রঙ্গমঞ্চ : প্রবন্ধ (প্রশ্ন ও উত্তর)

রঙ্গমঞ্চ প্রবন্ধ হতে প্রশ্ন ও উত্তর নিম্নে দেওয়া হল। Bengali B.A.(General) RANGAMANCHA Question Answer. প্রবন্ধ রঙ্গমঞ্চ হতে 2, 5, 10 নং প্রশ্ন ও উত্তরগুলি দেওয়া হল।

প্রবন্ধরঙ্গমঞ্চ
রচনাকাল পৌষ ১৩০১
গ্রন্থবিচিত্র প্রবন্ধ
রচনারবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকাশিতবঙ্গদর্শন পত্রিকা
রঙ্গমঞ্চ

Table of Contents

রঙ্গমঞ্চ প্রবন্ধ হতে প্রশ্ন ও উত্তর

Bengali B.A.(General) প্রবন্ধ রঙ্গমঞ্চ হতে প্রশ্ন ও উত্তর।


প্রবন্ধ রঙ্গমঞ্চ হতে প্রশ্ন মান – ২

১। ‘রঙ্গমঞ্চ’ প্রবন্ধটি কত বঙ্গাব্দে লেখা হয়? এটি কোন প্রবন্ধ গ্রন্থের অন্তর্গত?

  • ‘রঙ্গমঞ্চ’ প্রবন্ধটি পৌষ ১৩০১ বঙ্গাব্দে লেখা হয়।
  •  ‘রঙ্গমঞ্চ’ প্রবন্ধটি ‘বিচিত্র প্রবন্ধ’ গ্ৰন্থের অন্তর্গত।

২। ‘বিচিত্র প্রবন্ধ’ গ্রন্থটি প্রথমে কি নামে প্রকাশিত হয়? এটি কখন প্রকাশিত হয়?

  • ‘বিচিত্র প্রবন্ধ’ গ্রন্থটি প্রথমে গদ্য গ্রন্থাবলী শীর্ষক গ্রন্থমালার প্রথম গ্রন্থ রূপে প্রকাশিত হয়।
  • ‘বিচিত্র প্রবন্ধ’ গ্রন্থটি ১৩১৪ বঙ্গাব্দের ৩রা বৈশাখ (১৬ এপ্রিল ১৯০৭) প্রকাশিত হয়।

৩। ‘রঙ্গমঞ্চ’ প্রবন্ধটি ‘বিচিত্র প্রবন্ধ’ গ্রন্থের কত সংখ্যক প্রবন্ধ ? কলাবিদ্যার গৌরব কোথায় ?

  • ‘রঙ্গমঞ্চ’ প্রবন্ধটি ‘বিচিত্র প্রবন্ধ’ গ্রন্থের চতুর্থ প্রবন্ধ হিসেবে স্থান পায়। 
  • কলাবিদ্যা যেখানে একেশ্বরী সেখানেই তার পূর্ণ গৌরব।

৪। ‘বিচিত্র প্রবন্ধ’ গ্রন্থে পুনর্বিন্যস্ত সংস্করণকালে ভূমিকায় কী লেখা ছিল?

‘বিচিত্র প্রবন্ধ’ গ্রন্থে পুনর্বিন্যস্ত সংস্করণকালে ভূমিকায় “এই গ্রন্থের গ্রন্থ পরিচয় আছে, ‘বাজে কথা’ প্রবন্ধে। অর্থাৎ ইহার যদি কোনো মূল্য থাকে, তাহা বিষয়বস্তুর গৌরবে নয়, রচনা রস – সম্ভোগে।” 

৫। ‘রঙ্গমঞ্চ’ প্রবন্ধটি কবে কোন পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ?

‘রঙ্গমঞ্চ’ প্রবন্ধটি নবপর্যায় বঙ্গদর্শন পত্রিকায় পৌষ ১৩০৯ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয়।

৬। ‘বিচিত্র প্রবন্ধ’ গ্রন্থের প্রথম প্রবন্ধ ও শেষ প্রবন্ধের নাম কী?

‘বিচিত্র প্রবন্ধ’ গ্রন্থের প্রথম প্রবন্ধের নাম ‘লাইব্রেরি’ এবং শেষ প্রবন্ধের নাম ‘সরোজিনী- প্রয়াণ’। 

৭। ‘বিচিত্র প্রবন্ধ’ থেকে বর্জিত প্রবন্ধগুলির নাম কী ?

‘বিচিত্র প্রবন্ধ’ থেকে বর্জিত প্রবন্ধগুলি হল ‘নানা কথা’, ‘বন্ধুস্মৃতি’, ‘সতীশ চন্দ্র রায়’, ‘মোহিতচন্দ্র সেন’।

৮। নাট্যমঞ্চের বর্ণনা কোথায় পাওয়া যায় ? ভরতের নাট্যশাস্ত্রের রঙ্গমঞ্চে কিসের উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায় না?

  • নাট্যমঞ্চের বর্ণনা পাওয়া যায় ভরতের নাট্যশাস্ত্রে।
  • ভরতের নাট্যশাস্ত্রের রঙ্গমঞ্চে দৃশ্যপটের উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায় না।

৯। ‘রঙ্গমঞ্চ’ প্রবন্ধটিতে রামায়ণের কোন কোন কাণ্ডের কথা উল্লেখ আছে?

