বসন্তের কোকিল: প্রবন্ধ (প্রশ্ন ও উত্তর)

বসন্তের কোকিল প্রবন্ধ হতে প্রশ্ন ও উত্তর নিম্নে দেওয়া হল। B.A.(General) in Bengali.

প্রবন্ধবসন্তের কোকিল
গ্রন্থ কমলাকান্তের দপ্তর
রচনা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যা
প্রকাশিত বঙ্গদর্শন পত্রিকা
বসন্তের কোকিল

Table of Contents

বসন্তের কোকিল প্রবন্ধ হতে প্রশ্ন ও উত্তর

Bengali B.A.(General) প্রবন্ধ বসন্তের কোকিল হতে প্রশ্ন ও উত্তর।


প্রবন্ধ বসন্তের কোকিল হতে প্রশ্ন মান – ২

১। ‘বসন্তের কোকিল’ কোন গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত ? এটি কী জাতীয় রচনা ?

‘কমলাকান্তের দপ্তর’ গ্রন্থের অন্তর্গত। এটি রম্যরচনা।

২। ‘বসন্তের কোকিল’ কবে কোন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়?

১২৮০ বঙ্গাব্দে ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায়।

৩। ‘বসন্তের কোকিল’ কমলাকান্তের দপ্তর গ্রন্থের কত সংখ্যক রচনা? এতে কটি অনুচ্ছেদ আছে ?

সপ্তম সংখ্যক রচনা। এটিতে নয়টি অনুচ্ছেদ আছে।

৪। “রাগ করিও না তোমার মতো আমাদের মাঝখানে অনেক আছেন” – বক্তা কে? কথাটির তাৎপয কী?

  • ‘বসন্তের কোকিল’ প্রবন্ধের অন্তর্গত কমলাকান্ত রূপী বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আলোচ্য অংশটির বক্তা।
  • আলোচ্য অংশে প্রাবন্ধিক ইঙ্গিত করেছেন সমাজের স্বার্থপর, সুবিধাবাদী, বিলাস প্রিয়, আরাম প্রিয় মানুষদের যারা দুঃখের সময় পাশে দাঁড়ায় না কিন্তু সুখের সময় ভাগ নিতে আসে।

৫। ‘বসন্তের কোকিল’ রচনায় কোন জমিদারের উল্লেখ আছে? কখন কেন তাঁর কুঞ্জ মানুষ কোকিলে ভরে ওঠে ?

  • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘বসন্তের কোকিল’ রচনায় জমিদার নসিবাবুর উল্লেখ আছে।
  • তালুকের খাজনা জমা পড়বার সময় নসিবাবুর কুঞ্জ মানুষ কোকিলে ভরে ওঠে। সেই সময় অর্থাগমের জন্য খানা-পিনা, নাচ-গান, আমোদ – প্রমোদ সবই হয় – এই সব উপভোগ করতে মানুষ কোকিলরা ভিড় করে।

৬। কোন দিন নসিবাবুর কাছে একটিও লোক পাওয়া যায়নি এবং কেন?

  • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘বসন্তের কোকিল’ প্রবন্ধে বর্ণিত যে দিন অবিশ্রান্ত বৃষ্টি হচ্ছিল এবং নসিবাবুর পুত্রের অকাল মৃত্যু ঘটলো সেদিন তিনি একটি লোককেও পাশে পেলেন না।
  • নসিবাবুর পুত্র যেদিন মারা গেল আসলে সেটা ছিল দুঃখের দিন তার সংসরে সেদিন বর্ষার মতোই দুর্যোগ উপস্থিত হয়েছিল। তাই সুদিনের বন্ধুরা কেউ আসেনি।

৭। নসিবাবুর বিপদের দিন যারা আসতে পারেনি তারা কি কি অজুহাত দিয়েছিল ?

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘বসন্তের কোকিল’ প্রবন্ধে বর্ণিত নসিবাবুর বিপদের দিন যারা আসতে পারে নি তারা বিভিন্ন অজুহাত দিয়েছিল। কেউ অসুখের জন্য, কেউ সুখের জন্য, কারোর রাত্রে ঘুম হয়নি বলে, কারোর বা ঘুম বেশি হয়েছিল বলে আসতে পারে নি।

৮। “তখন মানুষ কোকিল তাহার সঙ্গে পিঁপিড়ার সারি দেয়।” – এখানে কার কোন সময়ের কথা বলা হয়েছে ? কার সাথে পিঁপিড়ার সারির মতো মানুষ কোকিল চলে?

  • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘বসন্তের কোকিল’ প্রবন্ধের আলোচ্য অংশে জমিদার নসিবাবুর বাড়িতে তালুকের খাজনা আসার সময়ের কথা বলা হয়েছে।
  • তালুকের খাজনা আসার পর নসিবাবু বাগানে বেড়াতে গেলে সুদিনের বন্ধু তথা বসন্তের কোকিলরা পিঁপড়ার সারির মতো তার সঙ্গে চলতে থাকে।

৯। “সেদিন বর্ষা বসন্ত নহে, বসন্তের কোকিল সেদিন আসিবে কেন?” – কোন দিনের কথা বলা হয়েছে ? বসন্তের কোকিলরা সেদিন আসেনি কেন ?

  • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘বসন্তের কোকিল’ প্রবন্ধে বর্ণিত যে দিন অবিশ্রান্ত বৃষ্টি হচ্ছিল এবং নসিবাবুর পুত্রের অকাল মৃত্যু ঘটলো সেদিন তিনি একটি লোককেও পাশে পেলেন না।
  • নসিবাবুর পুত্র যেদিন মারা গেল আসলে সেটা ছিল দুঃখের দিন তার সংসরে সেদিন বর্ষার মতোই দুর্যোগ উপস্থিত হয়েছিল। তাই সুদিনের বন্ধুরা কেউ আসেনি।

১০। “তখন কোথায় থাকো বাপু”- ‘বাপু’ কাকে বলা হয়েছে ? প্রাবন্ধিক এখানে কী প্রশ্ন তুলেছেন ?

  • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘বসন্তের কোকিল’ প্রবন্ধের আলোচ্য অংশে বসন্তের কোকিলকে ‘বাপু’ বলা হয়েছে।
  • শীত, বর্ষার সময় অর্থাৎ দুঃখের দিনে কোকিলরা কোথায় থাকে? – প্রাবন্ধিক সেই প্রশ্নই করেছেন।

১১। “তুমি বসন্তের কোকিল, শীত-বর্ষার কেহ নও” – এখানে শীত, বর্ষা ও বসন্ত বলতে কোন সময়কে বোঝানো হয়েছে?

  • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘বসন্তের কোকিল’ প্রবন্ধের আলোচ্য অংশে ‘শীত’ বলতে দুঃখময় সময়কে বোঝানো হয়েছে। শীতে যেমন প্রকৃতি নিঃস্ব হয়ে যায়, মানুষের সংসারেও তেমনি প্রিয়জন হারানোর সময় আসে। সেই অবস্থাকে এখানে শীতের সাথে তুলনা করা হয়েছে।
  • ‘বর্ষা’ প্রকৃতির মধ্যে লাবণ্য দানকারী ঋতু হলেও এই সময় বন্যা সহ নানা অসুখকর অবস্থার সৃষ্টি হয়ে থাকে। সেই রকম সংসারের অবস্থাকে আলোচ্য অংশে বর্ষার সাথে তুলনা করা হয়েছে।
  • আলোচ্য অংশে বসন্ত বলতে সুখকর ও আনন্দময় সময়কে বোঝানো হয়েছে।

১২। “ওই অশোকের ডালে বসিয়া কু-উ বলিয়া ডাকো” – এখানে অশোক গাছের প্রসঙ্গ তোলার কারণ কী? অশোক গাছের ডালে বসা কোকিলকে কিসের সাথে তুলনা করা হয়েছে ?

  • অশোক নামের মধ্যেই রয়েছে শোকহীনতার কথা। বসন্তকালে এই ফুল ফোটে। আর সেই শোকহীন আনন্দময় ফুলের গালে বসে বসন্তের কোকিল ডাকে। তাই প্রাবন্ধিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘বসন্তের কোকিল’ প্রবন্ধে অশোক গাছের প্রসঙ্গ এনেছেন।
  • আলোচ্য প্রবন্ধে অশোক গাছের ডালে বসা কোকিলকে জ্বলন্ত আগুনের মধ্যগত বেগুনের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।

১৩। “জ্বলন্ত আগুনের মধ্যগত কালো বেগুনের মতো লুকাইয়া রাখিয়া” – অংশটির অর্থ কী?

