ডাকাতের মা একাদশ শ্রেণী বাংলা সাহিত্য চর্চার গল্প। ডাকাতের মার রচয়িতা হলেন সতীনাথ ভাদুড়ী। ডাকাতের মা গল্প হতে বড় প্রশ্ন ও উত্তর নিম্নে দেওয়া হল। Bengali Class xi / Eleven DAKATER MAA Question Answer. গল্প ডাকাতের মা হতে 5 নং প্রশ্ন ও উত্তরগুলি দেওয়া হল।
বিষয় | বাংলা |
শ্রেণী | একাদশ শ্রেণী বাংলা গল্প |
গল্প | ডাকাতের মা |
রচনা | সতীনাথ ভাদুড়ী |
ডাকাতের মা গল্প হতে বড় প্রশ্ন ও উত্তর
ডাকাতের মা – সতীনাথ ভাদুড়ী
ডাকাতের মা প্রশ্ন ১:- ‘ছেলের নামে কলঙ্ক এনেছে’ – কে ছেলের নামে কলঙ্ক এনেছে? কলঙ্ক শব্দটি ব্যবহারের কারণ কী? (২০১৪)
ঔপন্যাসিক সতীনাথ ভাদুড়ীর অন্যতম একটি গল্প হল ‘ডাকাতের মা’। এই গল্পে সৌখীর মায়ের সামান্য ভুল সিদ্ধান্তে আনন্দ কিভাবে দুঃখে পরিণত হয় তার পরিচয় পাওয়া যায়।
আলোচ্য গল্পের প্রধান চরিত্র ডাকাতের মা অর্থাৎ সৌখীর মা তার ছেলে সৌখীর নামে কলঙ্ক এনেছে।
বহুদিন পর জেল থেকে ছাড়া পেয়ে পুত্র সৌখী মায়ের সামনে উপস্থিত হয়। পুত্রকে কাছে পেয়ে সৌখীর মা আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়। কিন্তু পুত্রকে কখনোই নিজের দারিদ্র্যের কথা জানতে দেয় নি। আবার জেলফেরত ছেলেকে ‘আলু চচ্চড়ি’ ভাত খাওয়াতে গিয়ে তাকে ছিঁচকে চোরের মতো মর্যাদা হানিকর কাজেও হাত দিতে হয়েছিল।
এক চরম অসহায় মুহূর্তে সৌখীর মা বাধ্য হয়ে পেশকারের বাড়ি থেকে পুরোনো একটি লোটা চুরি করেছিল। চোদ্দ আনায় সেই লোটা বিক্রিও করেছিল। এই লোটা চুরির কলঙ্কই পরে ছেলের নামের সঙ্গে জড়িয়ে যায়।
ডাকাতের বউ, ডাকাতের মা হিসেবে যার গর্ব ছিল, সেও ছিঁচকে চোরের মতো হীন কাজ করে বসে। এর ফলে লজ্জায়, দুঃখে তার মাথা হেঁট হয়ে যায়। আগে কখনোই সে দারোগা পুলিশের কাছে মাথা হেঁট করে নি। তার চেয়েও তার বড়ো কষ্ট ছেলের উপর কলঙ্ক লেপন করা। আর সেই বেদনাতেই সৌখীর মা বুক ভরা কান্নায় ভেঙে পড়েছিল।
ডাকাতের মা প্রশ্ন ২ :- ‘এতক্ষণে বোঝে সৌখী ব্যাপারটা।’—কোন্ ‘ব্যাপারটা’র কথা বলা হয়েছে? সে কীভাবে এই ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিল, তা আলোচনা করো। (২০১৫, ২০১৮, ২০২০, ২০২৩)
আধুনিক আর্থ-সামাজিক বাস্তব ভারতের প্রেক্ষাপটে সতীনাথ ভাদুড়ীর লেখা ‘ডাকাতের মা’ গল্প থেকে উদ্ধৃত অংশটি গৃহীত হয়েছে। দারোগার সামনে চুরির ঘটনা বিষয়ে সৌখীর মা একটিও বাক্য ব্যয় করার সাহস দেখায় নি। তাই সৌখী বুঝতে পারে, তার মা যে কাজটি করেছে, তা নিঃসন্দেহে গর্হিত কাজ। সেই প্রসঙ্গেই এই মন্তব্য করা হয়েছে।
সাংসরিক অভাব অনটন যখন চরম পর্যায়ে উঠেছিল তখন পুত্রবধূ ও নাতিকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে খইমুড়ি বিক্রি করে কোনোভাবে টিকেছিল সৌখীর মা। ছেলে বাড়ি ফেরায় সৌখীর মার মন জুড়ে ছিল আনন্দের সঙ্গে বিষাদও। ছেলেকে কী খাওয়াবে সেই চিন্তায় অস্থির সৌখীর মা সারারাত চোখের পাতা এক করতে পারে নি। ছেলের পছন্দের খাবার ছিল আলু চচ্চড়ি। সেই প্রসঙ্গেই গল্পকার লিখেছেন – “আলু, চাল, সরষের তেল সবই কিনতে হবে। অত পয়সা পাবে কোথায়?”