উ: ‘রঙ্গমঞ্চ’ প্রবন্ধটিতে রামায়ণের আদিকাণ্ড থেকে উত্তরকাণ্ডের কথা উল্লেখ আছে।

১০। যা উচ্চ অঙ্গের সংগীত তা আপনার কথা আপনার নিয়মেই বলে, তা কার জন্য অপেক্ষা করে না?

যা উচ্চ অঙ্গের সংগীত তা আপনার কথা আপনার নিয়মেই বলে তার জন্য কালিদাস-মিলটনের মুখাপেক্ষা করে না। 

১১। ললিতকলার একটা বারোয়ারি ব্যাপার করা যেতে পারে কীভাবে?

ললিতকলার একটা বারোয়ারি ব্যপার করা যেতে পারে ছবি, গান, কথা মিশিয়ে।

১২। ললিতকলার বারোয়ারি ব্যাপারটার স্থান কোথায় ? 

ললিত কলার বারোয়ারি ব্যাপারটা খেলা হিসাবে হতে পারে, হাটের জিনিস হতে পারে কিন্তু রাজকীয় উৎসবের উচ্চ আসন দেওয়া যাবে না। 

১৩। শ্রব্যকাব্যের চেয়ে স্বভাবতই কতকটা পরাধীন কী? দৃশ্যকাব্য নিজেকে সার্থক করে কীভাবে?

  • শ্রব্যকাব্যের চেয়ে স্বভাবতই কতকটা পরাধীন দৃশ্যকাব্য।
  • দৃশ্যকাব্য নিজেকে সার্থক করে বাইরের সাহায্য নিয়ে।

১৪। ভালো কাব্য কার অপেক্ষা করে? সাহিত্য পাঠ করবার সময় আমরা সকলে মনে মনে কি করে থাকি ?

  • ভালো কাব্য ভাবুকের অপেক্ষা করে।
  • সাহিত্য পাঠ করবার সময় আমরা সকলে মনে মনে অভিনয় করে থাকি।

১৫। অভিনয়ে কাব্যের কী খোলে? অভিনয় বিদ্যা নিতান্ত কী?

  • অভিনয়ে কাব্যের সৌন্দর্য খোলে।
  • অভিনয় বিদ্যা নিতান্ত পরাশ্রিতা। 

১৬। নাটক কখন উপহারের যোগ্য হয়ে ওঠে?

নাটক যদি অভিনয়ের অপেক্ষা করে নিজেকে নানা দিক থেকে খর্ব করে তবে উপহাসের যোগ্য হয়ে ওঠে।

১৭। নাটকের উপহাসকে কিসের উপহাসের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে?

স্ত্রৈণ স্বামী যেমন লোকের কাছে উপহাস পায়, নাটকের উপহাসকে সেইভাবে তুলনা করা হয়েছে।

১৮। নাটকের ভাব কীরকম হওয়া উচিত? 

নাটকের ভাব হওয়া উচিত – “আমার যদি অভিনয় হয় তো হউক, না হয় তো অভিনয়ের পোড়াকপাল – আমার কোনোই ক্ষতি নাই।”

১৯। অভিনয়কে কাব্যের কী বিষয় স্বীকার করতেই হয় ?

অভিনয়কে কাব্যের অধীনতা স্বীকার করতেই হয়।

২০। রবীন্দ্রনাথ অভিনয়কে মুক্ত রাখার কথা বলেছেন কোথা থেকে?

দৃশ্যপট, আলো, শব্দ, সাজসজ্জা ইত্যাদি কলাকৌশল থেকে রবীন্দ্রনাথ অভিনয়কে মুক্ত রাখার কথা বলেছেন।

২১। আমাদের দেশের যাত্রা রবীন্দ্রনাথের কাছে প্রিয় কেন?

আমাদের দেশের যাত্রার অভিনয়ে দর্শক ও অভিনেতার মধ্যে গুরুতর ব্যবধান থাকে না। তা সহজেই দর্শকের মনোরঞ্জন করতে পারে। তাই রবীন্দ্রনাথের কাছে আমাদের দেশের যাত্রা প্রিয়।

২২। নাটকাভিনয়ে কাল্পনিকতার সঙ্গে আর কিসের প্রয়োজন আছে বলে রবীন্দ্রনাথ মনে করেন ? 

নাটকাভিনয়ে কাল্পনিকতার সঙ্গে বাস্তবিকতার প্রয়োজন আছে বলে রবীন্দ্রনাথ মনে করেন।

২৩। লেখকের কাছে বিলাতে নকল করা থিয়েটার কী রকম? 

লেখকের কাছে বিলাতে নকল করা থিয়েটার ‘ভারাক্রান্ত একটা স্ফীত পদার্থ’।

২৪। লেখক নাট্য প্রযোজকদের কী আবেদন জানিয়েছেন?

লেখক নাট্য প্রযোজকদের আবেদন জানিয়েছেন যে, উপকরণ বাহুল্যে ও আয়োজনের আড়ম্বরে রাতে দর্শকের কল্পনা ক্লিস্ট হয়ে না পড়ে।

২৫। বিলাতি নাটকে গুণীর কদর অপেক্ষা কী বেশি?

বিলাতি নাটকে গুণীর কদর অপেক্ষা ধনীর মূলধনের আধিক্য বেশি।

২৬। লেখকের মতে অভিনেতার নিজের প্রতি কী থাকা প্রয়োজন?