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অপূর্ব দক্ষতার সঙ্গে ভাবাবেগময় রচনার মধ্যে এরূপ অদ্ভুত একটি উপমা প্রয়োগ করেছেন। জ্বলন্ত আগুন অতিরিক্ত মাত্রায় রক্ত বর্ণ আর সেখানে ঘন বর্ণের বেগুন বৈপরীত্যটি উপভোগ্য ও অতুলনীয়।

১৪। গলা বাজিতে জিতে পার্লামেন্টে স্থান হয় – এমন দুজনের নাম উল্লেখ করে পরিচয় দাও।

  • গলাবাজিতে জিতে পারলামেন্টে স্থান করে নিয়েছেন এমন দুজন হলেন গ্লাডস্টোন এবং ডিসরেলি।
  • গ্লাডস্টোন এবং ডিসরেলি দুজনই ইংল্যাণ্ডের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ এবং প্রসিদ্ধ বক্তা ছিলেন। দুজনেই ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীও হয়েছিলেন। ডিসরেলি আবার কূটনীতিক হিসেবেও খ্যাত ছিলেন। 

১৫। গলাবাজি তথা পঞ্চমস্বর নেই বলে কোন বিখ্যাত দার্শনিক পার্লামেন্টে স্থান পাননি?  তার পরিচয় দাও।

  • গলাবাজি তথা পঞ্চমস্বর নেই বলে বিখ্যাত দার্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিল পার্লামেন্টে স্থান পাননি।
  • জন স্টুয়াট মিল ছিলেন ইংল্যান্ডের এক প্রসিদ্ধ দার্শনিক এবং বুদ্ধিজীবী। তিনি কিছু মূল্যবাণ গ্রন্থও রচনা করেছিলেন।

১৬। “তোমার চেয়ে হড়িচাচা ভালো” – কে কাকে বলেছে ? হড়িচাচা কি?

  • ‘বসন্তের কোকিল’ প্রবন্ধে কমলাকান্ত রূপী বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আলোচ্য কথটি বলেছেন বসন্তের কোকিলকে।
  • হাড়িচাচা একশ্রেণীর পাখি। এরা দেখতে সুন্দর হলেও কণ্ঠস্বর ভালো নয়। হাড়ি চাঁচলে যেমন শব্দ হয় তেমনি কণ্ঠস্বর, তাই এরকম নাম।

১৭। “দুইটি পঞ্চম মিষ্ট বটে” – দুটি পঞ্চম কী? দুটি পঞ্চম কী কী? গুজরি পঞ্চম কী?

  • ‘বসন্তের কোকিল’ প্রবন্ধে কমলাকান্ত রূপী বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সুরের পঞ্চম এবং আলতা পরা ছোটো মেয়ের গুজরি পঞ্চমকে মিস্টি বলেছন।
  • গুজরি পঞ্চম হল একপ্রকার পদাভরণের ধ্বনি। মেয়েদের চলার সময় এই অলংকারের মধুর শব্দ শোনা যায়।

১৮। “স্যার জেমস মাকিটস তাহার বক্তৃতায় ফিলজফির কড়িমধ্যম মিশাইয়া হারাইয়া গেলেন, আর মেকলে রেটরিকের পঞম লাগাইয়া জিতিয়া গেলেন” – মাকিটস ও মেকলের পরিচয় দাও।

  • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘বসন্তের কেকিল’ প্রবন্ধে উল্লেখিত মাকিনটস হলেন ইংরেজ দার্শনিক ও সমাজবিজ্ঞানী।
  • অন্যদিকে মেকলে হলেন কবি, প্রাবন্ধিক ও ইতিহাসবিদ। ভাষার গুণে তিনি জনপ্রিয় লেখকও হন।

১৯। ‘ওইটি তোমার জিত” –ওইটি কী ? মানুষ কোকিলদের কোন বিশেষত্বকে পঞ্চমস্বর বলা হয়েছে ?

  • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘বসন্তের কোকিল’ প্রবন্ধের আলোচ্য অংশে ‘ওইটি’ বলতে পঞ্চম স্বরকে বোঝানো হয়েছে।
  • আলোচ্য অংশে মানুষ কোকিলদের গলাবাজি তথা বাক্ সর্বস্বতাকে পঞ্চমস্বর বলা হয়েছে।

২০। “তখন তুমি আসিয়া রসিকতা আরম্ভ কর” – কে কাকে এই কথা বলেছেন? সে কখন এসে কী ভাবে রসিকতা আরম্ভ করে?

  • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘বসন্তের কোকিল’ প্রবন্ধে কমলাকান্ত চক্রবর্তী আলোচ্য কথাটি বসন্তের কোকিলের উদ্দেশ্যে বলেছেন।
  • প্রকৃতিতে যখন চারিদিকে আনন্দের হিল্লোল বইতে থাকে, শীতের সদ্য দুঃখ ভোগ শেষ করে যখন নতুন পাতায় নতুন করে সেজে ওঠে পর্ণমোচী সেই সুখের সময়, সেই বসন্তকালে কোকিল এসে বলে ‘কু-উ’। সুন্দরের ওপর তার এই কটাক্ষপাতী উচ্চারণ। সমস্ত সুখের মধ্যে, সমৃদ্ধির মধ্যে সে কেবল কু উচ্চারণ করে রসিকতা করতে থাকে। এছাড়াও সুখের সময় মানুষের মনে বিরহের ভাব জাগিয়ে তুলে বসন্তের কোকিল রসিকতা আরম্ভ করে থাকে।

প্রবন্ধ বসন্তের কোকিল হতে প্রশ্ন মান – ৫

১। “আসল কথা, সেদিন বর্ষা, বসন্ত নহে” – প্রসঙ্গ সহ ব্যাখ্যা লেখো।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘বসন্তের কোকিল’ প্রবন্ধে বর্ণিত জমিদার নসিবাবুর পুত্রের মৃত্যু দিন প্রসঙ্গে আলোচ্য অংশটির অরতারণা করা হয়েছে।

বসন্তের কোকিল বলতে কোকিল রূপী আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপর মানুষদের বোঝানো হয়েছে। কোকিলের আবির্ভাব সময় হল বসন্তের আনন্দময় পরিবেশ। কোকিল সুখের পাখি, দুঃখের নয়। আমাদের চতুর্দিকের পরিচিত প্রতিবেশীরা অধিকাংশই বসন্তের কোকিল। দুর্দিনে, অসময়ে তাদের প্রসারিত বাহুর সন্ধান পাওয়া যায় না। অথচ এরাই সুসময়ে, সুখের দিনে সম্পদের চর্তুদিকে ভিড় করে থাকে।

কোকিল যেমন আনন্দময় বসন্তের পরিবেশ ছাড়া শীত বা গ্ৰীষ্মের দুঃখময় পরিবেশে আবির্ভূত হয়না তেমনি সমাজের এক শ্রেণীর মানুষ অন্যের সুখের সময় নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য উপস্থিত হয় বন্ধুরূপে। তাদের এই লজ্জাহীন উপস্থিতি মানুষত্ব বোধ সম্পন্ন ভাষা প্রাবন্ধিককে পীড়ন করেছে। আর তারই ক্ষুব্ধ অভিমানি কণ্ঠ ভাষা পেয়েছে এই উক্তির মধ্যে।

২। “যে সুন্দর, তাকেই ডাকি; যে ভালো, তাকেই ডাকি” – প্রসঙ্গ সহ ব্যাখ্যা লেখো।

কমলাকান্তের দপ্তর গ্রন্থের অন্তর্গত বসন্তের কোকিল প্রবন্ধ থেকে গৃহীত উদ্ধৃত উক্তিটিতে সাহিত্যতত্ত্ব সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্র তার অনুভূতি এবং বিশ্ব জগৎ সম্পর্কে এক ব্যাপ্ত বিস্ময়বোধ প্রকাশ করেছেন।

কোকিলের কণ্ঠ থেকে উৎসারিত সঙ্গীত এবং কবির সৃষ্টিকর্ম দুইয়েরই উদ্ভব অহেতুক আনন্দ থেকে। সব কিছুই আনন্দ থেকে উৎপন্ন এবং আনন্দের দিকেই তার গতি। এই বিশ্বজগতও বিধাতার এক আনন্দময় মহালীলা। ঋষি বঙ্কিম সেই অনুভবই এখানে প্রকাশ করেছেন।

বিশ্বজগতে অপরিমেয় আনন্দের সঙ্গে মিশে আছে অপার রহস্য। বিধাতার রহস্যময় আনন্দ লীলা আমাদের আরা জীবনের অনুধ্যানের বিষয়। আমাদের সমস্ত কর্ম, সৃষ্টি, চেতনা সেই লীলা জগতের অঞ্জলি বহন করছে। অহেতুক আনন্দ থেকে যে সাহিত্যকর্ম বা কোকিলের সুগীত সৃষ্টি তা সর্ব শব্দগ্রাহী বিধাতা-শিশুর কানে ধরা পড়বেই। বিধাতা ভুবন ব্যাপ্ত হয়ে আছেন, আমাদের ডাক সেখানে অবশ্যই পৌঁছাবে। এই কারণেই সুন্দরকে কমলাকান্ত রূপী বঙ্কিমচন্দ্র আহ্বান করেছেন।

৩। “তুইও যে, আমিও সে – সমান দুঃখের দুখী সমান সুখের সুখী” – এখানে তুই এবং আমি কে কে ? তারা সমান সুখের সুখী বা দুঃখী কেন?

