ক্রন্দনরতা জননীর পাশে – সাহিত্যচর্চা (দ্বাদশ শ্রেণী বাংলা)

ক্রন্দনরতা জননীর পাশে – মৃদুল দাশগুপ্ত সাহিত্যচর্চা (দ্বাদশ শ্রেণী বাংলা)

ক্রন্দনরতা জননীর পাশে – মৃদুল দাশগুপ্ত


১. ‘আমি তা পারি না’- কবি কী পরেন না? ‘যা পারি কেবল’ – কবি কী পারেন ? ২+৩

আলোচ্য প্রসঙ্গটি সমাজমনস্ক মানবতাবাদী কবি মৃদুল দাশগুপ্তের ‘ক্রন্দনরতা জননীর পাশে’ কবিতায় বর্ণিত হয়েছে।

২০০৬ সালে সিঙ্গুর আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে কবির উজ্জ্বল মানবতাবোধের প্রকাশ ঘটেছে উক্ত কবিতায়। সমাজ সচেতক সহৃদয় কবি গভীর মানবতাবাদ ও বাস্তববাদে বিশ্বাসী। নিজের প্রিয়জনকে হারানো কিংবা প্রিয়জনের অস্বাভাবিক মৃত্যুকে তিনি কখনোই সমর্থন করতে পারেন নি। কবিতা লেখা বা গানের উদ্দেশ্য মানুষকে বাস্তব সম্পর্কে সচেতন করা। কবির প্রতিবাদী কণ্ঠ সামাজিক অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সরব হয়ে উঠেছে।

কবি পারেন না নিহত ভাইয়ের শবদেহ দেখে রাগে উত্তেজিত না হয়ে স্থির থাকতে। আন্তরিক কবি আরো পারেন না নিখোঁজ ছিন্নভিন্ন মেয়েকে জঙ্গলে খুঁজে পেয়ে বিধির বিচার চেয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে। তিনি আদর্শ মানুষ হিসেবে পারেন না অবৈধ কাজকর্মের সাথে আপোষ করতে বা চুপ করে বসে স্থির থাকতে।

রাজনৈতিক ক্ষুদ্র স্বার্থের ছুরিকাঘাতে মানবিকতা, মূল্যবোধ হত্যায় কবি ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত। সামাজিক এই ব্যাধি ও ক্ষতের উপর কবি সহমর্মিতার প্রলেপ দিয়েছেন। বিধির বিচারের অপেক্ষা না করে তিনি বেছে নিয়েছেন সরাসরি বিদ্রোহ, প্রতিবাদ। মানবতন্ত্রে বিশ্বাসী কবি বিবেক ও মানবতার ডানায় ভর করে সামাজিক অপশক্তির বিরুদ্ধে শুভ শক্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে রুখে দাঁড়িয়েছেন। কবির ব্যক্তি চেতনায় জেগে উঠেছে –

“আমি তা পারি না, যা পারি কেবল সেই কবিতায় জাগে আমার বিবেক, আমার বারুদ বিস্ফোরণের আগে। “

সামাজিক শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ হিসেবে কবি উপলব্ধি করেছেন, লেখনী শক্তি দিয়ে বিবেকবোধের জাগরণ ঘটিয়ে সামাজিক ক্ষত সম্ভব হতে পারে যদি সমাজের সমস্ত মানুষ অসামাজিক বা অপকর্মের বিরুদ্ধে সচেতন হয়। সামাজিক দায়বদ্ধ বা কর্তব্য পরায়ণ মানুষ হিসেবে কবি লেখনীর মাধ্যমে তাঁর ক্ষোভকে উগরে দিতে চান বিস্ফোরণের পূর্ব মুহূর্তে বারুদের তীব্র শক্তিতে। কবি পারেন কেবল তারই কবিতায় বিবেক বোধের অর্থাৎ মানবিক মূল্যবোধের প্রকাশ ঘটিয়ে সুস্থ সমাজ গড়ে তুলতে।


