বিড়াল : প্রবন্ধ (প্রশ্ন ও উত্তর)

বিড়াল প্রবন্ধ হতে প্রশ্ন ও উত্তর নিম্নে দেওয়া হল। B.A.(General) in Bengali. বিড়াল – প্রবন্ধ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

প্রবন্ধবিড়াল
গ্রন্থকমলাকান্তের দপ্তর
রচনাবঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যা
প্রকাশিতবঙ্গদর্শন পত্রিকা

Table of Contents

বিড়াল প্রবন্ধ হতে প্রশ্ন ও উত্তর

B.A.(General) in Bengali হতে প্রবন্ধ বিড়াল হতে প্রশ্ন ও উত্তর।


প্রবন্ধ বিড়াল হতে প্রশ্ন মান – ২

১। ‘বিড়াল’ প্রবন্ধটি কখন কোন পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় ?

১২৮১ বঙ্গাব্দে ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায়।

২। ‘যদি নেপোলিয়ান হইতাম’ – এখানে ‘নেমোলিয়ান’ বলতে কাকে বলা হয়েছে ? প্রকৃতপক্ষে নেপোলিয়ান কে ছিলেন ?

  • ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ গ্ৰন্থের অন্তর্গত ‘বিড়াল’ প্রবন্ধের আলোচ্য অংশে নেপোলিয়ান’ বলতে কমলাকান্ত রূপী বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাঠায় নিজেকে বুঝিয়েছেন।
  • প্রকৃতপক্ষে নেপোলিয়ান ছিলেন ফরাসি সম্রাট। তিনি ওয়াটারলুর যুদ্ধে ইংরেজ সেনাপতি ডিউক অব ওয়েলিংটনের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন।

৩। “কেহ মরে বিল ছেঁচে, কেহ খায় কই”। – মন্তব্যটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ কর।

  • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘বিড়াল’ প্রবন্ধে কমলাকান্তের জন্য রক্ষিত দুধ চুপিসারে বিড়ালের খেয়ে নেওয়া প্রসঙ্গে মন্তব্যটি করা হয়েছে।
  • কমলাকান্তের জন্য রঙিত দুধ বিড়ালের খেয়ে নেওয়া যেন একজনের কষ্ট করে বিল ছেঁচা আর অন্য জনের কই খাওয়ার মতোই। সমাজেও একশ্রেণীর মানুষ করে মরে আর অপর শ্রেণি অন্যায় ভাবে তার মুনাফা ভোগ করে।

৪। “চোর দোষী বটে কিন্তু কৃপণ ধনী তদপেক্ষা শতগুণে দোষী।” – কে কার উদ্দেশ্যে উপকৃত কথাটি বলেছেন? কথাটির তাৎপর্য কি?

  • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘বিড়াল’ প্রবন্ধে আলোচ্য উক্তিটি করেছে বিড়াল কমলাকান্তকে উদ্দেশ্য করে।
  • কৃপন ধ্বনি সকলকে বঞ্চিত করে ধন সঞ্চয় করে। তাই ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য হয় এবং দরিদ্রের অভাবের শেষ থাকেনা। দারিদ্র্যের জন্য ধনীরাই পরোক্ষভাবে দায়ী।

৫। “পরোপকারই পরম ধর্ম” – উক্তিটি কে কাকে করেছে? পরোপকারকে কেন পরমধর্ম বলা হয়েছে ?

  • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘বিড়াল’ প্রবন্ধে আলোচ্য উক্তিটি করেছে বিড়াল কমলাকান্তকে উদ্দেশ্য করে।
  • কমলাকান্তের জন্য রাখা দুধ বিড়াল খেয়ে ফেললে কমলাকান্ত তাকে লাঠি দিয়ে মারতে যায়। তখন বিড়াল বলে মানুষের ধর্ম পরোপকার করা। কমলাকান্তের জন্য রাখা দুধ বিড়াল খেয়ে নেওয়ায় কমলাকান্তের পরোপকার সিদ্ধ হল এবং সে পরম ধর্মের ফল ভাগী হল।

৬। “আমি তখন চক্ষু মেলিয়া ভালো করিয়া দেখিলাম যে।” – কে কখন ভালো করে তাকিয়ে দেখলেন? তিনি কি দেখলেন?

  • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘বিড়াল’ প্রবন্ধের আলোচ্য অংশে ওয়াটারলুর যুদ্ধের বিজয়ী সেনানায়ক ডিউক অব ওয়েলিংটন ‘ম্যাও’ করলে নেশাগ্রস্ত কমলাকান্ত ভালো করে তাকিয়ে দেখলেন।
  • ভালো করে তাকিয়ে কমলাকান্ত দেখলেন ওয়েলিংটন নয় একটি বিড়াল তার জন্য রাখা সমস্ত দুধ খেয়ে ফেলেছে।

৭। “তোমাদের পেট ভরা আমার পেটের ক্ষুধা কি প্রকারে জানিবে” – কে কাকে বলেছিল? কি কারণে বলেছিল?

  • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘বিড়াল’ প্রবন্ধে আলোচ্য কথাটি বিড়াল কমলাকান্তকে উদ্দেশ্য করে বলেছিল।
  • সমাজে যারা ধনী সম্প্রদায় তারা কৃপণ ও স্বার্থপরতায় সংকীর্ণচেতা। পরের দুঃখে কাতর হওয়া তাদের প্রকৃতি বিরুদ্ধ। তারা নিজেদের নিয়ে সুখে থাকতে চায়। তারা তাদের উদ্বৃত্ত খাবার ফেলে দেয়, নষ্ট করে অথচ তা দিয়ে দরিদ্রের প্রতিপালন করা বা তাদের দুঃখ তারা বুঝতে পারে না।

৮। “আমি যে সেই চিরাগত প্রথার অবমাননা করিয়া মনুষ্যকূলে কুলাঙ্গার স্বরূপ পরিচিত হইব” – কার উক্তি? তাৎপর্য কি?

  • ‘বিড়াল’ প্রবন্ধে আলোচ্য উক্তিটি করেছেন কমলাকান্ত রূপী বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় স্বয়ং।
  • সমাজের চিরাগত প্রথা হলো বিড়ালে দুধ খেয়ে গেলে তাকে তাড়িয়ে মারতে যেতে হয়। কমলাকান্ত রূপী বঙ্কিমচন্দ্র সেই প্রথা মনে করেই বিড়ালকে মারতে উদ্যত হয়েছিলেন।

৯। “তুমি যদি ইতিমধ্যে নসিরাম বাবুর ভাঁড়ার ঘরে ধরা না পড়ো তবে আমাকে ঠেঙ্গাইয়া মারিও” – নসিরাম বাবু কে? তার ভাঁড়ারে নসিরাম বাবু ধরা পড়বেন কেন?

  • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘বিড়াল’ প্রবন্ধে নসিরাম বাবু হলেন কমলাকান্তের আশ্রয়দাতা।
  • বিড়ালের বিশ্বাস কমলাকান্তকে তিনদিন খেতে না দিলে তিনি ঠিক নসিরাম বাবুর ভাঁড়ারে চুরি করে খেতে গিয়ে ধরা পড়বেন।

১০। “তুমি যদি চাহ তবে পাঠার্থে তোমাকে আমি নিউমান ও পার্কারের গ্রন্থ দিতে পারি” – নিউমান ও পার্কার কারা?

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত বিড়াল প্রবন্ধে উল্লেখিত নিউমান ছিলেন একজন ধর্মতত্ত্ববিদ এবং থিওডোর পার্কার ছিলেন একজন জনপ্রিয় ধর্মতত্ত্ববিদ ও বহু গ্রন্থের প্রণেতা।

১১। “চোর দোষী বটে, কিন্তু কৃপণ ধনী তদপেক্ষা শতগুনে দোষী।” – উৎস নির্দেশ কর। কৃপণ ধনী কাদের বলা হয়েছে?

  • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘বিড়াল’ প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত অংশটি গৃহীত হয়েছে।
  • যে সমস্ত ধনী কেবল সংগ্রহ করে ব্যয় করে না, এমনকি ক্ষুধার্তকে না দিয়ে উদ্বৃত্ত আহার্য নষ্ট করে ফেলে তাদেরকে কৃপণ ধনী বলা হয়েছে।

১২। “ধনীর দোষেই দরিদ্র চোর হয়” – কে কাকে এই কথা বলেছে? এই কথা বলার কারণ কি?

  • আলোচ্য কথাটি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘বিড়াল’ প্রবন্ধে বিড়াল কমলাকান্তকে বলেছিল।
  • দরিদ্রদের শোষণ করেই ধনীরা ধন সংগ্রহ করে থাকে। মুনাফার লোভে তারা ক্ষুধার্তকে বঞ্চিত করে উদ্বৃত্ত আহার্য নষ্ট করে ফেলে। ফলে ক্ষুধার তাড়নায় দরিদ্ররা চুরি করতে বাধ্য হয়।

১৩। “চোরকে ফাঁসি দাও, কিন্তু তার সঙ্গে আরেকটি নিয়ম করো” – বক্তা কে? কোন নিয়মের কথা এখানে বলা হয়েছে? 

  • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘বিড়াল’ প্রবন্ধে আলোচ্য উক্তিটি করেছে একটি বিড়াল। 
  • বিড়ালের মতে কোনো চোরের বিচার করার আগে বিচারকদের একটি নিয়ম পালন করা উচিত। সে নিয়ম হলো বিচারের তিনদিন আগে থেকে তিনি কিছু খেতে পাবেন না। তারপরও যদি তার খেতে ইচ্ছে না করে তবেই তিনি চোরের বিচার করতে পারবেন।

১৪। “যাহারা বড়ো বড়ো সাধু চোরের নামে শিহরিয়া উঠেন, তাহারা অনেক চোর অপেক্ষাও  অধার্মিক” – বক্তা কে? এই উক্তির কারণ কী?

  • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘বিড়াল’ প্রবন্ধ থেকে গৃহীত আলোচ্য উক্তিটির বক্তা হল বিড়াল।
  • দুধ খেয়ে নেওয়ার জন্য কমলাকান্ত বিড়ালকে মারতে উদ্যত হয়েছিল। সেই সময় বিড়াল বলেছিল ক্ষুধার তাড়নায় সে চুরি করতে বাধ্য হয়েছে। চুরি করা যদি অধর্ম হয়, তবে অভাব সৃষ্টি করাটাও অধর্ম। জগতে অভাব না থাকলে কেউ চুরি করতো না। এই সার কথাটা কমলাকান্তকে বোঝানোর জন্যই বিড়াল আলোচ্য কথাটি বলেছিল।

১৫। “তোমার কথাগুলি ভারি সোশিয়ালিস্টিক” – কে কাকে বলেছে? এ কথা বলার কারণ কী?

  • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘বিড়াল’ প্রবন্ধ থেকে গৃহীত আলোচ্য কথাটি কমলাকান্ত বিড়ালকে বলেছে।
  • বিড়াল ক্ষুধার তাড়নায় কমলাকান্তের জন্য রাখা দুধ খেয়ে নেয়। তখন কমলাকান্ত লাঠি দিয়ে বিড়ালকে মারতে গেলে বিড়াল তাকে সমাজতন্ত্রের কথা বলেছে। তার মতে একশ্রেণীর মানুষ সমাজের সমস্ত অর্থকে দখল করে রাখছে বলেই এই অভাব।

১৬। “বিজ্ঞ লোকের মত এই যে” – উৎস নির্দেশ করো ? বিজ্ঞ লোক কী মত দেন ?

  • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘বিড়াল’ প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত অংশটি গৃহীত হয়েছে।
  • বিজ্ঞ লোকের মত এই যে যখন বিচারে পরাস্ত হবে তখন গম্ভীর ভাবে উপদেশ প্রদান করবে। কমলাকান্তও বিড়ালকে পরাস্ত করতে না পেরে উপদেশ দিয়েছিল।

১৭। বিড়াল চলে যাওয়ার পর কমলাকান্ত কী ভেবেছিল ?