‘কমলাকান্তের দপ্তর’ গ্রন্থের অন্তর্গত ‘বসন্তের কোকিল’ প্রবন্ধের উদ্ধৃত অংশে ‘তুই’ বলতে বসন্তের কোকিলকে এবং ‘আমি’ বলতে প্রাবন্ধিক বঙ্কিমচন্দ্র নিজেকে বুঝিয়েছেন।

আলোচ্য অংশে কমলাকান্ত কোকিলের স্বভাবধর্মের সাথে নিজেকে একান্ত করে নিয়ে প্রীতির বাঁধনে বন্দি করেছেন। কারণ দুজনের কাজ ও লক্ষ্য একই। কোকিল যেমন পুষ্পকাননে গাছে গাছে আনন্দে গেয়ে বেড়ায়, কমলাকান্তও সেরূপ সংসার অরণ্যে গৃহে গৃহে আনন্দের দপ্তর লিখে বেড়ায়। দুজনেই সহায় সম্বলহীন পরান্নে প্রতিপালিত। কোকিলের আনন্দের মাধ্যম গলা আর কমলাকান্তের আনন্দের মাধ্যম আফিমের ডেলা।

প্রকৃতপক্ষে কমলাকান্ত রূপী বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নিজেকে কোকিলের সঙ্গে অভিন্ন সূত্রে গ্রথিত করে জীবন রহস্যের সন্ধান পেতে চেয়েছেন, প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য্যকে। তাই কোকিলকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেছেন, “এখন আই, পাখি! তোতে আমাতে একবার পঞ্চম গাই। তুইও যে, আমিও সে – সমান দুঃখের দুঃখী, সমান সুখের সুখী।”

৪। “ওইটি তোমার জিত, ওই পঞ্চম স্বর” – আলোচ্য অংশটির তাৎপর্য লেখো।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘বসন্তের কোকিল’ প্রবন্ধ থেকে গৃহীত আলোচ্য অংশে বসন্তের কোকিলের কথা বলা হয়েছে।

বসন্তের কোকিল মধুর পঞ্চম স্বরে গান গায়। সুবিধাবাদী কালো কোকিলের ডাক কেউও শুনতো না, যদি না তার পঞ্চমস্বর থাকত। মধুর গলাবাজির গুনেই গ্লাডস্টোন, ডিসরেলি প্রমুখ বাজে উপন্যাস লিখেও রাজমন্ত্রী হয়েছেন। অর্থাৎ পৃথিবীতে কিছু মানুষ কোকিলের মতোই মধুর গলাবাজির জন্য জিতে গেছে।

তবে কোকিল কেবল চেঁচিয়ে চিত্ত জয় করে না, তার স্বরে পঞ্চম আছে। স্যার জেমস মাকিনটস তার বক্তৃতায় কড়ি মধ্যম লাগিয়ে হেরে যায় অন্যদিকে মেকলে পঞ্চম লাগিয়ে জিতে যান। ভারতচন্দ্র আদিরস পঞ্চম ধরে জিতেছেন। তাই কবি কঙ্কণের ঋষভ স্বর শোনার কেউ থাকেনি।

এই ভাবে কোকিলের কুহু স্বরের মাধুর্য্য ব্যাখ্যা করেছেন কমলাকান্ত রূপী বঙ্কিমচন্দ্র, আর তাকে মানব জীবন ও জগতের সঙ্গে যুক্ত করে বৃহত্তর তাৎপর্য দিয়েছেন।

৫। “তুমি বসন্তের কোকিল, শীত বর্ষার কেহ নও।” – কাদের ‘বসন্তের কোকিল’ বলা হয়েছে? কোকিলকে বসন্তের কোকিল বলা হয় কেন?

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘বসন্তের কোকিল’ প্রবন্ধ থেকে আলোচ্য অংশটি নেওয়া হয়েছে।

আলোচা অংশে, আমাদের সমাজ সংসারে যে সমস্ত ব্যক্তিকে ‘সুদিনের বন্ধু’ রূপে চিহ্নিত করা হয় তাদেরই ‘বসন্তের কোকিল’ নামে অভিহিত করা হয়েছে।

কোকিল আমাদের দেশীয় পাখি হলেও সারা বছর তাদের দেখা পাওয়া যায় না, একমাত্র বসন্তকালেই তাদের অস্তিত্ব অনুভূত হয়। তখনই তাদের সুমধুর পঞ্চম স্বরে ধ্বনিত ‘কু-উ’ সঙ্গীতে জগৎ মোহিত হয়। বসন্তকাল সর্বাধিক উপভোগ্য কাল। তখন শীতের প্রখরতা, গ্রীষ্মের প্রবলতা কিংবা বর্ষার উপদ্রব থাকে না। প্রকৃতিও তখন মনোহর সাজে সজ্জিত হয়। এই সুদিনেই শুধু কোকিলের দেখা পাওয়া যায়।

যখন প্রচণ্ড শীতের প্রবল প্রতাপে মানুষ থরহরি কম্পমান হয়, অথবা প্রচণ্ড বর্ষায় যখন অপর পাখিদের দুর্দশার আর সীমা থাকে না, তখন কিন্তু কোকিলের কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া যায় না। কাজেই কোকিল যে সুদিনের অর্থাৎ, বসন্তেরই কোকিল, দুর্দিনের অর্থাৎ, শীতের বা বর্ষার কেউ নয়’ – এই কথাটি যথার্থ। অবশ্য কোকিলের এই স্বভাব শুধু আমাদের দেশে নয়, সম্ভবত সমস্ত পৃথিবীতে একই রকম।

৬। “আসল কথা, সেদিন বর্ষা, বসন্ত নহে, বসন্তের কোকিল সেদিন আসিবে কেন?” – বসন্তের কোকিল’ কথাটির তাৎপর্য কী? বসন্তের কোকিলরূপী মানুষের চরিত্রের কোনদিক লেখক প্রকাশ করেছেন?

কোকিলের দেখা পাওয়া যায় শুধু বসন্তকালেই, যে সময় প্রকৃতি সর্বাধিক উপভোগ্য বিবেচিত হয়। যখন শীতে সকলেই থরহরি কম্পমান হয়, কিংবা বর্ষায় দুর্ভোগের একশেষ ঘটে, তখন কোকিলের দেখা পাওয়া যায় না, তাই কোকিলকে বলা হয় ‘বসন্তের কোকিল’, যার তাৎপর্য হল সুদিনের বন্ধু।

কমলাকান্ত মানুষের মধ্যেও এরূপ অনেক সুদিনের বন্ধু দেখেছেন। নসীবাবুর যখন সুদিন, যখন তার তোষাখানায় প্রচুর অর্থ আমদানি হয়, তখন তার বন্ধুবান্ধবের অভাব হয় না, নানা ধরনের প্রার্থীর আনাগোনায় তার বৈঠকখানায় সারাক্ষণ ভিড় লেগেই থাকে। তারপর এক দুর্যোগময়ী বর্ষা রজনীতে হঠাৎ নসীবাবুর পুত্রটি অকালে প্রাণত্যাগ করে। সেদিন কিন্তু নসীবাবুর সুদিনের বন্ধুদের কারো সাক্ষাৎ পাওয়া গেল না।

তারা সবাই এমন সমস্ত কৈফিয়ত দিলেন, সেগুলি পরস্পরবিরোধী এবং কোনটিই যুক্তিগ্রাহ্য নয়। কেউ অসুস্থতার ভান করলেন, কেউ বা তার অতিসুখের অজুহাত দেখালেন তার একটি নাতি হয়েছে, তিনি ঘরে বসে সেই সুখ অনুভব করছেন। আবার কেউ সারারাত্রি অনিদ্রায় ভুগছেন বলে আসতে পারলেন না, যেন না গেলেই ঘুম হবে ইত্যাদি। আসলে এগুলি কোনটিই যুক্তিসঙ্গত কারণ নয়, আসল কারণ হল সেদিন ছিল বর্ষারজনী, বসন্তের সুখের দিন নয়। সেইজন্যই যাঁরা ছিলেন সুদিনের বন্ধু, তারা নসীবাবুর দুর্দিনে সাড়া দিলেন না। এরা সকলেই আসলে ‘বসন্তের কোকিল’।

৭। “সেই বকুলকুঞ্জ হইতে ডাকিত, এ ‘কু-উ’।” – উদ্ধৃতিটির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো।

আলোচ্য অংশটি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘বসন্তের কোকিল’ নামক প্রবন্ধ থেকে নেওয়া হয়েছে। আফিংখোর কমলাকান্ত কোকিলকে শুধু বসন্তের কোকিল’ অর্থাৎ, সুদিনের বন্ধুরূপেই নিন্দিত করেননি, তাকে বিশ্বনিন্দুক বলে অভিহিত করেছেন। কোকিল নিজে কালো এবং পরান্নপ্রতিপালিত – এই দুই কারণেই সে কোনো ভাল জিনিস, সুন্দর সামগ্রীকে সহ্য করতে পারে না, সর্বাবস্থাতেই তার কণ্ঠ থেকে একটিমাত্র ধ্বনিই নির্গত হয় ‘কু-উ’ অর্থাৎ, সবই ‘কু’ কিছুই ভালো নয়। তিনি আলোচ্য অংশে এরূপ একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করেছেন।

