fbpx

বাংলা গানের ধারা: বাংলা ভাষা ও শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির ইতিহাস (দ্বাদশ শ্রেণী)

বাংলা গানের ধারা চতুর্থ অধ্যায় বাংলা ভাষা ও শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির ইতিহাস (দ্বাদশ শ্রেণী)

Table of Contents

বাংলা গানের ধারা চতুর্থ অধ্যায় বাংলা ভাষা ও শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির ইতিহাস


১। বাংলা গানের ধারায় দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের অবদান আলোচনা কর। (২০১৫)

প্রাককথন :- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমসাময়িক একজন অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য সংগীত ব্যক্তিত্ব ছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। তিনি ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে নদীয়ায় জন্ম গ্রহন করেন। তাঁর পিতা ছিলেন কৃষ্ণনগর রাজসভার দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র রায়। তিনি খেয়াল চর্চাকারীদের অন্যতম ছিলেন। ভারতীয় মার্গ সংগীত ছিল দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের অনয়াস বিচরন ক্ষেত্র। ১৮৮৪তে ইংল্যান্ডে প্রবাসসূত্রে তিনি বিদেশি সুরকেও সহজাত প্রতিভাবলে আত্মস্থ করে দেশে ফেরেন।

গানের জগতে বিজেদ্ৰ লাল রায় :- ধ্রুপদ, খেয়াল, টপ্পা,বাউল, কীর্তন, বৈঠকি, স্বদেশিগান, হাসিরগান, প্যারোডি ইত্যাদি বিচিত্র ও বহুমুখী শাখায় রচিত তার গানে ভারতীয় সংগীতের ক্রমনীয়তা ও গভীরতার সঙ্গে পাশ্চাত্য সংগীতের প্রাণশক্তি ও ওজোগুণ মিলেমিশে গেছে। তার রচিত গানগুলিকে নিম্নলিখিত ভাবে আলোচনা করা যেতে পারে। –

সংস্কৃত লঘু গুরু ছন্দে রচিত গান :- ‘একি মধুর ছন্দ’, ‘এসো প্রাণসখা এসো প্রাণে’, ‘একি শ্যামল সুষমা’, ‘পতিতোদ্ধারিনী গঙ্গে’ ইত্যাদি।

রাগরাগিনী বা লোকসংগীত আশ্রিত গান :- ‘ওই মহাসিন্ধুর ওপার হতে’ (দেশ), ‘প্রতিমা দিয়ে কি পূজিব তোমারে’ (জয়জন্তী), একবার গালভরা মা ডাকে’ (বাউল), ‘ও কে গান গেয়ে চলে যায়’ (কীর্তন) প্রভৃতি।

স্বদেশসংগীত :- ‘ধনধান্য পুষ্পভরা’, ‘বঙ্গ আমার জননী আমার’ প্রভৃতি স্বদেশ সংগীতের কারণে দ্বিজেন্দ্রলাল বাঙালি জীবনে চিরস্থায়ী আসন করে নিয়েছেন।

শেষকথা :- বাংলা সাহিত্যে মূলত নাট্যকার হিসেবে স্মরনীয় দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সমস্ত নাটকেই সংগীতের ব্যবহার সমধিক পরিমাণে দেখা যায়। কোরাস গীতভঙ্গি প্রয়োগে বংলায় তিনি ছিলেন পথিকৃৎ। তার পুত্র স্বনামধন্য সংগীতজ্ঞ দিলীপ কুমার রায় পিতার গানগুলিকে পাঁচভাগে ভাগ করেছেন – পূজা, দেশ, প্রেম, প্রকৃতি ও বিবিধ। দিজেন্দ্রলাল রায়ের গনগুলি দুখণ্ডে ‘আর্যগাথা’ গ্ৰন্থে সন্নিবেশিত হয়েছে।


২। বাংলার দুটি লোকসংগীতের ধারার নাম লেখা। যে কোনো একটি ধারার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও। ১+৪ (২০১৬) 

বাংলার লোকসংগীতের কয়েকটি ধারা হল সারিগান, ভাটিয়লি, ভাওয়াইয়া, ঝুমুর, জারি, বাউল-ফকিরি গান ইত্যাদি।