লেখকের মতে অভিনেতার নিজের প্রতি বিশ্বাস থাকা প্রয়োজন। 

২৬। ‘স্থূল বিলাতি বর্বরতা’ – পরিহার করার উপায় কী?

অভিনয়ের চারদিক থেকে জঞ্জাল ঝেড়ে ফেলে দিয়ে অভিনয় ও অভিনেতাকে অনুকরণের স্থূলতা থেকে মুক্তিদান ও আত্মগৌরব প্রদান করলে ‘স্থূল বিলতি বর্বরতা’ পরিহার করা যাবে।

২৭। অভিনয় ও রঙ্গমঞ্চ সার্থকতা পথে কীভাবে সমুত্তীর্ণ হবে ? 

আর্টে বাস্তবিকতাই একমাত্র উপাদান নয়, সেখানে চাই অন্তর রস। তাহলেই অভিনয় ও রঙ্গমঞ্চ সার্থকতার পথে সমুত্তীর্ণ হবে।


প্রবন্ধ রঙ্গমঞ্চ হতে প্রশ্ন মান – ৫

১। “ছবিতে গানেতে কথায় মিশাইয়া ললিতকলার একটা বারোয়ারি ব্যাপার করা যাইতে পারে – কিন্তু সে কতকটা খেলা হিসাবে – তাহা হাটের জিনিস, তাহাকে রাজকীয় উৎসবের উচ্চ আসন দেওয়া যাইতে পারে না।” – এই বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে লেখক কী বলতে চেয়েছেন?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘রঙ্গমঞ্চ’ প্রবন্ধটি শিল্প বিষয়ক প্রবন্ধ। মঞ্চ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের যথেষ্ট ধারণা ছিল। রবীন্দ্রনাথ ‘রঙ্গমঞ্চ’ প্রবন্ধের সূচনায় ভরতের নাট্যশাস্ত্র প্রসঙ্গে বলেছেন যে, ভরতের নাট্যশাস্ত্রে নাট্যমঞ্চের বর্ণনা থাকলেও দৃশ্যপটের উল্লেখ নেই। অবশ্য তার ফলে যে বিশেষ ক্ষতি হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ তা মনে করেন না। একেশ্বরী হওয়াতেই কলাবিদ্যার পূর্ণ গৌরব। রামায়ণ যদি সুর করে পাট করা হত তাহলে তা চিরকাল একঘেয়ে হয়ে থাকে, রাগিণীরূপে তার পদোন্নতি ঘটে না।

উঁচু দরের কাব্যের সংগীত আপন নিয়মেই আসে। বাইরে সংগীতের সাহায্য সেই উঁচু দরের কাব্য অবজ্ঞার সঙ্গে উপেক্ষা করে। সেই কাব্য আপন কথা নিজের নিয়মেই বলে। তার জন্য কালিদাস-মিলটনের মুখাপেক্ষা হয়ে থাকতে হয় না। সেই কাব্য নিতান্ত তুচ্ছ তোম-তানা-নানা নিয়ে চমৎকার কাজ চালিয়ে দেয়। অর্থাৎ উঁচু দরের কাব্য নিজের গুণেই সর্বগুণ সম্পন্ন হয়ে ওঠে। নিজের আলোতেই নিজে আলোকিত হয়ে ওঠে। 

ছবি-গান-কথা মিশিয়ে ললিতকলার একটা বারোয়ারি ব্যবহার হতে পারে ঠিক কথা কিন্তু সেটা কখনোই উঁচু দরের কাব্য হবে না। সেই কাব্য কতকটা খেলা-হিসাবে ব্যবহৃত হবে, হাটের জিনিস হিসাবে ব্যবহৃত হবে। কিন্তু তাকে রাজকীয় উৎসবের উচ্চ আসন দেওয়া কখনোই যাবে না।

২। “যদি তাহা সত্য হয়, তবে ডবল দাম দিলেও এমন সকল লোককে টিকিট বেচিতে নাই।” – কোন প্রসঙ্গে এমন উক্তি করেছেন প্রাবন্ধিক ?

‘রঙ্গমঞ্চ’ প্রবন্ধটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের থিয়েটার ভাবনার একটি উল্লেখযোগ্য প্রকাশ। তিনি বলেছেন অভিনয়কে কাব্যের অধীনতা স্বীকার করতেই হয়। কিন্তু তাই বলে সকল কলাবিদ্যার গোলামি তাকে করতে হবে এমন কোনো কথা নেই। অভিনয়কে যদি আত্মপ্রকাশের গৌরব বজায় রাখতে হয় তাহলে যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই কাব্যের অধীনতা স্বীকার করতে হবে। তার বেশি বা কম নয়।

অভিনেতার পক্ষে অতীব প্রয়োজন নাট্যোক্ত কথা অর্থাৎ সংলাপ। কবি যে কথার সাহয্যে তাকে হাসতে অথবা কাঁদতে সাহায্য করেন অভিনেতা ভার সাহায্য গ্রহণ করবেন। দর্শক অভিনয় উপভোগ করতে আসে, তাদের আনন্দ দানই অভিনয় ও অভিনেতার উদ্দেশ্য। প্রাবন্ধিক এখানে বলতে চেয়েছেন মঞ্চে অভিনয়, অভিনেতা ও দর্শকের মধ্যে এক বন্ধন থাকবে। সেখানে অভিনেতার অভিনয়-ই দর্শকদের মনে ফুটে উঠবে। সেই অভিনয়ের পরিপ্রেক্ষিতে যে দৃশ্যের প্রয়োজন সেই দৃশ্যপট সরাসরি উত্থাপন না করলেও চলবে। দৃশ্যপট দর্শকরা নিজেরাই কল্পনা শক্তির সাহায্যে ফুটিয়ে তুলবে।