শেষ পর্যন্ত চিন্তায় অস্থির হয়ে সৌখীর মা মাতাদীন পেশকারের বাড়ি থেকে একটি লোটা চুরি করে। ঘটনাচক্রে পরদিন সেই লোটা কেনার জন্য মাতাদীন বাসনের দোকানে গিয়ে উপস্থিত হলে গল্পের গতিপথ পরিবর্তিত হয়। দারোগা-পুলিশের সঙ্গে মাতাদীন পেশকারের গভীর সখ্যতার সম্পর্ক। তাই তারা একসঙ্গে গিয়ে হাজির হয় সৌখীর বাড়িতে।
সমস্ত সম্ভ্রমের নিষেধ অগ্রাহ্য করে শুধুমাত্র সন্তানের মুখে তৃপ্তির হাসি দেখার বাসনায় সৌখীর মা চৌর্যবৃত্তির পথ বেছে নিয়েছিল। তাই দারোগাসাহেবের প্রশ্নের জবাবে সৌখীর মা একটি কথাও বলতে পারে নি। ধূর্ত ও মতলবী দারোগার সামনে মায়ের নিশ্চুপ থাকার বিষয় সম্পর্কে গল্পকার লেখেন –
“কোনো জবাব বেরুল না বুড়ির মুখ দিয়ে। শুধু একবার ছেলের দিকে তাকিয়ে সে মাথা হেঁট করে”।
এরপরই সৌখী অনুধাবন করে যে, তার মা গত রাতে লোটা চুরি করেছে। সে ডাকাত হলেও তার মাকে নিয়ে তার একটা বিশ্বাসের জগৎ, গর্বের জায়গা ছিল, যা এই চুরির ঘটনায় কাঁচের টুকরোর মতো ভেঙে খান খান হয়ে যায়।
ডাকাতের মা প্রশ্ন ৩ :- ‘ডাকাতের মা’ গল্প অবলম্বনে সৌখীর মায়ের চরিত্র বিশ্লেষণ কর। (২০১৭)
ডাকাতের মা ছােটোগল্পের প্রধান চরিত্র সৌখীর মা চরিত্রটির বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলি হল –
অপত্যস্নেহ :-
পুত্রের চিন্তাভাবনা, আচার-আচরণের প্রতি তার পূর্ণ সমর্থন ছিল। আবার মেজাজি ডাকাত সর্দারের মা হিসেবে তার যথেষ্ট গর্বও ছিল। পুত্রের প্রতি তার সম্ভ্রম ও স্নেহ দুই প্রবল ছিল। তাই পুত্রকে সে নিজের দুর্বিষহ দারিদ্র্যের কথা যেমন জানাতে পারে নি। জেলফেরত ছেলেকে আলুচচ্চড়ি-ভাত খাওয়াতে তাকে ছিচকে চুরির মতাে মর্যাদাহানিকর কাজেও হাত দিতে হয়েছিল।
পুত্রবধূর প্রতি স্নেহপরায়ণতা :-
দুর্বল চেহারার পুত্রবধূর উপযুক্ত পরিচর্যার জন্য সে করতে পারে নি। তাই বাধ্য হয়েই সে নাতি সহ বউমাকে তার বেয়াই বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিল।
পরিশ্রমী :-
সৌখীর মা অত্যন্ত পরিশ্রমী মহিলা। সৌখীর অনুচররা তার জেলে যাবার দুবছর পর টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিলে সে খই-মুড়ি ভেজে তা বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিক্রি করে নিজের পেট চালিয়ে নিয়েছে।
পুরুষতন্ত্রে আস্থা :-