ভাওয়াইয়া গান :- বাংলার একটি বিশিষ্ট লোক সংগীতের ধারা হল ভাওয়াইয়া গান। এই গান গাওয়া হয় উত্তরবঙ্গের জপাইগুড়ি, দিনাজপুর, কোচবিহার, দার্জিলিং জেলার সমভূমি, রংপুর, গোফালপাড়ার ঠুড়ি জেলার বিস্তৃত ভূখণ্ডে।

ভাওয়াইয়া গানের গায়কদের বলা হয় বাউদিয়া। এই গানের ভাষা রাজবংশী বা কামরূপী। সম্ভবত বাউড়া বা বিবাগি শব্দ থেকে বাউদিয়া এবং ভাব শব্দ থেকে ভাওয়াইয়া কথার উৎপত্তি হয়েছে। বাউদিয়ারা ঘর ছাড়া বিবাগি মানুষ। এরা সামাজিক সংস্কার বা প্রচলিত ধর্ম খুব একটা মানেন না। তাই এই গানে বাউল, বৈষ্ণব, ফকিরি, সুফী, দরবেশি বিভিন্ন ভাগ ও সুর এসে মিশেছে। রাধাকৃষ্ণ নয়, নিজস্ব জগতে নিজের পরিমন্ডলে নিজেদের অভিজ্ঞতাই বাউদিয়াদের কণ্ঠে মূর্ত হয়ে ওঠে।

ভাওয়াইয়া গানে গাড়োয়ালি, মৈষাল, চটকা, প্রভৃতি বিভাগ রয়েছে। গরু বা মোষের গাড়ির চালককে উদ্দেশ্য করে গাওয়া গান গাড়োয়ালি। মহিষকুড়ায় প্রেমিকের উদ্দেশ্যে গাওয়া হয় বিরহভিত্তিক মৈষালবন্ধুর গান। চটকা হল চুটকি বা রঙ্গ-রসিকতার গান। দীর্ঘ বা বিলম্বিত খেয়ালের পর যেমন ছোটো দ্রুত খেয়াল গাওয়া হয়, তেমনি ভাওয়াইয়ার পর গাওয়া হয় চটকা গান। এই গানে সমাজের দোষ ত্রুটিকে ব্যঙ্গ বিদ্রুপের মাধ্যমে বৃদ্ধ করা হয়।


৩। বাংলা সংগীতের ধারায় কাজী নজরুল ইসলামের অবদান আলোচনা কর। (২০১৭)

প্রাককথন :- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর বংলাগানের দিক পরিবর্তনের সবচেয়ে বড়ো কাণ্ডারির ভূমিকা নিয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। বাংলা গানের আসরে তাঁর মতো বৈচিত্র্যপূর্ণ পসরা নিয়ে সম্ভবত আর কেউ আসেন নি। মাত্র ১৪ বছরের সংগীত জীবনে আনুমানিক ৩২৪৯টি গান তিনি রচনা করেছেন। তার গানকে নিমোক্ত কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করে আলোচনা করা যেতে পারে।

পেম ও প্রকৃতি বিষমক গান :- নজরুলের অধিকাংশ গানের বিষয় ভাবনায় প্রেম ও প্রকৃতিই প্রধান। এই প্রসঙ্গে ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রাণি’, ‘আমি চিরতরে দূরে চলে যাবো’ প্রভৃতি গান স্মরনীয়।

ঋতু সংগীত :- তার বহু গানে ঋতুর প্রসঙ্গ এসেছে। ‘নিদাঘের খরতাপে’, ‘বর্ষা ঋতু এল বিজয়ীর সাজ’, ‘পউষ এল গো’ প্রভৃতি তার উল্লেখযোগ্য ঋতু সংগীত।

রাগাশ্রয়ী গান :- বিভিন্ন রাগরাগিনী ব্যবহার করে তিনি অসংখ্য গান রচনা করেছেন। যেমন – ‘ভোরের হাওয়া এলে’ (রামকেলি / ঠুমরি), ‘নারায়ণী উমা’ (নারায়ণী) প্রভৃতি। এছাড়া তার মৌলিক ও স্বসৃষ্ট রাগ রাগিনীতে নিবদ্ধ গানের মধ্যে ‘দোলনচাঁপা বনে দোলে’ (দোলনচাঁপা), ‘হাসে আকাশে শুকতারা হাসে’ (অরুণরঞ্জনী)।

