কর্তার ভূত: একাদশ শ্রেণী বাংলা গল্প

কর্তার ভূত একাদশ শ্রেণী বাংলা সাহিত্য চর্চার গল্প। কর্তার ভূতের রচয়িতা হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কর্তার ভূত গল্প হতে বড় প্রশ্ন ও উত্তর নিম্নে দেওয়া হল। Bengali Class xi / Eleven  KARTAR BHOOT Question Answer. গল্প কর্তার ভূত হতে 5 নং প্রশ্ন ও উত্তরগুলি দেওয়া হল।

বিষয় বাংলা
শ্রেণী একাদশ শ্রেণী বাংলা গল্প
গল্প কর্তার ভূত
রচনা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কর্তার ভূত গল্প

Table of Contents

কর্তার ভূত গল্প হতে বড় প্রশ্ন ও উত্তর


কর্তার ভূত গল্প হতে প্রশ্ন-১: ওরে অবােধ, আমার ধরাও নেই ছাড়াও নেই, তােরা ছাড়লেই আমার ছাড়া’—এখানে কে কাদের অবােধ বলেছেন? উক্তিটির তাৎপর্য আলােচনা করাে। (২০১৫, ২০১৯) 

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কর্তার ভূত’ গল্পে বুড়াে কর্তা দেশের দু-একজন লােককে উদ্দেশ্য করে আলোচ্য মন্তব্যটি করেন।

সাধারণভাবে দেশের মানুষ ভূতের শাসনে নিশ্চিন্ত থাকলেও দু-একজনের ভাবনাচিন্তা একই খাতে চলে না। যারা দিনের বেলায় নায়েবের ভয়ে চুপ করে থাকে, রাতে বুড়াে কর্তার কাছে তারাই হাতজোড় করে দাঁড়ায়। তারা জানতে চায় যে, বুড়াে কর্তার তাদের ছেড়ে যাওয়ার সময় তখনও হয়েছে কি না। তখনই বুড়াে কর্তা প্রশ্নোদ্ধৃত মন্তব্যটি করেন।

ভয়ের মধ্যেই ভূতের অস্তিত্ব। সংস্কার আর অন্ধবিশ্বাসকে আঁকড়ে থাকা মানুষ নিজের যুক্তিবুদ্ধিকে বিসর্জন দিয়ে পরাধীন জীবনযাপনকে পছন্দ করে। সেখানে চোখ বুজে চলাই হল জগতের সব চেয়ে আদিম চলা। যারা হুঁশিয়ার তারাই অশুচি, হুঁশিয়ারদের প্রতি উদাসীন থাকাটাই সেখানে রীতি। ফলে ভূতের শাসন সর্বগ্রাসী হয়ে থাকে। মানুষ এর থেকে মুক্তি চায় না বা মুক্তির কথা ভাবতে পারে না। স্বভাবদোষে যারা নিজস্ব ভাবনা ভাবতে যায়, তারাই খায় ভূতের কানমলা। এইভাবে ভূতের শাসনের যে ধারাবাহিকতা তার অবসান ঘটা সম্ভব হয় না। মানুষের সংস্কার, অন্ধত্ব, আর তা থেকেই জন্ম নেওয়া ভয়কে অবলম্বন করে ভূতের শাসন চলতেই থাকে।


কর্তার ভূত গল্প হতে প্রশ্ন-২: “কেননা ভবিষ্যৎকে মানলেই তার জন্যে যত ভাবনা, ভূতকে মানলে কোনাে ভাবনাই নেই;”— কোন প্রসঙ্গে একথা বলা হয়েছে ? ভূতকে মানলে ভাবনা নেই কেন ? উদ্ধৃতিটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করাে। (২০১৬, ২০২০) 

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কর্তার ভূত’ রচনা থেকে আলােচ্য উদ্ধৃতিটি গ্রহণ করা হয়েছে। 

