লৌকিক সাহিত্যের নানা দিক: একাদশ শ্রেণী বাঙ্গালীর ভাষা ও সংস্কৃতি (প্রথম পর্ব পঞ্চম অধ্যায়)

লৌকিক সাহিত্যের নানা দিক একাদশ শ্রেণী বাঙ্গালীর ভাষা ও সংস্কৃতি (প্রথম পর্ব পঞ্চম অধ্যায়)

Table of Contents

লৌকিক সাহিত্যের নানা দিক একাদশ শ্রেণী বাঙ্গালীর ভাষা ও সংস্কৃতি হতে ছোট ও বড় প্রশ্নের উত্তর

লৌকিক সাহিত্যের নানা দিক একাদশ শ্রেণী বাঙ্গালীর ভাষা ও সংস্কৃতি Mcq Question Answer 👆

‘লোক’ শব্দে বোঝায় নিবিড় সন্নিবিষ্ট, দীর্ঘ ঐতিহ্যশালী কোনো জনসমষ্টি এবং এই জনসমষ্টির সামূহিক কৃতিকেই একত্রে বলা যায় লোকসংস্কৃতি। লোকসংস্কৃতির একটি অন্যতন প্রধান বৈশিষ্ট্য হল নামহীনতা। অর্থাৎ কোনো কোনো সময়ে কিছু গানে বা কাব্য-কবিতায় লেখকের ভনিতা থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই লোককৃতিগুলির রচয়িতার নাম লোকসংস্কৃতির অন্য একটি বৈশিষ্ট্য হল যুগপৎ ঐতিহ্য ও আধুনিকতার দুটি ভিন্ন স্তরে সত্তাবান হয়ে ওঠা। অর্থাৎ, লোকসংস্কৃতি একদিকে যেমন তার শিকড়কে চারিয়ে দেয় জাতির অতীত ও সমষ্টিগত স্মৃতির গভীরে, তেমনই তার ডানা মেলা থাকে সমসাময়িক বাস্তবতা ও ভবিষ্যতের সম্ভাবনার দিকে। পরিবর্তনশীলতা এবং সংরক্ষণ-এ দুই-ই লোকসংস্কৃতির বিশিষ্ট চরিত্র লক্ষণ। লোকশিল্পীরা একদিকে যেমন তাঁদের গোষ্ঠী ও ইতিহাসের প্রতি দায়লগ্ন, তাদের প্রত্যেকের স্বকীয় সৃষ্টিশীলতা এবং নিজস্ব নান্দনিকতার প্রকাশ ও আবার তাদের শিল্পে একই সঙ্গে প্রকাশ পায়। লোকসংস্কৃতির যে-কোনো ধারায়, তা সাহিত্য, সংগীত, চারু বা কারুশিল্প, যাই হোক না কেন, সমস্ত ক্ষেত্রেই তাই প্রকৃতপক্ষে একটি গোটা জাতির জীবনভাবনা ও সংস্কৃতির প্রতিফলন সেখানে ঘটে থাকে।

বর্তমান অধ্যায়ে আমরা বাংলা লোকসাহিত্যের, বা বলা যায়, লোকসংস্কৃতির বিশিষ্ট সাহিত্যিক প্রকাশের চারটি প্রধান ধারা (ছড়া, ধাঁধা, প্রবাদ, কথা) নিয়ে আলোচনা করব। লোকসংস্কৃতির অন্য ধারাগুলি নিয়ে বিস্তারিতভাবে দ্বাদশ শ্রেণিতে তোমরা পড়বে। কবে, কোথায়, কে বা কারা এগুলি রচনা করেছিলেন তা জানা সম্ভব নয়, সংগতও নয়। এগুলি উদ্ভাবিত হওয়ার পর একটি জাতির ব্যাবহারিক জীবনে এবং চিন্তা ও কল্পনার জগতে এদের চিরস্থায়ী স্থান তৈরি হয়েছে, সেই কারণেই কোনো ব্যক্তি-রচয়িতার নাম ব্যতিরেকেই এগুলি হয়ে উঠেছে জাতির অক্ষয় সম্পদ।

একাদশ শ্রেণী লৌকিক সাহিত্যের নানা দিক হতে ছোট প্রশ্ন ও উত্তর

১। লৌকিক সাহিত্য বা লোকসাহিত্য কাকে বলে?

লৌকিক সাহিত্য বা লোকসাহিত্য হল সেই সাহিত্য, যা স্রষ্টার মুখে সৃষ্টি হয়ে মুখে মুখেই প্রসার লাভ করে, বিবর্তনকে স্বীকার করে এবং মানব অভিজ্ঞতাকে আশ্রয় করে বেঁচে থাকে।

২। লোকসাহিত্যের সৃষ্টি ‘লোক’ বলতে কাদের বোঝানো হয়? 

‘লোক’ বলতে বুঝতে হবে এমন একটি সংহত সমাজ, যে তার নিজস্ব জন-অংশের মধ্যে থেকেও এবং তাদের সঙ্গে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার ভিতর দিয়ে চিরাচরিত প্রথায় আপন বিশিষ্টতাকে অক্ষুন্ন রাখতে পেরেছে বা পারে। 

৩। লোকসাহিত্যের শ্রেণিবিভাগ গুলি কি? 

লোকসাহিত্যের শ্রেণিবিভাগগুলি হল – (১) লোককথা, (২) লোকসংগীত, (৩) ছড়া, (৪) গীতিকা, (৫) ধাঁধা, (৬) প্রবাদ এবং (৭) প্রবচন।

৪। ‘ছড়া’ কাকে বলে?

যে সব ছোটো ছোটো পদ্য মুখে মুখে আবৃত্তির জন্য যা মুখেমুখেই রচিত হয়, তাকেই বলে ‘ছড়া’।

৫। রবীন্দ্রনাথ ছড়াকে কার সঙ্গে তুলনা করেছেন?

রবীন্দ্রনাথ ছড়াকে ভাসমান মেঘের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, “আমি ছড়াকে মেঘের সহিত তুলনা করিয়াছি। উভয়েই পরিবর্তনশীল, বিবিধ অর্থে রঞ্জিত, বায়ুস্রোতে যদৃচ্ছা ভাসমান”।

৬। ছড়ার আকর্ষণের কারণ কী ?

ছড়ার আকর্ষণের কারণ দ্বিবিধ – রচনা নির্মিতি কৌশল এবং উপযুক্ত কণ্ঠধ্বনি। 

৭। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি ছড়ার গ্রন্থের নাম লেখো।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছড়ার গ্রন্থের নাম হল ছেলে ভুলানো ছড়া। 

৮। ছড়ার ক্ষেত্রে কাদের ভূমিকা বেশি লক্ষ্য করা যায়?

ছড়ার ক্ষেত্রে শিশুই প্রধান উপজীব্য এবং এরপরই হল নারী।

৯। ছড়ার মধ্যে কোন ধরনের ছড়া বিশেষ উল্লেখযোগ্য?

ছড়ার মধ্যে ঘুমপাড়ানি-ঘুমভাঙানি, বীরত্বব্যঞ্জক, সামাজিক, পারিবারিক, আনুষ্ঠানিক, বর্ণনামূলক, ধর্মীয় ও খেলার ছড়া বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

১০। বিড়াল বলে মাছ খাব না/পুলিশ বলে ঘুষ নেব না’ – কোন সম্প্রদায়ের কোন ধরনের ছড়া?

জেতোড় সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে প্রচলিত সামাজিক ছড়া এটি।

১১। মামা ধামা বাজানা/কাঠের পুতুল কিনে দিবো/ শাউড়ি নাচানা’ – কোন সম্প্রদায়ের কোন ধরনের ছড়া?