গজল :- নজরুলের লেখা বাংলা গজল গুলিও রসসিদ্ধ হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই’, ‘গুলবাগিচায় বুলবুলি আমি’ প্রভৃতি গান বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

ইসলামী গান :- লোকসংগীত শিল্পী আব্বাস উদ্দিন আহমেদের অনুরোধে নজরুল ‘রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ এবং ‘ইসলামের ওই সওদা লয়ে এলো নবীন সওদাগর’ গান দুটি রচনা করেন। এরপর তিনি এই বিষয়ে প্রচুর কালজয়ী গান রচনা করেন।

অন্যান্য ভক্তিগীতি :- নজরুল বিভিন্ন সময় শ্রীচৈতন্য ও রামকৃষ্ণদেব বিষয়ক গান, শ্যামা সংগীত, নটরাজ ও শিব সংগীত, রামচন্দ্র বিষয়ক গান, কৃষ্ণ সংগীত এবং সরস্বতী ও দুর্গা বিষয়ক বহু গান লিখেছেন। এগুলির মধ্যে ‘শ্যামা বড়ো লাজুক মেয়ে’, ‘জয় বাণী বিদ্যায়নী’ ইত্যাদি বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

লোক সংগীত :- লোক সংগীতের বিভিন্ন আঙ্গিকে বাঁধা তার বহু গান আছে। যেমন – ‘পদ্মার ঢেউ রে’ (ভাটিয়ালি), ‘আমি ভাই ক্ষ্যাপা বাউল’ (বাউল), ‘ঐ রাঙ্গামাটির পথে লো’ (ঝুমুর)।

স্বদেশ সংগীত :- নজরুলের লেখা স্বদেশ সংগীত গুলি ইংরেজদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। এই প্রসঙ্গে লেখা ‘কারার ও লৌহ কপাট’, ‘ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল’ প্রভৃতি গান উল্লেখযোগ্য।

হাস্যরসাত্মক গান ও প্যারোডি গান :- হিজরী জেলে কারাবাসকালীন ‘তোমারি গেহে পালিছ স্নেহে’ প্রভৃতি প্যারোডি গান ও ‘আমার হরিনামে রুচি কারণ পরিনামে লুচি’, ‘পেঁয়াজ বন্দনা’ প্রভৃতি বিখ্যাত হাসির গান রচনা করেন।

হিন্দি গান :- নজরুল হিন্দী ভাষাতেও বেশ কিছু গান রচনা করে গেছেন। এর মধ্যে ‘আগার তুম রাধা হোতে শ্যাম’, ‘সুন্দর তুম মনমোহন হো’, ‘পরদেশী আয়া হুঁ দরিয়াকে পার’ ইত্যাদি বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

নতুন তালের গান :- নজরুল বেশ কিছু নতুন তালের সৃষ্টি করেন। এর মধ্যে উল্লেখ্য ‘জল ছল ছল এসো মন্দাকিনী’ (মন্দাকিনী/১৬ মাত্রা), ‘মহুয়া কা এ বন পাপিয়া’ (প্রিয়া ৭ মাত্রা) প্রভৃতি।

প্রভাবিত গান:- নজরুলের গানে দেশ বিদেশের গানের সুরের প্রভাব পড়েছে। এই প্রসঙ্গে ‘মোমের পুতুল মমীর দেশের মেয়ে’ (মিশরীয় সুর), ‘রেশমি রুমালে করবি বাঁধি’ (আরবি সুর), ‘কাবেরী নদী জলে’ (কর্ণাটকী সুর) ইত্যাদি গানের নাম করা যায়।

গীতিনাট্য ও গীতি আলেখ্য :- নজরুলে লেখা বিখ্যাত গীতিনাট্য হল ‘আলেয়া’, ‘মধুমালা’, ‘বনের বেদে’, ‘অতনুর দেশে’ প্রভৃতি। তার লেখা বিখ্যাত গীতি আলেখ্য গুলি হল ‘আকাশবাণী’, ‘শারদ শ্রী’, ‘বিজয়া’, দেবীস্তুতি ইত্যাদি।

