নানা রঙের দিন – সাহিত্যচর্চা (দ্বাদশ শ্রেণী বাংলা)

সাহিত্যচর্চা (দ্বাদশ শ্রেণী বাংলা) নানা রঙের দিন হতে প্রশ্ন উত্তর । অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত নানা রঙের দিন নাটকটি দ্বাদশ শ্রেণী বাংলা সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত ।

রচয়িতাঅজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়
কি ধরনের রচনানাটক
অন্তর্ভুক্তদ্বাদশ শ্রেণী বাংলা
পাঠ্য বইসাহিত্যচর্চা

Table of Contents

নানা রঙের দিন – সাহিত্যচর্চা (দ্বাদশ শ্রেণী বাংলা)


১. ‘নানা রঙের দিন’ নাটকটির নামকরণের তাৎপর্য আলোচনা কর।   ৫  (২০১৫)

শেক্সপীয়র বলেছেন, ‘What’s in a name?’ তবুও আমাদের মনে হয় মহৎ সাহিত্য সৃষ্টিতে নামকরণ একটি গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাস্তবে কানা ছেলের নাম ‘পদ্মলোচন’ কিংবা বোবা মেয়ের নাম সুভাষিনী আপত্তিকর নাও হতে পারে। কিন্তু সাহিত্যে এই ধরণের সামঞ্জস্যহীন নামকরণ তীব্র সমালোচনার বিষয়। সাহিত্যে নামকরণ প্রধানত তিনটি বিষয় অবলম্বনে হয়ে থাকে – কেন্দ্রীয় ঘটনা অবলম্বনে, প্রধান চরিত্র অবলম্বনে অথবা ব্যঞ্জনাধর্মী নামকরণ।

নাট্যকার অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘নানা রঙের দিন’ একাঙ্ক নাটকটির নামকরণ করেছেন কাহিনির ব্যঞ্জনাধর্মিতা বিচার করে। এই নাটকে এক প্রখ্যাত অভিনেতা রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের অতীত গৌরবের বিষণ্ন মধুর জীবন কথা বর্ণিত হয়েছে। থিয়েটারের মোহে পুলিশের চাকরি ছেড়েছিলেন রজনী বাবু। মঞ্চে অভিনয় করতেন দাপটের সঙ্গে। আলমগিরের পার্ট করতে দেখে এক সুন্দরী তাকে ভালোবেসেছিল। কিন্তু প্রেয়সী কোনো অভিনেতাকে নিয়ে বিবাহিত জীবন অতিবাহিত করতে চান না। অন্যদিকে রজনী বাবু অভিনয় ছাড়ার পক্ষপাতী নন। ভেঙে যায় স্বপ্ন, নতুন করে ঘর বাঁধা আর হয় না।

এক সময়ের প্রতিভাবান দুর্ধর্ষ অভিনেতার গৌররশ্মি আজ অস্তমিত। অভিনয়ের দুরন্ত নেশায় মত্ত হয়ে তিনি সংসার জীবনকে অবহেলা করেছেন। বার্ধক্যের ভারে ভালোবাসাহীন রজনীবাবুর জীবন টালমাটাল হয়ে চলেছে। জীবনের এরূপ অমানিশায় পৌঁছে রজনী বাবু অতীত জীবনের নানা গৌরবময় রঙিন দিনগুলির কথা স্মরণ করেছেন। দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছর মঞ্চকেই তিনি আঁকড়ে রয়েছেন। মঞ্চই তাঁর ধ্যান-জ্ঞান-স্বজন। এই মঞ্চেই তিনি রিজিয়া, শাহাজানের মতো কত নাটকে অভিনয় করেছেন।

পৌঢ় জীবনে এসে তিনি উপলব্ধি করেন যে, “থিয়েটারওয়ালা একটা নকল নবীশ, একটা অস্পৃশ্য ভাঁড়।” এর বেশি প্রাপ্তি নেই তাঁর। সংসার-পরিজন নেই তাঁর। তাই নিঃসঙ্গ হাহাকারে তিনি গুমরে ওঠেন – “পৃথিবীতে আমি একা! আমার আপনজন কেউ নেই।” জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে অতীতের বর্ণময় রঙিন দিনগুলি মনে পড়ে তাঁর বিষাদ ও হাহাকারই নিয়তি হয়ে ওঠে এই একাঙ্ক নাটকে। তাই নাটকের ‘নানা রঙের দিন’ নামকরণটি সর্বাংশে সার্থক হয়েছে।


