প্রাচীন বাংলার সমাজ ও সাহিত্য – প্রথম পর্ব: বাঙ্গালীর শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি (প্রথম পর্যায়)
প্রাচীন বাংলার সমাজ ও সাহিত্য- প্রথম পর্ব: বাঙ্গালীর শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
প্রাচীন বাংলার সমাজ ও সাহিত্য (ছোট প্রশ্ন )
১। প্রাচীন বাংলা বলতে আমরা কোন অঞ্চলকে বুঝি ?
প্রাচীন বাংলা বলতে বর্তমানের বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, আসামের কাছাড়, গোয়ালপাড়া, বিহারের পূর্ণিয়া, সিংভূম, মানভূম ও সাঁওতাল পরগণা প্রভৃতি অঞ্চলকে বুঝতে হবে।
২। প্রাচীন কোন্ গ্রন্থে বাংলার কথা পাওয়া যায় ?
প্রাচীন সংস্কৃত ও বৌদ্ধ গ্রন্থাদিতে এবং ভ্রমণবৃত্তান্তে বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির উল্লেখ পাওয়া যায়।
৩। চক্রপাণিদত্তের মৌলিক গ্রন্থের নাম কী?
চক্রপাণিদত্তের মৌলিক গ্রন্থের নাম ‘চিকিৎসা-সংগ্রহ’।
৪। প্রাচীনযুগে পণ্ডিত সুরেশ্বরের গ্রন্থের নাম কী?
প্রাচীনযুগে পণ্ডিত সুরেশ্বর রচিত গ্রন্থ হল ‘শব্দপ্রদীপ’ এবং ‘বৃক্ষায়ুর্বেদ’।
৫। প্রাচীনযুগে পণ্ডিত বঙ্গসেন রচিত গ্রন্থের নাম লেখো।
প্রাচীনযুগে পণ্ডিত বঙ্গসেন রচিত গ্রন্থের নাম ‘চিকিৎসা-সার-সংগ্রহ’।
৬। অভিনন্দ কে ছিলেন? তাঁর রচিত একটি গ্রন্থের নাম লেখো।
পালবংশীয় যুবরাজের সভাকবি ছিলেন অভিনন্দ।
তাঁর রচিত গ্রন্থের নাম ‘রামচরিত’ ও ‘যোগবাশিষ্ঠসংক্ষেপ’।
৭। সন্ধ্যাকর নন্দীর রচিত গ্রন্থের নাম কী?
সন্ধ্যাকর নন্দীর রচিত গ্রন্থের নাম ‘রামচরিত’।
৮। ক্ষেমীশ্বর রচিত একটি নাটকের নাম লেখো।
ক্ষেমীশ্বর রচিত নাটকের নাম হল চণ্ডকৌশিক।
৯। কীর্তিকর্মা রচিত গ্রন্থের নাম কী?
কীর্তিকর্মা রচিত অলংকারবহুল কাব্য ‘কীচকবধ’।
১০। ধোয়ী রচিত গ্রন্থের নাম কী?
ধোয়ী রচিত গ্রন্থের নাম পবনদূত। এটি কালিদাসের মেঘদূত কাব্যের অনুসরণে লেখা।
১১। ‘বেণীসংহার’ গ্রন্থটি কার রচনা?
মহাভারতের কাহিনি অবলম্বনে অষ্টম শতকে ‘বেণীসংহারম্’ কাব্যটি ভট্টনারায়ণের রচনা।
১২। বল্লাল সেন রচিত দুটি গ্রন্থের নাম লেখো।
বল্লাল সেন রচিত দুটি গ্রন্থের নাম ‘ব্রতসাগর’ ও ‘দানসাগর’।
১৩। হলায়ুধ রচিত দুটি গ্রন্থের নাম উল্লেখ করো।
হলায়ুধ রচিত দুটি গ্রন্থ হল ব্রাহ্মণসর্বস্ব ও মীমাংসাসর্বস্ব।
১৪। কবি জয়দেব রচিত গ্রন্থের নাম লেখো।
লক্ষ্মণসেনের সভাকবিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কবি জয়দেব রচিত গ্রন্থের নাম হল ‘গীতগোবিন্দ’।
১৫। শ্রীধর দাসের সংকলন গ্রন্থটির নাম কী?