বিড়াল চলে যাওয়ার পর কমলাকান্ত রূপী বঙ্কিমচন্দ্র এই ভেবে আনন্দিত হয়েছিল যে, সে একজন পতিত আত্মাকে অন্ধকার থেকে আলোয় এনেছে।


প্রবন্ধ বিড়াল হতে প্রশ্ন মান – ৫

১। “চোর দোষী বটে, কিন্তু কৃপণ ধনী তদপেক্ষা শতগুণে দোষী।” – প্রসঙ্গ সহ ব্যাখ্যা লেখ। অথবা, ‘অধম চোরের নহে, চোরে যে চুরি করে সে অধর্ম কৃপণ ধনীর”।

আলোচ্য অংশটি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ গ্ৰন্থের অন্তর্গত’ বিড়াল’ প্রবন্ধ থেকে গৃহীত। বিড়াল কর্তৃক চুরির মূল কারণ উদঘাটন প্রসঙ্গে এই উক্তি করা হয়েছে।

বিড়াল কমলাকান্তের জন্য রাখা দুধ খেয়ে ফেলেছিল বলে তার বিরোধিতা করেছে কমলাকান্ত। কিন্তু বিড়ালের বক্তব্য মানুষের ক্ষুৎপিপাস বেশি এটা কখনও হতে পারে না। কমলাকান্ত একটু চিন্তা করলেই বুঝতেন ক্ষুধার যন্ত্রনা সহ্য করতে না পেরে সে চুরি করেছে। পৃথিবীতে সাধু ব্যক্তি হিসেবে যাদের খুব খ্যাতি আছে, তারা সামাণ্য চোর অপেক্ষাও বেশি পাপী। দরিদ্রদের প্রতি সামান্যতম সহানুভূতি না দেখিয়ে তারা দিনের পর দিন অপর্যাপ্ত ধনসম্পদ সঞ্চয় করে যান। দরিদ্রের ভাগ্যে কিছুই জোটে না। তখন অভাবের তাড়নায় সে বাধ্য হয়ে চুরি করে।

সুতরাং চুরির মূল কারণ ধনীর অপরিসীম ধন সঞ্চয় প্রবণতা। চুরির জন্য যদি কোনো অধর্ম হয়, সে অর্ধম প্রকৃতপক্ষে কৃপণ ধনীরাই করে থাকে। চোরকে যদি দোষী বলা যায় তবে চুরির মূল কারণ কৃপণ ধনী, তারাই শত গুণ বেশি দোষী। তাই দরিদ্র সমাজের প্রতিনিধি বিড়ালের কাছে এই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে যে, চুরির জন্য দরিদ্র চোরের দণ্ড হয়, কিন্তু চুরির মূল কারণ ধনীর দন্ড হয় না কেন ?


২। “তেলা মাথায় তেল দেওয়া মনুষ্য জাতির রোগ” – প্রসঙ্গ সহ ব্যাখ্যা করো ?

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘বিড়াল’ প্রবন্ধে বড়োলোক, সমাজে প্রভাবশালী ক্ষমতাবান বা মান্যগণ্য মানুষকে তোয়াজ করার ব্যাপারে সাধারণ মানুষের যে প্রবণতা সে সম্পর্কে বলতে গিয়েই আলোচ্য উক্তিটি করা হয়েছে। 

মানুষ বড়ো স্বার্থপর ও সুবিধাবাদী। যার কাছ থেকে কিছু সুবিধা আদায়ের সম্ভাবনা আছে তাকে খাতির যত্ন করতে তার কার্পন্য নেই। খেতে না চাইলেও ভালো ভালো খাবার নিয়ে সাধাসাধি করে। তাকে তুষ্ট করার, তার প্রিয়পাত্র হওয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করে।

অনদিকে যে মানুষটি দরিদ্র ক্ষমতাহীন, যার প্রতিদান দেওয়ার মতো কিছু নেই, কোনো দিন কোনো উপকারে আসবে বলে মনে হয় না, তাকে কেউ কিছু দিতে চায় না। সে ক্ষুধার্ত হলেও তাকে এক মুঠো খেতে দিয়ে কেউ উপকার করে না। উদ্বৃত্ত খাদ্য নর্দমায় ফেলে দেয়, অথচ ক্ষঙধার্থকে দেয় না। অর্থাৎ মানুষ সুবিধা আদায়ের জন্য হীন কর্ম করতে যেমন দ্বিধা করে না, তেমনি সুবিধা লাভের বা কিছু পাওয়ার সম্ভবনা না থাকলে মহৎ কাজেও আগ্রহ দেখায় না। মানুষের এই স্বভাবের জন্যই বিড়াল ক্ষোভ প্রকাশ করে উদ্ধৃত কথাটি বলেছে।


৩। “এ সকল অতি নীতি বিরুদ্ধ, ইহার আন্দোলনেও পাপ আছে।” – বিড়ালের কোন কোন কথাকে কমলাকান্তের নীতি বিরুদ্ধ বলে মনে হয়েছে ? 

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ গ্ৰন্থের অন্তর্গত ‘বিড়াল’ প্রবন্ধ থেকে আলোচ্য অংশটি গৃহীত হয়েছে।

বিড়ালের বক্তব্য হল ধনী সম্প্রদায় দিনের পর দিন দরিদ্রকে বঞ্চিত করে অপর্যাপ্ত ধন সম্পদ সঞ্চয় করে। দরিদ্রের প্রতি তারা সামান্যতম সহানুভূতিও প্রদর্শন করে না। চুরির মূল কারণ এই ধনী সম্প্রদায়। অথচ চোরের দণ্ড আছে কিন্তু চুরির মূল কারণ ধনীর নির্দয়তার কোনো দণ্ড নাই। বিড়ালের মতে সমাজের ধন বৃদ্ধির অর্থ ধনীর ধন বৃদ্ধি। ধনীর ধন বৃদ্ধি না হলে দরিদ্রের ক্ষতি নেই।

বিড়ালের বক্তব্য চোরকে যদি সাজা দিতেই হয় তাহলে বিচারককে তিন দিন উপবাস থাকতে হবে। তার পরেও যদি তার চুরি করে খেতে ইচ্ছে না করে তবে তিনি স্বচ্ছন্দে চোরকে ফাঁসি দেবেন। বিড়ালের এইসব কথাগুলিকে কমলাকান্ত রূপী বঙ্কিমচন্দ্রের নীতি বিরুদ্ধ বলে মনে হয়েছে।


৪। “তোমার কথাগুলি ভারি সোসিয়ালিস্টিক” – প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ব্যাখ্যা করো। 

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ গ্ৰন্থের অন্তর্গত ‘বিড়াল’ প্রবন্ধে আলোচ্য কথাটি কমলাকান্ত বিড়ালকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন।

‘সোসিয়ালিস্টিক’ শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হল সমাজতান্ত্রিক মতবাদ। সমাজতন্ত্রের মূলকথা হল সমাজের সবাই সমান, রাষ্ট্রের সম্পত্তির মালিক হবে রাষ্ট্র। জনগণ যা কিছু উৎপাদন করবে তার সবই রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হবে। রাষ্ট্রের নাগরিকদের প্রয়োজনমতো তা সরবরাহ করা হবে। পৃথিবীতে সবাই বাঁচতে চাই এবং সম্মানের সঙ্গেই বাঁচতে চায়। 

ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দূর করে সমাজে সাম্য অবস্থা বিরাজ করবে এমনই প্রত্যাশা ‘বিড়াল’ প্রবন্ধের বিড়ালের। ধনীরা প্রচুর ধন সম্পত্তি জমা করে তা ভোগ করবে আর দরিদ্ররা তাদের পর্যাপ্ত অংশ থেকে বঞ্চিত হবে এমন হতে পারে না। বিড়ালের এইসব যুক্তিতে রাগান্বিত হয়ে কমলাকান্ত আলোচ্য মন্তব্যটি করেছেন।


৫। “আমি যে সেই চিরাগত প্রথার অবমাননা করিয়া মনুষ্যকুলে কুলাঙ্গার স্বরূপ পরিচিত হইব, ইহাও বাঞ্ছনীয় নহে।” – প্রসঙ্গ সহ ব্যাখ্যা লেখ।

আলোচ্য অংশটি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ গ্রন্থের ‘বিড়াল’ প্রবন্ধের অন্তর্ভুক্ত। ‘বিড়াল’ প্রবন্ধে তিনি একটি অতিশয় গুরুভার বক্তব্য পরিবেশনের প্রারম্ভে লঘুরসাত্মক কাহিনী উপস্থাপিত করেছেন। আলোচ্য উক্তিটি কমলাকান্ত-মুখ-নিঃসৃত।

আফিমের মাত্রা চড়িয়ে কমলাকান্ত একদিন নেশার ঝোঁকে নিজেকে ফরাসী সম্রাট নেপোলিয়নের স্থলাভিষিক্ত করে ওয়াটার্লুর যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যূহ রচনায় ব্যস্ত ছিলেন। এমন সময় একটি বিড়াল তাঁর জন্য রক্ষিত দুধ পান করে পরিতৃপ্ত চিত্তে শব্দ করলো ‘মেও’। কমলাকান্তের চিন্তা বাধাপ্রাপ্ত হল। তিনি ভাবলেন, বুঝি ওয়াটার্লু যুদ্ধের নায়ক ডিউক অব ওয়েলিংটন বিড়ালত্ব প্রাপ্ত হয়ে কমলাকান্তের নিকট কিঞ্চিৎ আফিম ভিক্ষা করছেন। কিন্তু তার এই অতিরিক্ত লোভ-দর্শনে বিরক্ত কমলাকান্ত যখন তাকে একটু রূঢ় ভাষায় প্রত্যাখ্যান করবেন বলে ভাবছেন, তখন আবার শুনতে পেলেন ‘মেও’।

এরপর কমলাকান্তের খানিকটা চেতনা ফিরলে, তিনি তাকিয়ে দেখতে পেলেন ডিউক নয়, একটি মার্জারী তাঁর জন্য রক্ষিত দুগ্ধ পান করে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে, যেন তার কিছু বক্তব্য আছে। মার্জারীর ‘মেও’ ধ্বনি থেকে কমলাকান্ত তার বক্তব্যটি অনুধাবন করতে পারলেন। যেন সে বলতে চাইছে দেখ, কার বস্তু, কে ভোগ করে। তোমার দুধ তো আমি খেয়ে নিলাম, এখন তুমি কী করতে পার। অর্থাৎ, বিড়াল কমলাকান্তের দুধ চুরি করেছে, কমলাকান্ত তার কী শাস্তি দেবেন?

কমলাকান্ত বেশ একটু দ্বিধায় পড়ে গেলেন। সত্যিই তো, তিনি কী করতে পারেন? অর্থাৎ, কার দুধ কে খেয়েছে? দুধ মঙ্গলা গাভীর, দোহন করেছে প্রসন্ন গোয়ালিনী। অতএব এই দুধের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে কমলাকান্তের কোনো সম্পর্ক নেই, বিড়ালেরও নেই। অর্থাৎ, এই ক্ষেত্রে দু’জনের একই অবস্থা। দুধ যখন কমলাকান্তের নয়, তখন বিড়াল সেটা খেয়ে নিয়েছে বলে তার উপর চুরির দোষ বর্তায় না। অতএব কমলাকান্তের কিছু করণীয় নেই।

কিন্তু কমলাকান্ত অসুবিধেয় পড়লেন আর একটি বিচারে। কমলাকান্ত তথা তিনি যার প্রতিনিধিস্থানীয়, তিনি একজন সমাজবদ্ধ জীব, অতএব সমাজের প্রচলিত রীতিনীতি তাঁকে মেনে চলতে হয়। এখন এই সমাজের দীর্ঘকাল ধরে একটা নিয়ম প্রচলিত রয়েছে যে বিড়াল দুধ খেয়ে গেলে তথা চোর অপরের দ্রব্য অপহরণ করলে তাকে লাঠি নিয়ে তাড়া করতে হয়। এখন কমলাকান্ত যদি নির্বিকার চিত্তে শুধু বসে থাকেন, বিড়ালের তথা অপরাধীর শাস্তিবিধানের জন্য উদ্যত হস্ত না হন, তা’ হলে সমাজের মানুষের দৃষ্টিতে তিনি কুলাঙ্গার-রূপে চিহ্নিত হয়ে থাকবেন। অর্থাৎ, তিনি সামাজিক বিধি-বিধান লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত হবেন কিন্তু কমলাকান্ত এরূপ দোষী হয়ে থাকা বিজ্ঞোচিত হবে না বলেই মনে করেন।

বিড়াল বা অপরাধীর দিক থেকেও কমলাকান্ত বিষয়টি পর্যালোচনা করলেন। তিনি ভাবলেন, তিনি যদি বিড়ালের প্রতি লাঠি দিয়ে তাড়া না করেন অর্থাৎ অপরাধীর শাস্তি বিধানের জন্য যদি কোনো উদ্যোগ গ্ৰহণ করা না হয়, তবে তাদের সমাজ কমলাকান্তদের কাপুরুষ বলে উপহাস করতে পারে। কারণ চিরকালই অপরাধীরা তাদের কৃত অপরাধের জন্য এভাবেই তাড়া খেয়ে আসছে। কমলাকান্তের নির্বিকারত্বে তারা উৎসাহিত হতে পারে।