২. ‘অভিনেতা মানে একটা চাকর – একটা জোকার, একটা ক্লাউন। লোকেরা সারাদিন খেটেখুটে এলে তাদের আনন্দ দেওয়াই হল নাটক-ওয়ালাদের একমাত্র কর্তব্য।’ — বক্তার কথার তাৎপর্য আলোচনা কর। ৫ (২০১৬)

নট ও নাট্যকার অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘নানা রঙের দিন’ নাটকের প্রধান চরিত্র বৃদ্ধ অভিনেতা রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায় আলোচ্য উদ্ধৃতিটির বক্তা।

নাটকে বৃদ্ধ অভিনেতা রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায় অভিনয় জীবনের শেষপ্রান্তে এসে অভিনেতার সামাজিক অবস্থান নিয়ে গভীর হতাশার শিকার হয়েছেন। একদিন পুলিশের চাকরি ছেড়ে অভিনয়কে সর্বস্ব করে নিয়েছিলেন তিনি। অনেক খ্যাতিও হয়েছিল তার। কিন্তু এই খ্যাতি বা কদর সবই ক্ষণিক, যতক্ষণ একজন অভিনেতা মঞ্চের উপরে থাকেন ততক্ষণ। সমাজ অভিনেতাকে আপন করে নেয় না। তাই যে অভিনয়সূত্রেই তার জীবনে একমাত্র প্রেম সম্পর্কটি এসেছিল তা পরিণতি পায় নি এই অভিনয়ের ফলেই। কারণ, তাকে শর্ত দেওয়া হয়েছিল থিয়েটার ছেড়ে দেওয়ার।

এই পরিস্থিতিতে তার জীবনের মোক্ষম উপলব্ধিটি হল “যারা বলে নাট্যাভিনয় একটি পবিত্র শিল্প, তারা সব গাধা”, তারা মিথ্যে কথা বলেন। অভিনেতাদের একমাত্র কাজ সারাদিনের পরিশ্রান্ত মানুষদের আনন্দ দেওয়া।” অর্থাৎ “একটা ভাঁড় কি মােসায়েবের যা কাজ তাই।” জনসাধারণ অভিনয়ের প্রশংসা করে হাততালি দেবে, কিন্তু স্টেজ থেকে নামলেই একজন অভিনেতার পরিচয় সে ‘থিয়েটারওয়ালা’, ‘নকলনবীশ’ কিংবা ‘অস্পৃশ্য ভাঁড়’।

রজনী মনে করেন, অভিনেতা মানে একটা চাকর, একটা জোকার, একটা ক্লাউন। থিয়েটার দেখার পাবলিকরা আসে সারাদিনের খাটুনির পর শ্রান্তি দূর করার জন কিছুটা বিনোদনের উদ্দেশ্যে। আর নাটকওয়ালাদের কাজ হল মোসাহেবদের মতো কিছুটা ভাঁড়ামি করে তাদের আনন্দ দেওয়া – এই হল পাবলিকের আসল চরিত্র। সেদিন রজনী এই সত্যটা বুঝলেন। তারপর থেকে দর্শকের হাততালি, খবরের কাগজের প্রশংসা, মেডেল, সার্টিফিকেট আর ‘নাট্যাভিনয় একটি পবিত্র শিল্প’ এই ধরনের উক্তি কোনোটাই তাঁর বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না।

কিছু পাবলিক অভিনেতার সঙ্গে আলাপ করে, চা, সিগারেট খাওয়ায়। তা কেবল বাইরে নিজেকে জাহির করবার ফালতু মনোভাব নিয়ে। ফলাও করে নিজেকে দেখাতে চায় অমুক আর্টিস্টের সঙ্গে তার খাতির আছে, দোস্তি আছে – এই পর্যন্তই। কিন্তু থিয়েটার ওয়ালারা তাদের কাছ থেকে কোনো সামাজিক সম্মান পায় না। থিয়েটার অভিনেতার সঙ্গে কোনাে বৈবাহিক সম্পর্কও কেউ স্থাপন করবে না। নিজের জীবন থেকে এই উপলদ্ধিই হয়েছিল রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের।


৩. ‘নানা রঙের দিন’ একাঙ্ক নাটক হিসেবে কতখানি সার্থক আলোচনা কর।  ৫  (২০১৭)

