রূপনারানের কূলে – সাহিত্যচর্চা (দ্বাদশ শ্রেণী বাংলা)

সাহিত্যচর্চা (দ্বাদশ শ্রেণী বাংলা) রূপনারানের কূলে

রূপনারানের কূলে – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-সাহিত্যচর্চা (দ্বাদশ শ্রেণী বাংলা)


১. ‘সে কখনও করে না বঞ্চনা’ – কে, কখনও বঞ্চনা করে না? কবি কীভাবে সেই ভাবনায় উপনীত হয়েছেন? ১+8

ক্রান্তদর্শী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন সায়াহ্নে রচিত ‘শেষলেখা’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত এগারো সংখ্যক কবিতা ‘রূপনারাণের কূলে’ একটি অনন্য সৃষ্টি। আলোচ্য কবিতা থেকে গৃহীত উদ্ধৃতাংশটির বক্তা স্বয়ং কবি।

‘সে’ বলতে কঠিন বাস্তব সত্যকে বোঝানো হয়েছে। কবির মতে এই কঠিন সত্য কখনও বঞ্চনা করে না।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর দার্শনিক সত্তা দিয়ে অনুভব করেছিলেন এ জগৎ স্বপ্নের নন্দনকানন নয়। কবি স্বপ্নের মায়াজাল ভেদ করে বাস্তবের রূঢ় কঠিন ভূমিতে দাঁড়িয়েছিলেন। তাই কবির স্পষ্ট উক্তি –

জেগে উঠিলাম জানিলাম এ জগৎ J স্বপ্ন নয়।’

কবি জানেন সত্য কঠিন, রূঢ় ও বাস্তব। এই সত্যকে বরণ করতে গেলে আঘাতের পর আঘাত, বেদনার পর বেদনা সহ্য করতে হয়। কারণ সত্যের পথ কুসুমাকীর্ণ নয়। সত্যের পথে পাড়ি দিতে হলে কণ্টকাকীর্ণ পথকে পদদলিত করতে হয়। সত্যকে বরণ করতে গেলে কঠিনকে ভালোবাসতে হয়। তাই কবির স্পষ্ট অভিমত —

‘সত্য যে কঠিন কঠিনেরে ভালোবাসিলাম

সে কখনও করে না বঞ্চনা।’

ব্যক্তিগত বিপর্যয় ও বিশ্বজনীন সংকট –

এই দুইয়ের প্রভাবে কবি যা কিছু কঠিন, যা কিছু নির্মম তাকেও শান্ত সমাহিত চিত্তে গ্রহণ করতে চেয়েছেন। কারণ, যা কঠিন তা কখনও বঞ্চনা করে না, তাতে ছলনা নেই, তা স্পষ্ট। আর এই বিচিত্র ছলনা জাল উপেক্ষা করে সত্যের দারুণ মূল্য লাভ করার জন্যই তিনি কঠিনকে ভালোবাসলেন।


২. ‘রূপনারানের কূলে জেগে উঠিলাম’ – কে জেগে উঠলেন ? জেগে ওঠার আসল অর্থ কবিতাটির মধ্যে কীভাবে প্রকাশিত হয়েছে তা বুঝিয়ে দাও। ১+৪

ক্রান্তদর্শী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন সায়াহ্নে রচিত ‘শেষলেখা’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত এগারো সংখ্যক কবিতা ‘রূপনারাণের কূলে’ একটি অনন্য সৃষ্টি। আলোচ্য অংশে স্বয়ং কবি নিজের আত্মজাগরণের কথাই বলতে চেয়েছেন।

‘রূপনারাণের কূলে’ বলতে কবি রূপময় পার্থিব জগতকে বুঝিয়েছেন। সত্যদ্রষ্টা কবি জীবনের শেষ প্রান্তে উপনীত হয়ে চেতনার তন্দ্রাচ্ছন্নতা ছিন্ন করে ধূলিময় মর্ত্য পৃথিবীতে জেগে উঠেছেন। রূপময় এই মর্ত্য পৃথিবী যেন রূঢ়, বাস্তব ও আঘাত-বেদনায় চির প্রবহমান। বাস্তব জীবনে নদীর মতো মানুষকে জীবনযুদ্ধে প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে এগিয়ে চলতে হয় নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে। কবি তাঁর ব্যক্তি জীবনে আঘাতে ও বেদনায় কঠিন সত্যকে উপলব্ধি করেছেন এবং ভালোবেসেছেন। কবির আত্মোপলব্ধিতে রূপনারাণের তীরে জেগে ওঠা কে মৃত্যু চেতনার মধ্য দিয়ে নতুন জীবন বোধে উত্তরণ বলা চলে।

জীবনের পড়ন্ত বেলায় কবি রূপনারাণের তীরে জেগে উঠে নতুন এক চেতনার আলোকে সঞ্জীবিত হয়েছেন। আশাবাদী ও আত্মবিশ্বাসী কবি বার্ধক্যের শেষ সীমানায় উপনীত হয়ে রূপময় এই পার্থিব জগতকে রূঢ় বাস্তব বলে জেনেছেন। জীবনে উত্থানপতন অর্থাৎ ভাঙা-গড়ার খেলা স্বাভাবিক। জীবন যুদ্ধের লড়াইয়ে জিততে গেলে মাঝে মাঝে হারতেও হয়। আর সেই হার থেকেই সংগ্রহ করতে হয় দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ী ও পরবর্তী পদক্ষেপ জয়ের স্বপ্ন।