শ্রীধর দাসের সংকলন গ্রন্থটি হল ‘সদুক্তিকর্ণামৃত’ (১২০৬ খ্রিস্টাব্দ)। এতে জয়দেবের ১৩টি পদ সংকলিত রয়েছে।
১৬। বৌদ্ধধাচার্য শীলভদ্র রচিত গ্রন্থের নাম লেখো।
বৌদ্ধাচার্য শীলভদ্র রচিত গ্রন্থের নাম ‘আর্যবুদ্ধভূমিব্যাখ্যান’।
১৭। রাজা শালবাহন (হাল) রচিত গ্রন্থের নাম কী?
রাজা শালবাহন রচিত গ্রন্থের নাম ‘গাহাসওসই’ (গাথাসপ্তশতী)।
১৮। পিঙ্গল রচিত ছন্দগ্রন্থটির নাম লেখো।
পিঙ্গল রচিত ছন্দগ্রন্থটির নাম ‘প্রাকৃতপৈঙ্গল’।
১৯। ‘চাচা’ গান কী?
ড. শশিভূষণ দাশগুপ্ত প্রায় শতাধিক নতুন চর্যাগান আবিষ্কার করেন যা ‘চাচা গান’ নামে পরিচিত।
২০। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম গ্রন্থটির নাম কী?
বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম গ্রন্থটির নাম ‘চর্যাপদ’ বা ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’।
২১। ‘চর্যাপদ’ পুথিটির আবিষ্কারকের নাম কী ?
মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ‘চর্যাপদ’ পুথিটি আবিষ্কার করেন।
২২। ‘চর্যাপদ’ গ্রন্থটির আবিষ্কারের সময়কাল কত?
১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে ‘চর্যাপদ’ গ্ৰন্থটি আবিষ্কৃত হয়।
২৩। চর্যাপদ রচনাকার হিসাবে কতজন কবির নাম পাওয়া যায় ?
‘চর্যাপদ’ রচনাকার হিসাবে ২৪ জন কবির নাম পাওয়া যায়।
২৪। ‘চর্যাপদ’ গ্রন্থটির আসল নাম কী ছিল?
‘চর্যাপদ’ গ্রন্থটির আসল নাম ছিল ‘চর্যাগীতিকোষ’।
২৫। ‘চর্যাপদ’-এর তিব্বতী অনুবাদ কে আবিষ্কার করেন?
‘চর্যাপদ’-এর তিব্বতী অনুবাদ আবিষ্কার করেন প্রবোধচন্দ্র বাগচী।
২৬। ‘চর্যাপদ’ -এর পুথিটি কে, কোথা থেকে আবিষ্কার করেন?
মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজদরবারের প্রন্থাগার থেকে ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে ‘চর্যাপদ’ -এর পুথিটি আবিষ্কার করেন।
২৭। চর্যাপদগুলি কোন সময়ের রচনা বলে অনুমান করা হয়?
চর্যাপদগুলি আনুমানিক দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে রচিত।
২৮। ‘চর্যাপদ’ কবে কোথা থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল? তখন কী নাম দেওয়া হয়েছিল?
১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। তখন নাম দেওয়া হয়েছিল ‘হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোঁহা।
২৯। ‘চর্যাপদ’ কী?
‘চর্যাপদ’ হল বৌদ্ধ সহজিয়া সিদ্ধাচার্যদের ধর্মসাধনার গূঢ়তত্ত্ব ও সাধনপদ্ধতি বিষয়ক গ্রন্থ। তবে চর্যাপদগুলি বৌদ্ধ তত্ত্বমূলক সংগীত।
৩০। চর্যাপদের রচনাকালে কোন রাজত্বকাল চলছিল ?
চর্যাপদের রচনাকালে বাংলাদেশে পাল রাজত্বকাল ছিল।
৩১। চর্যাপদে ব্যবহৃত ছন্দের নাম কী?