একজাতীয় মানুষ আছে, যারা সৌন্দর্যবিলাসী, মাধুর্যপিয়াসী। কিন্তু এর জন্য তাদের অপরের অনুগ্রহের উপর নির্ভর করতে হয়। সেই পরসাহায্যপ্রাপ্ত সৌন্দর্যে বিভোর হয়ে পরম আস্বাদ্য মাধুর্যরসে সিঞ্চিত হয়ে মনের আনন্দে যখন মনের কথাটি মুখের ভাষায় ব্যক্ত করে, তখন কিন্তু তা উপকারীর নিন্দাবাদে পরিণত হয়। এই জাতীয় মানুষরা শুধু নিন্দুকই নয়, উপকারীর ঋণকেও অস্বীকার করে। সুতরাং এরা কৃতঘ্নও বটে।

কমলাকান্ত এই জাতীয় মানুষের স্বভাব কোকিলের মধ্যেও দেখতে পেয়েছেন বলেই এদের বসন্তের কোকিল বলে মনে করেন। আলোচ্য অংশটিতে লেখক কোকিলের সেই পরনিন্দুক অকৃতজ্ঞ স্বভাবের একটি অপূর্বসুন্দর চিত্র অঙ্কন করেছেন।

বকুলগাছ অতি ঘনবিন্যস্ত গাঢ় সবুজ স্নিগ্ধোজ্জ্বল পত্ররাজিতে শোভিত থাকে। যখন শ্বেত পুষ্পরাজি শোভা পায়, তখন সেই বকুলের রূপ হয় পূর্ণযৌবনা লাবণ্যময়ী নারীর মতো। নারী এই কালটিতে পূর্ণ প্রস্ফুটিত হয়ে উঠে বলেই তার সৌন্দর্য-মাধুর্যে বহুজন আকৃষ্ট হয়ে থাকে। কোকিলও বকুলের সৌন্দর্যে আর সুগন্ধে আকৃষ্ট হয়ে তার শাখায় পত্রের আড়ালে বসিয়া এই সৌন্দর্য, মাধুর্য ও সৌরভে নিজের দেহ-মনকে সুরভিত করে তোলে। পাতার স্পর্শে দেহকে শীতল করে, বকুলের গন্ধে পবিত্র করে যখন সে মনের ভাব তার পঞ্চম সুরে প্রকাশ করে, তখন সেই শব্দটি হলো ‘কু-উ’ অর্থাৎ, ‘কু’। সকলেই ‘কু’, যার স্পর্শে দেহ মন শীতল হল, পবিত্র হল তাও ‘কু’ – এরাই জগৎ সংসারের পরনিন্দুক, ঈর্ষাজর্জর, অকৃতজ্ঞ মানুষ।

৮। “হেস্টিংস পর্যন্ত সকলেই কাঁপিয়া উঠুক।” – উদ্ধৃত উক্তিটি কে করেছেন? ‘সিংহাসন হইতে হেস্টিংস পর্যন্ত সকলেই কাঁপিয়া উঠুক’ বলতে লেখক কী বুঝিয়েছেন তা লেখো।

বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ গ্রন্থের ‘বসন্তের কোকিল’ নামক প্রবন্ধে আফিংখোর কমলাকান্তের জবানিতে এই উক্তিটি করেছেন।

‘বসন্তের কোকিল’ প্রবন্ধে কমলাকান্ত প্রথমে কোকিলকে ‘সুদিনের বন্ধু’ রূপে অভিহিত করেন। পরে তার মনে হয় কোকিলের মতো বিশ্বনিন্দুক এবং পরশ্রীকাতর আর কেউ নেই – তার দৃষ্টিতে সবকিছুই ‘কু’ বলে মনে হয়। কিন্তু তার কন্ঠ শুনে সকলেই মুগ্ধ হয়, তার একমাত্র কারণ তার মধুর কণ্ঠের পঞ্চম সুর। বস্তুত গলাবাজিতেই এখন জগৎ বশ।

এর পরই হঠাৎ কমলাকান্তের মনোভাবের পরিবর্তন ঘটে। তাঁর মনে হয়, এই ‘কু’ ধ্বনির মধ্যেও যেন সত্য রয়েছে। আলোচ্য অংশটিতে এই পরিবর্তিত মনোভাবের পরিচয়ই পাওয়া যায়। প্রসঙ্গটা এসেছিল ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে ডিসরেলি-গ্লাডস্টোনের প্রধানমন্ত্রীত্ব লাভ এবং জন স্টুয়ার্ট মিলের সদস্যপদ লাভেও ব্যর্থতায়।

কোকিলের পঞ্চম সুরে ধ্বনিত ‘কু’ মানুষ কান পেতে শোনে। আবার গলাবাজির জোরে ডিসরেলি, গ্লাডস্টোনরা ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীত্ব লাভ করেছিলেন। ইংল্যান্ডের অপর এক বাগ্মী এডমন্ড বার্ক ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেলের নানাবিধ দুষ্কর্মের জন্য তার বিরুদ্ধে পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে যে আবেগময় এবং ক্রোধোদীপ্ত ভাষণ দিয়েছিলেন, তাতে রাজসিংহাসন থেকে আরম্ভ করে অত্যাচারী হেস্টিংস পর্যন্ত সকলেই কেঁপে উঠেছিল। মধুর গলাবাজির এতই মহিমা।

তাই কমলাকান্তও কোকিলকে অনুরোধ করেছেন, কোকিলও যেন তার অমৃতমধুর কণ্ঠে উন্মুক্ত আকাশতলে দাঁড়িয়ে সমস্ত পৃথিবীবাসীকে উদ্দেশ্য করে তাদের যাবতীয় অত্যাচারকে ‘কু’ বলে অভিহিত করতে পারে। তাহলেই কমলাকান্তের আশা জগৎবাসীরা ভয়ে কেঁপে উঠে হয়তো বা তাদের দুষ্কর্ম থেকে বিরত থাকতে পারে। এখানে কমলাকান্তের কোকিলের প্রতি সহমর্মিতাই প্রকাশ পেয়েছে।

৯। “স্যার জেমস্ ম্যাকিন্টশ তাহার বক্তৃতায় ফিলজফির কড়িমধ্যম মিশাইয়া হারিয়া গেলেন – মেকলে রেটরিকের পঞ্চম লাগাইয়া জিতিয়া গেলেন। ভারতচন্দ্র আদিরসে পঞ্চম ধরিয়া জিতিয়া গিয়াছেন – কবিকঙ্কণের ঋষভস্বর কে শোনে?” – উদ্ধৃতিটির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো।

আলোচ্য অংশটি বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ গ্রন্থের ‘বসন্তের কোকিল’ নামক প্রবন্ধ থেকে গৃহীত হয়েছে। আফিংখোর কমলাকান্তের জবানিতে লেখক এখানে কোকিলকে বিশ্বনিন্দুকরূপে অভিহিত করে বলেছেন যে, সে পৃথিবীর যাবতীয় রূপ, সুখ, পবিত্রতার মধ্যেও কেবল ‘কু’-ই দেখতে পায়। ‘কু’ ছাড়া তার কোনো ধ্বনি নেই।

তবু কোকিলের ‘কু’-ধ্বনি সর্বজনের মনোহরণে সক্ষম, তার একমাত্র কারণ, তাঁর পঞ্চম স্বর। এই পঞ্চম স্বরের মাধুর্যই সর্বদোষবিনাশক। এই সমাজসংসারেরও এইটিই নিয়ম। সব সময় শুধু গলাবাজিতেও কাজ হয় না, তার সঙ্গে পঞ্চম স্বরটিও মেশাতে হয়। হাঁড়িচাচা পাখিরূপে অন্তত কোকিলকে হার মানায়, গলার জোরও তার কম নয়, কিন্তু তার সেই হাঁড়িচাচা কর্কশ ধ্বনিতে কড়ি মধ্যমের স্পর্শ থাকতে পারে, কিন্তু পঞ্চম স্বর লাগেনি বলেই তা আর উৎরায়নি।

একইভাবে লোকসমাজেও দেখা যায়, যিনি তাঁর বক্তব্যকে সরস মধুর ভঙ্গিতে উপস্থাপিত করতে পারেন, তার কথাই লোকে কান ভরে শুনতে চায়। বক্তব্য যতই জ্ঞানগর্ভ কিংবা হিতকর হোক না কেন, বলার ভঙ্গির সুরটি যদি মধুর না হয়, তবে তা সহজে গ্রহণযোগ্য হয় না। এই বিষয়ে কমলাকান্ত কয়েকটি উদাহরণও উল্লেখ করেছেন।