নিরক্ষর সৌখীর মা পুরুষের আধিপত্যকে শিরােধার্য করে নিয়েছিল। তাই তার বক্তব্য “বাপের বেটা, তাই মেজাজ অমন কড়া”। পুত্রের প্রহার বা শাসানিও তাকে বিচলিত করে নি।
বাস্তববুদ্ধি :-
সৌখীর মার যথেষ্ট বাস্তববুদ্ধি ছিল বলেই দীর্ঘদিন পর ছেলে বাড়ি ফিরলে সেই মুহূর্তেই সে ছেলেকে তার ডাকাত-অনুচরদের স্বার্থপরতার কথা অথবা তার স্ত্রী-পুত্রের অসুস্থতার কথা জানায় নি।
তার চরিত্রের এই সব গুণ থাকা সত্ত্বেও তার একটা আবেগতড়িত ভুল-সিদ্ধান্তের জন্যই গল্পটি বিষাদময় পরিসমাপ্তির দিকে এগিয়ে গিয়েছে।
ডাকাতের মা প্রশ্ন ৪ :- ডাকাতের মা ছোটগল্প অবলম্বনে সৌখীর চরিত্র বিশ্লেষণ করাে।
সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘ডাকাতের মা’ ছােটোগল্পের ডাকাত সর্দার সৌখীর যেসব বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে, সেগুলি হল –
আত্মমর্যাদাবােধ :-
প্রবল আত্মমর্যাদা সম্পন্ন ডাকাত ছিল সৌখী। এই জন্য জেলে থাকার সময় কখনও সে ছিচকে চোরদের সঙ্গে পারতপক্ষে কথা বলে নি। তার মতে ডাকাত বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আসামীরাই তার সমকক্ষ ছিল।
মেজাজি :-
সৌখী ছিল অত্যন্ত মেজাজি পুরুষ। টোকার শব্দে ঠিক সময়মতাে মার ঘুম না ভাঙার জন্য মাকে বেদম প্রহার করে সে। সৌখীর মা তাই বলেছে, ‘বাপের বেটা, তাই মেজাজ অমন কড়া।’
সাবধানী :-
ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিযুক্ত থাকার জন্য অত্যন্ত সাবধানে থাকতে হত সৌখীকে। দরজা খােলার আগেও মাকে বলেছিল দশ বার নিঃশ্বাস ফেলার সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে। তাছাড়া, দলের লােকদের বিশ্বাসঘাতকতা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সে বারবার তার সংকেত পালটে দিত।
ধূর্ত এবং কুশলী :-
বাস্তববুদ্ধির অধিকারী সৌখী জমাদারকে ঘুষ দিয়ে নিজের জেল-জীবনের মেয়াদ কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিল।
মাতৃভক্তি :-
মেজাজের বশে মাকে বেদম প্রহার করে ফেললেও সৌখীর মাতৃভক্তি ছিল যথেষ্ট। জেল থেকে বাড়ি ফিরে এসে মার গায়ে পুরােনাে ছেঁড়া কম্বল দেখে, জোর করেই তার গায়ের নতুন কম্বলটা মাকে দিয়ে দেয়।
অর্থাৎ সব দিক বিচার বিবেচনা করে বলা যায় যে, ডাকাত সর্দার সৌখী ছিল দোষে-গুণে মেশানাে এক রক্তমাংসের মানুষ।
ডাকাতের মা প্রশ্ন ৫ :- ‘এইবার সৌখীর মা ভেঙে পড়ল’ – কখন এবং কেন সে ভেঙে পড়েছিল?