বুড়াে কর্তা মারা যাওয়ার সময় ভগবান দয়াপরবশ হয়ে দেশবাসীকে জানান যে, মৃত্যুর পর কর্তা ভূত হয়েই দেশবাসীর ঘাড়ে চেপে থাকবেন। মানুষের মরণ থাকলেও ভূতের তাে মৃত্যু নেই। তাই দেশবাসী ভূতদশাপ্রাপ্ত বুড়াে কর্তার অভিভাবকত্বে থাকার নিশ্চয়তা পেয়ে নিশ্চিন্ত হয়। দেশবাসীর এই চিন্তাহীনতার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়েই লেখক প্রশ্নোক্ত উদ্ধৃতিটির অবতারণা করেছেন।

ভূতকে মানলে কোনো ভাবনাই নেই, কারণ ভূতকে মানলে স্বাভাবিকভাবেই সব ভাবনা ভূতের মাথায় চাপে। কিন্তু ভূতের মাথা নেই তাই কারো জন্য তার মাথা ব্যথাও নেই। 

আধুনিকতাকে মানতে গেলে সবকিছুকেই বিচারবিশ্লেষণ করতে হয়, যুক্তিকে অগ্রাধিকার দিতে হয়। কিন্তু ভূতরূপী ধর্মতন্ত্রকে অন্ধভাবে মানলে তাে কোনাে ভাবনাই থাকে না – সব ভাবনাচিন্তা ধর্মতন্ত্র তথা অদৃষ্টবাদের ওপর ন্যস্ত করে মানুষ দায়িত্বশূন্য হয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারে । 

আসলে ভূত হল অজ্ঞতা, ভবিষ্যৎ হল জ্ঞান। ভবিষ্যৎকে মানতে হলে অন্ধবিশ্বাস, অজ্ঞতা ও রক্ষণশীলতারক্ষণশীলতাকে বিসর্জন দিয়ে নতুন করে সবকিছু ভাবতে হবে। কিন্তু দেশবাসী এই পরিবর্তন চায় না। তাই লেখক এরকম মন্তব্য করেছেন। 


কর্তার ভূত গল্প হতে প্রশ্ন-: ‘কর্তার ভূত’ — কি নিছক ভূতের গল্প, নাকি রাজনৈতিক রূপক কাহিনী ? ব্যাখ্যা সহ লেখো। (২০১৭, ২০২২) 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কতার ভূত’ ছোটো গল্পটি আপাতভাবে বাহ্যিক আবরণে নিছক ভূতের গল্প বলে মনে হয়। বুড়ো কর্তার মৃত্যুর পরেও সেদেশের ঘাড়ে ভূত হয়ে চেপে থাকে। সেই দেশে সবাই ভূতগ্রস্থ হয়ে ভূত শাসনতন্ত্রকে মেনে নিয়ে হয়ে উঠেছিল আরামপ্রিয়, নিদ্রাচ্ছন্ন ও ভূতনির্ভর। সেখানকার দেওয়ালহীন ভূতুড়ে জেলখানার ঘানিতে প্রতিবাদী সত্তাকে পিষে বিদ্রোহের তেজ নিষ্কাশন করা হয়। ভূতের সঙ্গে ভয়ার্ত দেশবাসীর বেশ কিছু কথোপকথনও হয়। ফলে সমগ্র গল্পটিতে একটা ভৌতিক আবহ তৈরি হয়েছে।

কিন্তু এই ভৌতিক আখ্যানের আড়ালে লেখক রূপকার্থে মূল বক্তব্যের মধ্যে অন্তর্নিহিত ব্যঞ্জনা তুলে ধরেছেন। ঔপনিবেশিক শাসনে পরনির্ভরতার ফলে দেশবাসীর কাছে অনুসরণযোগ্য কোনো কর্তৃত্বকারী অস্তিত্বের রূপক হল ‘বুড়ো কর্তা’। আর ‘ভূত’ আসলে অন্ধকারাচ্ছন্ন মনের কুসংস্কার ও ভীতির রূপক। ভূতশাসনতন্ত্রের বংশবদ ‘তত্ত্বজ্ঞানী’রা আসলে স্বৈরাচারী রাষ্ট্রযন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার সাংস্কৃতি অস্ত্র। চক্ষুহীন আদিম চলার তত্ত্ব হল অসচেতনতার ভ্রান্ত দর্শন। চক্ষুহীন চলা তাই প্রশ্নহীন অন্ধ অনুসরনকেই রূপকায়িত করে। ভূতুড়ে জেলখানা হল রাষ্ট্রশক্তির পীড়নযন্ত্র। আবার জেলখানার ‘দেওয়ালহীন গারদ’ হল মানুষের অন্ধ মনেরই বন্দিশালা। ‘খোকা’ হল নবজন্মের রূপক।

ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের রাজনৈতিক অবস্থাই এখানে রূপকার্থে নিহিত। দেশবাসী এখানে মধ্যযুগীয় দর্শনের মায়ায় এবং ইংরেজ শাসকের ভয়ে নির্বিকার ও প্রতিবাদহীন। ভারতবাসীর কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনের অন্ততায়, পরনির্ভরতার দুর্বলতায় এবং প্রচন্ড ভীতিতে সর্বদা শোষিত ও পীড়িত হয়। যদিও ইংরেজ শাসন তাদের জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের পথ প্রশস্ত করে। শেষ পর্যন্ত তারা ভয় ভেঙে ভূত শাসন বা ঔপনিবেশিক শাসন অস্বীকার করে স্বরাজ চায়। অতএব গল্পটি আসলে এক রাজনৈতিক রূপকধর্মী গল্প।


কর্তার ভূত গল্প হতে প্রশ্ন-৪: ‘বুড়ো কর্তা বেঁচেও নেই, মরেও নেই, ভূত হয়ে আছে।’ – উক্তিটির আলোকে লেখকের মনোভাব ব্যক্ত করো।

বাংলা ছোটো গল্পের জনক, আধুনিক যুক্তিবাদী উদার মনোভাবাপন্ন রবীন্দ্রনাথ চিরাচরিত প্রথা, প্রাচীন শাস্ত্রাচার, অশিক্ষা ও জড়ত্বের প্রতি আস্থা, যুক্তিহীন সংকীর্ণ চিন্তা এবং অতীতের অন্ধ অনুগমনকে বুদ্ধিদীপ্ত রূপকের আড়ালে ‘কর্তার ভূত’ গল্পে আক্রমন করেছেন। অতীতের প্রভাবে আচ্ছন্ন হয়ে থাকা ঔপনিবেশিক ভারতের অধিবাসীদের উদ্দেশ্যে লেখক আলোচ্য মন্তব্যটি করেছেন। ‘কর্তার ভূত’ বলতে রবীন্দ্রনাথ প্রাচীন শাস্ত্রীয় বিশ্বাস অনুসারে যুক্তিহীন অলৌকিকতার মানুষ যে আস্থা রাখে, তাকে বুঝিয়েছেন।

দেড়শো বছরের বেশি সময় ধরে ভারতবর্ষের ওপর ইংরেজদের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনে নিষ্পেষিত ভারতবাসী অসহায়তাকে ভূত নামক রূপকথার রূপকের আড়ালে অসাধারণ ব্যঞ্জনায় লেখক প্রকাশ করেছেন। ভূত মানার বিশ্বাসকে তিনি ব্যঙ্গ করেছেন। কারণ, দেশের মানুষ যতই নিষ্ক্রিয় হয়েছে ততই সাম্রাজ্যবাদী শোষনের প্রতিভূ ‘কর্তার ভূত’ মানুষের মাথার উপর চেপে বসেছে। যে ভূতগ্রস্থ দেশবাসী ভূতশাসনতন্ত্রকে একরকম বাধ্য বাধকতা বলে মেনে নিয়েছিল, তারা ভূতের কানমলা, ভূতুড়ে জেলখানার অদ্ভূতুড়ে শোষন শাসনে আর খাজনা দেওয়ার প্রানান্তকর চাপে সেই শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে বীতস্পৃহ হয়ে উঠেছিল। আসলে নিয়মতন্ত্রের অধীনতা স্বীকার করা ভালো, আর এ সম্পর্কে যারা প্রশ্ন তোলে তাদের হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়। তবুও তাদের যুক্তিবাদী মনের প্রশ্ন ঠেকানো যায় না – ‘ভূতের শাসনটাই কি অনন্তকাল চলবে ?’