উনিশ শতকে ইংল্যাণ্ডের বিশিষ্ট অধ্যাপক, ব্যবহারশাস্ত্রবিদ এবং দার্শনিক পণ্ডিত স্যার জেমস্ ম্যাকিন্টশ তাঁর বক্তব্যে দর্শনের মিশেল দিয়েছিলেন বলে তা সর্বসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেননি। পক্ষান্তরে অপর বিশিষ্ট পণ্ডিত মনীষী মেকলে তাঁর বক্তব্যকে ওজোগুণান্বিত আলঙ্কারিক ভাষায় প্রকাশ করেছিলেন বলেই তা অসাধারণ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ম্যাকিন্টশ-এর ভাষা ছিল কড়িমধ্যমের মতোই একটু কর্কশ, আর মেকলের ভঙ্গিতে ছিল পঞ্চমের মধুর স্পর্শ। আমাদের দেশীয় সাহিত্যেও তেমন দৃষ্টান্ত বিরল নয়। রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের ‘বিদ্যাসুন্দর’ কাব্যে আদিরসের পঞ্চম লেগেছিল বলেই তা অতিশয় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, পক্ষান্তরে কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর ‘চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে’ বাস্তবতার ঋষভ স্পর্শ ছিল, তাই পণ্ডিতমণ্ডলীর বাইরে জনদরবারে কখনো আদর পায়নি। বক্তব্যের বিষয়টি তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে, ভঙ্গিটিই প্রাধান্য লাভ করে। কাজেই জয় আসলে পঞ্চম স্বরেরই প্রকৃত গুণের বা বিষয় গুরুত্বের নয়। 

১০। “আয়, ভাই, তোতে আমাতে মিলে মিশে পঞ্চম গাই।” – ‘পঞ্চম গাওয়া’ বলতে লেখক কী বুঝিয়েছেন তা লেখো।

কমলাকান্ত কোকিলকে বন্ধুরূপে এবং বিশ্বনিন্দুক ও পরশ্রীকাতররূপেই প্রথমে বর্ণনা করেছেন। কোকিলের ‘কু-উ’ ধ্বনির মধ্যে তিনি উপলব্ধি করেন যে, কোকিল যেন বিশ্বের যত সুখ, যত আনন্দ, যত সঙ্গীত সমস্ত কিছুর মধ্যে শুধু ‘কু’ দেখতে পায়। তাই কমলাকান্তের মনে হয়েছিল, কোকিল বিশ্বনিন্দুক। কিন্তু কমলাকান্ত ক্রমশ যেন গুঢ়তর সত্যের সন্ধান লাভ করলেন। তাঁর মনে হল কোকিলের ‘কু’ ধ্বনির মধ্যে গভীরতর সত্য নিহিত রয়েছে।

কোকিল তো মিথ্যে বলছে না, ধরিত্রী মাতার বুকে সর্বত্রই তো চলছে অন্যায়, অসত্য, অত্যাচারের বন্যা। লতায় কণ্টক আছে, পুষ্পে আছে কীট। কোকিলের ‘কু’ ধ্বনিতে তারই বিরুদ্ধে যেন সতর্কীকরণের ঘন্টা বাজে। আসলে কোকিল প্রকৃত আনন্দের, সুন্দরেরই তো আহ্বান জানাচ্ছে। এইবার কমলাকান্ত কোকিলের সঙ্গে অনুভব করলেন নিবিড় একাত্মতাবোধ। তিনিও তো একই উদ্দেশ্যে তাঁর দপ্তর রচনা করে চলছেন।

সমাজের বুকে যেখানেই তিনি কুশ্রীতা, ভণ্ডামি, দুর্নীতি কিংবা অসত্যের ছায়া দেখতে পেয়েছেন, সেখানেই কমলাকান্ত তীব্র ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের ভাষায় তাকে বিদ্ধ করতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কেন তিনি এরূপ নিন্দামন্দের আশ্রয় নিয়েছেন? বস্তুত কোকিল আর কমলাকান্ত উভয়ের উদ্দেশ্য এক এবং অভিন্ন। তবে কোকিলের কণ্ঠে যেমন পঞ্চম সুর লাগে, কমলাকান্তও তেমনি সেই মাধুর্য কামনা করেন। উভয়েরই কণ্ঠধ্বনিতে উচ্চারিত হয় আনন্দের, সুন্দরের উপাসনা। এক হৃদয়ে, এক প্রাণে, এক তানে তারা একই ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে চলেছেন।

১১। “আমিও ডাকি, তুইও ডাকিস।” – কাকে এবং কেন উভয়ে আকুল কণ্ঠে ডাকার কথা বলা হয়েছে?

‘বসন্তের কোকিল’ প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রথমদিকে লক্ষ্য ছিল সেইসব সুদিনের বন্ধু, যাদের শুধু জীবনের বসন্ত মুহূর্তেই দেখা পাওয়া যায়, শীত-বর্ষায় উধাও হয়ে যায় এবং সেইসব পরনিন্দুকদের, যারা সব ভালো জিনিসের মধ্যেও সদা-সর্বদা শুধু ‘কু’ দেখে থাকে। পরমুহূর্তেই কমলাকান্তের মনে হয়, কোকিলের মধুররস সিঞ্চিত পঞ্চম সুরে ধ্বনিত ‘কু’ শব্দের একটা গভীরতর তাৎপর্য আছে। সত্যই তো লতায় কণ্টক আছে, পুষ্পে কীট আছে‌। এই জগতের ভালোর মধ্যেও ‘কু’ রয়েছে। তাই সতর্ক করে দেবার জন্যই যেন কোকিল ‘কু’ বলে ডাকছে।

কমলাকান্ত বিবেচনা করলেন, তিনিও তো তাঁর দপ্তরে এইভাবে কটু কথা বলে সকলকে সতর্ক করে যাচ্ছেন। অতএব উভয়েই তো একই উদ্দেশ্যে অনুপ্রাণিত হয়ে অভিন্নত্ব হয়ে গেছেন। কিন্তু বস্তুত কোকিলের পঞ্চম সুরে উচ্চারিত ‘কু-উ’ ধ্বনি কিংবা কমলাকান্তের দপ্তরের লেখা – কোনটাই পরনিন্দা নয়, কোনো এক মহত্তর উদ্দেশ্যেই তা উচ্চারিত হয়েছে। কিন্তু কার উদ্দেশ্যে, কাকে তারা এমন আকুল কণ্ঠে ডাকে। আলোচ্য অংশটিতে তার উপরই আলোকপাত করা হয়েছে।

কোকিলের সঙ্গে একাত্মতা বোধ করেই কমলাকান্ত তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন – ‘সে কাকে ডাকে? তিনি নিজেকেও জিজ্ঞাসা করেন তিনিই বা কাকে ডাকেন। প্রশ্নের উত্তরটিও তিনি নিজেই দিয়েছেন— ‘যে সুন্দর, তাকেই ডাকি; যে ভাল, তাকেই ডাকি। যে আমার ডাক শুনে, তাকেই ডাকি।’ উত্তরটি যখন পাওয়া গেল, তখনই আমরা বুঝতে পারি, যা সৎ, যা আনন্দময়, যা সুন্দর, তারই জন্য তাদের উভয়ের আকুলতা। এই সত্য, সুন্দর ও আনন্দ এদের উপলব্ধির মধ্য দিয়েই তারা অনন্ত সুন্দর জগৎ শরীরের আত্মা পরমপিতার কাছে তাদের নিবেদন পৌঁছে দেয়।

১২। “কমলাকান্তের মনের কথা, এ জন্মে বলা হইল না” – উদ্ধৃত উক্তিটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ গ্রন্থের ‘বসন্তের কোকিল’ প্রবন্ধ থেকে আলোচ্য অংশটি উদ্ধৃত হয়েছে।

প্রবন্ধটির প্রথম অংশে লেখক আফিংখোর কমলাকান্তের জবানিতে ‘বসন্তের কোকিলে’র রূপকে সমাজে যারা সুদিনের বন্ধু এবং পরনিন্দুক তাদের হালকা সুরে কিছুটা পরিহাস করে নিয়েছেন। প্রবন্ধের শেষাংশে কমলাকান্তের বক্তব্য বিষয়ে এবং বলার ভঙ্গিও সহসা অনেকটা পরিবর্তিত হয়ে যায়। ঔপন্যাসিক এবং প্রাবন্ধিক বঙ্কিমের মধ্যেও যে একটা কবি-মন এবং প্রগাঢ় অধ্যাত্মবোধ চিরজাগ্রত রয়েছে, আলোচ্য অংশটিতে তারই পরিচয় পাওয়া যায়।

কমলাকান্ত অনুভব করেছেন যে, কোকিলের কুহুধ্বনি এবং তাঁর দপ্তর একই উদ্দেশ্যে নিবেদিত। এই অনন্তসুন্দর জগৎ-শরীরের আত্মা যিনি, তারই উদ্দেশ্যে কোকিলের ডাক, কমলাকান্তেরও আকুল আহ্বান। হয়তো বা জাগতিক কোনো কলুষ বিহঙ্গ কোকিলকে স্পর্শ করতে পারেনি বলেই তার কণ্ঠ থেকে যে পঞ্চম সুর বহির্গত হয়, তা যথাস্থানে পৌঁছতে পারে। কমলাকান্তের এটিই ধারণা। কিন্তু তাঁর দুর্ভাগ্য যে তাঁর সেই কোকিল কণ্ঠ নেই বলেই তিনি পঞ্চম সুরে গাইতে পারেন না। বস্তুত তিনি আফিংখোর বলে তাঁর কোনো সুরবোধ নেই বলেই তিনি মনে করেন। তাই তাঁর ধারণা, তাঁর আকুল আহ্বান কখনো যথাস্থানে গিয়ে পৌঁছুবে না। কমলাকান্তের মনের এই কাতরতাই এখানে কবিত্বময় অনবদ্যরূপে ফুটে উঠেছে।