উদাহরণ হিসেবে ‘শকুন্তলা’ নাটকের একটি দৃশ্যের কথা বলা যায়, যেখানে রাজা দুষ্যন্ত গাছের গুঁড়ির আড়ালে দাঁড়িয়ে সখীদের সঙ্গে শকুন্তলার কথাবার্তা শুনছেন। অতি উত্তম কথা। কথাবার্তা বেশ রসে জমিয়ে বলে গেলেই হবে। তার জন্য আস্ত গাছের গুঁড়িটা দর্শকের সম্মুখে উপস্থিত না করার কথা বলছেন প্রাবন্ধিক। তিনি বলতে চাইছেন যে দর্শক অভিনয় দেখতে এসেছেন তার কল্পনা শক্তি একটু হলেও থাকা প্রয়োজন। যাতে সেই আস্ত গুঁড়িটা না থাকলেও দর্শক যেন তা কল্পনা করতে পারে। এইটুকু বিশ্বাস দর্শকদের উপর করতেই হবে। কিন্তু দর্শকদের মধ্যে যদি এই কল্পনা শক্তিটুকু না থাকে তবে ডবল দাম দিলেও এই সমস্ত লোককে টিকিট না বেচাই ভালো। কারণ অভিনয়, অভিনেতার সঙ্গে দর্শকের কল্পনা শক্তিটুকুও প্রয়োজন।

৩। “আমাদের দেশের যাত্রা আমার ঐ জন্য ভালো লাগে। ” – প্রাবন্ধিকের দেশের মাত্রা ভালো লাগার কারণ কী? 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘রঙ্গমঞ্চ’ প্রবন্ধে নাটক অভিনয়ের এক বিশেষ দিককে ফুটিয়ে তুলেছেন। আমাদের দেশে যাত্রা অভিনয়ে দর্শক ও অভিনেতার মধ্যে গুরুতর ব্যবধান থাকে না বলে তা সহজেই দর্শকদের মনোরঞ্জন করতে পারে। কাব্যরস যেটা অভিনয়ের সাহায্যে ফেরাবার মতো দর্শকদের পুলকিত চিত্তের উপর ছড়িয়ে পড়ে। তিনি দর্শকদের সঙ্গে অভিনেতাদের সম্পূর্ণের একাত্মতা স্থাপনের কথা বলেছেন। তিনি অভিনয়কে কাব্যরসাশ্রিত, যাত্রারীতি অনুসারী ও ব্যঞ্জনাধর্মী করতে

তিনি ভাবুকের চিত্তমধ্যবর্তী রঙ্গমঞ্চের উপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছেন। সেখানে জাদুকরের হাতে যে দৃশ্যপট রচিত হতে থাকে সেই পট, সেই মঞ্চই নাট্যকারের লক্ষ্যস্থল। কাব্যের খাতিরে অনিবার্য ত্রুটিকে মার্জনা করা গেলেও যেতে পারে, কিন্তু মঞ্চের জন্য কাব্যকে ছোটো করা উচিত নয়। শকুন্তলা নাটক অভিনয়কালে বাইরের চিত্রপটের প্রয়োজন নেই, চিত্রপটগুলি যেন আপনি-ই সৃষ্ট হয়ে চলেছে। 

রবীন্দ্রনাথের মতে “কী চরিত্রসৃজনে, কী স্বভাব চিত্রে নিজের কাব্যসম্পদের উপরেই তাহার একমাত্র নির্ভর।” আবার নাটকাভিনয়ে শুধু কাল্পনিকতাকে প্রশ্রয় দিলে চলবে না, বাস্তবিকতারও প্রয়োজন আছে। তবে নাটকাভিনয়ে আয়োজনের ভাব জটিল ও অতিরিক্ত হলে চলবে না।

৪। “বিলাতের নকলে আমরা যে থিয়েটার করিয়াছি, তাহা ভারাক্রান্ত একটা স্ফীত পদার্থ।” – এর মধ্যে দিয়ে প্রাবন্ধিক কী বলতে চেয়েছেন?

‘রঙ্গমঞ্চ’ প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন মঞ্চের ‘চিত্রপট’-এর চেয়ে দর্শকের ‘চিত্তপট’-এর উপর ভরসা রাখা প্রয়োজন। নাটকে যা দেখা যায় সেই উপকরণ নিয়ে যা দেখা যায় না সেই ভাবরসকে নাটকে অভিব্যক্ত করতে হবে। তিনি প্রবন্ধ শুরুই করেছেন ‘ভরতের নাট্যশাস্ত্রে নাট্যমঞ্চের বর্ণনা আছে। তাহাতে দৃশ্যপটের কোনো উল্লেখ দেখিতে পাই না। তাহাতে যে বিশেষ ক্ষতি হইয়াছিল এরূপ বোধ করি না।’ 