২. ‘কেন ভালোবাসা, কেন বা সমাজ / কীসের মূল্যবোধ !’ – ভালোবাসা, সমাজ, মূল্যবোধের কথা কবি কেন বলেছেন, তা আলোচনা কর। ৫

সমাজমনস্ক মানবতাবাদী কবি মৃদুল দাশগুপ্তের ‘ক্রন্দনরতা জননীর পাশে’ কবিতায় স্বদেশের বিপন্ন মুখচ্ছবির কথা ফুটে উঠেছে। রাজনৈতিক পীড়ন ও অত্যাচারে দেশের সাধারণ মানুষ রক্তাক্ত। স্বদেশের ব্যথিত মানবাত্মার সীমাহীন দুর্দশায় কবি শুনতে পেয়েছেন জননীর কান্না। মাতৃভূমির অশ্রুপাতের হাহাকারে ক্ষুব্ধ কবি অনুতপ্ত বোধ করেছেন।

মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন মানুষের মানবিক কাজ। ক্ষুদ্র স্বার্থ কে রক্ষা করতে গিয়ে ব্যক্তিস্বার্থ কে যারা প্রাধান্য দেয় তারা বিবেকহীন কিংবা অমানুষ। মানুষের প্রকৃত ধর্ম মনুষ্যত্ব বা মানবধর্ম, যা নিহিত আছে দয়া, মমতা, প্রেম, ভালোবাসা, মূল্যবোধ প্রভৃতির মধ্যে।

২০০৬ সালে সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণ কে কেন্দ্র করে প্রাণ হারিয়েছে বহু নিরপরাধ মানুষ। সিঙ্গুর কাণ্ডের সেই বর্বরতা মনে করিয়ে দেয় মিথ্যা ভালোবাসা ও সামাজিক মূল্যবোধের কথা। কবি কৃত্রিম ভালোবাসার মায়াজালে সামাজিক মূল্যবোধের পরিচয় দিয়ে মহৎ হতে চান নি। তিনি চেয়েছেন প্রকৃত বিবেক ও মনুষ্যত্বের প্রতিষ্ঠা করতে। নিহত ভাইয়ের মরদেহের পাশে দাঁড়িয়ে নির্মমভাবে অত্যাচারিত ভাইয়ের জন্য কবি বেদনার্ত আর সেই সঙ্গে ক্রুদ্ধও বটে। ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসার টানই তাঁর ব্যথিত চিত্তে রাগের জন্ম দিয়েছে। ভ্রাতৃ সম্পর্ক পরস্পরের মধ্যে স্নেহ ও ভালোবাসার বন্ধন নিবিড় কিংবা একান্ত আন্তরিক। তার ওপর আঘাত স্বাভাবিক ভাবেই ক্রোধের সঞ্চার করে। তাই রক্তের সম্পর্কের সহোদর ভাই না হলেও স্নেহের সম্পর্কের ওপর আঘাত জনিত কারণে ক্রোধ মাথা চাড়া দেয়।

বর্তমান সমাজে ভালোবাসা-মূল্যবোধ প্রায় লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। মানুষ তার মানবিক বোধ হারিয়ে ক্ষুদ্র স্বার্থকে আঁকড়ে ধরতে গিয়ে বিসর্জন দিচ্ছে আর্থ-সামাজিক বৃহত্তর স্বার্থকে। তাই প্রয়োজন কবির মতো সহৃদয় ও মানবিক হয়ে ভাইয়ের বিপদে পাশে দাঁড়িয়ে সমস্যা সমাধান ও আন্তরিক সহযোগিতা। আর তখনই প্রকৃত মনুষ্যত্বের প্রকাশ ঘটবে এবং বিবেক ও মানবতা বোধে উজ্জ্বল হয়ে এক নতুন সমাজ গড়ে উঠবে। সেই কারণেই কবি প্রশ্নোদ্ধৃত অংশটির অবতারণা করেছেন।

Leave a Comment