কথাকার সতীনাথ ভাদুড়ী রচিত ‘ডাকাতের মা’ গল্প থেকে আলোচ্য অংশটি গৃহীত হয়েছে।
ডাকাত সৌখীর মা পেশকার সাহেবের বাড়ি থেকে লোটা চুরি করার ফলে সৌখীকে ধরার জন্য তার বাড়িতে দারোগা সাহেব এসেছিল। তাই সৌখীর নামে কলঙ্ক হওয়ায় সৌখীর মা ভেঙে পড়েছিল।
বহুদিন পর সৌখী জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বাড়িতে আসে। সৌখী বাড়ি ফিরে আসায় তার মা আনন্দে ভরপুর হয়ে ওঠে। অভাবের কারণে পরদিন ছেলেকে কী খেতে দেবে – এই চিন্তায় সৌখীর মায়ের সারারাত ঘুম আসে না।
শেষ পর্যন্ত সৌখীর মা সেই রাত্রে পেশকার সাহেবের বাড়ী থেকে লোটা চুরি করে এবং চোদ্দ আনায় বিক্রি করে। এই লোটা চুরির কারণে পরদিন সকালে সৌখীর বাড়িতে পুলিশ আসে সৌখীকে ধরতে। তাই ছেলের নামে কলঙ্ক আনাটা তার মায়ের কাছে শোক বার্তা বয়ে এনেছিল। সৌখীর মা ভাবতে থাকে যে, শেষকালে ছিঁচকে চুরির অপরাধে কিনা ছেলে জেলে যাবে। এই সব কারণেই সৌখীর মা ভেঙে পড়েছিল।
ডাকাতের মা প্রশ্ন ৬ :- ‘মা তখনো মেঝেতে পড়ে ডুকরে কাঁদছে’ – প্রসঙ্গ উল্লেখ করে কাঁদার কারণ উল্লেখ করো।
ঔপন্যাসিক সতীনাথ ভাদুড়ীর অন্যতম একটি গল্প ‘ডাকাতের মা’। এই গল্পে সৌখীর মায়ের সামান্য ভুল সিদ্ধান্তে আনন্দ কিভাবে দুঃখে পরিণত হয় তার পরিচয় আছে।
চরম অভাবের কারণে সৌখীর মা মাতাদিন পেশকারের বাড়ি থেকে লোটা চুরি করেছিল। কিন্তু সেই চুরির দায় পড়েছিল সৌখীর উপর। দারোগা সাহেব সৌখীকে ধরে নিয়ে যাবার সময় তার মায়ের অবস্থা প্রসঙ্গে এই উক্তিটি করা হয়েছে।
দীর্ঘদিন পর সৌখী নিজের বাড়ি ফিরেছে। তখন ছেলেকে কী খাওয়াবে এই চিন্তায় সৌখির মা সারারাত চোখের পাতা এক করতে পারে নি। ছেলের পছন্দের খাবার আলু চচ্চড়ি। সে প্রসঙ্গে সৌখীর মায়ের ভাবনা –
“আলু, চাল, সরষের তেল সবই কিনতে হবে। অত পয়সা পাব কোথায়?”