আলোচ্য অংশটিতে বঙ্কিমচন্দ্র ও কমলাকান্ত অভেদাত্মা হয়ে উঠেছেন। এই জীবনে যা তিনি বলে উঠতে পারলেন না মানুষী ভাষায় হয়তো বা জগৎ-আত্মার সেই রহস্য প্রকাশ করাও যায় না। তাই, তিনি কামনা করছেন, কোকিলের মতো অমানুষী ভাষা পান, তবেই হয়তো বিশ্বরহস্যের ভিতর প্রবেশ করে সেই বিশ্বাত্মাকে ডাকবার সুযোগ পাবেন। কমলাকান্তের মনের এই গভীর আকুতির মধ্য দিয়ে বস্তুত কবিপ্রাণ বঙ্কিমের আধ্যাত্ম্য ভাবনারই পরিচয় পাওয়া যায়।


প্রবন্ধ বসন্তের কোকিল হতে প্রশ্ন মান – ১০

১। বসন্তের কোকিল প্রবন্ধের বিষয়বস্তু নিজের ভাষায় লেখ।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অসামান্য প্রতিভার নিদর্শন ‘কমলাকান্তের দপ্তর’। এই অসাধারণ রচনার অন্যতম সৃষ্টি হল ‘বসন্তের কোকিল’। এই প্রবন্ধটির মধ্য দিয়ে কমলাকান্তের জবানবন্দীতে বঙ্কিমচন্দ্র সুনিপুন শিল্পকুশলতায় কোকিলের রূপকে মানবজীবনের সঙ্গে তুলনা করে জীবনরহস্যের গভীর ও বাস্তব তাৎপর্যে রূপ দিয়েছেন।

এই সংসারে সুখের সময় উপস্থিত হয় বসন্তের কোকিল, দুঃখের সময় তার দেখ মেলে না। যখন ফুল ফোটে, দক্ষিণে বাতাস বাহিত হয়, সুখের প্লাবনে চারিদিক ভাসে তখন তার আবির্ভাব ঘটে। কিন্তু যখন দারুণ শীতে সকলেই কেঁপে অস্থির অথবা প্রবল বর্ষায় যখন জীবন বিপর্যস্ত তখন তার সাক্ষাৎ মেলে না, তাই কোকিল কেবলমাত্র বসন্তের, শীত বা বর্ষার নয়।

মানুষের মধ্যেও অনেকে আছে যারা সুদিনের বন্ধু। উদাহরণস্বরূপ নসীবাবুর কাছারিতে যখন টাকা আসে তখন এই মানুষরূপী কোকিলে তার গৃহ পরিপূর্ণ থাকে। শুধু তাই নয়, গৃহে হয় অফুরন্ত নাচ, গান ও কবিতা, কিন্তু গৃহ জনারণ্যে পরিপূর্ণ হয়ে থাকে। পিঁপড়েরাও তাদের সাথে যোগ দেয়। কিন্তু যেদিন অবিশ্রান্ত বর্ষামুখর রাত্রিতে তার পুত্রসন্তান অকালে মারা যায়, সেদিন তার কাছে একটি লোকও ছিল না। কেউ গভীর নিদ্রায় মগ্ন, কারও অসুখ, কারও আনন্দ বংশধরের আগমনে, কেউ অনিদ্রাজনিত রোগে অস্থির তাই কেউ আসতে পারলেন না। এই কোকিল রূপী মানুষেরা তখন অন্তর্হিত।

তবে এর জন্য কমলাকান্ত কোকিলরূপী এই মানুষগণকে দোষ দিতে চাননি। কারণ, কোকিলের মধ্যে রয়েছে কু, তার চোখে পৃথিবীর সব কিছুই ‘কু’। কিন্তু তার ‘কু’ রবটি বড়ই সুন্দর। সেই জন্য সে সকলের ভালোবাসার পাত্র। কোকিল পরান্ন পালিত, সৌন্দর্যগ্রাহ্য, সুতরাং যেখানে সৌন্দর্যের আভাস, পুষ্পস্তবকের সৌন্দর্য, ঘন পল্লবের শোভা – সেখানেই তার ঈর্ষাজনিত ‘কু’ ডাক। কিন্তু এই মিষ্টি ‘কু’ ডাকের জন্যই সে সর্বত্র জিতে যায়, নইলে রূপের দিক থেকে হাঁড়িচাচার চেয়েও সে নিকৃষ্ট। ইংল্যান্ডে এই গলাবাজির জোরেই গ্লাডস্টোন, ডিসরেলীর মতো অপণ্ডিত ব্যক্তিরা মন্ত্রীত্বের পদ পেল অথচ স্টুয়ার্ট মিলের মতো পাণ্ডিত্যপূর্ণ ব্যক্তির কপালে মন্ত্রীত্ব দূরের কথা, পার্লামেন্টেও ঠাই হল না।

কমলাকান্ত কোকিলকে প্রকৃতির মহা পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে নক্ষত্রময় নীলচন্দ্রের আলোয় আভাসমণ্ডিত, সুসজ্জিত মহাসভাগৃহের উদ্দেশ্যে ঐ মধুর ‘কু’ স্বরে ডাকার আহবান জানিয়েছেন। যাতে ইংরেজ শাসক হেস্টিংসের সিংহাসন কেঁপে ওঠে। পৃথিবীর সর্বত্রই সুন্দরের মধ্যে ‘কু’ লুকিয়ে আছে – এই বিষয় সম্পর্কে তিনি অবগত। উদাহরণ হিসাবে বলেছেন লতায় কন্টক আছে, কুসুমে আছে কীট, গন্ধে আছে বিষ, পত্র হয় শুষ্ক, রূপ বিকৃত হয় কিন্তু তা বলে গলাবাজির জোরে কর্কশ মধুর বলে মানতে পারবেন না। তাই তিনি কোকিল যেমন গলাবাজি না করে তার গলার স্বরে পঞ্চম সুর সৃষ্টি করে তেমনি কোকিলরূপ এই মানুষগুলোকেও শুধু গলাবাজি বা যুক্তি তর্কের জোরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়ে কোকিলের মতো মাধুর্যতা আনতে হবে কণ্ঠে তবেই সুষ্ঠভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব।

সাহিত্যের ক্ষেত্রে এর অজস্র উদাহরণ আছে। তার মধ্যে থেকে তিনি কয়েকটি তুলে ধরেছেন। পাশ্চাত্যের স্যার জেমস্ মাকিন্টশ তাঁর বক্তৃতায় দর্শনের গভীর তত্ত্ব মিশিয়ে দিতেন বলে জনসাধারণ তা গ্রহণ করেনি, অথচ মেকলে তাঁর বক্তৃতায় সুন্দর অলঙ্করন ব্যবহার করে জনগণের মন জয় করেছেন। বাংলা সাহিত্যে ভারতচন্দ্ৰ আদিরসের ব্যবহার করে সমাদর পেলেন কিন্তু মুকুন্দরামের কথা কেউ শুনতে চাইল না।

এরপর কমলাকান্তের সাথে কোকিলের সাদৃশ্য তুলে ধরেছেন। উভয়েই আশ্রয়হীন পরান্ন প্রতিপালিতা, উভয়েই সমান দুঃখে দুঃখী, সমান সুখে সুখী। কোকিল পুষ্প কাননে, বৃক্ষে বৃক্ষে আনন্দের সাথে গেয়ে বেড়ায়। কমলাকান্তও সংসার কাননে, গৃহে গৃহে আনন্দের সাথে দপ্তর লিখে বেড়ায়। উভয়েই স্বভাব পিয়াসী, তাই উভয়ই অনন্ত সুন্দর জগৎ-সংসারের আত্মাকে ডাকেন। কোকিলের এই ডাক পরমব্রহ্মের কানে একদিন পৌঁছাবে। তবে কমলাকান্তের দুঃখ কোকিলের মতো কণ্ঠস্বর নেই। তাই তিনি মনের কথা খুলে বলতে পারেননি। তাই কোকিলকে অনুরোধ করেছেন তাঁর হয়ে সে যেন মনের কথাটি প্রকাশ করে।


২। বসন্তের কোকিল কারা? এদের সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্রের মনোভাব আলোচনা কর।