রবীন্দ্রনাথের নাট্য ভাবনার বিশ্বাসের জগতের মধ্যে ঐতিহ্য অনুসরণের প্রয়াস ছিল। তাঁর মতে কাব্যকলার আভাসই যথেষ্ট। আঁকা ছবি দ্বারা অত্যন্ত বেশি নির্দিষ্ট না হওয়াতেই দর্শকের মনে অবাধে সে কাজ করতে পারে। নাট্যকাব্য দর্শকের কল্পনার উপরে দাবি রাখে, চিত্র সেই দাবিকে খাটো করে, তাতে ক্ষতি হয় দর্শকেরই। অভিনয় ব্যাপরটা বেগবান, প্রাণবান, গতিশীল; দৃশ্যপটটা তার বিপরীত, অনাধিকার প্রবেশ করে সচলতার মধ্যে যাকে সে মূক, মূঢ় দর্শকের চিত্ত দৃষ্টিকে নিশ্চল বেড়া দিয়ে সে একান্ত সংকীর্ণ করে রাখে।

তাই প্রাবন্ধিকের কাছে বিলাতের নকল করা থিয়েটার ভারাক্রান্ত পদার্থ। প্রবল আতিশয্য অভিনয় বিষয়ের স্বচ্ছতা একেবারে নষ্ট করে দেয়। সেটি কেবল বাইরের দিকেই দোলা দেয়, গভীরতার মধ্যে প্রবেশ করতে বাধা দেয়। বিলাতি অভিনয়রীতি অনুকরণের ফলে লক্ষ্মীর প্যাঁচাই সরস্বতীর পদ্মকে প্রায় আচ্ছন্ন করে। এখানে যেন গুণীর কদর অপেক্ষা ধনীর মূলধনের আধিক্য। 

প্রাবন্ধিকের মতে, অভিনেতার নিজের উপর বিশ্বাস-ই বড়ো কথা। অভিনয়ের চারিদিক থেকে জঞ্জাল ঝেড়ে ফেলে দিয়ে অভিনয় ও অভিনেতাকে অনুকরণের স্থূলতা থেকে মুক্তি দান ও আত্মগৌরব দান প্রদান করতে হবে। ‘স্থূল বিলাতি বর্বরতা’র সঙ্গে জটিলতাকে পরিহার করতে হবে বঙ্গ রঙ্গমঞ্চে। 

৫। ‘স্ত্রী চরিত্র অকৃত্রিম স্ত্রীলোককে দিয়াই অভিনয় করাইতে হইবে, এই অত্যন্ত মূল বিলাতি বর্বরতা পরিহার করিবার সময় আসিয়াছে।’ – এই উক্তির মধ্যে প্রাবন্ধিকের কোন চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে?

‘রঙ্গমঞ্চ’ প্রবন্ধটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের থিয়েটার ভাবনার একটি উল্লেখযোগ্য প্রকাশ। বিভিন্ন চিঠিপত্রে, আলাপচারিতায় এবং নাট্যগ্রন্থের ভূমিকায় তাঁর থিয়েটার ভাবনার কথা বলেছেন রবীন্দ্রনাথ। বাংলায় নাট্য প্রযোজনায় রবীন্দ্রনাথ এক স্বতন্ত্র ও ভিন্নমুখী ধারা তৈরি করেছেন। রবীন্দ্রনাথ নাটক ও অভিনয় জগতের সঙ্গে বেশ ঘনিষ্টভাবে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর নাট্যাভিনয়ের জীবনকে দুটি পর্বে ভাগ করা যায় – জোড়াসাঁকো পর্ব ও শান্তিনিকেতন পর্ব। শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাট্য প্রযোজনায় দৃশ্যপটের সরলীকরণও এর মধ্যে সাংকেতিকতায় রহস্য আরোপ সাধিত হয়েছিল। কিন্তু স্ত্রীলোকের চরিত্র পুরুষের দ্বারা অভিনয় করবার দুঃসাহসিকতা রবীন্দ্রনাথ দেখাতে পারেননি।

মনে রাখা দরকার, ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দ থেকেই মেয়েরা নারী চরিত্রে পাকাপাকিভাবে অবতীর্ণ হতে শুরু করেছে। এর আগে দু-একটি অভিনয়ে থিয়েটারে মেয়েরাই স্ত্রী চরিত্রে অভিনয় করেছিল, বাদ বাকি সব অভিনয়েই পুরুষেরাই নারী ভূমিকায় অভিনয় করত। মেয়েরা পাকাপাকিভাবে নারী চরিত্রে অভিনয় শুরু করে দিলে, তৎকালীন সামাজিক অনেক হইচই, মতান্তর ও বাদানুবাদ হলেও বাংলা সাধারণ রঙ্গালয় থেকে অভিনেত্রীদের আর বাদ দেওয়া হয়নি। রাজকৃষ্ণ রায় তাঁর ‘বীণা’ থিয়েটারে নারী চরিত্র আগের মতো পুরুষদের দিয়ে অভিনয় করাতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে পথের ভিখিরি হয়ে পড়েছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের যে নাটকগুলি সাধারণ রঙ্গালয়ে অভিনয় করা হয়েছিল সেগুলিতেও স্ত্রী ভূমিকা মেয়েদের দ্বারাই অভিনীত হয়েছে। সেকালে ক্রমে ক্রমে সাধারণ মানুষ রঙ্গালয় থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন, আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে এবং স্বভাবতই বীতস্পৃহ হয়ে পড়েছেন। সেই উষ্মা ‘রঙ্গমঞ্চ’ প্রবন্ধে প্রতিফলিত। তাই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন বিলাতি থিয়েটার এক ভারাক্রান্ত স্ফীত পদার্থ। তাকে নাড়ানো শক্ত, আপামর সকলের কাছে আনা দুঃসাধ্য। তাই তিনি বলেছেন বাগানকে যে অবিকল বাগান এঁকে খাড়া করতে হবে এবং স্ত্রী চরিত্র অকৃত্রিম স্ত্রীলোককে দিয়ে অভিনয় করতে হবে, এই স্থূল বিলাতি বর্বরতা পরিহার করতে হবে। 