এই চিন্তায় অস্থির হয়ে সৌখীর মা মাতাদীন পেশকারের বাড়ি থেকে একটি লোটা চুরি করে।
মাতাদিন পেশকারের সঙ্গে দারোগা পুলিশের গভীর বন্ধুত্বের সম্পর্ক। তাই খুব তাড়াতাড়িই সৌখীর বাড়িতে পুলিশ হাজির হয়। দারোগা সাহেবের প্রশ্নের জবাবে একটি কথাও বলতে পারে না সৌখীর মা। সব কিছু বুঝতে পেরে সৌখী যখন মায়ের চুরির অপবাদ নিজের মাথায় নিল, তখন সৌখীর মা ডুকরে কেঁদে উঠেছিল।
লোটা চুরির কলঙ্ক সৌখীর কাঁধে চাপার ফলে দীর্ঘদিনের গর্ব এক মুহূর্তে যেন খান খান হয়ে যায়। যে ছিঁচকে চোরদের সৌখীর মায়ের একেবারেই পছন্দ হয় না, সেই ছিঁচকে চুরির অপবাদেই সৌখীর জেল হবে জেনে মায়ের সমস্ত অহংকার ধূলিস্যাৎ হয়। এই কারণেই সৌখীর মা কান্নায় ভেঙে পড়ে।
ডাকাতের মা প্রশ্ন ৭ :- ‘ওরা কি ডাকাত দলের যুগ্যি’ – কোন প্রসঙ্গে এই মন্তব্য? বক্তার একথা বলার কারণ বিশ্লেষণ কর।
ঔপন্যাসিক সতীনাথ ভাদুড়ী রচিত ‘ডাকাতের মা’ গল্প থেকে আলোচ্য অংশটি গৃহীত হয়েছে।
গল্পের মূল চরিত্র সৌখীর মা নিজের স্বামী ও ছেলের চেহারা সম্পর্কে সচেতন। ডাকাত দলের স্বাস্থ্যহীন কালিঝুলি মাখা, রোগাপাতলা ছেলেকে দেখে সৌখীর মা আলোচ্য মন্তব্যটি করেছে।
ডাকাতের মা হিসাবে সৌখীর মায়ের একটা গর্ব ছিল। সৌখীর দলের ছেলেরা অবশ্য শেষপর্যন্ত আনুগত্য স্বীকার করে নি। সৌখীর মা-বউ – এর কথা তারা একবারও ভাবে নি। সৌখীর মা এদেরকে চিহ্নিত করেছে ‘বদ-লোক’ বলে। তার বক্তব্য –
“আসতে দাওনা সৌখীকে ! দলের ওই বদলোক গুলোকে ঠান্ডা করতে হবে”।
প্রসঙ্গক্রমে সৌখীর মা আরো বলেছে, “এই সব একলষেঁড়ে লোকদের দলে না নিলেই হয়”। সৌখীর মায়ের এইরকম সিদ্ধান্তের কারণ এদের চেহারা ডাকাতের সঙ্গে মানানসই নয়, দেখতে অনেকটা তালপাতার সেপাই, রোগাপটকাকে দেখে কেউ কখনো ভয় পায় না।
তাই সৌখীর মায়ের সিদ্ধান্ত সৌখীর দলের লোকেরা কেউ ডাকাত দলের যোগ্য নয়।
ডাকাতের মা প্রশ্ন ৮ :- জেল থেকে ফিরে আসার দিন রাত্রে সৌখীর সঙ্গে তার মায়ের যে কথোপকথন হয়েছে তা গল্পানুসরনে লেখ।
সতীনাথ ভাদুড়ি রচিত ‘ডাকাতের মা’ গল্পে দেখা যায়, জেল থেকে সৌখীর ফিরে আসার দিন রাত্রে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিল তার মা। ছেলের বাড়ির ফেরার আনন্দে মা অভিভূত। তাদের দুজনের মধ্যে যে কথোপকথন হয়েছিল তা মা-ছেলের সম্পর্কের দিকটি তুলে ধরে।
সৌখী অনেক রাতে বাড়ি ফিরেছিল। সৌখী জানায়, হেড জমাদার সাহেবকে টাকা খাইয়ে সে ছাড়া পেয়েছে। সৌখী দরকারের চাইতেও যেন বেশি জোরে কথা বলছিল। কারণ, সে তার পত্নী ও সন্তাকে খুঁজছিল। ছেলের এই ঔৎসুক্য সম্পর্কে সৌখীর মা আগে থেকেই জানত। লেখক লিখেছেন –
“প্রতি মুহূর্তে বুড়ি এই প্রশ্নেরই ভয় করছিল”।
তার ভয়ের কারণ, সৌখী জানতে চেয়েছিল – সে তার ছেলে-বউকে দেখতে পাচ্ছে না কেন? ছেলের এই প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে সৌখীর মা জানায় –
“মেয়েদের কি মা-বাপকে দেখতে ইচ্ছে করে না একবারও?”