ছোটোগল্পের মতো একই তাড়না ও প্রেরণা থেকে একাঙ্ক নাটকের জন্ম। তাছাড়া একাঙ্ক সৃষ্টির মূলে আছে জীবনের তীব্র অভিজ্ঞতা বা গাঢ় অনুভূতি। একাঙ্ক নাটকের বৈশিষ্ট্য হল, ঘটনার একমুখীনতা, ঘটনার বাহুল্য বর্জন, স্থান, সময় ও ঘটনার ঐক্য, ঘটনার দ্রুতগামিতা প্রভৃতি। একাঙ্কের এই বৈশিষ্ট্যগুলির ওপর ভিত্তি করে আলোচনা করা হবে অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলায় রূপান্তরিত নাটক ‘নানা রঙের দিন’।

ঘটনার একমুখীনতা একাঙ্ক নাটকের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। আমরা আগেই জেনেছি একাঙ্ক নাটকের সৃষ্টি-মূলে আছে জীবনের তীব্র অভিজ্ঞতা বা গাঢ় অনুভূতি। কাজেই ঘটনার তীব্রতা বা গাঢ়তা রক্ষা করতে হলে ঘটনার একমুখীনতা অবশ্যই দরকার। ‘নানা রঙের দিন’ একাঙ্কটিতে ঘটনার একমুখীনতার বৈশিষ্ট্যটি দৃঢ়ভাবে রক্ষিত হয়েছে। রজনী স্টেজে পৌঁছানোর পর থেকে তাঁর অভিনয় জীবনের নানা ঘাতপ্রতিঘাত, আশানিরাশা, সুখ-দুঃখ ও মর্মবেদনার কাহিনি একমুখী হয়ে এগিয়ে চলেছে চরম নাটকীয় পরিণতির দিকে।

ঘটনার বাহুল্য বর্জন একাঙ্ক নাটকের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। একাঙ্কে ঘটনা একমুখী হওয়ায় নাটকে বেশি ঘটনার স্থান হয় না। লক্ষণীয় যে, ‘নানা রঙের দিন’ নাটকটি চরিত্রকেন্দ্রিক। নাটকে কালীনাথ ও রজনী দুটি চরিত্র থাকলেও রজনী চরিত্রই প্রধান। তাঁর অভিনয় জীবনের বৈচিত্র্য রূপায়ণ নাটকের বিষয়। তাতে বহুবিধ ঘটনার স্থানলাভের সুযোগ থাকলেও নাট্যকার তাঁর জীবনের তিক্ত উপলব্ধির ওপর আলোকপাত করে অভিনেতা জীবনের করুণ পরিণতির ছবিটিকে দর্শকের কাছে তুলে ধরেছেন। তাতে জীবনের সুতীব্র অভিজ্ঞতা প্রকাশের প্রয়োজনে নাটকে একমুখী একক ঘটনা স্থান করে নিয়েছে।

স্থান, কাল ও কার্যের ঐক্য একাঙ্ক নাটকের আর একটি বৈশিষ্ট্য। সাধারণভাবে একাঙ্ক নাটকে একই দৃশ্যে নাটক অভিনীত হওয়ায় স্থান ও কালের ঐক্য থাকে। আর কার্যই হল ঘটনা। ঘটনার মধ্যে ভিন্নতা থাকে না। একই ঘটনা এগোতে এগোতে চরম পরিণতি ঘটে। সুতরাং, ত্রিবিধ ঐক্যের আদর্শ একাঙ্ক নাটকে অনুসরণ করা হয়। ‘নানা রঙের দিন’ নাটকটিতে একটিমাত্র দৃশ্যে নাটক উপস্থাপিত। একই সময় রাত্রি।। আর রজনীর অভিনয় জীবনের ঘটনাকে ঘিরেই নাটক। কাজেই একই ঘটনা বা কার্য।

একাঙ্ক নাটকের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হল ঘটনার দ্রুতগামিতা। ‘নানা রঙের দিন’ নাটকটি চরিত্রকেন্দ্রিক হওয়ায় দ্রুতগামিতা অপেক্ষাকৃত শ্লথ। কিন্তু জীবন অভিজ্ঞতার তীব্রতা ও গাঢ়তা দ্রুতগামিতার যেটুকু ঘাটতি থেকেছে তা পুষিয়ে দিয়েছে।

নাটকটিতে রজনীকান্তের জীবনকে কেন্দ্র করে নাট্যকার আধুনিক জীবনের যুগযন্ত্রণা ও সমাজ ভাবনাকে ফুটিয়ে তুলেছেন। তাই সবদিক বিচার করে বলা যায় ‘নানা রঙের দিন’ নাটকটি একটি সার্থক একাঙ্ক নাটক।