প্রাজ্ঞ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অতীত আর ইতিহাসের যোগসূত্রে বুঝেছিলেন কালের নিয়মে একদিন রুদ্ধ হয়ে যাবে ভূত শাসনতন্ত্রের চাকা। নির্মম শাসন আর শোষনে ভারতীয়দের দুর্বলতার সুযোগে যে নিয়মতন্ত্র গড়ে উঠেছিল, ভারতবাসী যে ভূতশাসনতন্ত্রকে তাদের ভবিতব্য বলে, মেনে নিয়েছিল, লেখকের বিশ্বাস সেই মাত্রাহীন শোষন থেকেই একদিন উঠে আসবে প্রতিবাদ। সাম্য আর ঐক্যের মন্ত্রে উজ্জীবিত নিয়মতন্ত্র বুড়ো কর্তার বাঁচা বা মরার উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকবে না। পরাধীন ভারতবাসীর সজাগ দৃষ্টিভঙ্গি ও রাজনৈতিক সচেতনতা তাকে ধ্বংস করবে।


কর্তার ভূত গল্প হতে প্রশ্ন-৫: মানুষের মৃত্যু আছে, ভূতের তো মৃত্যু নেই। কোন প্রসঙ্গে, কে এই মন্তব্যটি করেছে? ‘ভূতের মৃত্যু নেই’ কথাটির তাৎপর্য কী ?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কর্তার ভূত’ গল্পে দেবতা প্রশ্নোদ্ধৃত মন্তব্যটি করেছিলেন।

বুড়ো কর্তার জীবৎকালে তিনিই ছিলেন দেশবাসীর নিয়ামক। কর্তার নির্দেশ এবং ভাবনাই ছিল কর্তার দেশের শেষ কথা। তাই সেখানকার মানুষ স্বাধীন ভাবনার অভ্যাসটা হারিয়ে ফেলে হয়ে উঠেছিল আরামপ্রিয়, নিদ্রাপরায়ন ও পরনির্ভর। কর্তার মরনকালে তাই তাদের উদ্বেগ, কর্তার মৃত্যু হলে তাদের ভাবনা কে ভাববে? দেশবাসীর এই উদ্বেগের উপশম করতেই দেবতা বিধান দিয়েছিলেন, বুড়ো কর্তার মৃত্যুর পরেও কর্তার ভূত দেশবাসীর ঘাড়ে চেপে শাসন চালাবে। এই প্রসঙ্গেই উদ্ধৃত অংশের অবতারনা।

ভূত শব্দের অর্থ অতীত। মৃত অতীতের নামান্তরই ভূত, অতীত তাই সচল নয়, একটি স্মৃতিতে নির্দিষ্ট ও স্থির হয়ে থাকে। তাই অতীত বা ভূতের মৃত্যু নেই। কিন্তু মরণশীল মানুষ স্বল্প জীবনসীমায় বর্তমানের কৃতকার্যকে পাথেয় করে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলে। আগামী প্রজন্মকে নিজেদের সুফলটুকু দিয়ে যেতে চায় সভ্যতার পরিপুষ্টতার জন্য। আর ভূতগ্রস্ততা আমাদের পশ্চাদমুখিতাকেই উৎসাহিত করে। তাই অতীতচর্চা বা ভূতগ্রস্ততার জন্য মানুষ কখনো এগোতে পারে না।


কর্তার ভূত গল্প হতে প্রশ্ন-৬: ‘নইলে ছন্দ মেলে না, ইতিহাসের পদটা খোঁড়া হয়েই থাকে’। – প্রসঙ্গ উল্লেখ করে কীভাবে ইতিহাসের পদটি খোঁড়া হয় তা সংক্ষেপে বুঝিয়ে দাও।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘লিপিকা’ গ্রন্থের অন্তর্গত ‘কর্তার ভূত’ গল্পে পরাধীন ভারতের নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করেছেন । জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ড প্রতিবাদে তিনি নাইট উপাধী ত্যাগ করেন কিন্তু তৎকালীন দেশনেতাদের কন্ঠে প্রতিবাদ ধ্বনিত না হলে তীব্র ব্যঙ্গ বিদ্রূপের সঙ্গে তিনি উদ্ধৃত উক্তিটি করেন।