নাতি আর বউমার প্রসঙ্গ থেকে সৌখীর মা অন্য প্রসঙ্গে আসে। সৌখীকে হাত-মুখ ধুয়ে আসতে বলে খাওয়ার জন্য। সৌখী খেয়ে এসেছে জানালে সৌখীর মা জানায়,
“খই মুড়ি আছে। খেয়ে নে। তুই যে কত খেয়ে এসেছিস, সে আর আমি জানিনে”।
এখানে সৌখীর মায়ের অপত্য স্নেহ ধরা পড়েছে। এরপর নিজের কম্বলখানা মায়ের গায়ে জড়িয়ে দেয় সৌখী। নতুন কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়েও ছেলেকে খাওয়ানোর চিন্তায় তার ঘুম আসে না। সেই রাতে সৌখী আর তার মায়ের মধ্যে যে কথোপকথন হয়েছিল তা আন্তরিক।
ডাকাতের মা প্রশ্ন ৯ :- দারোগা পুলিশ দেখে বুড়ির বুক কেঁপে উঠল কেন?
সতীনাথ ভাদুড়ী রচিত ‘ডাকাতের মা’ গল্পে সৌখীর মা ছিল বেশ সাহসী। স্বামী ও সন্তানকে নিয়ে তার বেশ গর্ব ছিল। তার দুটি পরিচয়— (১) সে ডাকাতের বউ। (২) সে ডাকাতের মা।
তার ভয় ছিল না। জীবনে বহু ঘটনার সাক্ষী সৌখীর মার পুলিশ-দারোগা নিয়ে কোনো ভীতিবোধ নেই। তার স্বামীকে সবাই মান্য করত। কিন্তু মাতাদীন পেশকারের বাড়ি থেকে লোটা চুরি করাটা মোটেই গর্বের বিষয় ছিল না। এর ফলে বাসনওয়ালা, পেশকার সাহেব ও দারোগাকে দেখে সৌখীর মায়ের বুক কেঁপে উঠেছিল। গল্পকার লিখেছেন –
“পুলিশ দেখে ভয় পাবার লোক সে নয়। এর আগে কতবার সময়ে অসময়ে পুলিশকে তাদের বাড়ি হানা দিতে দেখেছে”।
কিন্তু এবার তার ভয়ের কারণ আলাদা। ডাকাতি করা তার স্বামী-পুত্রের জীবিকা। এই জীবিকা নিয়ে তার কোনো আফশোস নেই। কারণ, তার স্বামী-পুত্রের কাজ ‘মরদের কাজ’। সেই কাজ নিঃসন্দেহে গর্বের কাজ।
কিন্তু সৌখীর মা লোটা চুরি করে ‘ছিঁচকে চোরের কাজ করেছে। তাই সৌখী কি ভাববে – সেই চিন্তায় তার মা ভয় পেয়েছিল।
ডাকাতের মা প্রশ্ন ১০ :- ‘আগে সে ছিল ডাকাতের বউ। …তার পরিচয় ডাকাতের মা বলে।’’ –‘ডাকাতের বউ’ কীভাবে ‘ডাকাতের মা’-এ পরিণত হয়েছে, তা দেখাও।
নিম্নবর্গের প্রাত্যহিক দিনযাপনের চিত্র অঙ্কনে ক্লান্তিহীন সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘ডাকাতের মা’ গল্পটি বাংলা সাহিত্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। লেখক সৌখীর মায়ের চরিত্র অঙ্কনে প্রথমেই পাঠককে বলে দিয়েছেন, এই চরিত্রটির একটি বিশেষ পরিচয় আছে –
“আগে সে ছিল ডাকাতের বউ। সৌখীর বাপ মরে যাবার পর থেকে তার পরিচয় ডাকাতের মা বলে”।
এরপরেই বর্ণিত হয়েছে সৌখীর মায়ের কার্যকলাপ। কীভাবে সে পুলিশের সঙ্গে মোকাবিলা করে, কীভাবেই বা দলের ছেলেদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করে, সেই বিষয়গুলি লেখক নিখুঁতভাবে উপস্থাপন করেছেন।
স্বামী ও সন্তানের কাজের সঙ্গে তার জীবন একই সূত্রে বাঁধা পড়েছে। তাই অনুশোচনাবোধ ও আশঙ্কা সবসময় তার মনের মধ্যে লালিত হতে থাকে। গল্পকার লিখেছেন –
“ঝি-চাকরের কাজও তো আমরা করতে পারি না। করলেই বা রাখতে কে? সৌখীর মা-বউকে কেউ বিশ্বাস পায়!”