ছড়াটি জেতোড় জনগোষ্ঠীভুক্ত মানুষের একটি পারিবারিক ছড়া।

১২। একটি আনুষ্ঠানিক ছড়ার উল্লেখ করো।

একটি আনুষ্ঠানিক ছড়া হল – দুগগা মাগো দুগ্‌গা মা পিছনে তোর কে?/ভোলানাথ লুকিয়ে আছে গাঁজাটুকু দে।

১৩। একটি ধর্মীয় ছড়ার উল্লেখ করো।

একটি ধর্মীয় ছড়া হল “রোদ হয় জল হয় শিব দুগগার বিহা হয়। / জলে যাই ভাসি বুড়া মরে কাশি।

১৪। “ইচিক দানা মিচিক দানা দানার উপর দানা / লেডকার উপর লেড়কি নাচে লেড়কা হয় দু-আনা।” – কোন ধরনের ছড়া এটি?

ছড়াটি খেলার এবং এখানে বক্তা স্বয়ং শিশুই, যার অর্থ সঠিকভাবে বোঝা যায় না।

১৫। একটি আধুনিক ছড়ার উল্লেখ করো।

একটি আধুনিক ছড়া হল “আকাশে রকেট ছোটে রেডিও মোলে কাঁধে। / কানে কানে কথা বলে কলকাতা টেলিফোনে।

১৬। ছড়া মুখাত কাদের জন্য রচিত? 

ছড়া মুখ্যত শিশুদের জন্য রচিত।

১৭। ছড়া শিশু ছাড়া আর কাদের প্রয়োজন সিদ্ধ করে?

শিশু ছাড়া ছড়া বয়স্কদের ব্যাবহারিক প্রয়োজনে রচিত।

১৮। বাংলা ধাঁধার প্রথম সংগ্রাহক কে?

বাংলা ধাঁধার প্রথম সংগ্রাহক হলেন নবীনচন্দ্র দত্ত।

১৯। নবীনচন্দ্র দত্তের ধাঁধা সংক্রান্ত গ্রন্থটি কবে প্রকাশিত হয়েছিল?

১২৯৯ বঙ্গাব্দের (১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দ ফেব্রুয়ারি) মাঘ মাসের ‘বামাবোধিনী’ পত্রিকায় নবীনচন্দ্রের মোট ১০০টি ‘প্রহেলিকা বা হেঁয়ালী সংগ্রহ’ প্রকাশিত হয়েছিল।

২০। হেঁয়ালী বা ধাঁধা কাকে বলে?

হেঁয়ালী বা ধাঁধা হল যার আপাতত একটি অর্থ, উদ্দেশ্য অন্য অর্থ, অথবা কতকগুলি পদবিন্যাস, যার অর্থের জন্য ধোকা দেওয়া হয়, এরূপ গদ্য বা পদ্য লিখিত প্রশ্নকে হেঁয়ালী বা ধাঁধা বলে।

২১। হেঁয়ালীর প্রয়োজনীয়তা কী?

হেঁয়ালী মনোযোগ, অধ্যবসায় এবং অনেক বিষয়ে ধারণা শক্তি বৃদ্ধি করতে ও তরুণ বয়সে হেঁয়ালী বড়ো উপকারের।

২২। গদ্য অপেক্ষা পদ্য হেঁয়ালীর রূপ দীর্ঘকাল অবিকৃত থাকে কেন? 

গদ্য অপেক্ষা পদ্য সহজেই স্মৃতিতে থেকে যায় বলে পদ্য হেঁয়ালী দীর্ঘকাল অবিকৃত অবস্থায় থাকে।

২৩। জলপাইগুড়িতে ধাঁধার পরিচিতি কী নামে?

জলপাইগুড়িতে ধাঁধার পরিচিতি ‘ফাকরি’ নামে।

২৪। বাংলা ধাঁধাকে কেউ কেউ কয়টি ভাগে ভাগ করার কথা বলেছেন?

সুশীল হালদার আকৃতিগত বিচারে ধাঁধাকে – (ক) লৌকিক ধাঁধা, (খ) আক্রমণাত্মক ধাঁধা, (গ) প্রাচীন ধাঁধা, (ঘ) সাহিত্যিক ধাঁধা, (ঙ) নয়া সাহিত্যিক ধাঁধা, (চ) মার্জিত লৌকিক ধাঁধা, (ছ) ছড়ামূলক ধাঁধা ও (জ) বিদেশি ধাঁধা।

২৫। প্রকৃতি ভেদে ধাঁধাকে কয়টি ভাগে ভাগ করার কথা বলা হয়েছে? 

সুশীল হালদার প্রকৃতি ভেদে ধাঁধাকে – (ক) প্রকৃতি বিষয়ক, (খ) গার্হস্থ্য জীবন বিষয়ক, (গ) আচারগত, (ঘ) পারিবারিক সম্পর্কমূলক, (ঙ) আখ্যানমূলক, (চ) গাণিতিক ও (ছ) আলংকারিক ধাঁধা – এই সাতটি ভাগে ভাগ করেছেন।

২৬। ধাঁধায় স্থান পেয়েছে এমন কয়েকটি নিত্য ব্যবহার্য বস্তুর নাম লেখো। 

বাংলার পশ্চিম সীমান্তবর্তী গ্রামগুলিতে শালুক ফুল, বাঁশের কোঁড়, তাল, ডালিয়া ফল, চিচিঙ্গে, ব্যাঙের ছাতা, মুড়ি, খই প্রভৃতি ধাঁধায় স্থান পেয়েছে।

২৭। ‘প্রহেলিকা’র সংজ্ঞা প্রথম কে দিয়েছিলেন? 

‘প্রহেলিকা’র সংজ্ঞা প্রথম দিয়েছিলেন মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকার।

২৮। ধাঁধা প্রকাশিত হত এমন কয়েকটি পত্রিকার নাম লেখো।

ধাঁধা প্রকাশিত হত এমন কয়েকটি পত্রিকা হল ‘সখা’, ‘উৎসাহ, অতিথি’, ‘মুকুল’ প্রভৃতি। 

২৯। চট্টগ্রামের ধাঁধাগুলির বিশেষত্ব কি? 

মহম্মদ এনামূল হক চট্টগ্রামের ধাঁধা সম্পর্কে বলেছেন যে, বিভিন্ন দেশের ধাঁধা বুদ্ধির পরীক্ষা নিয়েই ব্যস্ত থাকে জীবনের সঙ্গে সম্পর্ক অল্প কিন্তু চট্টগ্রামের ধাঁধা কৃষকজীবনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।

৩০। বরিশাল জেলার ধাঁধা কী হিসাবে পরিচিত?

বরিশাল জেলার ধাঁধা ‘ভাঙানী’ রূপে পরিচিত এবং পাত্র-পাত্রী দেখার সময় পাত্র ও পাত্রীকে ভাঙানীর মাধ্যমে প্রশ্ন করা হয়।

৩১। যে সমস্ত লোকবাদ্য নিয়ে ধাঁধা রচিত তার নাম কী? 

যে সমস্ত লোকবাদ্য ধাঁধায় স্থান পেয়েছে তার মধ্যে রয়েছে ঢাক, বাঁশি, মাদল ও শঙ্খ, খঞ্জনি, করতাল, ঢোল, ঘুঙুর ইত্যাদি।

৩২। রামায়ণের কোন কোন চরিত্র নিয়ে ধাঁধা পাওয়া যায় ?

রামায়ণের সীতা, বাল্মীকি, লবকুশ, রাবণ, মন্দোদরীকে নিয়ে ধাঁধা রচিত হয়েছে।

৩৩। মহাভারতের কোন কোন চরিত্র নিয়ে ধাঁধা রচিত হয়েছে বেশি? 