চলচ্চিত্র :- নজরুল বহু চলচ্চিত্রে একাধারে গীতিকার, সঙ্গীত পরিচালক, চিত্রনাট্যকার, অভিনেতা এমনকি চলচ্চিত্র পরিচালকের ভূমিকা নিয়েছেন। তিনি প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন পাতালপুরী, গোরা, বন্দিনী, চৌরঙ্গী ইত্যাদি ছবির সাথে।

শেষ কথা :- সব মিলিয়ে বাণী ও সুরের বৈচিত্র্যে, তাদের সার্থক সমন্বয়ে, প্রয়োজনে নিত্য নতুন রাগ ও তাল উদ্ভাবনে ও প্রয়োগে, প্রাচ্য, পাশ্চাত্য ও লোকসুরের অনুসরণে অপ্রচলিত রাগ-রাগিনীর ব্যবহারে নজরুল ইসলাম বাংলা গানের ইতিহাসে চিরস্থায়ী আসনের মালিক হয়ে আছেন। তার গানকে সক্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছেন কানন দেবী, অনুপ ঘোষাল প্রমূখ বিখ্যাত শিল্পীরা।


৪। বাংলা গানের ধারায় রজনীকান্ত সেনের অবদান আলোচনা কর।  (২০১৮)

প্রাককথন :- রজনীকান্ত সেন ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের অনুজ প্রতিম। স্বল্পকালের জীবনদশায় তিনি অসংখ্য স্মরণীয় গান রচনা করেছেন। তার গানে হিন্দুস্তানী মার্গ সংগীত, টপ্পা, বাউল, কীর্তন, প্রভৃতি সুরের প্রভাব দেখা যায়। তার গানগুলিকে কয়েকটি পর্যায়ে জাগ করা যায়। যথা –

ভক্তিগীতি :- বানী, সুর, ভাব, কাব্যমাধুর্য, স্বকীয়তা এবং সহজ চলনে তার লেখা ভক্তিগীতি গুলি বাংলা গানের ভুবনে বিশিষ্ট হয়ে আছে। তার উল্লেখযোগ্য ভক্তিগীতি গুলি হল ‘তুমি নির্মল কর মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে’, ‘আমি অকৃতি আধর্ম’, ‘প্রেমে জল হয়ে যাও গলে’ প্রভৃতি। তাছাড়া তার লেখা ‘ওমা, উমা ও আনন্দ কোথা রাখি বল’ ইত্যাদি উমা সংগীত গুলিও ভারত হৃদয়ের সহজ আকুতি ও আনন্দকে প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছে।

স্বদেশ সংগীত :- রজনীকান্ত কিছু অসামান্য দেশাত্মবোধক গান রচনা করেছেন। যেমন – ‘ভারত কাব্য নিকুঞ্জে জাগো সুমঙ্গলময়ী মা’, শ্যামল শস্য ভরা চিরশান্তি বিরাজিত পূণ্যময়ী’, ‘নমো নমো নমো জননী বঙ্গ’, ‘মায়ের দেওয়া মোটাকাপড় মাথায় তুলে নেরে ও ভাই’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য 

হাস্যরসাত্মক গান :- রজনীকান্ত বেশ কিছু হাসির গাধও রচনা করেছিলেন। ‘যদি কুমড়োর মতো চালে ধরে রত পানতোয়া শতশত’, ‘বাজার হউদ্দআ কিন্যা আইনা ঢাইলা দিছি পায়’ প্রভৃতি গান এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য।

শেষকথা :- মূলত তাঁর ভক্তিগীতির নিবিড় আন্তরিক ও সারল্য মন্ডিত কান্তির কারণে তিনি কান্তকবি নামে এবং তার গান কান্তগীতি নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। তাঁর গাম গুলি বানী ও কল্যানী গ্ৰন্থ দ্বয়ে সংকলিত হয়েছে। কান্তগীতির গায়কদের মধ্যে কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, মান্না দে প্রমুখ বিশেষ উল্লেখযোগ্য।