৪. ‘আমি রোজ লুকিয়ে লুকিয়ে গ্রিনরুমে ঘুমোই চাটুজ্জেমশাই — কেউ জানে না’ — কোন নাটকের অংশ ? বক্তা কে ? তিনি কেন গ্রিনরুমে ঘুমান ?    ১+১+৩  (২০১৮)

প্রশ্নে উদ্ধৃত উক্তিটি অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘নানা রঙের দিন’ নাটকের অংশ।

আলোচ্য উদ্ধৃতিটির বক্তা হলেন প্রম্পটার কালীনাথ সেন।

প্রায় ষাট বছর বয়সি বৃদ্ধ কালীনাথ সেন ময়লা পাজামা পরে, কালাে চাদর গায়ে দিয়ে, এলােমেলাে চুল নিয়ে গভীর রাতে মঞ্চে প্রবেশ করেছিলেন। রজনীকান্ত তাঁকে দেখে অবাক হয়ে গেলে কালীনাথ প্রশ্নোদ্ধৃত উক্তিটি করেন। এরপরই হতদরিদ্র প্রম্পটার কালীনাথ রজনীকান্তকে গ্রিনরুমে ঘুমােনাের কারণ বিবৃত করেন।

কালীনাথ সেন নেহাতই হাঘরে, তার শোবার জায়গা না থাকায় তাকে গ্রিনরুমে ঘুমোতে হয়। তখন এই মানুষটির চালচুলোহীন হতদরিদ্র অবস্থাটি সম্পূর্ণরূপে প্রকাশিত হয়। নাটককে ভালোবেসে নিজের ব্যক্তিজীবনের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে তাকাননি কালীনাথ সেন। তাই তিনি রজনীবাবুকে বলেছেন গ্রিনরুমে ঘুমানোর কথাটা যেন মালিকের কানে না যায়, তাহলে তিনি বেঘোরে মারা পড়বেন এবং শোবার জায়গাটুকু চলে যাবে। অর্থাৎ প্রশ্নোদ্ধৃত উক্তির মধ্যে স্পষ্ট হয় যে তৎকালীন সময়ে নাটকের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের জীবন বঞ্চনার অন্ধকারে ঢাকা পড়ে থাকত।


৫. ‘……. প্রাক্তন অভিনেতা রজনী চাটুজ্জের প্রতিভার অপমৃত্যুর করুণ সংবাদ !’ — কে বলেছেন ? এই অপমৃত্যু কীভাবে ঘটে বলে বক্তা মনে করেন ?     ১+৪   (২০১৯)

অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘নানা রঙের দিন’ নাটক থেকে গৃহীত প্রশ্নোদ্ধৃত উক্তিটির বক্তা হলেন নাটকের কেন্দ্রীয় তথা প্রধান চরিত্র রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়।

রজনী চাটুজ্জে আটষট্টি বছর বয়সে এসে পঁয়তাল্লিশ বছরের অভিনয় জীবনের স্মৃতিচারণায় মগ্ন হয়েছেন। গভীর রাতে মঞ্চের উপরে শূন্য অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহের দিকে তাকিয়ে জীবনের ফেলে আসা দিনগুলিকে তিনি মনে করেছেন। তীব্র হতাশা এবং কষ্টবােধে ভুগেছেন তিনি। নিজের যৌবনে পুলিশ ইনস্পেকটরের চাকরি ছেড়ে নাটকের জগতে এসেছিলেন তিনি। নাটকের কারণেই তার নামডাক হয়েছিল।

ধনী বড়োলোকের একমাত্র মেয়ের সঙ্গে জীবনের একমাত্র প্রেম সম্পর্কটিও হয়েছিল এই অভিনয়ের সূত্রেই। কিন্তু সেই সম্পর্ক ভেঙেও গিয়েছিল এই অভিনয়কে ছাড়তে না পারার জন্যই। আর তখন থেকেই রজনীকান্ত উপলব্ধি করেছিলেন অভিনেতার জীবনের অর্থহীনতাকে। সেদিন রজনী বুঝতে পারেন যারা বলে ‘নাট্যাভিনয় একটা পবিত্র শিল্প’ তারা সব গাধা।

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই অভিনেতা হিসেবে তার কদরও কমল। গলার কাজ নষ্ট হল, চরিত্রকে বােঝার এবং ফুটিয়ে তােলার ক্ষমতাও নষ্ট হয়ে গেল। আর এই কারণেই হতাশ রজনীকান্তের মনে হল থিয়েটারের দেওয়ালে কোনো অদৃশ্য  হাত অঙ্গারের কালো কালো অক্ষরে লিখে দিয়ে গেছে তার প্রতিভার অপমৃত্যুর করুণ সংবাদ।