৬। “বিজ্ঞ চতুষ্পদের কাছে শিক্ষালাভ ব্যতীত তোমাদের জ্ঞানোন্নতির উপায়ান্তর দেখি না।” – প্রসঙ্গ সহ ব্যাখ্যা লেখ।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘বিড়াল’ প্রবন্ধ থেকে আলোচ্য অংশটি নেওয়া হয়েছে। বঙ্কিম-সৃষ্ট কমলাকান্ত আফিম সেবনের ফলে দিব্যদৃষ্টি প্রাপ্ত হয়ে রূপকের আড়ালে অনেক বাস্তব সত্যের স্বরূপ উদ্ঘাটন করেছেন। একদিন কমলাকান্ত নেশাগ্রস্ত অবস্থায় যখন ফরাসী সম্রাট নেপোলিয়নের স্থলবর্তী হয়ে ওয়াটার্লু রণাঙ্গনে ব্যূহসজ্জায় ব্যস্ত ছিলেন, সেই অবসরে এক বিড়াল এসে তাঁর জন্য রক্ষিত দুগ্ধ পান করে ‘মেও’ শব্দে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কমলাকান্ত প্রথম ভেবেছিলেন, বুঝি ওয়াটার্লু যুদ্ধ জয়ী ডিউক অব ওয়েলিংটন তাঁর নিকট আফিম ভিক্ষা চাইছেন, পরে বুঝলেন, বিড়াল তাঁর দুধ খেয়ে যেন তাঁকে বলতে চাইছে সে তো কমলাকান্তের বস্তু চুরি করে খেয়ে নিয়েছে, এখন কমলাকান্ত কী করতে পারেন। 

প্রথমে কমলাকান্ত চিন্তা করেছিলেন যে এই বিষয়ে তাঁর কিছু করণীয় নেই, কারণ দুধের উপর নীতিগতভাবে তাঁর কোনো অধিকার নেই। তাঁর আর বিড়ালের এই বিষয়ে সমান অধিকার। কিন্তু মনুষ্য সমাজের চিরাচরিত প্রথা স্মরণ করে তিনি একটি ভাঙা লাঠি নিয়ে বিড়ালকে মারতে উদ্যত হলে সে ভয়ে পিছিয়ে না গিয়ে কমলাকান্তকে কিছু বলতে চাইলো। আলোচ্য কথাটি বিড়ালের বক্তব্যেরই অংশবিশেষ। 

বিড়াল কমলাকান্তকে মারপিট করতে নিষেধ করে তার বক্তব্য অনুধাবন করতে অনুরোধ জানায়। বিড়ালের বক্তব্য এই যে মানুষের মতোই তাদেরও ক্ষুধা পিপাসা রয়েছে, তার নিবৃত্তির জন্য মানুষ খাদ্য-পানীয় গ্রহণ করে, তখন বিড়ালের কোনো আপত্তি থাকে না কিন্তু বিড়াল ক্ষুধার তাড়নায় খেতে চাইলেই মানুষ তাকে মারবে কেন? মানুষের এই অযৌক্তিক ব্যবহারের পিছনে কোনো ন্যায়সঙ্গত কারণ থাকতে পারে না। তাদের আচরণ প্রকৃতপক্ষে নির্বোধের মতো, তাই অপরের নিকট থেকে তাদের জ্ঞান বুদ্ধি গ্রহণ প্রয়োজন। এ বিষয়ে তারা বিজ্ঞ চতুষ্পদ প্রাণীর সহায়তা গ্রহণ করতে পারে। তবে মানুষ এই সত্যটি উপলব্ধি করতে পেরেছে যে তাদের জ্ঞানোন্নতির জন্য ক্রমশই চতুষ্পদের উপর তাদের নির্ভর করতে হবে।

বিড়ালের এই উক্তিটিতে সমকালীন শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি বঙ্কিমচন্দ্রের মনোভাবের সুস্পষ্ট প্রতিফলন ঘটেছে। বঙ্কিমচন্দ্র অতি তীব্ৰ-ব্যঙ্গ-বিদ্রূপাত্মক ভাষায় সেই শিক্ষা ব্যবস্থাকে আক্রমণ করেছেন। ইঙ্গিতে বোঝাতে চাইছেন যে তৎকালীন শিক্ষাব্যবস্থার কর্তৃপক্ষ জ্ঞান-বুদ্ধি রহিত পশুর মতোই আচরণ করেছেন যার ফলে, এ-জাতীয় ব্যবস্থাপনায় যারা শিক্ষালাভ করবে, তারা যথার্থ মানুষ হয়ে উঠবে না। শিক্ষা-ব্যবস্থার এই গলদ, জীবনের নানাক্ষেত্রে বাঙালীর পশ্চাদ্‌গামিতা প্রভৃতি বিষয়ে বঙ্কিমচন্দ্র বহু প্রবন্ধেই তীব্র মন্তব্য করেছেন।


৭। “তুমি অদ্য হইতে তিন দিবস উপবাস করিয়া দেখ। তুমি যদি ইতিমধ্যে নসীরামবাবুর ভাঁড়ার ঘরে ধরা না পড়, তবে আমাকে ঠেঙ্গাইয়া মারিও, আমি তাহাতে আপত্তি করিব না।” – প্রসঙ্গ সহ ব্যাখ্যা লেখ?

আলোচ্য উক্তিটি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘বিড়াল’ নামক প্রবন্ধের একটি অংশ। আলোচ্য ‘বিড়াল’ প্রবন্ধের বক্তব্য বিষয় ধনবণ্টন নীতির বৈষম্য হেতু সমাজে ধনীদরিদ্রের বৈষম্য এবং কৃপণ ধনীর নির্দয়তার কারণে দরিদ্রের বাধ্য হয়ে চৌর্যবৃত্তি অবলম্বন। এই প্রবন্ধে তিনি বিড়ালকে দরিদ্রের প্রতিনিধি এবং কমলাকান্তকে ধনীর প্রতিনিধিরূপে দাঁড় করিয়েছেন। কিন্তু বঙ্কিমের যুক্তিবাদী মনের প্রতিফলন পড়েছে বিড়ালের বক্তব্যেই।

একদিন কমলাকান্ত আফিমের নেশায় আচ্ছন্ন থাকা অবস্থায় এক বিড়াল এসে চুরি করে তার দুধ খেয়ে নিয়ে সশব্দে তার উপস্থিতি জ্ঞাপন করে। কমলাকান্ত চিরাচরিত প্রথানুযায়ী তাকে ঠেঙ্গা নিয়ে মারতে উদ্যত হলে বিড়াল তাঁকে থামিয়ে দিয়ে তার বক্তব্য শুনতে অনুরোধ করে। কমলাকান্ত তখন দিব্যকর্ণ প্রাপ্ত হয়ে বিড়ালের বক্তব্য অনুধাবন করেন। 