মহাভারতের যুধিষ্ঠির, অভিমন্যু, অর্জুন, দ্রৌপদী, গান্ধারী, পঞ্চপাণ্ডবদের নিয়ে ধাঁধা রচিত হয়েছে বেশি।

৩৪। ধাঁধা সম্পর্কে সংকলন ও আলোচনার কৃতিত্ব দাবী করতে পারে এমন কয়েকজনের নাম লেখো।

ধাঁধা সম্পর্কে, সংকলন ও আলোচনার কৃতিত্ব দাবী করতে পারেন ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য, ড. নির্মলেন্দু ভৌমিক ও ড. শীলা বসাক।

৩৫। প্রথম কোন প্রবাদ সংকলন গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। 

রেভারেন্ড উইলিয়াম মর্টন নামে এক বিদেশি পাদ্রী ‘দৃষ্টান্ত বাক্য সংগ্রহ’ নামে ৮০৩ টি বাংলা প্রবাদ এবং ৭০টি সংস্কৃত প্রবাদের ইংরেজি অনুবাদ ও ব্যাখ্যা সহ সংকলন গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল।

৩৬। বাংলা প্রবাদ চর্চার সঙ্গে যুক্ত কয়েকজন বিদেশির নাম লেখো। 

বাংলা প্রবাদ চর্চায় উইলিয়াম মর্টন, মার্শম্যান, Lewin, Anderson প্রমুখের নাম যুক্ত।

৩৭। প্রবাদের বিষয়বস্তু মূলত কী?

প্রবাদের বিষয়বস্তু মূলত লোকচরিত্র এবং ব্যাবহারিক জগৎ।

৩৮। ‘Women’s Dialect in Bengali’ প্রবন্ধটির রচয়িতা কে?

‘Women’s Dialect in Bengali’ প্রবন্ধটির রচয়িতা হলেন ড. সুকুমার সেন।

৩৯। ‘যাহার লাগিয়া চুরি করি গিয়া, সেই জন কহে চোর’, ‘সে কহে বিস্তর মিছা যে কহে বিস্তর’, ‘মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন’, ‘নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়?’ – প্রবাদগুলির সংগ্রহীতা কে?

প্রবাদগুলির সংগ্রহীতা হলেন রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র রায়। 

৪০। কাশীরাম দাসের মহাভারতে উল্লিখিত একটি প্রবাদের নাম লেখো।

কাশীরাম দাসের মহাভারতে উল্লিখিত উল্লেখযোগ্য একটি প্রবাদ হল ‘চোরা নাহি শোনে ধর্মের কাহিনি’।

৪১। কোন সময়কে বাংলা সাহিত্যে প্রবাদের যুগ’ বলা হয়। 

ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ পাদ পর্যন্ত হল ‘বাংলা সাহিত্যে প্রবাদের যুগ’। কারণ, ভবানীচরণ, কালীপ্রসন্ন সিংহ, টেকচাঁদ ঠাকুর, দাশরথি রায়, দীনবন্ধু মিত্র, অমৃতলাল বসু পর্যন্ত তাদের লেখায় প্রবাদ ব্যবহার করেছেন। 

৪২। সংস্কৃত বাক্যাংশ কীভাবে বাংলা প্রবাদে উত্তীর্ণ হয়েছে উদাহরণ দাও।

সংস্কৃত বাক্যাংশ বাংলা প্রবাদে উত্তীর্ণ হয়েছে এর উদাহরণ হল শুভস্য শীঘ্রম, মধুরেণ সমাপয়েৎ, মুখেন মারিতং জগৎ প্রভৃতি।

৪৩। প্রবাদের লক্ষণ কী?

প্রবাদ আকারে ছোটো অথচ চোখা ভাষায় নিরেট বাক্য, প্রবাদের উদ্ভব ও প্রচলন লোকের মুখে মুখে আমাদের দেশে মেয়েদের মুখেমুখেও প্রবাদ সূচনা করে ব্যষ্টি বা সমষ্টিকে।

৪৪। কৃষিসংক্রান্ত প্রবাদকে কী বলে?

কৃষিসংক্রান্ত প্রবাদকে বলে ‘খনার বচন’ অর্থাৎ কিংবদন্তী প্রখ্যাত স্ত্রীজ্যোতির্বিজ্ঞানী খনার মন্তব্য।

৪৫। আবহাওয়া সংক্রান্ত প্রবাদকে কী বলে?

আবহাওয়া সংক্রান্ত প্রবাদকে বলে ডাকের বচন অর্থাৎ কিংবদন্তী নায়ক ডাক-এর নামে প্রচলিত। তবে ‘ডাক’ অর্থে প্রাজ্ঞ ব্যক্তিকেও বোঝায়।

৪৬। প্রবাদের ক্ষেত্র কী?

বাংলা প্রবাদের ক্ষেত্র গার্হস্থ্যজীবন ও তার নানা সমস্যা। 

৪৭। ডাক ও খনার বচন সম্পর্কে আলোচনা করেছেন এমন একজন লেখকের নাম লেখো।

হীরেন্দ্রকুমার বসু অর্চনা পত্রিকায় ‘ডাক ও খনার বচন’ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।

৪৮। কোন দেবতা সম্পর্কে বেশি প্রবাদ রয়েছে।

বাঙালিদের কাছে জনপ্রিয় দেবদেবীদের মধ্যে অন্যতম হলেন জগন্নাথ, তাই এই দেবতাকে নিয়ে প্রবাদের সংখ্যা বেশি।

৪৯। জগন্নাথ ছাড়া আর কোন কোন দেবদেবী সম্পর্কে প্রবাদ রয়েছে?

জগন্নাথ ছাড়া দুর্গা, কালী, শিব, মনসা, হরি, কৃষ্ণ, গোবিন্দ সম্পর্কে প্রবাদ রয়েছে।

৫০। সামাজিক চরিত্র নিয়ে রচিত প্রবাদগুলির বৈশিষ্ট্য কী?

সামাজিক চরিত্র নিয়ে রচিত প্রবাদে কোনোপ্রকার রূপকের আশ্রয় না নিয়ে বিভিন্ন বৃত্তিভোগী মানুষ সম্পর্কে সরাসরি মন্তব্য করা হয়েছে।

৫১। বাংলা প্রবাদে নারীদের কোন দিকগুলি ফুটে উঠেছে?

বাংলা প্রবাদ মূলত সমালোচনামূলক, এখানে নারার বাচালতা, কলহপরায়ণতা, বুদ্ধিসত্তা, ঈর্ষা প্রভৃতি নির্মমভাবে সমালোচিত হয়েছে।

৫২। মুসলিম সম্প্রদায়কে নিয়ে লেখা দুটি প্রবাদ উল্লেখ করো।

মুসলিম সম্প্রদায়কে নিয়ে লেখা প্রবাদ হল চাচা আপন চাচি পর, চাচার মেয়েকে বিয়ে কর’, ‘ঘরামি তুমি সরে যাও, বিবি বাজারে যাবে’।

৫৩। কোন বিষয়ের প্রবাদগুলির কেবল বাচ্যার্থ রয়েছে ? 

কৃষি, জলবায়ু, স্বাস্থ্য বিষয়ের প্রধানগুলির কেবল বাচ্যার্থ পাওয়া যায়।

৫৪। পাশ্চাত্য পণ্ডিত ও গবেষকদের ধারণা কী ছিল?

পাশ্চাত্য ও পণ্ডিত ও গবেষকদের ধারণা ছিল যে, ভারত উপমহাদেশ লোককাহিনিতে যেমন সমৃদ্ধ তেমনই সমৃদ্ধ পৌরাণিক কাহিনিতেও।

৫৫। বাংলা লোককাহিনি কোথা থেকে গ্রহণ করা হয়েছে?