বাংলা সাহিত্যের যুগন্ধর পুরুষ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর অমর সৃষ্টি ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ প্রবন্ধগ্ৰন্থ। কমলাকান্তের জবানবন্দীতে বঙ্কিমচন্দ্র সমাজের এক বাস্তবতাকে উন্মোচন করেছেন ব্যঙ্গ ও পরিহাসের সুরে। আমাদের আলোচ্য ‘বসন্তের কোকিল’ তারই অন্যতম। প্রকৃতপক্ষে প্রবন্ধটি ব্যক্তিগত হয়েও সর্বজনীন, রূপকের আড়ালে সামাজিক সত্যের বাস্তবায়নে অনবদ্য।

‘বসন্তের কোকিল’ বলতে সমাজের সুবিধাবাদী, আত্মকেন্দ্রিক মানুষ যারা সুখের দিনে পাশে থাকলেও দুঃখের দিনে তাদের দেখা পাওয়া যায় না, তাদের বোঝানো হয়েছে। কোকিল সুখের দিনের পাখি বসন্তের আনন্দময় পরিবেশে তার আবির্ভাব, কিন্তু দুঃখময় বর্ষা বা শীতে তাকে দেখা যায় না। মানবসমাজেও কোকিলরূপী বহু মানুষ বর্তমান, যারা সুখ-সমৃদ্ধির সময় আনন্দ করে, নৃত্যগীতের উৎসবের সময় কোলাহল করে ঠাট্টা-তামাশার মাধ্যমে। কিন্তু দুঃখের সময় তাদের দর্শন পর্যন্ত মেলেনা। উদাহরণ হিসাবে কমলাকান্ত নসীবাবুর বাড়ির চিত্র তুলে ধরেছেন। যেখানে উৎসবের দিনে অগণিত মানুষের ভিড় থাকলেও, অবিশ্রান্ত বর্ষণে পুত্রের অকাল মৃত্যুতে কোকিলরূপী মানুষদের সাক্ষাৎ মেলে না। এইভাবেই উদাহরণ সহযোগে বঙ্কিমচন্দ্র মানুষ কোকিলদের শ্রেণি নির্দেশ করেছেন।

মানবজীবনের ত্রুটি-বিচ্যুতি-দুর্বলতা-অসঙ্গতি প্রভৃতি বিষয় ‘কমলাকান্তের দপ্তরের’ নানা প্রবন্ধে ব্যক্ত হয়েছে। আমাদের আলোচ্য ‘বসন্তের কোকিল’ প্রবন্ধে কোকিলরূপী মানবজীবনের অসঙ্গতি, আত্মকেন্দ্রিতা, স্বার্থপরতা প্রভৃতি তুলে ধরে জীবনরহস্যের গভীর ও বাস্তব তাৎপর্যকে রূপ দিয়েছেন। ফলে সংসারের অসংগতি, অপরিপূর্ণতা শিল্পীর দৃষ্টিতে হয়ে উঠেছে বিষন্ন-মধুর। এই অম্লমাধুর্যের দীপ্তিতে কল্পনার ‘ক্রিয়াশীল উচ্ছ্বাসে’ তা হয়ে উঠেছে অপরূপ রচনা।

রচনাটি পর্যবেক্ষণ কালে চারটি পর্যায় দৃষ্ট হয়। প্রথম পর্যায়ে কমলাকান্তের বক্তব্য-বসন্তের কোকিল সুখের অংশীদার কিন্তু দুঃখের সাথী নয়। দ্বিতীয় পর্যায় বিশ্বের কাছে নিন্দুক পাখিরূপে কোকিল গণ্য, বস্তুত স্বার্থপরতায় প্রতিপালিত, আত্মকেন্দ্রিকতায় পরিপূর্ণ এক শ্রেণির মনুষ্যকে ব্যঙ্গ করা হয়েছে। তৃতীয় পর্যায় কোকিলের সুমধুর কণ্ঠস্বরের কথা এবং তার সাথে এক শ্রেণির মানুষের কথা বলা হয়েছে, যারা কেবলমাত্র বাকচাতুর্যে ও গলার জোরে নিজেদের করতে চায়। চতুর্থ পর্যায় কোকিলের সঙ্গে কমলাকান্তের সাযুজ্যতা।

প্রবন্ধে কমলাকান্তের জবানবন্দীতে বঙ্কিমচন্দ্র কোকিলের প্রকৃতিধর্ম এবং সেই সূত্রে সাধারণ মানুষের প্রকৃতিধর্মের একটি চমৎকার বিশ্লেষণ করেছেন। কোকিলের কন্ঠস্বর মধুর, কারণ তার স্বরে কোনো গলাবাজি নেই, আছে পঞ্চম স্বর। আমাদের সমাজ সংসারে এমন অনেক মানুষ আছে যারা কেবলমাত্র গলাবাজির, জোরেই নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। যুক্তি-তর্কের ধার ধারে না। উপলব্ধি করে না যে এমন অনেক উৎকৃষ্ট উপায় আছে যার সাহায্যে সহজেই মানুষের মন জয় করে সফলতা লাভ করা যায়। প্রকৃতপক্ষে বঙ্কিমচন্দ্র কোকিলের সাদৃশ্যে কোকিলরূপী এই সমস্ত ঈর্ষা জর্জরিত মানুষদেরকে বিদ্রুপ করেছেন।

বঙ্কিমচন্দ্র উপলব্ধি করেছিলেন সমাজে এক ধরণের মানুষ আছে যারা মুখ্যকে অস্বীকার করে গৌণকে বড় করে জাহির করতে চায়, চাকচিক্যময়তা বা আড়ম্বরকে কাজে লাগিয়ে নিজেদেরকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তাই তাদেরকে সচেতন করে করেছেন নিকৃষ্টতম এবং বলেছেন যে কেবলমাত্র গলাবাজির জোরে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করা যায় না। এক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত দিয়েছেন বাজে নভেল লিখে একজনের রাজমন্ত্রী হওয়ার, অন্যদিকে পাণ্ডিত্য থাকা সত্ত্বেও পার্লামেন্টে স্থান না পাওয়ার।

বঙ্কিমচন্দ্র মনে করেন, কোকিলের যেমন গলাবাজি করে কুহুস্বর সৃষ্টি হয় না, তাকে কণ্ঠে মাধুর্যময়তা এনে স্বরের মধুরতা সৃষ্টি করতে হয়। তেমনি সমাজসংসারে প্রতিষ্ঠত হতে গেলে গলাবাজির সাথে মাধুর্যময়তাকে যুক্ত করতে হয়। তবেই মানুষের মন জয় করা যায়, প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায় সফলভাবে সমাজসংসারে। তাই কোকিলের মতো কণ্ঠে মধুরতা আনয়ন করার কথা বঙ্কিমচন্দ্র এই সমস্ত ঈর্ষা জর্জরিত মানুষগুলোকে বলেছেন।

বাইরে কোকিলের গান, অন্তরে কমলাকান্তের প্রাণের গান – এই হল প্রবন্ধের মূল বক্তব্য। এই বক্তব্য বঙ্কিমচন্দ্র স্বনামে প্রকাশ করতে না পারায় কমলাকান্তের জবানবন্দীতে প্রকাশ করেছেন। ফলে তা ব্যক্তিগত হয়েও হয়ে উঠেছে সর্বজনীন।

কমলাকান্ত কোকিলের প্রকৃতিধর্ম বিশ্লেষণ করে তার সমালোচনা করলেও পরিশেষে তার মনের গতি পরিবর্তিত হয়েছে। কোকিলের প্রতি তার বিরাগ পরিণত হয়েছে অনুরাগে। কোকিলের সঙ্গে নিজেকে নিলিয়ে দিয়ে একাত্মতা অনুভব করেছেন, নিবিড় প্রীতি বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। অনুভব করেছেন তাদের কাজ এক, লক্ষ্যও এক। কারণ, তারা দুজনেই সমসুখে সুখী, সমদুঃখে দুঃখী, দুজনেই সহায় সম্বলহীন, পরান্নপালিতা। দুজনেই স্বানন্দে গান গেয়ে বেড়ায়। কোকিল পুষ্পকাননে গাছে গাছে গান গায় আর কমলাকান্ত গৃহে গৃহে দপ্তর লিখে বেড়ায়। অর্থাৎ দুজনেই সমব্যবসায়ী।


৩। সমালোচক বলেছেন, “কোকিলের প্রতিকূল সমালোচনা হঠাৎ সহানুভূতির ও সমদরদীর প্রীতিবন্ধনে রূপান্তরিত হইয়াছে।” – ‘বসন্তের কোকিল’ রচনা প্রসঙ্গে মন্তব্যটি সার্থকতা নিরূপণ করো।

ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা ভাষায় প্রথম সার্থক উপন্যাস রচনা করেন এবং উপন্যাস- সাহিত্যের তিনি অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পীও বটে। তিনি বহু গুরু-গম্ভীর প্রবন্ধ রচনা করে বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যকেও সমৃদ্ধও্ করে তুলেছিলেন। কিন্তু তিনি আবার ‘কমলাকান্তের দপ্তরের লঘু হাস্যরস ও প্রধান প্রবন্ধ লিখতে গেলেন কেন এই বিষয়ে একটু ভাবতেই হয়।