চর্যাপদে ব্যবহৃত ছন্দের নাম পাদাকুলক ছন্দ।
৩২। চর্যা সমকালে বাঙালী রচিত দুটি সংস্কৃত কবিতার সংকলনের নাম লেখ।
চর্যা সমকালে বাঙালী রচিত দুটি সংস্কৃত কবিতার সংকলনের নাম হল কবীন্দ্রবচন সমুচ্চয় ও সদুক্তিকর্ণামৃত।
৩৩। চর্যা সমকালে বাঙালী রচিত দুটি প্রাকৃত কাব্য সংকলনের নাম লেখ।
হাল রচিত ‘গাথাসপ্তশতি’ ও পিঙ্গলাচার্য রচিত ‘প্রাকৃতপৈঙ্গল’।
৩৪। চর্যার পুঁথিতে কটি পদ পাওয়া যায়? এর পদকর্তা কজন?
চর্যার পুঁথিতে সাড়ে ছেল্লিশটি পদ পাওয়া গেছে।
এর পদকর্তা ২৪ জন।
৩৫। চর্যার প্রধান বা শ্রেষ্ঠ পদকর্তা কে? তিনি কটি পদ রচনা করেছেন ?
চর্যার প্রধান বা শ্রেষ্ঠ পদকর্তা হলেন কৃষ্ণপদাচার্য বা কাহ্নপাদ।
তিনি ১২টি পদ রচনা করেন।
৩৬। চর্যার সর্বপ্রাচীন পদবর্তা কে? তার রচিত পদের সংখ্যা কটি?
চর্যার সর্বপ্রাচীন পদবর্তা লুইপাদ।
তার রচিত পদসংখ্যা মাত্র ২টি।
৩৭। চর্যার চিত্রধর্মী কবি কাকে বলা হর? তার রচিত পদের সংখ্যা কটি?
চর্যার চিত্রধর্মী কবি হলেন ভুসুকপাদ।
তার রচিত পদের সংখ্যা ৮টি।
৩৮। চর্যাপদের মধ্যে সর্বসাকুল্যে কয়টি পদ ও কতজন কবির ভণিতা পাওয়া গেছে?
চর্যাপদের মধ্যে সর্বসাকুল্যে ৫১ টি পদ ও ২৪ জন কবির ভণিতা পাওয়া গেছে।
৩৯। চর্যাপদের টিককারের নাম কি? তিনি কটি পদের টিকা রচনা করেছেন ?
চর্যাপদের টিককারের নাম মুনিদত্ত।
তিনি ৫০ টি পদের টিকা রচনা করেছেন।
৪০। বাংলা সাহিত্যের আদিতম নিদর্শন কোনটি? এর রচয়িতাদের কী নামে অভিহিত করা হতো?
বাংলা সাহিত্যের আদিতম নিদর্শন হল চর্যাপদ।
চর্যাপদের রচয়িতাদের সিদ্ধাচার্য নামে অভিহিত করা হতো
৪১। চর্যাপদের ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’ নামকরণ কে করেন? এই নামের অর্থ কি?
চর্যাপদের ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’ নামকরণ মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী।
এই নামের অর্থ হল আচরনীয় এবং অনাচরনীয় বিষয় নির্দেশ।
৪২। চর্যাপদে সমাজের কোন শ্রেণীর জীবনমাত্রা বর্ণিত হয়েছে?
চর্যাপদে সমাজের নিম্ন শ্রেণীর অস্পৃশ্য মানুষদের জীবনযাপন বর্ণিত হয়েছে।
৪৩। চর্যাপদের পাতার মাপ কি ছিল?
চর্যাপদের পাতার মাপ ছিল 33×4½ সেমি।
৪৪। চর্যাপদের ভাষাকে সন্ধাভাষা বলা হয় কেন?
সন্ধ্যাভাষার অর্থ হলো আলো-আঁধারি ভাষা, আসলে কতক আলো এবং কতক অন্ধকার। খানিক বোঝা যায়, খানিক বোঝা যায় না। চর্যার ভাষা সকলের বোধগম্য নয়। তাই চর্যার ভাষা হল সন্ধ্যাভাষা।
৪৫। চর্যাগীতি বলতে কি বোঝায়?