বাংলা লোককাহিনি রামায়ণ, মহাভারত, পঞ্চতন্ত্র, জাতক কাহিনি বৃহৎ কথা, কথাসরিৎ সাগর, বেতাল পঞ্চবিংশতি প্রভৃতি থেকে গ্রহণ করা হয়েছে।

৫৬। বাংলা লোককথা সংগ্রহ ও চর্চার ইতিহাসে দুজন বিদেশির নাম লেখো। ।

বাংলা লোককথ্য সংগ্রহ ও চর্চার ইতিহাসে দুজন বিদেশির নাম হল জি এইচ ড্যামান্ট এবং ডেল্টন।

৫৭। বাংলা লোককথা সংগ্রহের প্রথমদিকের ইতিহাসে একজন বাঙালি মিশনারির নাম লেখো।

বাংলা লোককথা সংগ্রহের প্রথমদিকের ইতিহাসে একজন বাঙালি মিশনারি হলেন রেভারেন্ড লালবিহারী দে।

৫৮। উইলিয়াম কেরির ইতিহাসমালা গ্রন্থটিতে কোন বিষয়বস্তু আছে? 

‘ইতিহাসমালা’ গ্রন্থে বাংলায় প্রচলিত রূপকথা ও উপকথা আছে এবং পঞ্চতন্ত্র, হিতোপদেশ প্রভৃতি থেকে সংগৃহীত গল্পও রয়েছে।

৫৯। ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ গ্রন্থের সংকলকের নাম কী?

‘ঠাকুরমার ঝুলি’ গ্রন্থটির সংকলক হলেন দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার। 

৬০। ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ গ্রন্থের কয়েকটি গল্পের নাম লেখো।

‘ঠাকুরমার ঝুলি’ গ্রন্থের কয়েকটি গল্প হল কলাবতী রাজকন্যা, ঘুমন্তপুরী, কাঁকনমালা, কাঞ্চনমালা, সাতভাই চম্পা, ডালিমকুমার ইত্যাদি। 

৬১। ‘উপকথা’ বলতে কোন বিষয়কে বোঝায়?

‘উপকথা’ বলতে জীবজন্তু বিষয়ক লোককাহিনিকে বোঝায়।

৬২। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর কয়েকটি গ্রন্থের নাম লেখো।

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর কয়েকটি গ্রন্থের নাম হল ‘টুনটুনির বই’, ‘ছেলেদের রামায়ণ’ ‘ছোটোদের মহাভারত’ ‘পৌরাণিক কাহিনি’ ‘সেকালের কথা’ প্রভৃতি। 

৬৩। মেয়েদের ব্রতকথা’ সম্পর্কে লেখা একজন রচয়িতার নাম লেখো। 

‘মেয়েদের ব্রতকথা’ সম্পর্কে লেখা একজন রচয়িতা হলেন আশুতোষ মুখোপাধ্যায়।

৬৪। মেয়েদের ব্রতকথাগুলির গুরুত্ব কী?

‘ব্রতকথা’র মধ্য দিয়ে হিন্দু রমণীগণ ছোটোবেলা থেকে স্বামীভক্তি, গুরুভক্তি, ধর্মে বিশ্বাস, গৃহকর্মে আস্থা, ইন্দ্রিয় সংযম প্রভৃতি সদগুণ শিক্ষা করে সচ্চরিত্রা ও পতিপরায়ণা হয়ে উঠতে পারবেন।

৬৫। ‘ঠাকুরদাদার রূপকথা’ গ্রন্থটির লেখক কে?

‘ঠাকুরদাদার রূপকথা’ গ্রন্থটির লেখক হলেন কালীমোহন ভট্টাচার্য।

৬৬। ‘ঠাকুরদাদার রূপকথা’ গ্রন্থের কয়েকটি গল্পের নাম লেখো। 

‘ঠাকুরদাদার রূপকথা’ গ্রন্থের কয়েকটি গল্প হল সোনার পুতুল, চাবি, কবিরাজ পুত্র, কনকলতা, ফুলকুমার, ব্যান্ডের খোলায় ইত্যাদি।

৬৭। রূপকথার গল্প বলতে কী বোঝায়।

রূপকথা বলতে রাক্ষস, ডাইনী, রাজ-রানি রাজপুত্র, রাজকন্যা প্রমুখদের নিয়েই গল্পকে বোঝায়।


১। প্রবাদ ও প্রবচন বলতে কি বোঝো? অন্তত চারটি বাংলা প্রবাদের উদাহরণ দাও। ৩+২ (২০১৪) অথবা, প্রবাদ ও প্রবচন বলতে কী বোঝো? কয়েকটি প্রবাদ-এর উদাহরণ বাক্যসহ লেখো। ২+৩  (২০২৩)

উৎস :- ‘প্রবাদ’ শব্দটির উৎপত্তি প্র-✓বিদ+অ। এর অর্থ হল জনশ্রুতি বা পরম্পরাগত বাক্য । লোক-প্রবাদের অর্থ আরো ব্যাপকতর। ল্যাটিন PROVERBIUM শব্দটি হল একটি সংযোজক শব্দ। ‘PRO’ অর্থ পূর্ব এবং ‘VERBIUM’ বলতে বোঝায় শব্দ। ফলত, PROVERB শব্দটি অভিজ্ঞতা, উক্তি ইত্যাদি নানা অর্থকে অভিব্যক্ত করে ।

সংজ্ঞা :- প্রবাদ হল একটি জাতির সুদীর্ঘ ব্যবহারিক জীবন অভিজ্ঞতার সংক্ষিপ্ততম রসাভিব্যক্তি। প্রবাদ যেমন একদিন থেকে অতি প্রাচীন (পূর্ব থেকে প্রচলিত হয়ে আসছে বলে), তেমনি অন্যদিক থেকে আধুনিক (প্রচলিত মনোভাব প্রকাশ করে বলে)।

যাই হোক, যে সব প্রাজ্ঞ উক্তি লোক পরম্পরায় জনশ্রুতি অনুসারে চলে আসছে, তাই হলো প্রবাদ। প্রবাদ সম্পর্কে বলা হয়, “wite of one wisdom of many”। যে কোনো প্রবাদই বহুকালের বহুজনের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে বিস্মৃত বা স্মরনীয় কোনো মানুষের বাচনশৈলী দ্বারা অধারিত হয়। 

এবার প্রবচন শব্দটি নিয়ে কিছু আলোচনার অবকাশ আছে। বাংলায় ‘বচন’ শব্দটির ব্যাপক প্রচলন দেখা যায়। যেমন, ডাকের বচন, খনার বচন, বৃদ্ধের বচন, চাণক্য বচন প্রভৃতি। প্রকৃতপক্ষে প্রবাদ বলতে আমরা এখন যা বুঝি এক সময় বচন শব্দ দিয়েই তা বোঝানো হত। রবীন্দ্রনাথ যদিও অন্য মতের পোষক। প্রভাত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়কে লেখা একটি চিঠিতে দেখি তাঁর মতে প্রবাদ কথাটির মধ্যে একটি গল্পের ভাব আছে, কিন্তু প্রবচন ছাঁটা-কাটা কথা মাত্র, আনন্দ-দুঃখ বা কিছু অভিজ্ঞতার জ্ঞান ছাড়া তার আর অন্য কিছু পরিবেশনের নেই। 

যদিও বর্তমানে প্রবাদ ও প্রবচন প্রায় সমার্থক এবং পরিপূরক শব্দ হিসেবেই ব্যবহৃত হয়। সেই অর্থে কৃষি-বিষয়ক খনার বচন বা লৌকিক জ্যোতিষ বিষয়ক ডাকের বচনও ব্যাবহারিক জীবনের অভিজ্ঞতালব্ধ সত্যকেই সহজ-সরল অথচ সালংকারভাবে প্রকাশ করে বলে এগুলিকেও প্রবাদের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।

প্রবাদের বৈশিষ্ট্য :- (ক) প্রবাদ লোকসাহিত্যের এক গুরুত্বপূন উপসর্গ। প্রবাদের ভাব ও অর্থ সংক্ষিপ্ত আকারে একাশিত।