অনেকদিন পর ছেলে বাড়ি ফিরে এলে আনন্দে মায়ের বুকের মধ্যে যেভাবে তোলপাড় করে সেই বোধের বিশ্লেষণে সতীনাথ লিখেছেন –
“বুড়ি ছেলেকে জড়িয়ে ধরেছে।…এ ছেলে বুড়ো হয়েও সেই একইরকম থেকে গেল।…এই আনন্দ আর রাখবার জায়গা নেই”।
সতীনাথ অবশ্য এই চরিত্রের বিবর্তন দেখিয়েছেন। অভাবের কারণে বৃদ্ধা মা ছেলেকে খাওয়ানোর চিন্তায় সারারাত চোখের পাতা এক করতে পারে নি। তার মাথার মধ্যে সর্বক্ষণ ঘুরেছে একটাই প্রশ্ন –
“সৌখীকে কী খেতে দেবে কাল সকালে সেই হয়েছে বুড়ির মস্ত ভাবনা”।
আর সেই ভাবনা থেকে মাতাদীন পেশকারের বাড়ি থেকে সে চুরি করেছে পুরোনো একটি লোটা। এই লোটা চুরির ফলেই ঘটেছে বিপত্তি। দারোগা যখন সৌখীকে পুনরায় জেলখানার উদ্দেশ্যে নিয়ে চলে সেই মুহূর্তের পরিস্থিতি বর্ণনায় গল্পকার লিখেছেন –
“মা তখনও মেঝেতে পড়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। উনোনে চড়ানো আলুর তরকারির পোড়া গন্ধ সারা পাড়ায় ছড়িয়ে পড়েছে”।
আর এভাবেই ‘ডাকাতের মা’ গল্পের সৌখীর মা ‘ডাকাতের বউ’ থেকে ‘ডাকাতের মা’-এ পরিণত হয়েছে।
ডাকাতের মা প্রশ্ন ১১ :- ‘তার বাড়ি ফিরবার আনন্দ অর্ধেক হয়ে গিয়েছে মুহূর্তের মধ্যে।’ —এখানে কার কথা বলা হয়েছে? কোন্ প্রসঙ্গে বক্তব্যটি করা হয়েছে? ‘বাড়ি ফিরবার আনন্দ’ কেন ‘অর্ধেক হয়ে গিয়েছে’ বলে লেখক জানিয়েছেন?
সতীনাথ ভাদুড়ী রচিত ‘ডাকাতের মা’ গল্প থেকে উদ্ধৃত উক্তিটি গৃহীত হয়েছে। এখানে সৌখীর কথা বলা হয়েছে।
দীর্ঘদিন জেলে থাকার পর সৌখী যখন বাড়ি ফিরে আসে তখন স্ত্রী ও শিশুপুত্রকে না দেখতে পেয়ে তার মনের অবস্থা বর্ণনায় লেখক এই উক্তিটি করেছেন।
সতীনাথ ভাদুড়ীর মধ্যে ছিল সর্বব্যাপী ও সুগভীর অন্তর্দৃষ্টি। ‘ডাকাতের মা’ গল্পে এক বিশেষ আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে একজন যুবকের বিপথগামী হওয়ার আখ্যান লিখেছেন সতীনাথ। জীবনের বেশিরভাগ সময়ই সে অন্ধকারের মধ্যে দিন যাপন করেছে। গল্পকার লিখেছেন –
“সৌখী জেলে গিয়েছে আজ পাঁচ বছর; … সৌখীরও তো এর আগে দুবার কয়েদ হয়েছে”।
অর্থাৎ কারাগারে থাকাই যেন তার নিত্য রুটিন।