ছন্দবদ্ধ ছেলেভুলানো ছড়ায় ইতিহাসের চরম সত্য প্রতিফলিত হয়েছে। বহিঃশত্রুর আকস্মিক আক্রমণে বারবার এদেশের মানুষের জীবন বিপন্ন হয়েছে। তারা ক্রমাগত নিপীড়িত, নিষ্পেষিত, অত্যাচারিত, শোষিত হয়েছে। ক্রমান্বয়ে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির সারনি ধরে বেনিয়াবেশি ইংরেজ দেশীয় রাজন্যবর্গের অন্তদ্বন্দ্বের সুযোগে রাজদন্ড ধরে বিকীর্ণ করেছে তার তেজ, সৃষ্টির অনিবার্য পরিনাম ধ্বংস। তাই কালস্রোতে একদিন বিলীন হয়ে যাবে তার সাম্রাজ্যের দেশ বেড়াজাল। ছন্দ থাকলে ছন্দপতন হবেই। আবার নতুন সৃষ্টি, নতুন ছন্দ স্বাভাবিক নিয়মেই উদ্ভাসিত ও ঝংকৃত হয়। এটাই শ্বাশ্বত সত্য। তা না হলে যেমন ছন্দ মিলবে না, তেমনি ইতিহাসের পুনারাবৃত্তি না হয়ে তা খোঁড়া হয়েই থাকবে।

লেখক জীবনের চরৈবেতি মন্ত্রে বিশ্বাসী। কবির আশাজীর্ণ সংস্কারের বেড়াজালে নাভিশ্বাস ওঠা মানুষ একদিন সংস্কার মুক্ত হবেই। আত্মশক্তির জোরেই তারা মনের ভয়, ভীতি, আত্মগ্লানি দূরে সরিয়ে রেখে সাহসী হয়ে উঠবে। সেই সঙ্গে ছিন্ন হবে পরাধীনতার শৃঙ্খল, যা পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ঘটে চলেছে। কবি এখানে আন্তরিক আশাবাদী হয়ে উঠেছেন।


কর্তার ভূত গল্প হতে প্রশ্ন-৭: ‘কর্তার ভূত’ গল্পের নামকরণের সার্থকতা বিচার কর।

সাহিত্যে নামকরণ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সাহিত্যের কোনো একটি নামকরণ তাই খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। নামকরণ এমন হবে যা যথাযথ এবং চরিত্র, বিষয়, ঘটনার সামগ্রিকতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যা পাঠ করে পাঠক মানসিক তৃপ্তির সঙ্গে সম্যক ধারনা লাভ করে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘লিপিকা’ গ্রন্থের অন্তর্গত ‘কর্তার ভূত’ গল্পটি একটি রূপকধর্মী রচনা। গল্পটিতে কুসংস্কারমূলক লঘু আখ্যানের রূপকথা। লোককথার মিশ্রনে রাজনৈতিক শ্লেষ উচ্চারিত হয়েছে। কর্তার প্রচন্ড শাসনে প্রতিবাদী কন্ঠস্বর ম্লান হয়ে যায়। ফলে বিনা প্রশ্নে পীড়নমূলক শাসন মেনে চলতে সকলেই বাধ্য হয়।

বুড়ো কর্তার মরনকালে উদ্বিগ্ন দেশবাসী প্রশ্ন তোলে এখন তারা কার শাসন মেনে চলবে। শাসনতন্ত্রের নিজস্ব পদ্ধতিতে কর্তার ভূত দেবতার দয়ায় অমরত্ব লাভ করে দেশবাসীর ঘাড়ে চেপে বসে পীড়নমূলক শাসন চালাতে থাকে।