(খ) প্রবাদের অন্তনিহিত অর্থ অনুধাবন করতে হয়। যার মধ্যে পাওয়া যায় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি, যা জীবন অভিজ্ঞতার শিল্পিত ফসল। 

(গ) প্রবাদ হল জনরব বা জনশ্রুতি বা পরম্পরাগত বাক্য। 

(ঘ) প্রবাদের ধর্ম সত্যকখন। তবে অতিকথন প্রবাদে প্রশ্রয় পায় না, এতে কাব্য গুণের প্রকাশও কম।

(ঙ) প্রবাদে বর্ণের লালিত্য থাকে না। থাকে, ঐতিহ্য আশ্রয়ী অর্থের মহিমা।

(চ) প্রবাদ প্রাচীন হলেও চিকালীন। এর মধ্যে উচ্চ মননশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়। 

(ছ) প্রবাদ মূলত অশিক্ষিত (প্রাতিষ্ঠানিকভাবে) লোকের দীর্ঘ অভিজ্ঞতলব্ধ সৃষ্টি।

(জ) ক্ষেত্রবিশেষে প্রবাদে ছড়া বা ধাঁধার মতো ছন্দবদ্ধ চরণ দেখা যায়।

প্রবাদের উদাহরণ :- (ক) চোরে চোরে মাসতুতো ভাই। 

(খ) নাচতে না জানলে উঠোন বাঁকা।

(গ) ফাঁকা কলসির আওয়াজ বেশি।

(ঘ) পেটে খেলে পিঠে সয়। 

(ঙ) শিকারী বিড়াল গোঁফে চেনা যায়।


২‌। ধাঁধার বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর। অন্তত দুটি ধাঁধার উদাহরণ দাও। ৩+২  (২০১৫, ২০১৮)

ধাঁধা :- ধাঁধা বলতে সাধারণত সংক্ষিপ্ত হেঁয়ালিপূর্ণ শ্লোককেই বোঝানো হয়। লোকসমাজের বুদ্ধি চর্চার প্রকাশ হিসেবে ধাঁধা হলো এক ঐতিহ্য নির্ভর কচিৎ ঐন্দ্রজালিক, মৃদ কৌতূকময় মানসিক ক্রিয়া।

প্রকৃতি বা লক্ষণ :- ধাঁধা লোকসাহিত্য তথা লোকসমাজে অত্যন্ত আদরনীয় একটি বিষয়। এর সাহিত্যিক গুণ রচনাভঙ্গিতে,  জীবনায়নে এবং প্রত্যক্ষ বস্তুর সরল রূপায়নের মধ্যে দিয়ে অনাবিল ভাবে প্রকাশ পায়। এর প্রকৃতি নির্ণয়ে বলতে হয় –

(ক) ধাঁধার বহিরাঙ্গিক আকৃতি ক্ষুদ্র ও সংহত। 

(খ) ধাঁধার মধ্যে একটি রহস্য বা প্রহেলিকা তৈরির প্রবনতা থাকে। 

(গ) ধাঁধা সাধারণত প্রশ্নবাচক। প্রশ্ন উচ্চারনের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতটিই ধাঁধার প্রাণ। প্রহলিকার উত্তর জানতে চাওয়াটাই ধাঁধার ধর্ম। 

(ঘ) ধাঁধা হল কৌতুকময় এবং নির্মল আনন্দদায়ক।

(ঙ) ধাঁধার মধ্যে দিয়ে বুদ্ধি চর্চার সঙ্গে সঙ্গে ঐন্দ্রজালিক ইঙ্গিতটিই অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত থাকে। তাই বুদ্ধি বা মননের সাহায্যে সব ধাঁধার উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়, সেখানে ঐতিহ্যজ্ঞান একান্ত আবশ্যক। 

যেমন – “এক হাত গাছটি/ ফুলে তার পাঁচটি।” (হাতের পাঁচটি আঙুল, পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের জীব)।

ধাঁধার শ্রেণিবিভাগ :- ধাঁধার বিজ্ঞানসম্মত শ্রেণিবিভাগ প্রায় অসম্ভব। কেননা মানব চিন্তা-বুদ্ধি-কর্মের যাবতীয় বিষয় ধাঁধার অন্তর্গত হতে পারে। তবু উপলব্ধিগত সুবিধার জন্য আমরা এর কতগুলি শ্রেণিবিভাগ করে নিতে পারি, বিষয়গত ভাবনার ওপর ভিত্তি করে। তবে তার আগে মনে রাখতে হবে যে, ধাঁধা সচেতন শিল্পী মনের সৃষ্টি। ধাঁধার মধ্যে যুগরুচি ও রসবোধের পূর্ণাঙ্গ রূপটি প্রচ্ছন্নতায় ব্যক্ত হয়। তাই এর শ্রেনিগত বিবর্তনও খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। যাই হোক, ধাঁধার শ্রেণিবিভাগ করার প্রয়াস রাখা যাক —

ধাঁধা ৬ প্রকার – (ক) ঐন্দ্রজালিক, (খ) আচারমূলক, (গ) আধ্যাত্মিক, (ঘ) লৌকিক, (ঙ) নীতিমূলক ও (চ) সাহিত্যিক। 

আরেক ভাবে ধাঁধার শ্রেণিবিভাগ করা যায়। সেক্ষেত্রে ধাঁধা ২ প্রকার – (i) সাহিত্যাশ্রয়ী ও (ii) লৌকিক। লৌকিক ধাঁধাকে আবার ৪ ভাগে করা যায় – (ক) নরনারী বিষয়ক, (খ)প্রকৃতি বিষয়ক, (গ) গার্হস্থ্যধর্মী (ঘ) পশুপাখি বিষয়ক। সাহিত্যাশ্রয়ী ধাঁধার প্রচুর নিদর্শন রয়েছে মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্য ও অনুবাদ সাহিত্যে। 

যেমন – চন্দ্র বান পক্ষ ঋতু শক সুনিশ্চয়।/ বিরাট হইল সাঙ্গ কাশীরাম দাস কয়।।” 

লোকসমাজে তথা লোকমুখে প্রচলিত অলিখিত জনসৃষ্ট ধাঁধাই হল লৌকিক ধাঁধা। 

যেমন – “ছাই ছাড়া শোয় না / লাথি ছাড়া ওঠে না।” (কুকুর)


৩। ছড়ার বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা। যে কোনো দুই ধরনের ছড়ার উদাহরণ দাও।  ৩+২  (২০১৬, ২০১৯) 

ছড়া বাংলা লোকসংস্কৃতির একটি বিশেষ অঙ্গ। ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ অনুযায়ী লৌকিক বিষয় নিয়ে রচিত গ্রাম্য কবিতা হল ছড়া। সাধারণত মৌখিক আবৃত্তির জন্য ছড়া গুলি মুখে মুখে রচিত হয়। ছড়া অনেক সময় সুর করেও আবৃত্তি করা হয়।

ছড়ার বৈশিষ্ট্য :- (ক) মূলত শিশুদের জন্য ছড়া রচিত, ছড়া কোনো বার্তা বা মনোভাব প্রকাশের জন্য রচিত হয় না। ছড়ার জন্ম সাধারণত শিশুদের ভোলানোর জন্য বা ঘুম পাড়ানোর জন্য। মেয়েলি ছড়াগুলি অবশ্য একান্তভাবেই মেয়েদের সম্পদ।

(খ) ছড়াগুলি শিশুর প্রলাপের মতো অনেকসময় অর্থহীন হয়। শিশুমনে অর্থের বিশেষ কোনো ভুমিকা নেই বলে ছড়া রচনার সময় অর্থের দিকটি খেয়াল না রাখলেও চলে।

(গ) ছড়াতে থাকে পরস্পর সম্পর্কহীন কতকগুলি ছবির সমাহার। আসলে শিশুর সদাচঞ্চল মনের মতো ছড়ার কথাগুলি এলোমেলো হয়।