৬। “কেবল কাব্যরসের প্রাণদায়িনী বিশল্যকরণীটুকু হইলে চলিবে না, তাহার সঙ্গে বাস্তবিকতার আস্ত গন্ধমাদনটা পর্যন্ত চাই।” – কথাটির তাৎপর্য ব্যাখ্যা কর।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘রঙ্গমঞ্চ’ প্রবন্ধে কলাবিদ্যার অন্তঃপ্রেরণা সম্বন্ধে সুচিন্তিত অভিমত ব্যক্ত করেছেন। ‘রঙ্গমঞ্চ’-এ কলাবিদ্যার দৃশ্যপট, অভিনয় কৌশল প্রভৃতি প্রত্যক্ষতা বিভ্রম সৃষ্টির উপযোগী দাহ্য উপাদানের উপর অতি নির্ভরতা এর স্বতন্ত্র মর্যাদার পক্ষে হানিকরকরূপে লেখক অনুভব করেছেন। প্রাবন্ধিক ‘রঙ্গমঞ্চ’ প্রবন্ধে থিয়েটার ভাবনার মত প্রকাশ করেছেন।

প্রাবন্ধিকের মতে নাট্যকারের আবেদন অভিনেতার সহায়তা ভিন্ন সম্পূর্ণ হয় না। কিন্তু নাটক দৃশ্যপটের সাহায্য কেন গ্রহণ করবে? দৃশ্যপটের অতি নিখুঁত আয়োজন কার্যত দর্শকের কল্পনাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়ার জন্য যাত্রা, লেখকের নিকট অধিকতর রুচিকর। দুষ্যন্তের রথবেগের পরিমাপের জন্য আস্ত রথখানাকে রঙ্গমঞ্চে হাজির করতে হয় না, দৃশ্যপটের ঘনঘন পরিবর্তনও নাটারস উপভোগের জন্য অত্যাবশ্যকীয় মনে হয় না। 

পাশ্চাত্য নাট্যকলা বাস্তবের তথ্যভাবগ্রস্ত অনুকরণে কল্পনাকে উত্তেজিত করার পরিবর্তে বস্তুপিণ্ডের চাপে তাকে পিষে মারে। কেবল কাব্যরসের প্রাণদায়িনী বিশল্যকরণীয়টুকু হলে চলবে না, বাস্তবের আস্ত গন্ধমাদনটাও চাই। সুতরাং উপকরণ বাহুল্য আয়োজনের আড়ম্বরে যাতে দর্শকের কল্পনা ক্লিষ্ট হয়ে না পড়ে লেখক নাট্য প্রযোজকদের সেই আহ্বানই জানিয়েছেন। 


প্রবন্ধ রঙ্গমঞ্চ হতে প্রশ্ন মান – ১০ 

১। “বাস্তবিকতা কাঁচপোকার মতো আর্টের মধ্যে প্রবেশ করিলে তেলাপোকার মতো তাহার অন্তরের সমস্ত রস নিঃশেষ করিয়া ফেলে,” – এই উক্তির মধ্যে দিয়ে প্রাবন্ধিক কী বলতে চেয়েছেন ‘রঙ্গমঞ্চ’ প্রবন্ধ অনুসারে আলোচনা করো।

‘রঙ্গমঞ্চ’ প্রবন্ধটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের থিয়েটার ভাবনার একটি উল্লেখযোগ্য প্রকাশ। বিভিন্ন চিঠিপত্রে, আলাপচারিতায় এবং নাট্যগ্রন্থের ভূমিকায় তাঁর থিয়েটার ভাবনার কথা বলেছেন রবীন্দ্রনাথ। বাংলায় নাট্য প্রযোজনায় রবীন্দ্রনাথ এক স্বতন্ত্র ও ভিন্নমুখী ধারা তৈরি করেছেন। এই প্রবন্ধটি এক শিল্পী বিষয়ক প্রবন্ধ। রবীন্দ্রনাথ নাটক ও অভিনয় জগতের সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠ ভাবে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর কাছে নাট্যাভিনয় বিদ্যাচর্চার অঙ্গ। তাঁর নাট্যাভিনয়ের জীবনকে দুটি পর্বে ভাগ করা যায় – জোড়াসাঁকো পর্ব ও শান্তিনিকেতন পর্ব।

জোড়াসাঁকো পর্বে মঞ্চকলাশ্রিত প্রসেনিয়ামের অধীন রোমান্টিক মঞ্চাভিনয় বলা যেতে পারে। শান্তিনিকেতন পর্বে অভিনয় ও প্রয়োগ সম্বন্ধে তাঁর ধারণা পরিবর্তিত হল। শান্তিনিকেতন পর্বে আবেগধর্মী অভিনয় তাঁর কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। ‘রঙ্গমঞ্চ’ প্রবন্ধের সূচনায় রবীন্দ্রনাথ ভরতের নাট্যশাস্ত্রের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন। ভরতের নাট্যশাস্ত্রে নাট্যমঞ্চের বর্ণনা থাকলেও দৃশ্যপটের উল্লেখ নেই। অবশ্য তার ফলে যে বিশেষ ক্ষতি হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ তা মনে করেন না।