৫। বাংলা গানের ধারায় সলিল চৌধুরীর বিশিষ্টতা সম্পর্কে আলোচনা কর।  (২০১৯)

বাংলা গানে নতুন আলোর পথযাত্রী খ্যাতনামা সুরকার ও গীতিকার সলিল চৌধুরী। ভারতীয় সংগীতধারা সম্পূর্ণরূপে আত্মস্থ করে তাকে নিজের অপূর্ব সৃষ্টি কৌশলে উপস্থাপন করেন তিনি। তাঁর নতুন নতুন সুর আর কথার জাদুতে আচ্ছন্ন ছিল ছয়-সাত দশকের বাংলা গান। 

১৯৪৪ সালে তিনি যুক্ত হন গণনাট্য সংঘের সাথে। তাঁর গানে সমকালীন বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলন আর রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের প্রভাব গভীরভাবে লক্ষ্য করা যায়। আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচার উপলক্ষ্যে তিনি রচনা করেছেন ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা আজ জেগেছে সেই জনতা’। ঐতিহাসিক নৌবিদ্রোহের সমর্থনে লিখেছেন, ‘ঢেউ উঠছে, কারা টুটছে’। 

তাঁর রচিত ‘আজ নয় গুনগুন গুঞ্জন প্রেমে। চাঁদ ফুল জোছনার গান আর নয় – ওগো প্রিয় মোর, খোলো বাহুডোর। পৃথিবী তোমারে যে চায়’ – গানটির বক্তব্য অনুধাবন করলে তাঁর সমকালের চাহিদা, সমাজতান্ত্রিক বোধের উজ্জীবন, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ঐকান্তিক ইচ্ছার কথা বোঝা যায়। তিনি গানের সুরারোপ কথার সাথে উপযুক্ত করে তুলেছিলেন গানের সুরকে। হিন্দি আধুনিক গান, সিনেমার গান রচনাতেও সিদ্ধহস্ত ছিলেন তিনি। 

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বা সুকান্ত ভট্টাচার্যের বেশকিছু কবিতায় সুরারোপ করে সেগুলিকে গান হিসেবে কালজয়ী করে দিয়েছেন সলিল চৌধুরী। তাঁর সমকালীন সমস্ত খ্যাতনামা ভারতীয় সংগীতশিল্পীই তাঁর রচিত ও সুরারোপিত গান গেয়েছেন। বাংলা গানকে একক প্রচেষ্টাতেই তিনি নিয়ে গেছেন সম্পূর্ণ নতুন পথে, যে পথ চির-আধুনিক।


৬। বাংলা সংগীত জগতে গায়ক ও সুরকার রূপে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের স্থান নিরূপণ কর।  (২০২০)

হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আধুনিক বাংলা সংগীত সাগরের এক বিশাল তরঙ্গ। তাঁর জীবন কণ্ঠশিল্পী, সংগীত পরিচালক, সুরস্রষ্টা এমনকি চলচ্চিত্র প্রযোজকরূপেও বর্ণময়। হেমন্ত কুমার নামে তিনি হিন্দি সিনেমার জগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি রবীন্দ্রসংগীতেও বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। বাংলা আধুনিক গান ও সিনেমার গান – দুই ধারাতেই তাঁর অবদান অসামান্য।

তিনি রবীন্দ্রসংগীতকেও বিরাট উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিলেন। ১৯৩৭ সালে বাংলা বেসিক ডিস্কের গানে প্রথম তাঁর কণ্ঠ শুনতে পাওয়া যায়। ১৯৪১ সালে তিনি নেপথ্যশিল্পীরূপে আত্মপ্রকাশ করেন ‘নিমাই সন্ন্যাস’ ছায়াছবিতে। অতি বিখ্যাত বাংলা সিনেমাগুলিতে তাঁর কণ্ঠের জাদু শ্রোতাদের মুগ্ধ করে। ‘শাপমোচন’, ‘হারানো সুর’, ‘সূর্যতোরণ’, ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘সপ্তপদী’, ‘দীপ জ্বেলে যাই’, ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’, ‘বালিকা বধূ’, ‘দাদার কীর্তি’ প্রভৃতি অসংখ্য ছায়াছবিতে তিনি অমর সুরের মায়াময় পরিবেশ সৃষ্টি করে গিয়েছেন।