(ঘ) ছড়াগুলি প্রকৃতপক্ষে মৌখিক আবৃত্তি করার জন্য। তাই শুনতে ভালো লাগে এবং সহজে মনে থাকে এমন শব্দ ছড়াতে প্রয়োগ করা হয়।

পরিশেষে বলা যায় যে, সকল যুগে সকল দেশে শিশুমনের প্রকৃতি একই রকমের। তাই ছড়ার ভাণ্ডার সব ভাষাতেই যথেষ্ট সমৃদ্ধ। বাংলা ভাষার ছড়াগুলিও বাংলা লোকসাহিত্যের বিশেষ সম্পদ।

উদাহরণ :- (ক) মেয়েলি ছড়া –

আম পাতা জোড়া জোড়া,

মারবো চাবুক চড়ব ঘোড়া। 

ওরে বিবি সরে দাঁড়া, 

আসছে আমার পাগলা ঘোড়া। 

পাগলা ঘোড়া খেপেছে, 

বন্দুক ছুড়ে মেরেছে। 

অলরাইট ভেরি গুড 

মেম খায় চা বিস্কুট ৷৷

(খ) ছেলে ভুলানো ছড়া :

সোনা সোনা ডাক ছাড়ি, 

সোনা নেইকো বাড়ি, 

মনা মনা ডাক ছাড়ি 

মনা আছে বাড়ি। 

আয়রে মনা আয়, 

দুধ মাখা ভাত কাগে খায় ।


৪। লোককথা কাকে বলে? লোককথার দুটি শাখার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।  ১+২+২  (২০১৭) অথবা, লোককথা কাকে বলে? দুটি লোককথার নাম লেখ এবং যে কোনো একটি লোককথা সম্পর্কে তোমার মত লিপিবদ্ধ কর। ২+১+২  (২০২০)

‘লোক’ শব্দে বোঝায় নিবিড় সন্নিবিষ্ট, দীর্ঘ ঐতিহ্যশালী কোনো জনসমষ্টি এবং এই জনসমষ্টির সামূহিক কৃতিকেই একত্রে বলা যায় লোকসংস্কৃতি। লোকসংস্কৃতির প্রধানতম অঙ্গ হল লোককথা। যে সকল কথা বা কাহিনি বহুযুগ ধরে লোকমুখে প্রচলিত আছে সেগুলিকে লোককথা বলে। 

লোক সমাজে প্রচলিত রূপকথা, উপকথা, নীতিকথা, ব্রতকথা, পুরানকথা, জনশ্রুতি – এসবই লোককথার অন্তর্গত। নিচে লোককথার দুটি শাখা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল – 

(ক) রূপকথা :-

রূপকথা বলতে সাধারনত সেইসব কাহিনিকে বোঝায় যার প্রেক্ষাপটে রয়েছে একটি কল্পিত দেশ, যার নায়ক কোনো একজন ভাগ্যহত রাজপুত্র অথবা সাধারণ দরিদ্র যুবক, যে কাহিনির নায়িকা কোন এক রাজকন্যা এবং অলৌকিক ক্ষমতা, যাদুবিদ্যা প্রভৃতির সমাবেশে এমন এক বিচিত্র ও জটিল ঘটনাক্রমে কাহিনি অগ্রসর হয় যা সাধারণ বুদ্ধিতে অবিশ্বাস্য বলে মনে হবে। পৃথিবীর সমস্ত দেশের রূপকথাতেই নরবলি, নরমাংস ভক্ষন প্রভৃতির উল্লেখ পাওয়া যায়। এইজন্য পণ্ডিতদের অনুমান রূপকথা হল প্রাগৈতিহাসিক যুগে মানুষের দ্বারা রসসৃষ্টির প্রথম প্রয়াস।

রূপকথার মধ্যে অতিপ্রাকৃত চরিত্রগুলি প্রাধান্য পায়। কাহিনিগুলি বেশ দীর্ঘ হয়। রচনাও বেশ জটিল। রূপকথার মধ্যে প্রেমকাহিনি নেই, হৃদয়ের সঙ্গে হৃদয়ের যোগ নেই, রয়েছে গভীর রূপমোহ। রূপকথার গল্প সম্পর্কে জনৈক সমালোচক বলেছেন, রূপকথা মূলত নায়ক-নায়িকার রোমাঞ্চকর অভিযান। রূপকথার চরিত্রের নামকরণ নেই এবং কাহিনি নির্বিশেষ চরিত্রে পরিপূর্ণ।

(খ) ব্রতকথা :-

ব্রতকথা মূলত গ্রামের মেয়েদের আচার এবং পূজা অনুষ্ঠানে পালনের কাজে ব্যবহার করা হয়। ব্রতকথায় মেয়েরা তাদের ভবিষৎ জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষা, সুখ-দুঃখ, সতীনের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ প্রভৃতি ব্যক্ত করে। এখানে দেব-দেবীর চরিত্র মানুষের মতো দোষত্রুটিপূর্ণ বা অনেক সময় ভাগ্যের প্রতীক। ব্রতকথায় দেব-দেবী রক্ষণশীল হিন্দুসমাজের দেব-দেবী নয়। ব্রতকথার জগৎ পার্থিব এবং নৃতাত্ত্বিক মূল্য অপরিসীম।

বাংলার ব্রতকথা গুলি হল লৌকিক দেবদেবীর মাহাত্ম্য প্রচারমূলক উপাখ্যান। অনিষ্টকারী দেবতাকে প্রসন্ন করে বরলাভের মাধ্যমে গৃহস্থের কল্যানসাধনই হল ব্রতকথাগুলির মূল উপজীব্য। দেবতাদের প্রতি মানুষের স্বাভাবিক ভয় এবং ভক্তির কারনে ব্রতকথা গুলি একসময় খুব জনপ্রিয় ছিল।


৫। ছড়ার সৃষ্টি ও প্রকৃতি সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করে।

সাহিত্য সমাজের দর্পণ। তাই সাহিত্যের মধ্যে সমাজ ও সময় দুই-ই প্রতিফলিত হয়। সাহিত্যের মধ্যে আবার লিখিত সাহিত্য যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে মৌখিক সাহিত্য। মৌখিক, সাহিত্য সাধারণত নিরক্ষর শ্রেণিহীন সম্প্রদায়ের সামাজিক ফসল, কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ের কিংবা ব্যক্তিবিশেষের সৃষ্টি নয়। তবে এটাও মনে রাখতে হবে মৌখিক সাহিত্য ব্যক্তিবিশেষের, তারপর ক্রমাগত পুনর্গঠন এবং পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে তা পরিণামে একটি সামগ্রিক রূপ লাভ করে।

প্রথমেই বলা যায়, ছেলে ভুলানো ছড়ার কথা। এই ছড়া প্রত্যেক দেশে ও কালে সর্বাধিক প্রচারিত। বাংলা ছেলে ভুলানো ছড়াকে দু-ভাগে ভাগ করা যায়। একটি হল জননী বা ধাত্রীর দ্বারা শিশুকে ঘুম পাড়ানো বা ভোলানোর জন্য আবৃত্তি করে। ছেলে ভুলানো ছড়ার একটি প্রচলিত দোলনার গান হল –

“দোল দোল দোল দোলন হরি/কে দেখেছে হরি

ঝোলনাতে ঝুলছে আমার ঐ গিরিধারী।”

ছেলে ভুলানো ছাড়া’র পর বলা যায় খেলার ছড়া। এই ছড়া একটু বেশি বয়সের শিশুরা খেলার ছন্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আবৃত্তি করে। খেলার ছড়াগুলো শিশুদের নিজস্ব সৃষ্টি। শিশুদের লক্ষ্য ছড়ার তাল ও ছন্দের দিকে বেশি থাকায় ছড়ার অর্থ প্রায় থাকে না বললেই হয়। যেমন –