প্রাবন্ধিকের মতে একেশ্বরী হওয়াতেই কলাবিদ্যার পূর্ণ গৌরব। রামায়ণ যদি আগাগোড়া সুর করে পড়া হয় তাহলে কাব্যমহিমা ধূলিসাৎ হয়, আবার সংগীতের রাগিণীকে কাব্যসৌন্দর্যে ভূষিত করতে গেলে তার নিজস্ব সৌন্দর্যটি হীনপ্রভ হয়ে পড়ে। উঁচু দরের কাব্য সংগীত আপন নিয়মেই আসে। ছবি-গান-কথা মিশিয়ে একটা বারোয়ারি ব্যাপারকে রবীন্দ্রনাথ মনে হয় দৃশ্যপাত বা নাট্যাভিনয় রূপে বোঝাতে চেয়েছেন।

শ্রব্যকাব্য অপেক্ষা দৃশ্যকাব্য অর্থাৎ নাটক অনেক পরাধীন। কারণ, তাকে অভিনয়ের জন্য অপেক্ষা করতে হয় অর্থাৎ বাইরের সাহায্যে তাকে সার্থক হতে হয়। তিনি একথাও বলেন যে সাহিত্য পাঠ করার সময় পাঠক মনে মনে অভিনয় করে, সেই অভিনয়ে যে কাব্যের সৌন্দর্য খোলে না সে কাব্যে কোনো কবিকে যশস্বী করে না। অভিনয় বিদ্যা পরাশ্রিতা, নাটকের গৌরবেই তার গৌরব। বিচিত্র প্রবন্ধের অন্তর্গত ‘রঙ্গমঞ্চ’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ অভিনয়কে কেবল কাব্যের অধীনে রাখতে চেয়েছেন। অর্থাৎ দৃশ্যপট, আলো, শব্দ, সাজসজ্জা ইত্যাদি কলাকৌশল থেকে তিনি অভিনয়কে মুক্ত রাখার কথা বলেছেন। তাই বলে সকল কলাবিদ্যার গোলামি তাকে করতে হবে এমন কোনো কথা নেই। অভিনয়কে যদি আত্মপ্রকাশের গৌরব বজায় রাখতে হয় তাহলে যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই কাব্যের অধীনতা স্বীকার করতে হবে, তার বেশি বা কম নয়।

অভিনেতার পক্ষে অতীব প্রয়োজন নাট্যোক্ত কথা অর্থাৎ সংলাপ। কবি যে কথার সাহায্যে তাঁকে হাসতে অথবা কাঁদতে সাহায্য করেন অভিনেতা তার সাহায্য গ্রহণ করবেন। দর্শক অভিনয় উপভোগ করতে আসে, তাদের আনন্দ দানই অভিনয় ও অভিনেতার উদ্দেশ্য। তাদের কল্পনা শক্তির সাহায্যে নাটকাভিনয় তাদের কাছে উপভোগ্য হয়ে ওঠে। প্রাবন্ধিক এখানে কালিদাসের ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম’ নাটকের উল্লেখ করেছেন – “দুষ্যন্ত গাছের গুঁড়ির আড়ালে দাঁড়াইয়া সখীদের সহিত শকুন্তলার কথাবার্তা শুনিতেছেন। অতি উত্তম….আস্ত গাছের গুঁড়িটা আমার সম্মুখে উপস্থিত না থাকিলেও সেটা আমি ধরিয়া লইতে পারি, এতটুকু সৃজনশক্তি আমার আছে,” অর্থাৎ এখানে দর্শকের কল্পনাশক্তির প্রতি প্রাধান্য দিতে চেয়েছেন প্রাবন্ধিক। তিনি প্রসেনিয়ামের বাধা তুলে দিয়ে দর্শকদের সঙ্গে অভিনেতাদের সম্পূর্ণ একাত্মের কথাই বলেছেন। তিনি অভিনয়কে কাব্যরসাশ্রিত, যাত্রারীতি অনুসারী ও ব্যঞ্জনাধর্মী করতে চেয়েছিলেন। 

প্রাবন্ধিক ভাবুকের চিত্তমধ্যবর্তী রঙ্গমঞ্চের উপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছেন। সেখানে জাদুকরের হাতে যে দৃশ্যপট আপনি রচিত হতে থাকে সেই পট, সেই মঞ্চই নাট্যকারের লক্ষ্যস্থল কাব্যের খাতিরে মঞ্চের অনিবার্য ত্রুটিকে মার্জনা করা গেলেও যেতে পারে, কিন্তু মঞ্চের জন্য কাব্যকে ছোটো করা উচিত নয়। শকুন্তলা নাটক অভিনয় কালে বাইরে চিত্রপটের প্রয়োজন নেই তার জন্য দর্শকের ‘চিত্তপট’-ই যথেষ্ট। আবার নাটকাভিনয়ে শুধু কাল্পনিকতাকে প্রশ্রয় দিলে চলবে না, বাস্তবিকতারও প্রয়োজন আছে। তবে নাটকাভিনয়ে আয়োজনের ভার জটিল ও অতিরিক্ত হলে চলবে না।