মে সব গানে বৌদ্ধ যোগীদের সাধ্যতত্ত্ব ও সাধন প্রক্রিয়া পরিবেশিত হয়, সেগুলিকে বলা হয় চযাগীতি।
৪৬। নবচর্যাপদ কি?
হরপ্রসাদের চর্যাপুথি আবিষ্কারের অনেক পরে ডক্টর শশীভূষণ দাশগুপ্ত নেপাল থেকে আরো ২৫০ টি নতুন চর্যাগান আবিষ্কার করেন। এর মধ্যে ৯৪টি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মুদ্রিত হয়। এগুলিই হল নবচর্যাপদ।
৪৭। চর্যাকবিদের নামের সঙ্গে ‘পাদ’ শব্দের যোগ দেখা যায় কেন?
‘পাদ’ শব্দের অর্থ পূজনীয়। অর্থাৎ যার চরন স্পর্শ করে শ্রদ্ধা জানানো যায়। আবার পাদ মানে ধর্মগুরু। চর্যা কবিরা শিষ্য ভক্ত মন্ডলীর কাছে পূজনীয় আচার্য বা গুরু হিসেবে মর্যাদা পেয়েছিলেন। তাই ভক্তশিষরা তাদের নামের সঙ্গে পাদ শব্দটি যোগ করে দিতেন।
৪৮। চর্যার ভাষা প্রধানত কোন উপভাষার ওপর প্রতিষ্ঠিত?
চর্যার ভাষা প্রধানত রাঢ়ি উপভাষার ওপর প্রতিষ্ঠিত।
৪৯। চর্যার ভাষাকাঠামো কোন অপভ্রংশের ওপর প্রতিষ্ঠিত?
চর্যার ভাষাকাঠামো শৌরসেনি অপভ্রংশের ওপর প্রতিষ্ঠিত।
৫০। চর্যাপদে ব্যবহৃত দুটি রাগ-রাগিনীর নাম লেখ।
চর্যাপদে ব্যবহৃত দুটি রাগ-রাগিনীর নাম হল পটমঞ্জরী ও গুর্জরী।
৫১। চর্যাপদে ব্যবহৃত দুটি প্রবাদ-প্রবচনের নাম লেখ।
চর্যাপদে ব্যবহৃত দুটি প্রবাদ-প্রবচন হল আপনা মাংসে হরিনা বৈরি এবং দুহিল দুধ কি বেন্টে সমায়।
৫২। চর্যাপদের তিব্বতী অনুবাদের অনুবাদক কে? তার গ্ৰন্থটির নাম কি?
চর্যাপদের তিব্বতী অনুবাদের অনুবাদক হলেন প্রবোধচদ্ৰ বাগচী।
তার গ্ৰন্থটির নাম চর্যাগীতিকোষবৃত্তি।
৫৩। বাংলা সাহিত্যে কোথায় প্রথম নৃত্য-গীতের উল্লেখ আছে?
চর্যাপদের ১৭ সংখ্যক পদে প্রথম নৃত্য-গীতের উল্লেখ আছে।
৫৪। শবরপাদ কটি পদ রচনা করেন?
শবরপাদ ২ টি পদ রচনা করেন।
৫৫। চর্যাপদের ধর্মমতে পরম সত্য কি?
চর্যাপদের ধর্মমতে পরম সত্য হল বোধিচিত্ত।
৫৬। চর্যার ছদ্মনাম যুক্ত দুজন কবির নাম লেখো। চর্যার ছদ্মনাম যুক্ত দুজন কবির নাম হল ডোম্বীপাদ ও কুক্কুরীপাদ।
৫৭। চর্যার ভাষা যে বাংলা তা কে, কোথায় প্রমাণ করেন?
চর্যার ভাষা যে বাংলা তা ড: সুনীতি কুমার চড়ৌপাধ্যায় তার origin and Development of Bengali language. (ODBL) গ্ৰন্থে প্রমাণ করেন।
৫৮। চর্যাপদ কবে কোথা থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়?