ইচিং বিচিৎ/জামাই চিচিৎ।/তায় পল্লো মাকড় বিচিং।” খেলার প্রকৃতি অনুযায়ী নানা ধরনের ছড়াও রয়েছে। প্রশ্নোত্তরবাচক খেলার মধ্যে দুজন অংশগ্রহণকারীর মধ্যে সংলাপের আকারে রচিত হয়। এই গুলি খুবই বৈচিত্র্যমন্ডিত।

ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য ছড়া প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, “বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, বিশেষত মেয়েদের ক্ষেত্রে, ছড়াগুলো ক্রমশ জীবনধর্মী হয়ে ওঠে। যদিও মূলত সেগুলো খেলার ছড়াই থেকে যায়, তবু অসংলগ্ন হলেও কিছু কিছু বাস্তবজীবনের কথা তার ভিতরে প্রবেশ করতে থাকে। এই সকল চিন্তা পরিবার এবং পারিবারিক জীবনকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে। এক্ষেত্রে ছড়াগুলি শিশুকন্যার কুমারীজীবন ও বিবাহিত জীবনকে কেন্দ্র করে প্রকাশ পায়। যেমন – যমুনাবতী সরস্বতী কাল যমুনার বিয়ে / যমুনা যাবেন শ্বশুরবাড়ি কালীতলা নিয়ে।” মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে পিতামাতারা যে অন্তর্বেদনা অনুভব করে তারও প্রকাশ ঘটেছে ছড়াতে। যেমন –

আজ দুর্গার অধিবাস, কাল দুর্গার বিয়ে। দুর্গা যাবেন শশুরবাড়ি সংসার কাঁদিয়ে।” 

বিবাহ উৎসবের নানান বর্ণনা পাওয়া যায় ছড়ায়। ছড়ার প্রকৃতিতে আরও রয়েছে বারবার ছড়া, সামাজিক ছড়া, আনুষ্ঠানিক ছড়া, ধর্মীয় ছড়া, ঐন্দ্রজালিক ছড়া, আধুনিক ছড়া প্রভৃতি। ছড়ার প্রকৃতি এই যে তা নিয়তই পরিবর্তিত হতে থাকে। ছড়ার এই সজীব চরিত্রই এর সর্বপ্রধান বৈশিষ্ট্য।


৬। মৌখিক সাহিত্যের মধ্যে ধাঁধার গুরুত্ব আলোচনা করো।

মৌখিক সাহিত্যের মধ্যে ধাঁধার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। ধাঁধা সাধারণ গ্রাম্য মানুষই সৃষ্টি করেছে। ধাঁধার মধ্যে রয়েছে জ্ঞান-বুদ্ধির প্রকাশ। ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য বলেছেন, “প্রতিটি ধাঁধাই একটি জ্ঞানের ধাঁধা জ্ঞানবুদ্ধির প্রকাশ বিষয়কে কৌতুকের ছদ্মবেশে চাতুর্যপূর্ণ ভাষার সহযোগিতায় পরোক্ষে ব্যক্ত করে।” কিন্তু চিন্তা এবং বুদ্ধির উদ্দেশ্যে নিবেদিত হলেও ধাঁধা নিতান্ত কাব্যগুণশূন্য নয়। ধাঁধাকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। তার মধ্যে একটি হল সাহিত্যিক ধাঁধা এবং অপরটি হল লৌকিক ধাঁধা। লৌকিক ধাঁধাকে ভিত্তি করেই সাহিত্যিক ধাঁধা গঠিত হয়েছে। তবে লৌকিক ধাঁধাকে ভিত্তি করে সাহিত্যিক ধাঁধা গঠিত হলেও লৌকিক চরিত্র অক্ষুণ্ণ থাকে। 

ধাঁধা প্রশ্নোত্তরের মতো করে উপস্থাপিত করা হয়। ধাঁধা একজন জিজ্ঞাসা করে অপর একজন উত্তর দেয়। ধাঁধা শিশুর কাছে যেমন উপভোগ্য, বড়োদের কাছেও তেমনি উপভোগ্য। বিশেষত ধাঁধা অবসর যাপনের প্রধান অবলম্বন। তবে ধাঁধার মধ্য দিয়ে মানুষের বুদ্ধি ও কল্পনা দূর ও বিসদৃশ্যকে একসূত্রে গ্রথিত করে। আসলে ধাঁধার যাঁরা রচয়িতা, তাঁরা যেমন রোমান্টিক মানসিকতার অধিকারী, তেমনই সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ শক্তির সঙ্গে বাস্তবতা বোধও ছিল তাদের সক্রিয়।

ধাঁধার বিষয় দৈনন্দিন জীবনের নিতান্ত পরিচিত বস্তু। প্রতিটি দেশের ধাঁধার সঙ্গে মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের যোগ রয়েছে। ধাঁধার আকৃতি ও প্রকৃতি অর্থাৎ গঠনবৈশিষ্ট্য এবং বিষয়ের বিচারে বাংলা ধাঁধাকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করেছেন কেউ কেউ। আকৃতিগত বিচারে ধাঁধার ভাগগুলি হল লৌকিক, আক্রমণাত্মক, প্রাচীন সাহিত্যিক, নয়া সাহিত্যিক, মার্জিত লৌকিক, ছড়ামূলক ও বিদেশি ধাঁধা। আর প্রকৃতি বা বিষয় ভেদে ভাগগুলি হল প্রকৃতিবিষয়ক, গার্হস্থ্যজীবনবিষয়ক, আচারগত, পারিবারিক সম্পর্কমূলক, আখ্যানমূলক, গাণিতিক ও আলংকারিক ধাঁধা।

ধাঁধার আর একটি প্রয়োগক্ষেত্র হল ধর্মীয় অনুষ্ঠান। মন্ত্রের অলৌকিক ক্ষমতা বৃদ্ধি করার জন্য তা সরাসরি প্রকাশ না করে তা ধাঁধার মাধ্যমে প্রকাশ করা হত। ধাঁধার ব্যবহার যে কত ব্যাপক তা সহজে অনুমেয়। লৌকিক ধাঁধাগুলি মূলত আচর ও ধর্মনিরপেক্ষ। যেমন বাংলার বুকে নববিবাহিত জামাতা বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে গেলে শশুর তাকে বিভিন্ন ধাঁধা জিজ্ঞাসা করেন। তবে এক্ষেত্রে ধাঁধা খুবই গতানুগতিক ও প্রথাসিদ্ধ হলেও জামাতাকে উত্তর দিয়ে আসন গ্রহণ করতে হয়। এই প্রথা পশ্চিমবঙ্গে আজও বর্তমান। 

আমাদের দেশে ধাঁধা বলতে কালিদাসের হেঁয়ালী বা ধাঁধা বলা হয়। মনে করা হয় ধাঁধার রচয়িতাও কালিদাস এবং বুদ্ধিমান ব্যক্তিও কালিদাস। তবে ধাঁধা যে বুদ্ধিমান ব্যক্তিরাই প্রয়োগ করতে পারেন তা বলা যায়। বাংলায় প্রাপ্ত প্রায় পাঁচ হাজার ধাঁধার গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। শেষে বলা যায় ধাঁধা শুধু অবসর বিনোদনের মাধ্যম নয় ধাঁধা সমষ্টিগত সামাজিক জীবনের বৃহত্তর ক্ষেত্রেও এর ভূমিকা রয়েছে।


৭। প্রবাদ সৃষ্টির উদ্দেশ্য এবং তার প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করো। 