বিড়ালের মূল বক্তব্য ধনীরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত ধন সঞ্চয় করে রাখে, এমনকী অপচয়ও হতে দেয়, তবু উদ্ধৃত্ত বস্তু দরিদ্রকে দান করে না। ফলত অভাবগ্রস্ত দরিদ্র উদরান্ন সংস্থানের প্রয়োজনে চুরি করতে বাধ্য হয়। প্রত্যেকেরই বেঁচে থাকবার অধিকার রয়েছে। দরিদ্রেরও  ক্ষুধা-তৃষ্ণা বোধ আছে। অতএব বাঁচবার প্রয়োজনেই তারা চুরি করে খেতে বাধ্য হয়। তাদের চৌর্যবৃত্তির জন্য মূল অপরাধী নির্দয় কৃপণ ধনী। চোরের দণ্ড হয়, কিন্তু মূল অপরাধী কৃপণ ধনীর কেন দণ্ড হয় না।

বিড়ালের এই সাম্যবাদী বৈপ্লবিক মতবাদ শ্রবণে কমলাকান্ত কিছুটা বিব্রত হয়ে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন যে ধনীর ধনবৃদ্ধি না হলে সমাজের ধনবৃদ্ধি হয় না এবং সমাজের ধনবৃদ্ধি না হলে সমাজের উন্নতিও সম্ভবপর নয়। বিড়াল জানায় যে সমাজের উন্নতির অর্থ ধনীর উন্নতি, তাতে দরিদ্রের কোনো আগ্রহ নেই। বিড়ালের যুক্তিতে কোণঠাসা হয়ে কমলাকান্ত যুক্তির পথ বর্জন করে গায়ের জোরেই বলেন, সমাজের উন্নতিতে দরিদ্রের প্রয়োজন না থাকলেও ধনীর প্রয়োজন রয়েছে এবং তারই জন্য চোরের দণ্ডবিধান কর্তব্য। কমলাকান্তের এই বক্তব্যের উত্তরে বিড়াল যে উক্তি করেছে, আলোচ্য অংশ তারই কিয়দংশমাত্র।

বিড়াল কোনো আপত্তি না করে জানায় যে চোরের দণ্ডবিধানে তার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু যে অবস্থায় পড়ে চোর চুরি করতে বাধ্য হয়, দণ্ডদাতাকেও সেই অবস্থায় গিয়ে বিচারে দণ্ডের নির্দেশ দিতে হবে। বিচারক নিজে তিন দিন উপবাসে থাকবার পরও যদি তার চুরি করে খেতে ইচ্ছা না হয়, তা হলে তিনি চোরের দণ্ডবিধান করতে পারেন। কমলাকান্ত বিড়ালের চুরির জন্য তাকে শাস্তি দিতে গিয়েছিলেন, তাই বিড়াল এবার সরাসরি তাকেই আহ্বান জানায় কমলাকান্ত তিন দিন উপবাস করুন। বিড়ালের স্থির বিশ্বাস, তখন কমলাকান্ত নিশ্চিতই ক্ষুধার তাড়নায় তাঁর আশ্রয়দাতা নসীরামবাবুর ভাড়ার ঘরে চুরি করে খেতে গিয়ে ধরা পড়বেন। যদি তা না হয়, তবে কমলাকান্ত আবার লাঠি দিয়ে চুরির অপরাধে বিড়ালকে ঠেঙ্গাতে পারেন। বিড়াল তখন স্বেচ্ছায় এই শাস্তি মাথা পেতে গ্রহণ করবে।

আলোচ্য অংশে বঙ্কিমচন্দ্র কমলাকান্তের হাতে যে ভাঙা যষ্টি অর্থাৎ সচ্ছিদ্র দুর্বল যুক্তির পশরা সাজিয়ে দিয়েছিলেন তা সুতার্কিক বিড়ালের সমাধান বা চ্যালেঞ্জের মুখে একেবারেই ভেঙে গুড়ো গুড়ো হয়ে যায়।


প্রবন্ধ বিড়াল হতে প্রশ্ন মান – ১০

১। ‘বিড়াল’ প্রবন্ধে বিড়ালের বক্তব্য সংক্ষেপে নিজের ভাষায় লেখো? 

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ গ্রন্থের নায়ক কমলাকান্ত চক্রবর্তী আফিমসেবী দরিদ্র ব্রাহ্মণ। একমাত্র অফিম ছাড়া অন্য কোনো জিনিসের প্রতি তাঁর আকর্ষণ নেই। এই আফিমের প্রভাবেই তিনি দিব্যদৃষ্টি ও দিব্যকর্ণের অধিকারী হন। আপাতদৃষ্টিতে তাঁর বক্তব্য খেয়ালি মনের কল্পনা উচ্ছ্বাস মনে হলেও একটু চিন্তা করলেই তাঁর আবেগের তিব্রতা ও অনুভূতির গভীরতা উপলব্ধি করা যায়।

আলোচ্য ‘বিড়াল প্রবন্ধে কমলাকান্ত লঘু সুরে ধনী-দরিদ্রের সামাজিক অসাম্যের বিষয়টি অবলম্বন করে বিড়ালের সাথে এক কাল্পনিক বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন। সামান্য ছোট একটি নিরীহ বিড়ালের মুখ দিয়ে সমাজতন্ত্রবাদের মূলতত্ত্ব বিশ্লেষণ করা হয়েছে। কমলাকান্তকে ধনী সম্প্রদায় ও বিড়ালকে দরিদ্র সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি করে পৃথিবীর চিরন্তন সমস্যার যে আলোচনা করা হয়েছে তা বাস্তবিক চিত্তাকর্ষক।

কমলাকান্তের জন্য রক্ষিত দুধ একটি ছোট বিড়াল খেয়ে ফেলায় কমলাকান্ত তাকে প্রহার করতে উদ্যত হয়েছিলেন। এর জবাবে বিড়াল যে সকল বক্তব্য রেখেছে তাতেই ধনী-দরিদ্রের সামাজিক বৈষম্যের বিষয়টি সুন্দর ভাবে ফুটে উঠেছে। বিড়ালের মূল বক্তব্য এই যে বিড়াল চুরি করে দুধ খেয়েছে বলে তাকে মারপিট করা হয় কেন? তারা কেন চুরি করে তার খবর কেউ রাখে না। ধনীরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত ধন সঞ্চয় করে রাখে। ফলে সমাজের অন্যত্র ধনের অভাব ঘটে। এই কৃত্রিম অভাবের জন্যই সমাজে দরিদ্র শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে। ধনীর মতো তাদেরও ক্ষুধা-তৃষ্ণা আছে, কিন্তু তার সংস্থানের ব্যবস্থা নেই।