ভূত শাসনতন্ত্রের প্রশ্নহীন মানুষের চেতনা ও বিচার বিবেচনা নিরুপদ্রব ঘুমের শাস্তিতে শায়িত থাকে। এই সুযোগে সাম্রাজ্যবাদী হানাদারী ও বর্গিরা দেশে হঠাৎ পৌঁছে যায়। তখন তত্ত্বজ্ঞানীরা প্রতিবাদীদের অপবিত্র, অশূচি বলে আখ্যায়িত করে। ভূত শাসনতন্ত্রের প্রতিবাদীরা সজাগ হয়ে প্রতিবাদ করতে চাইলে নায়েব গোমস্তারা কারাগারে পাঠিয়ে তাদের মনুষ্যত্ব (তেজ) পীড়নযন্ত্রে নিষ্পেষিত করে বের করে নেয়। 

পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মানুষ ভূতগ্রস্ত নয়, তারা সচেতন, বিদ্রোহী, প্রতিবাদী, প্রগতিপন্থী। কিন্তু এদেশের মানুষের একমাত্র কাজ বিনা প্রশ্নে ভূতগ্রস্ত হয়ে খাজনা দেওয়া। কর্তার অশরীরি অস্তিত্বের উপস্থিতিতে তারা সনাতম ঘুমকে আশ্রয় করে মেনে নেয় – ‘প্রবুদ্ধমিব সুপ্তঃ’ ।

গল্পের শেষাংশে কর্তার বয়ানে জানা যায় কর্তা মৃত, তার ভূতও অবাস্তব। মানুষ সচেতন হলে ভূতের শাসনতন্ত্র এক মুহূর্তে ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। মানুষের মনেই বাসা বাঁধে ভূতের ভয় আর তারই রূপক হল ‘কর্তার ভূত’ গল্পটি। তাই সবদিক বিচার করে লেখকের সঙ্গে একমত হয়ে একথা অনায়াসেই বলা যায় গল্পের নামকরণ সার্থক, যথাযথ ও ঘটনার সামগ্রিতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়েছে।


কর্তার ভূত গল্প হতে প্রশ্ন-৮: “সেইখানেই তো ভূত” – কার উক্তি ? সেখানে ভূত বলতে কী বোঝানো হয়েছে ? (২০২৩)

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘কর্তার ভূত’ গল্পের একেবারে শেষে বুড়ো কর্তা এই উক্তি করেছেন।

বুড়ো কর্তা মারা যাওয়ার পর ভূত হয়ে দেশবাসীর ঘাড়ে চেপে বসেছিল। এই রকম অবস্থায় দেশের দু-একজন মানুষ যারা দিনের বেলায় ভুতুড়ে নায়েবের ভয়ে মুখ খুলতে পারে না তারা গভীর রাতে কর্তার শরনাপন্ন হয়। তারা কর্তাকে জিজ্ঞাসা করে কখন তিনি ছেড়ে যাবেন। উত্তরে কর্তা বলেন তিনি তো তাদের ধরে রাখেন নি তারা ছাড়লেই কর্তার ছেড়ে যাওয়া হবে। একথা শুনে তারা সকলেই বলে ‘ভয় করে যে কর্তা’। এরপরই বুড়ো কর্তার উক্তি ‘সেইখানেই তো ভূত’।

বুড়ো কর্তার এই কথাটি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। বুড়ো কর্তা মারা যাওয়ার পর দেশবাসী মনে করে যে বুড়ো কর্তা ভূত হয়ে তাদের ধরে রেখেছে। বুড়ো কর্তার অভিভাবকত্বে অনেকে শান্তি অনুভব করলেও দেশের নবীন প্রজন্ম বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে যে ভূতের হাত থেকে কীভাবে মুক্তি পাওয়া যাবে? 

আসল সত্য এই যে বুড়ো কর্তা তাদের ধরে রাখে নি বরং তারাই বুড়ো কর্তাকে ধরে রেখেছে। এমনকি যখন কর্তা দেশবাসীকে অভয় দিয়ে বলেন “তোরা ছাড়লেই আমার ছাড়া, তখনও ধর্মভীরু দেশবাসী সেটা পেরে ওঠে না। আসল কথা হল কর্তার ভূতের বাস্তব কোনো অস্তিত্ব নেই। মানুষের ভয় থেকেই ভুতের জন্ম হয় এবং মানুষই তাকে পোষণ করে।


Leave a Comment