৬. ‘নানা রঙের দিন’ নাটকের সূচনায় মঞ্চসজ্জার যে বর্ণনা আছে, তা নিজের ভাষায় লেখ। নাটকটির নামকরণ কতখানি সার্থক — তা আলোচনা কর।   ২+৩  (২০২০)

মঞ্চসজ্জা :- অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘নানা রঙের দিন’ একটি একাঙ্ক নাটক। এই নাটকের সূচনায় মঞ্চসজ্জার বর্ণনা করা হয়েছে। পর্দা ওঠার সঙ্গে সঙ্গে দেখা যায় একটি পেশাদারি থিয়েটারের ফাঁকা রঙ্গমঞ্চ। প্রায় মহসজ্জার বর্ণনা অন্ধকার সেই মঞ্চে রয়েছে রাত্রে অভিনীত ‘সাজাহান’ নাটকের দৃশ্যপট, আর বেশ কিছু জিনিসপত্র এদিক-ওদিক ছড়ানো। মঞ্চের মাঝখানে রয়েছে একটি ওলটানো টুল। দর্শক আসনও একেবারে ফাঁকা। দিলদারের পোষাক পরে রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায় প্রবেশ করেন। তার হাতে একটা মোমবাতি, তিনি হাসছেন।

নামকরণ :- শেক্সপীয়র বলেছেন, ‘What’s in a name?’ তবুও আমাদের মনে হয় মহৎ সাহিত্য সৃষ্টিতে নামকরণ একটি গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাস্তবে কানা ছেলের নাম ‘পদ্মলোচন’ কিংবা বোবা মেয়ের নাম সুভাষিনী আপত্তিকর নাও হতে পারে। কিন্তু সাহিত্যে এই ধরণের সামঞ্জস্যহীন নামকরণ তীব্র সমালোচনার বিষয়। সাহিত্যে নামকরণ প্রধানত তিনটি বিষয় অবলম্বনে হয়ে থাকে – কেন্দ্রীয় ঘটনা অবলম্বনে, প্রধান চরিত্র অবলম্বনে অথবা ব্যঞ্জনাধর্মী নামকরণ।

নাট্যকার অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘নানা রঙের দিন’ একাঙ্ক নাটকটির নামকরণ করেছেন কাহিনির ব্যঞ্জনাধর্মিতা বিচার করে। এই নাটকে এক প্রখ্যাত অভিনেতা রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের অতীত গৌরবের বিষণ্ন মধুর জীবন কথা বর্ণিত হয়েছে। থিয়েটারের মোহে পুলিশের চাকরি ছেড়েছিলেন রজনী বাবু। মঞ্চে অভিনয় করতেন দাপটের সঙ্গে। আলমগিরের পার্ট করতে দেখে এক সুন্দরী তাকে ভালোবেসেছিল। কিন্তু প্রেয়সী কোনো অভিনেতাকে নিয়ে বিবাহিত জীবন অতিবাহিত করতে চান না। অন্যদিকে রজনী বাবু অভিনয় ছাড়ার পক্ষপাতী নন। ভেঙে যায় স্বপ্ন, নতুন করে ঘর বাঁধা আর হয় না।

এক সময়ের প্রতিভাবান দুর্ধর্ষ অভিনেতার গৌররশ্মি আজ অস্তমিত। অভিনয়ের দুরন্ত নেশায় মত্ত হয়ে তিনি সংসার জীবনকে অবহেলা করেছেন। বার্ধক্যের ভারে ভালোবাসাহীন রজনীবাবুর জীবন টালমাটাল হয়ে চলেছে। জীবনের এরূপ অমানিশায় পৌঁছে রজনী বাবু অতীত জীবনের নানা গৌরবময় রঙিন দিনগুলির কথা স্মরণ করেছেন। দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছর মঞ্চকেই তিনি আঁকড়ে রয়েছেন। মঞ্চই তাঁর ধ্যান-জ্ঞান-স্বজন। এই মঞ্চেই তিনি রিজিয়া, শাহাজানের মতো কত নাটকে অভিনয় করেছেন।