১৯১৬ সালে হরপসাদ শাস্ত্রীর সম্পাদনায় কলকাতার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে হাজার বছরের পুরোনো বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোঁহা’ নামে প্রকাশিত হয়।
প্রাচীন বাংলার সমাজ ও সাহিত্য (বড় প্রশ্ন )
১। ‘চর্যাপদ’ কে আবিষ্কার করেন। ‘সন্ধ্যাভাষা’ বলতে কী বোঝো । বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এই গ্রন্থের গুরুত্ব কোথায় ?
১+২+২ (২০১৪)
মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে নেপালের রাজদরবারের গ্ৰন্থাগার থেকে চর্যাপদের পুঁথি আবিষ্কার করেন।
সন্ধ্যাভাষার অর্থ হল আলো-আঁধারি ভাষা, আসলে কতক আলো এবং কতক অন্ধকার, খানিক বোঝা যায় খানিক বোঝা যায় না। চর্যার ভাষা সকলের বোধগম্য নয়। তাই চর্যাভাষা হল সন্ধ্যাভাষা।
চর্যার ভাষা, ছন্দ, শব্দ ব্যবহার এবং অলংকারের প্রয়োগ নিঃসন্দেহে কবিকর্মের পরিচায়ক। বাংলা পয়ার ও ত্রিপদী ছন্দের প্রাথমিক প্রয়োগ এই চর্যাপদের পদগুলিতেই লক্ষ্য করা যায়।
“সোনে ভরিতি করুণা নাবী/রূপা থোই নাহিক ঠাবী” পদে যে চিত্রকল্প সৃষ্টি হয়েছে, “তুলা ধুনি ধুনি আঁশুরে আঁশু / আশু ধুনি ধুনি নিরাবর মোবু” পদে ধ্বনিমাধুর্য, কাব্যসৌন্দর্য অর্থকে অতিক্রম করে যে কাব্যিক ব্যঞ্জনা লাভ করেছে, তাতে চর্যাপদগুলি সাহিত্যসম্পদে হয়ে উঠেছে সমৃদ্ধ। চর্যাপদ যেন তত্ত্বের মৃণালে কাব্যের শতদল।
২। চর্যাপদের পুঁথি কে আবিষ্কার করেন? আনুমানিক কোন সময়ে চর্যাপদগুলি রচিত হয়েছিল? এই পদগুলিতে তৎকালীন সমাজজীবনের যে প্রতিফলন দেখা যায়, সংক্ষেপে লেখো।
১+১+৩ (২০১৭, ২০২২)
মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে নেপালের রাজদরবারের গ্ৰন্থাগার থেকে চর্যাপদের পুঁথি আবিষ্কার করেন।
আনুমানিক দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে চর্যাপদগুলি রচিত হয়েছিল।
প্রাচীন বাংলা ভাষার বিশ্বস্ত দলিলরূপে যেমন চর্যাপদের গুরুত্ব, তেমনি বাঙালি জাতির আদি জীবনচর্যার চিত্রাঙ্কনেও তার মূল্য অপরিসীম। বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণ ধর্মের গূঢ় সাধনতত্ত্বের কথা ও অমর্ত উপলব্ধিকে ব্যক্ত করতে গিয়ে বাংলার সমাজ ও জীবনের প্রতি মরমি দৃষ্টিতে যে উজ্জ্বল ছবি তুলে ধরেছেন, তা বড়োই হৃদয়স্পর্শী।
চর্যাপদে সমাজের অন্ত্যজ যে সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রেণি, তাদের কথাই ব্যক্ত হয়েছে। প্রবল বর্ণবৈষম্যের জন্য অচ্ছুৎ ডোম, নিষাদদের স্থান ছিল গ্রামের বাইরে, জীবন ছিল নিশ্ছিদ্র দারিদ্র্যে ভরা, দুবেলা দু-মুঠো আহার জুটত না, ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে না পেরে চুরি-ডাকাতি করত, কিন্তু দারিদ্র্য সত্ত্বেও অতিথি-অভ্যাগতদের জানাত সমাদর।