মানুষের যেমন ক্ষুধা-পিপাসা আছে বিড়ালেরও তেমনি ক্ষুধা আছে একথা মানুষকে বুঝতে হবে। বিড়াল কমলাকান্তকে উপদেশ দিয়েছে দুধ খাওয়ার মাধ্যমে সে তাকে পরোপকারে সাহায্য করেছে। পরোপকার মানুষের শ্রেষ্ঠ ধর্ম আর ধর্ম লাভে বিড়াল কমলাকান্তের সহায়ক।

বিড়ালের আরো বক্তব্য এই সংসারে যারা বড়ো বড়ো সাধু বলে পরিচিত তারা চোর অপেক্ষাও অধার্মিক। তারা ধন সম্পদ সঞ্চয় করে কিন্তু তার সামান্য অংশও গরীবকে দেয় না। অভাবের তাড়নায় বাধ্য হয়ে গরীবরা চুরি করে। সুতরাং চুরির মূলকারণ এইসব তথাকথিত সাধু ব্যক্তিরা। অথচ বড়ো লোকের জন্য তাদের সকল সহানুভূতি ঝরে পড়ে। বড়ো লোক হলে তাদের ক্ষুধা-তৃষ্ণা গরীবের চেয়ে বেশি হবে এমন কোনো কথা নেই। আসলে তেলা মাথায় তেল দেওয়া মনুষ্য জাতির অভ্যাস।

অবশ্য বড়ো লোকের পোষা সোহাগের বিড়ালের জন্য স্বতন্ত্র ব্যাবস্থা। তাদের প্রচুর আদর যত্ন করা হয়। অথচ রাস্তার বিড়ালের দুঃখ দুর্দশার সীমা থাকে না। তার এই রূপ শোচনীয় অবস্থা দেখেও কারোর দয়া হয় না। চোরের দন্ড দেওয়ার ব্যবস্থা আছে কিন্তু নির্দয়তার দণ্ডের ব্যবস্থা নেই। মানব সমাজের রীতি নীতি অতি বিচিত্র।

কমলাকান্ত ভাবলেন বিড়ালের এই কথাগুলি সমাজতান্ত্রিক। এই সব কথা থেকে সমাজে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। ধনী যদি ইচ্ছামত ধন সঞ্চয় করতে না পারে বা চোরের জন্য সঞ্চিত ধন ভোগ করতে না পারে, তবে সমাজের ধন বৃদ্ধি হবে না। আর ধন বৃদ্ধি না হলে সমাজের মঙ্গলও হবে না। কিন্তু বিড়ালের বক্তব্য সমাজের ধন বৃদ্ধির অন্য নাম ধনীর ধনবৃদ্ধি, এতে গরীবের কোনো মঙ্গল নেই। এর উত্তরে কমলাকান্ত বললেন যে সমাজের উন্নতিতে গরীবের প্রয়োজনে না থাকতে পারে, কিন্তু ধনীর আছে। সুতরাং এই অবস্থায় গরীব যদি চুরি করে তবে তার দন্ড বিধান করা কর্তব্য।

কমলাকান্তের বক্তব্যের জবাবে বিড়াল জানায় যে চোরের ফাঁসিতে তার কোনা আপত্তি নেই। তবে তিনদিন না খেয়ে থেকেও যদি বিচারকের চুরি করে খাবার ইচ্ছে না হয় তা হলেই তিনি ফাঁসির হুকুম দেবেন। কমলাকান্তও তিন দিন উপবাসী থেকে যদি নসিরাম বাবুর ভাঁড়ারে ধরা না পড়েন তবেই বিড়ালকে ঠেঙ্গাতে পারেন। এর উত্তরে কমলাকান্ত গম্ভীর ভাবে বিড়ালকে বলেন যে তার এইসব কথা অত্যন্ত নীতি বিরুদ্ধ আর তার আলোচনাও পাপ।

প্রবন্ধটিতে বঙ্কিমচন্দ্রের সমাজমনস্কতার পাশাপাশি উদার মানবতার পরিচয় পরিস্ফুট হয়েছে। এই প্রবন্ধে তিনি একদিকে শোষণ ও অন্যদিকে বঞ্চনার চিত্র তুলে ধরেছেন। সমাজে ধনী-দরিদ্র থাকুক, না হলে সমাজের উন্নতি বিঘ্নিত হতে পারে। তবে এই ধনী শেণি যদি তাদের স্বার্থ কিছুটা ত্যাগ করে তা দরিদ্রের সেবায় নিয়োজিত করত তাহলে বণ্টনের অসাম্য অনেকাংশেই দূরীভূত হত। প্রাবন্ধিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সেই মনুষ্যত্ব বোধের জাগরণই ঘটাতে চেয়েছেন আলোচ্য প্রবন্ধে।


২। ‘বিড়াল’ প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাম্যবাদী চিন্তার যে পরিচয় আছে, তা লিপিবদ্ধ করো।

”কমলাকান্তের দপ্তর’ গ্রন্থের একটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা ‘বিড়াল’। এখানে বিড়াল নামের ইতর প্রাণীটির মুখ দিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর সাম্যবাদী চিন্তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন বিশেষ কৌশলে। আসলে, বিড়াল কিছুই বলেনি। আফিমের নেশাগ্রস্ত কমলাকান্ত বিড়ালের ‘মেও’ ডাকের মধ্যে দিয়ে তার সাম্যবাদী বক্তব্য অনুভব করেছেন। কমলাকান্তের জন্য রাখা দুধ বিড়াল পান করলে কমলাকান্ত তাকে মারতে উদ্যত হয়। তখন বিড়াল ‘মেও’ শব্দ করে একটু সরে বসে। নেশার ঘোরে থাকা কমলাকান্ত বিড়ালের বক্তব্য বুঝতে পেরে পাঠকদের জন্য তা উপস্থাপিত করেছেন। আর তার মধ্যে দিয়েই লেখকের সাম্যবাদী ভাবনার প্রকাশ ঘটেছে। 

বঙ্কিমচন্দ্র যে সময়ের মানুষ, তখন প্রকাশ্যে সাম্যবাদী ভাবনার কথা প্রচার করা সরকারি আমলাদের পক্ষে সহজ ছিল না। তাই বিড়াল ও কমলাকান্তের কথোপকথনের আড়ালে বঙ্কিমচন্দ্র নিজের বক্তব্য উপস্থাপিত করতে চেয়েছেন।