দীর্ঘদিন পর সৌখী যখন বাড়ি ফিরেছিল তখন স্ত্রী ও পুত্রকে না দেখে তার বাড়ি ফেরার আনন্দ অর্ধেক হয়ে গিয়েছিল। প্রতিটি মানুষের মধ্যে তার নিজস্ব ভালোলাগার জগৎ আছে। যতই বিপর্যয় আসুক না কেন প্রত্যেকটি মানুষ বেঁচে থাকে একটুকরো স্বপ্ন নিয়ে।
ভাগ্যহীন হলেও সৌখীর মধ্যে সেই স্বপ্নটুকু ছিল। সে ডাকাত হলেও, দারিদ্র্য তাদের পরিবারে নিত্য সহচর হলেও মানবিক বোধবুদ্ধির বিলুপ্তি ঘটে নি। তাই দীর্ঘদিন পর বাড়ি ফিরে তার চোখ খুঁজতে থাকে অন্তরঙ্গ মানুষজনদের।
সৌখীর মা জানত সৌখী নিঃসন্দেহে জানতে চাইবে তার ছেলে বউয়ের কথা। ঘটনাচক্রে কথা প্রসঙ্গে সৌখী তার মাকে প্রশ্ন করেছে তার বউ হঠাৎ বাপের বাড়িতে কেন? গল্পকার লিখেছেন –
“ছেলে ছেলে করে মরে সৌখী। …শরীর খারাপের কথা শুনলে হয়তো সৌখী এখানে আর একদিনও থাকবে না”।
এতদিন পর বাড়ি ফিরে ছেলে ও বউয়ের মুখ না দেখতে পেয়ে সৌখীর বাড়ি ফেরার আনন্দ মুহূর্তেই কর্পূরের মতো উবে যায়। আন্তর্মানবিক সম্পর্কগুলি কীভাবে আমাদের মনের মধ্যে ফল্গুধারার মতো ক্রিয়াশীল তাই দেখিয়েছেন গল্পকার সতীনাথ ভাদুড়ী।
ডাকাতের মা প্রশ্ন ১২ :- ‘প্রতি মুহূর্তে বুড়ি এই প্রশ্নের ভয়ই করছিল?’– ‘বুড়ি’ বলতে কার কথা বলা হয়েছে? তার ভয়ের কারণ কী ছিল?
সতীনাথ ভাদুড়ী রচিত ‘ডাকাতের মা’ গল্প থেকে গৃহীত আলোচ্য অংশে ‘বুড়ি’ বলতে সৌখীর মায়ের কথা বলা হয়েছে।
দীর্ঘ পাঁচ বছর পর সৌখী বাড়ি ফিরেছে। স্বভাবতই তার চোখ ছেলে ও বউকে খুঁজতে থাকে। কারণ, বাড়ি ফিরে তাদের কাউকে দেখতে পায় নি। মায়ের কাছে সৌখী জানতে চেয়েছিল “এদের কাউকে দেখছি না?” সেই প্রসঙ্গেই সৌখীর মায়ের অবস্থা নির্ণয়ে এই বক্তব্য উঠে এসেছে।
সৌখী জেলে যাওয়ার পর তার দলের ছেলেরা প্রথম প্রথম সাহায্য করত। কিন্তু পরে দিকে সৌখীর মায়ের কোনো খবর তারা নেয় নি। তাই সৌখীর মায়ের মনে হয়েছে “দিনকাল পড়েছে অন্যরকম!” নাতি ও বউমাকে খাবার দেওয়ার সাধ্য সৌখীর মায়ের নেই। রুগ্ন বউকে বাড়িতে রেখে দিতে না পেরে বাধ্য হয়ে ছেলের শ্বশুর বাড়িতে তাদের পাঠিয়ে দেয়।
ছেলে বাড়ি ফিরে প্রথমে বউ ও বাচ্চার মুখ দেখতে চাইবে এটাই স্বাভাবিক। তাই সৌখী যখন তার সন্তান ও স্ত্রীর কথা বলে, তখন তার মা রীতিমতো ভয় পেয়ে যায়।