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বিখ্যাত গানগুলি হল ‘মুছে যাওয়া দিনগুলি’,  ‘আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা’, ‘নীড় ছোট ক্ষতি নেই’। সলিল চৌধুরীর কথা ও সুরে হেমন্তের গাওয়া গানগুলি বাঙালি কখনও ভুলবে না। ‘কোনো এক গাঁয়ের বধূ’ , ‘ধিতাং ধিতাং বোলে’ ইত্যাদি। গানের সঙ্গে কবি সুকান্তের কথা ও সলিল চৌধুরীর সুরে হেমন্ত গেয়েছেন ‘রানার’ , ‘ঠিকানা’ ইত্যাদি গান। তাঁর ভরাট সুরেলা গলায় অসংখ্য রবীন্দ্রসংগীত গভীরতর তাৎপর্য নিয়ে বাঙালির হৃদয়ে ধরা দিয়েছে। 


৭। বাংলা সংগীত জগতে গায়ক ও সুরকার রূপে মান্না দের স্থান নিরূপণ কর।  (২০২০)

মান্না দে আধুনিক বাংলা গানে নিজস্ব গায়কি এবং সংগীতে অসামান্য বুৎপত্তি নিয়ে এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। তাঁর রক্তেই ছিল সংগীতের উত্তরাধিকার। কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে ছিলেন সেকালের বিস্ময়কর সংগীতস্রষ্টা। তাঁর কাছেই মান্না দের শৈশবের সংগীত শিক্ষা হয়েছিল। এ ছাড়াও ওস্তাদ দবীর খাঁ-র কাছে তিনি উচ্চাঙ্গ সংগীতের শিক্ষা নেন। কিন্তু ছোটোবেলায় সংগীতের থেকে খেলাধুলাতেই তাঁর বেশি আগ্রহ ছিল। স্কটিশচার্চ কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময়ে কলেজ উৎসবে সংগীতের তিনটি আলাদা শ্রেণিতে পরপর তিনবার মান্না দে প্রথম হন। এখান থেকেই বাংলা গানের জগতে নতুন নক্ষত্রের জন্ম হয়। 

১৯৪২ সালে কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে-র সঙ্গী হয়ে তিনি মুম্বাই যান। এখানে প্রথমে কাকা এবং পরে শচীনদেব বর্মন ও অন্যান্যদের সঙ্গে সহকারী সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৪৩ সালে ‘তামান্না’ সিনেমায় সুরাইয়া-র সঙ্গে দ্বৈতসংগীত ‘জাগো, আয়ি ঊষা’ দিয়ে নেপথ্য শিল্পী হিসেবে মান্না দে-র আবির্ভাব ঘটে। ১৯৫০ সালে ‘মশাল’ ছবিতে একক শিল্পী হিসেবে মান্না দে-কে পাওয়া যায়। এর মধ্যেই নিজে সংগীত পরিচালনাও শুরু করেন। কিন্তু গানের শিক্ষাকে তিনি থামিয়ে দেন নি। পেশাগত ব্যস্ততার মধ্যেই উচ্চাঙ্গ সংগীতের তালিম নিয়েছেন ওস্তাদ আমন আলি খান এবং ওস্তাদ আব্দুল রহমান খানের কাছে এবং ধীরে ধীরে হিন্দি ও বাংলা গানের জগতে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন মান্না দে। 

তিনি সর্বমোট ১২৫০টি বাংলা গান গেয়েছেন। আধুনিক গান, রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি, ভক্তিগীতি-সহ সংগীতের সব শাখাতেই ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ। বাংলা ছাড়াও ভোজপুরি, মৈথিলি, অসমিয়া, ওড়িয়া, গুজরাটি, পাঞ্জাবি-সহ সবকটি প্রধান ভারতীয় ভাষাতেই মান্না দে গান করেছেন। ‘শঙ্খবেলা’, ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’, ‘চৌরঙ্গি’, ‘তিন অধ্যায়’, ‘বনপলাশীর পদাবলী’, ‘মৌচাক’, ‘ধন্যি মেয়ে’, ‘শেষ থেকে শুরু’, ‘সন্ন্যাসী রাজা’ এরকম অসংখ্য বাংলা চলচ্চিত্রে মান্না দে-র গাওয়া গান ইতিহাস হয়ে গিয়েছে। 

