিবর্তে সেখানে ছিল আত্মাভিমানের নির্লজ্জ প্রকাশ, ছিল মনুষ্যত্বকে অপমান করবার প্রবল আকাঙ্ক্ষা। মানুষের মনুষ্যত্বে শ্রদ্ধাশীল কবি উপকারী ও উপকৃত – উভয়ের পক্ষে অহিতকর এই হিতকর্ম থেকে বিরত থাকার জন্য কঠোরভাবে নির্দেশ দিয়েছেন। 


১৫। ‘বঙ্গ বিচ্ছেদ ব্যাপারটা আমাদের অন্নবস্ত্রে হাত দেয় নাই; আমাদের হৃদয়ে আঘাত করিয়াছিল। – কোন প্রসঙ্গে এই মন্তব্য? ‘আমাদের হৃদয়ে আঘাত করিয়াছিল’ – কথাটির তাৎপর্য কি ? রবীন্দ্রনাথ এই আঘাতের কি কারণ নির্দেশ করেছেন?

সামাজিক অপমান গায়ে না লেগে হৃদয়ে লাগে সেই প্রসঙ্গে আলোচনা করার সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘লোকহিত’ প্রবন্ধে বঙ্গ বিচ্ছেদের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে উক্ত মন্তব্য করেছেন। 

বঙ্গ বিচ্ছেদের ফলে বাঙালির অর্থনৈতিক সংকট খুব বেশি হয়নি কারণ তার রুজি রোজগারে হাত পড়েনি। কিন্তু এর সঙ্গে সমগ্র জাতির আবেগ, অনুভূতি, মন এবং প্রাণ একাকার হয়ে ছিল। তাই বঙ্গভঙ্গ সমগ্র জাতির প্রাণ চেতনায় হেনেছিল প্রবল আঘাত।

বঙ্গ বিচ্ছেদ বলতে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের কথা বলা হয়েছে। বঙ্গ দেশ দ্বিখণ্ডিত করার সরকারী প্রস্তাব প্রকাশিত হয় ক্যালকাটা গেজেটে ১৯০৩ সালের ডিসেম্বর মাসে। তখন বঙ্গদেশের ভৌগোলিক সীমা ছিল বহুদূর বিস্তৃত। বিহার, উড়িষ্যা এবং বর্তমান বাংলাদেশ এই বৃহৎ বঙ্গের অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রশাসনের সুবিধার জন্য রাজশাহী, ঢাকা এবং চট্টগ্রাম বিভাগকে আসামের সঙ্গে যুক্ত করে “পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ’ গঠনের প্রস্তাব হয়। পশ্চিমবঙ্গ, বিহার উড়িষ্যা বঙ্গদেশ রূপে অভিহিত হয়। 

এই সময় ভারতের বড়লাট ছিলেন লর্ড কার্জন। মুসলমান প্রধান অঞ্চল বলে লর্ড কার্জন বঙ্গদেশের স্বপক্ষে একদল মুসলমানের সমর্থন আদায় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর বঙ্গচ্ছেদ ঘোষিত হয়। এর ফলে দেশ ব্যাপী শুরু হয় প্রবল আন্দোলন। এই আন্দোলন স্বদেশি আন্দোলন নামে পরিচিত। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করা হয়। 

বাংলা দেশ হিন্দু মুসলমানের সম্মিলিত দেশ। হিন্দু-মুসলমানের পার্থক্যটাকে আমাদের সমাজে আমরা এতই কুশ্রীভাবে বে-আব্রু করে রেখেছি যে, কিছুকাল পূর্বে স্বদেশি অভিযানের দিনে একজন হিন্দু স্বদেশী প্রচারক একগ্লাস জল খাবেন বলে তাঁর মুসলমান সহযোগীকে দাওয়া থেকে নেমে যেতে বলতে কিছুমাত্র সংকোচ বোধ করেন নি। কাজের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা বশে মানুষ মানুষকে ঠেলে রাখে, অপমানও করে, তাতে বিশেষ ক্ষতি হয় না। 

কুস্তির সময়ে কুস্তিগিরদের গায়ে পরস্পরের পা ঠেকে, তার হিসেব কেউ জমিয়ে রাখে না, কিন্তু সামাজিকতার স্থলে কথায় কথায় কারো গায়ে পা ঠেকাতে থাকলে তা ভোলা শক্ত হয়। আমরা বিদ্যালয়ে ও অফিসে প্রতিযোগিতার ভিড়ে মুসলমানকে জোরের সঙ্গে ঠেলা দিয়েছি। সেটা সম্পূর্ণ প্রীতিকর নয়, তবু সেখানকার ঠেলাঠেলিটা গায়ে লাগতে পারে হৃদয়ে লাগে না। কিন্তু সমাজের অপমানটা গায়ে লাগে না হৃদয়ে লাগে। কারণ সমাজের উদ্দেশ্যই এই যে পরস্পরের পার্থক্যের উপর সুশোভন সামঞ্জস্যের আস্তরণ বিছিয়ে দেওয়া। 

তাই বাংলাদেশ হিন্দু মুসলমানের সম্মিলিত দেশ হলেও দুর্ভাগ্যবশতঃ বঙ্গবিভাগ জনিত বেদনা মুসলমানদের ততটা স্পর্শ করেনি। হিন্দুরা বঙ্গ বিচ্ছেদের আশঙ্কায় যে পরিমাণে বেদনার্ত ও বিক্ষুব্ধ হয়েছিল, মুসলমানেরা সেই পরিমাণে হয়নি। তার কারণ হিন্দুরা কোনো দিন মুসলমানের সঙ্গে একাত্ম হয়নি। তাদের হৃদয়ের সমমর্মিতা অনুভব করে নি।

Leave a Comment