প্রবন্ধ নিরক্ষরতা দূরীকরণে ছাত্রসমাজ
নিরক্ষরতা দূরীকরণে ছাত্রসমাজ -প্রবন্ধ
“তুমি মাটির দিকে তাকাও, সে প্রতীক্ষা করছে।
তুমি মানুষের হাত ধরো, সে কিছু বলতে চাই।”
ভূমিকা :- কোন মানুষ ? নিরক্ষর মানুষ, নিরক্ষরতার জন্য শোষনের শিকার যে মানুষ। এই নিরক্ষর মানুষদের কথা বলতে গিয়েই লেনিন বলেছিলেন, “He (an illiterate Person) must first be taught the alphabets.” নিরক্ষরতাই এই দুর্ভাগা দেশের অভাগা জনগণের জীবনে এক নিদারুণ অভিশাপ। জ্ঞানের ও রসের রাজ্যে নিরক্ষর মানুষদের প্রবেশের অধিকার নেই। তারা ‘শুধু বহি চলে মন্দগতি জীবনের ভার’। প্রবহমান শিক্ষার দৌলতে সাক্ষরতার হার বাড়লেও নিরক্ষরতা দূরীকরণের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ এখনও পিছিয়ে আছে। নিরক্ষর মানুষ আজ ‘আমরা শক্তি, আমরা বল, আমরা ছাত্রদল’ -এর প্রতি অনেক আশা ভরসা নিয়ে তাকিয়ে আছে। তারা জানে ছাত্ররাই সাক্ষরতা প্রসারের বাধা কাটিয়ে সেখানে ভগীরথের মতো আনতে পারে মৃত সঞ্জীবনী শিক্ষার প্লাবন।
দারিদ্র্য ও নিরক্ষরতা :- দারিদ্র্য ও নিরক্ষর পরস্পরের বন্ধু। এখনও গ্রামের শতকরা ৩৬ জন মানুষ প্রায় দারিদ্রসীমার নীচে বাস করে। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে সংবিধান প্রণেতারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে ভারতের নতুন প্রজন্মের একজনও নিরক্ষর থাকবে না। কিন্তু নিরক্ষরতার অভিশাপ ঘোচেনি। ফলে অসংখ্য নিরক্ষর গরিব মানুষ প্রত্যহ প্রতিবেশীর কাছে ঠকে।
নিরক্ষরতার কারণ :- দেশের বেশিরভাগকে নিরক্ষর করে রাখা সুবিধভোগী শ্রেণীর এক চক্রান্ত। এর কারণ বঞ্চনা, প্রতারণা, অধিকারবোধকে না বুঝতে দেওয়া, নিরক্ষর মানুষকে প্রানের ভোজ থেকে, মনের ভোজ থেকে দূরে রাখা। রবীন্দ্রনাথ বড়ো দুঃখে লিখেছিলেন, “আমাদের ভদ্র সমাজ আরামে আছে, কেননা আমাদের লোক সাধারন নিজেকে বোঝে নাই”। আমাদের দুয়ারে এসেছে পশ্চিমের গণতন্ত্রের রথ। সেই রথকে নিরক্ষর মানুষ, অন্ধ মানুষ অপরের নির্দেশে টেনে চলেছে। তারা ভাবে এই পথেই একদিন তাদের জীবনে নবীন সূর্যোদয় হবে। তারা জানে না এটা বঞ্চনারই আর এক নাম।
নিরক্ষরতা দূরীকরণের উপায় :- পরিসংখ্যান বলছে ২০১৪-২০১৭ সালের মধ্যে পৃথিবীর দুজন নিরক্ষর মানুষের মধ্যে একজন হবে ভারতীয়। শহরের মানুষের তুলনায় গ্ৰামের মানুষ শিক্ষার আলোর বৃত্তের বাইরে বেদনাহীন অন্ধকারে ডুবে আছে। যে সব নিরক্ষর মানুষ ধু ধু তেপান্তরের অসীম অন্ধকারে ডুবে আছে তাদের আলোর বৃত্তে আনতে হলে চেনাতে হবে জীবনের সঠিক রাস্তা, আর লেখাপড়াই সেই রাস্তা। Each one tach one নীতি নিয়ে সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে। পশ্চিমবঙ্গে সাক্ষরতার হার বাড়ানোর জন্য আমাদের রাজ্য সরকার প্রবাহমান শিক্ষা নামে এক নতুন শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেছেন।
নিরক্ষরতা অবসানের জন্য দুভাবে অভিযান চালানো যায়। যথা –
- (১) সংবিধানের নির্দেশ মতো বাধ্যতামূলক শিক্ষা ব্যবস্থাকে যথাযথ কার্যকরী করা।
- (২) বয়স্ক নিরক্ষরদের সাক্ষর করার ব্যাপারে বাস্তবোচিত পরিকল্পনা করা।
লক্ষ্য রাখতে হবে, এ ভারত আগামী দিনে যেন একজন নিরক্ষর শিশুরও বাসভূমি না হয়।
ছাত্রছাত্রীদের দায়িত্ব :- ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে আছে পিছিয়ে পড়া মানুষদের ভালো করার দূরন্ত আবেগ। নিরক্ষরতা দূর করতে তারা এগিয়ে আসতে পারে। নৈশ বিদ্যালয়ে তারা পালা করে নিয়মিত পড়াতে পারে। প্রবহমান শিক্ষা নামক শিক্ষা ব্যবস্থায় তারা সপ্তাহে একটা দিনও নিজেদের যুক্ত করতে পারে।
সাক্ষরতা অভিযান ও ছাত্রসমাজ :- নিরক্ষর মানুষকে সাক্ষ করে তোলার জন্য দিকে দিকে আওয়াজ তোলা হচ্ছে, সাক্ষরতার আলো ঘরে ঘরে জ্বালো, অথবা বাঁচার মতো বাঁচতে চাই, সাক্ষরতা ভিন্ন পথ নাই এবং ক্ষুধাতুর মানুষ হাতে তুলে নাও বই, বই হোক তোমার হাতিয়ার। কিন্তু নিরক্ষর মানুষদের কাছে এইসব শ্লোগান কার্যকরী ভাবে পৌছে দিতে পারে একমাত্র ছাত্রছাত্রীরাই। নিরক্ষরতার বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজের লড়াই কেবল কর্তব্য নয়, এটা একটা অভিশাপে নির্মূল করার একটা বিদ্রোহ। নিরক্ষর মানুষ সে তো মানুষ নামক পাথর, তাতে শিক্ষার আলো পড়ে না, তাই অন্ধকারে নড়ে না।
উপসংহার :- আজ ছাত্রসমাজের কাছে দেশের শুভকামী মানুষ চাই, তারা যেন শুধু নিজেদের কেরিয়ার তৈরীতেই না ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তারা যেন স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক না হয়। এককথায় বলা যায় ছাত্রসমাজের উচিত দেশ সেবার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে শিক্ষা নামক প্রাণের প্রদীপকে নিরক্ষর মানুষদের ঘরে ঘরে নিয়ে যাওয়া। “অজ্ঞানের অন্ধকারে আড়ালে ঢাকিছ যারে / তোমার মঙ্গল ঢাকি গড়িছে সে ঘোর ব্যবধান।” – বিশ্বকবির এই উপলব্ধি কি ছাত্রদের মধ্যে সঞ্চারিত হবে না? এই দায় কেবল সরকারের নয়, সকলেরই এটা দায় দায়িত্ব।