বাঙালির হৃদয়ে চিরস্থায়ী জায়গা করেছে তার ‘ওই মহাসিন্ধুর ওপার থেকে’, ‘দীপ ছিল শিখা ছিল’, ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা’, ‘আমি যে জলসাঘরে’ ইত্যাদি অজস্র গান। চলচ্চিত্রে একাধিকবার জাতীয় পুরস্কার ছাড়াও ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ এবং দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করে।


৮। বাংলা সংগীতের ইতিহাসে রবীন্দ্র সংগীতের গুরুত্ব আলোচনা কর। (২০২৩)

বাংলা গানের ধারায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক অবিস্মরণীয় নাম। রবীন্দ্র-সংগীত সময়ের সাথে সাথে সমসাময়িক হয়ে উঠেছে। বাঙালি সমাজে এই গানের গ্রহণযোগ্যতা চিরকালীন। বাংলার মানুষের আনন্দ, দুঃখ, প্রেম, প্রতিবাদ, প্রকৃতিমুগ্ধতা, দেশপ্রেম, ঈশ্বর উপলব্ধি সমস্ত কিছুর প্রকাশ যাকে আশ্রয় করে – তিনি রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর গান। হতাশাপূর্ণ জীবনে আলোর পথ দেখায় তাঁর গান। আর সব গানের থেকে এই গান আলাদা, অনন্য। স্বাধীন দুটি পৃথক রাষ্ট্রের জাতীয় সংগীত রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি। ভারতবর্ষের জাতীয় সংগীত ‘জনগণমন অধিনায়ক জয় হে’ এবং বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’। 

তাঁর গানের সংখ্যা দেড় হাজারের কিছু বেশি। প্রায় সমস্ত গানের বাণী এবং সুর রবীন্দ্রনাথের। তাঁর দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর অবশ্য রবীন্দ্রনাথের অল্প কিছু গানে সুর দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ গান রচনা করেছেন বাংলা গানের বিষয় বিন্যাসের প্রচলিত রীতি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে গিয়ে। নতুনত্ব এনেছেন শুধু বিষয়ে নয়, গানের গঠনেও। পুরোপুরি নতুন গান সৃষ্টির সাথে সাথে তৈরি করেছিলেন একদল দীক্ষিত ছাত্রছাত্রী, যারা পরম্পরাবাহী হয়ে আজও তাঁর গানকে উজ্জীবিত রেখেছে প্রথম দিনের মতোই। 

রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেছিলেন, প্রাচীন সংগীতের জড় পুনরাবৃত্তিতে নয়, বাংলা গানকে টিকে থাকতে হবে নিত্য নতুন সৃষ্টির মাধ্যমে। তবু তাঁর গান পরম্পরাহীন নয়। ভারতীয় প্রাচীন সংগীত ধারার সাথে তা সংযোগবাহী। ধ্রুপদ, ধামার, খেয়াল, ঠুংরির সাথে পাশ্চাত্যের সুরধারাও এসে মিশেছে তাঁর গানে, আর আছে আমাদের বাউল, কীর্তন। সবটাই উপলব্ধি করা যায়। কিন্তু বিচ্ছিন্ন করা যাবে না কিছুতেই। সমন্বয়বাদী ঋষির এটাই অনন্যতা। বাংলা সিনেমার গান হিসেবে আজও রবীন্দ্রসংগীতের জনপ্রিয়তা সর্বাধিক।


৯। বাংলা গানের ধারায় অতুলপ্রসাদ সেনের অবদান আলোচনা কর।

প্রাককথন :- বাংলা সংগীতের ধারায় অতুলপ্রসাদ সেন এক বিশিষ্ট অবদানের অধিকারী। তার লেখা গানগুলি কাকলি, কয়েকটি গান ও গীতগুঞ্জ – এই তিনটি বইয়ে সংকলিত হয়েছে। তার গানগুলিকে কয়েকটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে। যথা –