বাংলা লোকসাহিত্যের অবহেলিত অঙ্গনে আজ বহু শিক্ষিত ও রসিকজনের উল্লেখযোগ্য সমাবেশ লক্ষ্য করা যায়। আর এই অবহেলিত অঙ্গনের প্রতি শিক্ষিত জনের দৃষ্টি আকর্ষণে যাঁরা প্রয়াসী হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতি প্রেমিক রবীন্দ্রনাথ। বাংলা লোকসাহিত্যের ধাঁধা, প্রবাদ, ছড়া, গান, লোককথা প্রভৃতি সকল বিভাগই যথেষ্ট সমৃদ্ধ, কিন্তু তথাপি লোকসাহিত্য চর্চার প্রথম যুগে বিশেষভাবে প্রবাদ চর্চার প্রতি সমধিক গুরুত্ব আরোপিত হতে দেখা গেছে। আসলে প্রবাদের ব্যাবহারিক গুরুত্ব অনেক বেশি। তা ছাড়া প্রবাদের ব্যবহার খুব কম হলেও দীর্ঘকাল পর্যন্ত প্রবাদের ব্যবহার থাকে। এছাড়াও সহজবোধ্যতা, সরল প্রকাশভঙ্গি বৈশিষ্ট্যের জন্য প্রবাদের প্রতি আকর্ষণ গভীর।

মানুষের বাস্তবজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে প্রবাদের সৃষ্টি তাই প্রধান দেশে ও কালে কিছু বিষয়ে মূলত এক এবং অভিন্ন। ফলে মৌলিক পরিবর্তন তেমন কিছু ঘটে না। প্রবাদের স্রষ্টা মহিলা এবং তারাই ব্যবহারও করে বেশি । প্রবাদের প্রধান উপজীব্যই হল নারী। দেখা যায় নারীর দৃষ্টিতে নারী চরিত্র ব্যাখ্যাত হয়ে চলেছে। প্রবাদ শুধু সমালোচনা নয়, বলা যায় নির্মম সমালোচনা এবং তার প্রকাশও বিদ্বেষপূর্ণ ও শ্লেষাত্মক। প্রবাদে কোথাও মায়ের স্থান উঁচুতে আবার মা কোথাও অবহেলিতা ও লাঞ্ছিতা। যেমন প্রবাদে রয়েছে –

“চিড়ে বল মুড়ি বল ভাতের বাড়া নাই। 

পিসি বল মাসি বল মায়ের বাড়া নাই।”

আবার পাশাপাশি এটাও রয়েছে, মায়ের পেটে ভাত নাই/বৌয়ের গলায় সোনার হার।”

বাংলা প্রবাদে বেশকিছু সংখ্যক প্রবাদ কৃষি-সম্পর্কিত। সেগুলি অবশ্য ‘খনার বচন’ বলে খ্যাত। আবার কিছু প্রবাদ রয়েছে আবহাওয়া-সংক্রান্ত। এগুলি আবার ‘ডাকের বচন’ বলে খ্যাত। প্রবাদের মধ্য দিয়ে সামাজিক, পারিবারিক নানা বিষয়ের ওপর অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বহু বিষয় উপস্থাপিত হয়েছে। বিশেষত গার্হস্থ্যজীবন ও তার নানা সমস্যার কথা এতে ফুটে উঠেছে। 

গৃহে ব্যবহৃত জিনিসপত্রের কথাও প্রবাদে স্থান পেয়েছে। যেমন – ‘ঢেঁকি’ সম্পর্কে একটি প্রবাদ রয়েছে, “ঢেঁকি স্বর্গে গিয়েও ধান ভানে”। বাংলা প্রবাদে ব্রাহ্মণদের অশিক্ষা, দারিদ্র্য, লোভ কঠোরভাবে ব্যক্ত হয়েছে। ড. আশুতোষ ভট্টাচার্যের বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রবাদে বৈদ্য ও তার প্রদও ওষুধের ওপর বিশেষ নির্ভরতা একেবারেই দেখা যায় না। ইংরেজ মিশনারিরা প্রবাদ সংগ্রহ শুরু করলেও বর্তমানে বহু বাঙালি প্রবাদ সংগ্রহে একান্তভাবে মনোনিবেশ করেছেন। এখনও পর্যন্ত সংগৃহীত প্রবাদের সংখ্যা প্রায় তেরো হাজার।


৮। লোককথা সম্পর্কে আলোচনা করো। 

বাংলা গদ্য চর্চার ইতিহাসে যেমন ব্রিটিশ কর্মচারী, ইউরোপীয় মিশনারীদের দান রয়েছে বাংলা লোককথা তার ক্ষেত্রেও এদের অবদান অনস্বীকার্য। খ্রিস্টধর্ম প্রচারের জন্য ইউরোপীয় মিশনারীরা ভারতবর্ষে এলেও সেই উদ্দেশ্যসাধনের জন্য জনগণের সঙ্গে মিশে তাদের আচার-আচরণ, বিশ্বাস, লোকঐতিহ্য, জাতি সম্পর্কে জানার জন্য আগ্রহী হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে অ্যামান্ট এবং ডেল্টানের নাম অবশ্যই করতে হয়। এরপর বাঙালি মিশনারী রেভারেন্ড লালবিহারী দের নাম তো করতেই হবে। তার গ্রন্থটির নাম হল Folktales of Bengal। আর একটি নাম হল ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান উইলিয়াম কেরি। তিনি যে ইতিহাসমালা গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন সেটি মোটেই ইতিহাস গ্রন্থ নয়। কারণ, এতে ছিল ছোটো-বড়ো দেড়শোটি গল্প, যার মধ্যে কয়েকটি রূপকথা ও উপকথার গল্প, পঞ্চতন্ত্র ও হিতোপদেশের গল্পও ছিল। 

বাংলা লোককথার সমৃদ্ধি এবং ঐতিহ্য অনেক ব্যাপক। লোককথাকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। তা হল রূপকথা, উপকথা ও ব্রতকথা। রূপকথার মধ্যে অতিপ্রাকৃত চরিত্রগুলি প্রাধান্য পায়। কাহিনিগুলি বেশ দীর্ঘ হয়। রচনাও বেশ জটিল। রূপকথার মধ্যে প্রেমকাহিনি নেই, হৃদয়ের সঙ্গে হৃদয়ের যোগ নেই, রয়েছে গভীর রূপমোহ। রূপকথার গল্প সম্পর্কে জনৈক সমালোচক বলেছেন, রূপকথা মূলত নায়ক-নায়িকার রোমাঞ্চকর অভিযান। রূপকথার চরিত্রের নামকরণ নেই এবং কাহিনি নির্বিশেষ চরিত্রে পরিপূর্ণ।

উপকথায় মানবচরিত্রগুলি পশুপক্ষীর ছদ্মবেশে কাহিনি রূপে উপস্থাপিত হয়। এখানে হাস্যরসের উপস্থাপনার সঙ্গে থাকে সূক্ষ্ম পরিহাস, যা রসের আবেশ সৃষ্টি করে। তবে লঘু পরিহাসের ছলে যে কাহিনি পরিবেশিত হয় সেখানে কিছু নীতি উপদেশও থাকে। বাঙালির ঘরে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর টুনটুনির বইটি খুবই গ্রহণীয় ও শিশুদের আকর্ষণীয় হয়ে রয়েছে।

ব্রতকথা মূলত গ্রামের মেয়েদের আচার এবং পূজা অনুষ্ঠানে পালনের কাজে ব্যবহার করা হয়। ব্রতকথায় মেয়েরা তাদের ভবিষৎ জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষা, সুখ-দুঃখ, সতীনের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ প্রভৃতি ব্যক্ত করে। এখানে দেব-দেবীর চরিত্র মানুষের মতো দোষত্রুটিপূর্ণ বা অনেক সময় ভাগ্যের প্রতীক। ব্রতকথায় দেব-দেবী রক্ষণশীল হিন্দুসমাজের দেব-দেবী নয়। ব্রতকথার জগৎ পার্থিব এবং নৃতাত্ত্বিক মূল্য অপরিসীম।

Leave a Comment