শ্রব্যকাব্যের থেকে দৃশ্যকাব্যকে বাইরের সাজসজ্জার উপর কিছুটা বেশি নির্ভরশীল মনে হতে পারে, রবীন্দ্রনাথ তাঁর অতিবিশুদ্ধির জন্য এই মতকে ততটা আমল দেননি। কাব্য ও নাট্য উভয়ের উপভোগের জন্য তিনি একমাত্র ভাবুকতাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন, বহিরঙ্গ আয়োজনের সহযোগিতার উপর কোনো গুরুত্ব আরোপ করেননি।

তবে নাট্যকারের আবেদন অভিনেতার সহায়তা ভিন্ন সম্পূর্ণ হয় না, কিন্তু নাটক দৃশ্যপটের সাহায্য গ্রহণ করবে কেন? দৃশ্য পটের অতি নিখুঁত আয়োজন করার মানে হল দর্শকদের প্রতি বিশ্বাস না রাখা। রবীন্দ্রনাথ ‘চিত্রপট’ এর উপর গুরুত্ব আরোপ করেননি, তিনি ‘চিত্তপট’ এর উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। দৃশ্য নিরপেক্ষতার জন্য ও দর্শকের কল্পনাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়ার জন্য যাত্রা লেখকের নিকট অধিকতর রুচিকর হয়। দুষ্যন্তের রথবেগের পরিমাপের জন্য আস্ত রথখানাকে রঙ্গমঞ্চে হাজির করতে হয় না। দৃশ্যপটের ঘনঘন পরিবর্তন নাট্যরস উপভোগের জন্য অতি আবশ্যক বলে মনে হয় না।

পাশ্চাত্য নাট্যকলা বাস্তবের তথ্যভাবগ্রস্ত অনুকরণে কল্পনাকে উত্তেজিত করার পরিবর্তে বস্তুপিণ্ডের চাপে তাকে পিষে মারে। শুধু কাব্যরসের প্রাণদায়িনী বিশল্যকরণীটুকু হলে চলবে না, তার সঙ্গে বাস্তবের আস্ত গন্ধমাদনটা পর্যন্ত চাই। সুতরাং উপকরণ বাহুল্য ও আয়োজনের আড়ম্বরে যাতে দর্শকের কল্পনা ক্লিস্ট না হয়ে পড়ে লেখক নাট্য প্রযোজকদের সেই আবেদনই জানিয়েছেন।

বিলাতি অভিনয়রীতি অনুকরণের ফলে লক্ষ্মীর প্যাঁচাই সরস্বতীর পদ্মকে প্রায় আচ্ছন্ন করেছে। প্রাবন্ধিকের কাছে বিলাতের নকলে থিয়েটার ভারাক্রান্ত একটা স্ফীত পদার্থ। তাকে নড়ানো শক্ত, আপামর সকলের কাছে এনে দেওয়াও দুঃসাধ্য। এখানে যেন গুণীর কদর অপেক্ষা ধনীর মূলধনের আধিক্য। অসংযত আতিশয্যে অভিনেতব্য বিষয়ে স্বচ্ছতা একেবারে নষ্ট করে ফেলে, সেটা কেবল বাইরের দিকেই দোলা দেয়, গভীরতার মধ্যে প্রবেশ করতে দেয় না। অভিনেতার নিজের উপর বিশ্বাসই বড়ো কথা। অভিনয়ের চারিদিক থেকে জঞ্জাল ফেলে দিয়ে অভিনয় ও অভিনেতাকে অনুকরণের স্থূলতা থেকে মুক্তিদান ও আত্মগৌরব দান করতে হবে। স্ত্রীলোকের অভিনয় স্ত্রীলোককে দিয়েই করাতে হবে। অভিনয়ের দ্বারা নাট্যচরিত্রের সঙ্গে অভিন্নতার ভ্রান্তি উৎপাদন করতে হলে। স্ত্রী-পুরুষের প্রকৃতি ভেদকে উপেক্ষা করা যায় না।

তাই শেষে প্রাবন্ধিক বলতে চেয়েছেন স্থূল বিলাতি বর্বরতার সঙ্গে জটিলতাকে পরিহার করবার দিন এসেছে বঙ্গ রঙ্গমঞ্চে। সহজ সরল ভাবে নাটককে উপস্থাপন করতে হবে, দর্শকরা যেন নিজেরাই নিজেদের কল্পনাশক্তি দিয়ে তা উপলব্ধি করতে পারে। জটিলতা সব সময় অক্ষমতারই পরিচয় দেয়। তাই বাস্তবিকতা, কাঁচপোকার মতো আর্টের মধ্যে প্রবেশ করলে তেলাপোকার মতো তার অন্তরের সমস্ত রস শুয়ে নেয়, যেখানে এই রসের অভাবের ফলেই বহুমূল্যের বাহ্য প্রাচুর্যকে ভিড় করে আসে। যার ফলে জটিলতার সৃষ্টি হয়। কাব্যের মধ্যে রস-ই হল প্রধান। আর্টে বাস্তবিকতাই একমাত্র উপাদান না, সেখানে চাই অন্তর রস। তাহলেই অভিনয় ও রঙ্গমঞ্চ সার্থকতার পথে সমুত্তীর্ণ হবে। 

Leave a Comment