রাগাশ্রয়ী গান :- বাণী, কাব্য, ছন্দ ও সুরের চলন গানের এই বিভিন্ন অঙ্গের সাথে সামঞ্জস্য ও সঙ্গতি রেখে রাগ মিশ্রণের কারণে তার সৃষ্ট রাগাশ্রয়ী গানগুলি অনন্য সাধারণ হয়ে উঠেছে। ‘ডাকে কোয়েলা বারে বারে’ (গৌড় মল্লার), ‘মুরলী কাঁদে রাধে রাধে’ (আশাবরি) এবং মিশ্র রাগে বাঁধা ‘কে আবার বাজায় বাঁশি’, ‘যাবনা যাবনা যাবনা ঘরে’, ‘সে ডাকে আমারে’, ‘আমার বাগানে কত ফুল’ ইত্যাদি বহু রসোত্তীর্ণ গান অতুলপ্রসাদ বাঙালি শ্রোতাদের উপহার দিয়েছেন।

গজল :- বাংলা ভাষায় গজল রচনায় তিনি ছিলেন পথিকৃৎ। ‘কে গো তুমি বিরহিনী’, ‘জল বলে চল’, ‘কত গান তো হলো গাওয়া’, ‘তব অন্তর এত মন্থর’ প্রভৃতি গান এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য।

টপ্পা ও ঠুংরি :- লখনৌয়ে থাকার ফলে তার টপ্পা ও ঠুংরি রচনাগুলিতে উত্তর প্রদেশের কাজরি ও লগনী গানের প্রভাব পড়েছে। ‘তবু তোমারে ডাকি বারে বারে’, ‘কে যেন আমারে বারে বারে চায়’, কাঙ্গাল বলিয়া করিও না হেলা’ ইত্যাদি গানে সার্থক টপ্পার প্রয়োগ ঘটেছে। পিলু রাগিনী আশ্রিত ‘ওগো আমার নবীন সাথী’ প্রভৃতি গান অতুলপ্রসাদ রচিত রসসিদ্ধ ঠুংরির উদাহরণ।

স্বদেশ সংগীত :- অতুলপ্রসাদের লেখা বহু স্বদেশী সংগীত চূড়ান্ত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। এর মধ্যে ‘উঠো গো ভারত লক্ষ্মী’, ‘বল বল বল সবে’, ‘হও ধর্মেতে ধীর’, ‘ভারত ভানু কোথায় লুকালে’ ইত্যাদি গান এখনো সমান জনপ্রিয়।

ঋতু সংগীত :- তার বহু গানে প্রকৃতি ও বিভিন্ন ঋতুর সার্থক চিত্রায়ণ রয়েছে। যেমন – মল্লার রাগে ‘বঁধুয়া নিন্দ নেহি আঁখি পাতে’ গানে বর্ষার চিত্র পাওয়া যায়। বাহার রাগে ‘আইলো আজি বসন্ত মরি মরি’ কিংবা পিলু রাগের আশ্রয়ে ‘বন দেখে মোর মনের পাখি ডাকলো গো’ গানগুলি বসন্ত ঋতুর আহ্বানে যথার্থই ঋতু সংগীত হয়ে উঠেছে।

বিবিধ গান :- অতুলপ্রসাদ বাউল, কীর্তন, রামপ্রসাদী, ভাটিয়ালি প্রভৃতি দেশীয় সুরে অনেক চমৎকার গান রচনা করেছিলেন। তার লেখা বাউলাঙ্গ-কীর্তনাঙ্গ গানগুলির মধ্যে ‘ওগো সাথী মম সাথী’, ‘আমার চোখ বেঁধে ভবের খেলায়’, ‘যদি তোর হৃদযমুনা’ ইত্যাদি বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

শেষ কথা :- অতুলপ্রসাদী গান গেয়ে যারা বিখ্যাত হয়েছেন তাদের মধ্যে রেনুকা দাসগুপ্ত, কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায়, সবিতাব্রত দত্ত বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখেন।

Leave a Comment