“ন্যাকামি, কপটতা, অসংযত আতিশয্য ও মুঢ়তায় ভরা মানবজগতের অনুষ্ঠান প্রতিষ্ঠান লইয়া বঙ্কিমচন্দ্র প্রবন্ধে অনেক আলোচনা করিয়াছেন, কিন্তু তাহাতে তাহার তৃপ্তি হয় নাই। তিনি বুঝিয়াছিলেন যুক্তির চেয়ে ব্যঙ্গের ধার বেশি। এই ব্যঙ্গবর্ষণের জন্য তাঁহাকে অনুপযোগী ভঙ্গীর অনুসরণ করিতে হইয়াছে। কমলাকান্তের দপ্তরের প্রধান উপজীব্য এই ব্যঙ্গবাণবর্ষণ। অবশ্য সেই সঙ্গে কবি বঙ্কিমের হৃদয়োচ্ছ্বাসের বাহন হইয়াছে এই দপ্তর।”

সাধারণভাবে ‘কমলাকান্তের দপ্তরে’র প্রবন্ধগুলি ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের শাণিত অস্ত্রের ক্ষুরধার তীক্ষ্ণতা নিয়ে বর্তমান থাকলেও ‘বসন্তের কোকিলে’র রচনাভঙ্গি একটু পৃথক প্রকৃতির। সমালোচক এটিকে fantasy’-ধর্মী বলে অভিহিত করেছেন। কারণ, এতে আছে কল্পনার অবাধ সঞ্চরণ, অতএব মুহূর্তে ক্ষেত্র পরিবর্তন সম্ভবপর। রচনাটির আরম্ভেই কমলাকান্ত ‘বসন্তের কোকিল’কে সুদিনের বন্ধুরূপে অভিহিত করেছেন। বসন্তেই তার আবির্ভাব ঘটে এবং গানে গানে সে বিশ্বকে মাতিয়ে তোলে, শীতে বা বর্ষায় তার কোন সাক্ষাৎ পাওয়া যায় না। এরা যথার্থই শুধু সুদিনের বন্ধু, দুঃখের দিনের কেউ নয়।

এই জ‍গৎ সংসারে কমলাকান্ত এদের প্রত্যক্ষ সাক্ষাৎ পেয়েছেন নসীবাবুর বৈঠকখানায়। নসীবাবুর তোষাখানায় যখন আমদানির বান ডাকত, তখন এই সুদিনের বন্ধুদেরও আনাগোনার বিরাম ঘটত না, তাদের ডাকার প্রয়োজন হতো না, তারা সর্বক্ষণ নসীবাবুর বৈঠকখানা আলো করে বসে থাকতেন। কিন্তু যে দুর্যোগময়ী বর্ষারজনীতে নসীবাবুর পুত্রটির অকালমৃত্যু ঘটলো, সেদিন ডাকাডাকি করে তিনি একটি বন্ধুরও সন্ধান পেলেন না। কেউ অসুখে থাকবার দোহাই দিয়ে আসতে পারেননি, আবার কেউ বা অতিসুখ ছেড়ে দিয়ে আসবার সুযোগ করতে পারেননি; কেউ অনিদ্রায় কষ্ট পান বলে আসেননি, কেউ বা নিদ্রাগত বলে আসেননি। এরাই অর্থাৎ এই সুদিনের বন্ধুরাই হলেন বসন্তের কোকিল।

এরপর কমলাকান্তের মনে হয়েছে, বসন্তের কোকিল শুধু সুদিনের বন্ধুই নয়, সে বিশ্বনিন্দুকও বটে। সে যেমন কালোরূপে হাঁড়িচাচার কাছেও হার মানে, তেমনি বিশ্বের সর্বত্রই ‘কু’ ছাড়া কিছুই দেখতে পায় না। প্রকৃতির সৌন্দর্য বা পুষ্পের সুরভি-যাইই দেখুক না কেন, সবকিছুই তার নিকট ‘কু’। ঈর্ষা দ্বেষ কাতর মনুষ্যের এই স্বভাবচিত্ত কমলাকান্ত আবিষ্কার করেছেন কোকিলদের মধ্যে। তা সত্ত্বেও কোকিলের কণ্ঠ মানুষকে মাতিয়ে তোলে তার কারণ কোকিলের পঞ্চম স্বর, ঐ মধুর কণ্ঠধ্বনি।

বস্তুত পৃথিবীতেও গলাবাজরাই জয়ী হয়। যিনি যত অলঙ্কৃত মধুর বাক্য ব্যবহার করবেন, তিনিই তত জয়ধ্বনি শুনতে পাবেন। যুক্তি-তর্ক হিতকর বচন এদের কোনো মূল্য নেই। তাই গ্লাডস্টোন, ডিসরেলির মতো গলাবাজ বাজে লেখকরা রাজমন্ত্রী হন, মেকলে ও ভারতচন্দ্র সাহিত্যিকের মর্যাদা লাভ করেন। কিন্তু স্টুয়ার্ট মিল পার্লামেন্টেও স্থান পান না, জেমস্ ম্যাকিন্টশ বা কবিকঙ্কণের সাহিত্যের কদর নেই।

এই পর্যন্ত কমলাকান্ত যে সুরে কথা বলেছেন, তা সমালোচনার সুর, এতে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের তীক্ষ্ণ বাণ না থাকলেও পরিহাস-প্রবণতার পরিচয়টি অক্ষুণ্ণ রয়েছে। কিন্তু এর পরই কমলাকান্তের কল্পনা লঘুপক্ষ বিহঙ্গের মতোই যেন চলার গতি থামিয়ে দিয়ে আত্মমগ্ন হয়ে গান গাইতে বসে গেলো। হঠাৎ কমলাকান্তের মনে হল কোকিল আর তিনি – দুজনেই তো সমান দুঃখের দুঃখী। কারো কোনো নির্দিষ্ট বাসস্থান নেই, উভয়েই পরানুগ্রহপ্রার্থী। তিনি কোকিলের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন হয়ে উঠলেন।

তাঁর মনে হল তারা উভয়েই তো সমব্যবসায়ীও বটে। দুজনের একই কাজ, একই উদ্দেশ্যে। তিনি যে উদ্দেশ্যে দপ্তর রচনা করেন, কোকিলও তার উদ্দেশ্যে গান করে। তাই কমলাকান্ত বলেন, “এখন আয় পাখী, তোতে আমাতে একবার পঞ্চম গাই। তুইও যে, আমি ও সে সমান দুঃখের দুঃখী, সমান সুখে সুখী – তুই এই পুষ্পকাননে, বৃক্ষে বৃক্ষে আপনার আনন্দে গাইয়া বেড়াস্ – আমিও এই সংসার-কাননে, গৃহে গৃহে, আপনার আনন্দে এই দপ্তর লিখিয়া বেড়াই – আয়, ভাই, তোতে আমাতে মিলে মিশে পঞ্চম গাই।”

কমলাকান্তের মনে সংশয় আছে, তাঁর কণ্ঠ নেই বলে, তিনি যাকে ডাকেন, সেখানে হয়তো তাঁর ডাক পৌঁছবে না। কিন্তু কোকিলের পঞ্চম সুর নিশ্চিত সেখানে পৌঁছাবে। কাজেই যে কথাটি তিনি নিজে বলতে চাইলেও বলতে পারেন না কোকিল যেন সেই কথাটি বলে দেয়। কিন্তু সেই কথাটি কী। কাকে তারা ডাকেন? এর উত্তরের মধ্যেই কিন্তু বঙিমচন্দ্রের সাহিত্য জিজ্ঞাসার শেষ মীমাংসাটির সন্ধান পাওয়া যায়। কমলাকান্ত বলেছেন – “এই যে ব্ৰহ্মাণ্ড দেখিয়া কিছুই বুঝিতে না পারিয়া বিস্মিত হইয়া আছি, ইহাকেই ডাকি। এই অনন্ত সুন্দর জগৎ-শরীরে যিনি আত্মা, তাহাকে ডাকি।”

একটিমাত্র বিশেষণের সাহায্যে যাকে তিনি বুঝতে চেয়েছেন, সেই বিশেষণটি হলো ‘অনন্ত সুন্দর’। অতএব কমলাকান্তের দপ্তর রচনা করে কোন সাধনায় ব্রতী রয়েছেন, তার উত্তর পেতে দেরি হয় না। কমলাকান্ত ওরফে বঙ্কিমচন্দ্র সাহিত্য ব্যাপারে মূলত সৌন্দর্য উপাসক। সৌন্দর্য সৃষ্টি যে সাহিত্যরচনার প্রধান উদ্দেশ্য, একথা তিনি প্রকারান্তরে নানাভাবেই উল্লেখ করেছেন। নীতিবাদী বলে বঙ্কিমের অপবাদ থাকলেও আমরা মনে করি তাঁর উক্তিটি – “কাব্যের মূল উদ্দেশ্য নীতিজ্ঞান নহে, কিন্তু নীতিজ্ঞানের যে উদ্দেশ্য, কাব্যেরও সেই উদ্দেশ্য – অর্থাৎ, চিত্তশুদ্ধি।”


Leave a Comment