‘হাঁড়িত ভাত নাহি নিতি আবেশী।’
শবরদের যে জীবনকথা পদের মধ্যে পাওয়া যায় তাতে জানা যায় যে, শবরেরা বাস করত উঁচু পাহাড়ে বা টিলাতে, পরিধানে থাকত ময়ূরপুচ্ছ, গলায় পরত গুঞ্জার মালা, ঘরের চারদিকে ফুটত কাপাস ফুল, আবার এই কার্পাস তুলো থেকে কাপড় বুনে, বনে-জঙ্গলে হরিণ শিকার করে জীবিকানির্বাহ করত। সমাজে মদ খাওয়ার রেওয়াজ ছিল এবং নির্দিষ্ট স্থানে নিঃশব্দে মদ খেত।
ডোমেরা বেত ও বাঁশের চাঙারি, চুপড়ি, ধামা, কুলো তৈরি করত। কেউ-কেউ পল্লি অঞ্চলে থাকা ছোটো নদী পারাপারের জন্য খেয়ামাঝির কাজ করত, ডোম নারীদের কেউ-কেউ নৃত্যবিদ্যায় নিপুণা ছিল।
‘নাচন্তী গাইল বাজন্তী দেবী’।
সচ্ছল পরিবারে অর্থাৎ ধনীগৃহে অনুষ্ঠান খুব সাড়ম্বরে পালিত হত, বাদ্যভাণ্ড বাজিয়ে ডোমকন্যাকে বিবাহ করতে যাওয়ার কথা কাহ্নপাদের পদে রয়েছে এবং বাসরঘরে মেয়েরা বরকে ঘিরে সারারাত হাস্যকৌতুকের কথা, আমোদ-আহ্লাদ উপভোগের কথা, বিধবাবিবাহের কথাও পাওয়া যায়।
সমাজে ধার্মিক লোকেদের পুঁথি পড়তে, কোশাকুশি দিয়ে পুজো করতে, মালা জপতে দেখা যায়, নাট্যানুষ্ঠানও হত। স্ত্রীলোকদের কাঁকন, মুক্তাহার, কুন্তল ইত্যাদি অলংকারের ব্যবহার, ধনীদের সোনা-রূপার অলংকার ব্যবহারের পরিচয় পাওয়া যায়।
চর্যাকারগণ বাঙালি সমাজের হাড়ি, ডোম, শবর, শুঁড়ি, কাঠুরে, তেলি, নটনটী, পাটনি প্রভৃতি লোকজীবনের অন্তর্গত বহু নারীর জীবনচিত্র – সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আশা-নিরাশার করুণ ও মধুরজীবনের চিত্র এঁকে যেমন প্রাচীন যুগের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পরিচয় দিয়েছেন, তেমনি সাধারণ অজ্ঞাত মানুষের জীবনালেখ্য আমাদের কাছে বিধৃত করেছেন চর্যাপদের মধ্যে, যা অমূল্য।
৩। বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন কোনটি ? এটি কে, কোথা থেকে আবিষ্কার করেন? বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এই গ্রন্থের গুরুত্ব কোথায় ?
১+১+১+২ (২০১৯)
বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন হল চর্যাপদ।
মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে নেপালের রাজদরবারের গ্ৰন্থাগার থেকে চর্যাপদের পুঁথি আবিষ্কার করেন।
চর্যার ভাষা, ছন্দ, শব্দ ব্যবহার এবং অলংকারের প্রয়োগ নিঃসন্দেহে কবিকর্মের পরিচায়ক। বাংলা পয়ার ও ত্রিপদী ছন্দের প্রাথমিক প্রয়োগ এই চর্যাপদের পদগুলিতেই লক্ষ্য করা যায়।
“সোনে ভরিতি করুণা নাবী/রূপা থোই নাহিক ঠাবী” পদে যে চিত্রকল্প সৃষ্টি হয়েছে, “তুলা ধুনি ধুনি আঁশুরে আঁশু / আশু ধুনি ধুনি নিরাবর মোবু” পদে ধ্বনিমাধুর্য, কাব্যসৌন্দর্য অর্থকে অতিক্রম করে যে কাব্যিক ব্যঞ্জনা লাভ করেছে, তাতে চর্যাপদগুলি সাহিত্যসম্পদে হয়ে উঠেছে সমৃদ্ধ। চর্যাপদ যেন তত্ত্বের মৃণালে কাব্যের শতদল।