পৌঢ় জীবনে এসে তিনি উপলব্ধি করেন যে, “থিয়েটারওয়ালা একটা নকল নবীশ, একটা অস্পৃশ্য ভাঁড়।” এর বেশি প্রাপ্তি নেই তাঁর। সংসার-পরিজন নেই তাঁর। তাই নিঃসঙ্গ হাহাকারে তিনি গুমরে ওঠেন – “পৃথিবীতে আমি একা! আমার আপনজন কেউ নেই।” জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে অতীতের বর্ণময় রঙিন দিনগুলি মনে পড়ে তাঁর বিষাদ ও হাহাকারই নিয়তি হয়ে ওঠে এই একাঙ্ক নাটকে। তাই নাটকের ‘নানা রঙের দিন’ নামকরণটি সর্বাংশে সার্থক হয়েছে।


৭. ‘নানা রঙের দিন’ নাটক অবলম্বনে রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায় চরিত্রটি বিশ্লেষণ কর।

প্রখ্যাত নাট্যকার অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘নানা রঙের দিন’ নাটকের কেন্দ্রীয় তথা প্রধান চরিত্র রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়। পেশাদারী নাট্যমঞ্চের এককালের সফল অভিনেতা তিনি। তাঁর চরিত্রের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য আমরা এই নাটকে পাই।

থিয়েটার-প্রীতি :- রজনী বাবুর চরিত্রের প্রথম ও প্রধান বৈশিষ্ট্য হল তাঁর থিয়েটার-প্রীতি। পুলিশ ইন্সপেক্টরের চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি থিয়েটারের জগতে প্রবেশ করেছিলেন। এমনকি থিয়েটারকে ভালোবেসে নিজের প্রেমকে বিসর্জন দিতে পিছপা হননি।

অভিনয় দক্ষতা :- আপন প্রতিভা বলে তিনি অসাধারণ অভিনয় দক্ষতায় সকলের মন জয় করে নিয়েছেন। মঞ্চে আলমগীরের ভূমিকায় অসাধারণ অভিনয় করতে দেখে মন মজে ছিল এক বিত্তশালী সুন্দরী নারীর।

প্রেমিক সুলভ মনোভাব :- আর পাঁচটা মানুষের মতো রজনীকান্ত ছিলেন রসিক, প্রেমিক। অভিনয় দেখে ভালো লাগার একটা মেয়ের প্রেমে পড়েন তিনি। কিন্তু বিয়ের প্রস্তাবে মেয়েটি অভিনয় ছাড়তে বললে তার প্রেমিক সত্তায় আঘাত লাগে। তাই তিনি ভালোবেসে ঘর বাঁধতে পারেন নি।

সচেতন শিল্পী :- রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায় ছিলেন শিল্পের প্রতি দায়বদ্ধ এক সচেতন শিল্পী। তাই রজনীবাবু বলেন, “শিল্পকে যে মানুষ ভালোবেসেছে তার বার্ধক্য নেই কালীনাথ, একাকীত্ব নেই, রোগ নেই, মৃত্যুভয়ের ওপর সে তো হাসতে হাসতে ডাকাতি করতে পারে।”

মহানুভবতা :- রামব্রিজকে তিন টাকা বকশিশ দেওয়ার ঘটনাটি তাঁর মহানুভতার পরিচায়ক। তেমনি কালীনাথ সেনের সঙ্গে তাঁর ব্যবহার যথেষ্ট ভদ্র ও মার্জিত।

জীবনবোধ :- জীবনের অপরাহ্ন বেলায় এসে তাঁর উপলব্ধি আশ্চর্য গভীর। জীবন পথে তিনি যে ক্লান্ত, তাঁর এবার অবসরের পালা এসেছে তা বুঝতে দেরি হয় না। থিয়েটার তাকে খ্যাতি দিয়েছে, জনপ্রিয়তা দিয়েছে, কিন্তু জীবন কেড়ে নিয়েছে তাঁর মানবীয় সত্তাকে। রজনী বাবু তাই বলেন, “পৃথিবীতে আমি একা! আমার আপনজন কেউ নেই।”

সমগ্র নাটকে রজনী বাবু চরিত্রের যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ার মতো তা হল তার বিগত যৌবনের জন্য বিলাপ ও নিঃসঙ্গতা জনিত হাহাকার। কিন্তু নাটকের শেষে তিনিই কালীনাথকে বুঝিয়েছেন “হ্যাঁ, কালীনাথ, আমাদের দিন ফুরিয়েছে।” কালের অমোঘ নিয়মকে স্বীকার করার মধ্য দিয়ে চরিত্রটি মহত্তর স্তরে উন্নীত হয়েছে।


Leave a Comment