মারতে ওঠা কমলাকান্তকে বিড়াল বলেছে, পরোপকার পরমধর্ম। কমলাকান্ত সেই ধর্মের ফলভোগী হবেন। কারণ, তাঁর জন্য রাখা দুধটুকু খেয়ে ক্ষুধার্ত বিড়ালের খুবই উপকার সাধিত হয়েছে। একথা ঠিক, বিড়াল দুধটুকু চুরি করে খেয়েছে। চুরি করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু বিড়াল সাধ করে চুরি করেনি। খেতে পেলে কেউ চুরি করে খায় না। আর বিড়ালের না খেতে পাবার কারণ ধনীর অকারণ সঞ্চয় এবং কৃপণতা। বিড়ালের বক্তব্যে এখানেই সাম্যবাদী চিন্তার প্রকাশ ঘটেছে।

এই জগতে যত জীবের সৃষ্টি, প্রত্যেকের খোরাক হিসেবে তত খাদ্যেরও সংস্থান আছে বলে বিড়ালের বিশ্বাস। অথচ, ক্ষমতাবান মানুষেরা নিজেদের ভোগ সুখ সুনিশ্চিত করতে খাদ্য সঞ্চয়ে প্রবৃত্ত হওয়ায়, প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্য ও সম্পদ মজুত করতে থাকে। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই দুর্বলের খাদ্যে টান পড়ে। তার ক্ষুধা নিবৃত্তি হয় না। ক্ষুধার জ্বালা যে কেমন, তা কাউকে বোঝানো যায় না। সেই ক্ষুধার জ্বালা সইতে না পেরেই বিড়ালের মতো অসহায়েরা চুরি করতে বাধ্য হয়।

চুরি অবশ্যই অধর্ম। কিন্তু বিড়ালের বক্তব্য, “অধর্ম চোরের নহে – চোরে যে চুরি করে, সে অধর্ম কৃপণ ধনীর। চোর দোষী বটে, কিন্তু কৃপণ ধনী তদপেক্ষা শতগুণে দোষী।” এই সমাজে না খেয়ে মরবার জন্য কেউ জন্মায় না। তাই, ক্ষুধায় কাতর হয়ে দরিদ্র, অসহায়রা চোর নামে পরিণত হয়। ধনীরা যদি তাদের প্রয়োজনাতিরিক্ত খাদ্য ক্ষুধার্তকে দান করত, তাহলে তারা চোর হত না। কাজেই কৃপণ ধনীরাই চোর তৈরি করে। অধর্ম তো তাদেরই হবার কথা। অথচ এমনই সমাজিক নিয়ম চোরের দন্ড হয়, চোর সৃষ্টিকারী কৃপণ ধনীর দণ্ড হয় না।

সমাজে আরো কত রকমের বৈষম্য রয়েছে যাতে দরিদ্রের অপকার ছাড়া উপকার নেই। মানুষ দরিদ্রের দুঃখে দুঃখিত হয় না। দরিদ্র্যদের কিছু দিতেও চায় না। “তেলা মাথায় তেল দেওয়া মনুষ্যজাতির রোগ – দরিদ্রের ক্ষুধা কেহ বুঝে না।” সেই জন্যই, যাকে খেতে বললে বিরক্ত হয় তার জন্য ভোজের আয়োজন করে, আর যে ক্ষুধায় কাতর হয়ে খাদ্যভিক্ষা চায় তাকে একমুঠো উচ্ছিষ্টও দিতে চায় না। পেটের জ্বালায় চুরি করলে তাকে দণ্ড দেবার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠে। সমাজের এই রীতি বিড়ালের মতে মোটেই প্রশংসনীয় নয়।

আসলে, বঙ্কিমচন্দ্রই সমাজের এই ধনবৈষম্য সমর্থন করতেন না। বহুজনের খোরাক একজনে সঞ্চয় করায় মানুষের কী কল্যাণ হয়? বরং, সমাজের বহু মানুষকে এর জন্য অভুক্ত থাকতে হয়, চোর হতে হয়। পুঁজিবাদ বা সঞ্চয়-স্পৃহা সমাজে অপরাধের জন্ম দেয়। এই জন্যই বঙ্কিয়চন্দ্র বিড়ালের মুখ দিয়ে বলিয়েছেন, “পাঁচ শত দরিদ্রকে বঞ্চিত করিয়া একজনে পাঁচশত লোকের আহার্য সংগ্রহ করিবে কেন? যদি করিল, তবে সে তাহার খাইয়া যাহা বহিয়া পড়ে, তাহা দরিদ্রকে দিবে না কেন? যদি না দেয়, তবে দরিদ্র অবশ্য তাহার নিকট হইতে চুরি করিবে।” এই চুরির অপরাধ শুধু দরিদ্রের নয়, ধনীরও। সাধারণ মানুষকে অভুক্ত রেখে বা বঞ্চিত করে ধনীর ধন সঞ্চয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের সমর্থন ছিল না।

সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক সংকট সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্র সচেতন ছিলেন। বঞ্চিত মানুষের বুকের জ্বালাও তিনি অনুভব করতেন। তাদের প্রতিবাদের অনুচ্চারিত ভাষা তিনি বুঝতেন। তাই তাদের পক্ষের বলবার কথাগুলি যুক্তিপূর্ণ করে তিনি বিড়ালের মুখে বসিয়ে দিয়েছেন। সেই সময় পুঁজিবাদী, বড়লোকের সমালোচনা করার সাহস, প্রবৃত্তি এবং ইচ্ছা মানুষের ছিল না। সরকারি কর্মচারি বঙ্কিমচন্দ্রও পুঁজিবাদ বিরোধী বক্তব্য সরাসরি উপস্থাপন করতে অস্বস্তিবোধ করতেন। কিন্তু সাম্যবাদ বিষয়ে তাঁর ভাবনা অনেক গভীর ছিল। সেই ভাবনার অভিব্যক্তি না ঘটিয়েও তিনি স্বস্তি পাননি। তাই, অভুক্ত, বঞ্চিত, দরিদ্র মানুষের প্রতিনিধি বিভাগের মুখ দিয়েই তিনি সাম্যবাদী চিন্তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। সূচনা ও উপসংহারে কিছুটা হাস্যরসের মিশ্রণ থাকলেও বক্তব্যের দিক থেকে রচনাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই কমলাকান্তের দপ্তর’ গ্রন্থের একটি বিশিষ্ট রচনা হয়ে উঠেছে ‘বিড়াল’।


Leave a Comment