কবি জীবনের পলে পলে আঘাতে আহত হয়েছেন, বেদনায় বিহ্বল হয়েছেন, রক্তের অক্ষরে নিজের রূপ দেখেছেন। তবুও সত্য কঠিন জেনেও তাকে ভালোবেসেছেন।
রূপনারাণের তীরে জেগে উঠে স্বপ্নভঙ্গের মোহ কাটিয়ে কবি উপলব্ধি করেন জীবন হল দুঃখের তপস্যা। আর এই তপস্যার মধ্যে দিয়েই সত্যের নিদারুণ মূল্য লাভ করা যায়।


৩. ‘মৃত্যুতে সকল দেনা শোধ করে দিতে’ – বক্তা কে? ‘মৃত্যুতে সকল দেনা’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে ? সে ‘দেনা’ কীভাবে শোধ করতে চেয়েছিলেন কবি? ১+১+৩

ক্রান্তদর্শী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন সায়াহ্নে রচিত ‘শেষলেখা’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত এগারো সংখ্যক কবিতা ‘রূপনারাণের কূলে’ একটি অনন্য সৃষ্টি। আলোচ্য কবিতা থেকে গৃহীত উদ্ধৃতাংশটির বক্তা স্বয়ং কবি।

বিশ্ব প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত দুর্লভ জীবনে মানুষ নানা উত্থান পতন বা প্রতিকূলতার মধ্যে যে সত্য কে খুঁজে পায়, সেই সত্য চরম মূল্যবান। এই সত্য লাভই হল দেনা। এই দেনা শোধ করার বিকল্প পথ শুধু মৃত্যু লাভ। এই অর্থেই কবি উক্ত পংক্তিটি ব্যবহার করেছেন।

বাস্তব সমাজের উপর ভিত্তি করে কবি রবীন্দ্রনাথ মোহ, যুক্তিহীন আবেগ সরিয়ে বাস্তব জগতের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে উপলব্ধি করেছেন সমগ্র জীবনকে। বিশ্ব সংসারের সমস্ত ঋণ তিনি পরিশোধ করতে চান মৃত্যু অবধি কঠোর সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে সত্যানুসন্ধানের মাধ্যমে। কিন্তু সেই চলা অন্তহীন নয়, মৃত্যুতেই সমাপ্ত।

যুগ চেতনায়, যুগোত্তীর্ণ অন্তর্দৃষ্টির অধিকারী কবি মানব জীবনের আসা-যাওয়ার মধ্যে জীবনের মূল সত্যটি সমস্ত মানুষের প্রাণে অভয় মন্ত্র রূপে দান করেছেন। জীবনচর্যায় তিল তিল করে সঞ্চিত হতে থাকে সকল দেনার ভার। আর তাকে মৃত্যুর মধ্যে দিয়েই তো শোধ করে দিয়ে যেতে হয়।

সত্যের দারুণ মূল্য লাভ করে জীবনের ভাঁড়ার মানি পূর্ণ করে সকল দেনা চুকিয়ে অমিয় লোকে পাড়ি দিতে চান কবি। কবির আত্মোপলব্ধিতে ফিরে উঠেছে জীবন প্রবাহের যে দেনা, তা শোধ করার একমাত্র পন্থা অনিবার্য মৃত্যু। আর মৃত্যু যেহেতু জীবনের শেষ পরিসমাপ্তি সেহেতু লেনদেন সব মিটিয়ে লোকান্তরিত হওয়াটা তৃপ্তিদায়ক বা সুখকর।


৪. ‘আমৃত্যু দুঃখের তপস্যা এ জীবন’ – বক্তা কে ? আমৃত্যু দুঃখের তপস্যা বলতে কী বোঝানো হয়েছে? ১+৪

ক্রান্তদর্শী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন সায়াহ্নে রচিত ‘শেষলেখা’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত এগারো সংখ্যক কবিতা ‘রূপনারাণের কূলে’ একটি অনন্য সৃষ্টি। আলোচ্য কবিতা থেকে গৃহীত উদ্ধৃতাংশটির বক্তা স্বয়ং কবি।

সুখ আর দুঃখ মানব জীবনের অঙ্গে গাঁথা। সুখ আর দুঃখ একে অপরের পরিপূরক। সুখের আনন্দে মানুষ যেমন আবেগে বিহ্বল হয়ে ওঠে, ঠিক তেমনি দুঃখের বেদনায় মুহ্যমান হয়ে থাকে। সুখের পরিপূর্ণতা দুঃখের মধ্যেই ব্যাপ্ত থাকে।

দুঃখের অভিঘাতে জীবনের সত্য অনুসন্ধান করেছেন কবি তাঁর দূরদৃষ্টি দিয়ে। গভীর দার্শনিক জীবন জিজ্ঞাসা থেকে কবির উপলব্ধি কঠিন তপস্যার মধ্যে দিয়ে সত্যকে অনুভব করতে হয়। নিজের সুদীর্ঘ জীবনেও অনেক দুঃখ, অনেক আঘাত নেমে এসেছে। বারবার সে আঘাতে কবির তপশ্চর্যা বিচলিত হয়েছে। তাস্বত্ত্বেও কবি জীবন সত্যের নিগূঢ় সারকথা উপলব্ধি সাধনায় কবি সংকল্পবদ্ধ হয়েছেন।

সত্য দ্রষ্টা কবি বিশ্বাস করলেন, জীবনে সুখ-দুঃখ, আলো-অন্ধকার পাশাপাশি অবস্থান করে। তবে সুখের মুহূর্তগুলি ক্ষণস্থায়ী, দুঃখের মুহূর্তগুলি যেন স্থায়ী ও দীর্ঘ প্রসারী হয়। দুঃখের তপস্যা এক ধরনের কৃচ্ছ্রসাধন। কারণ বক্তা সত্য ও সাধনার পথকে আঘাত ও বেদনার মধ্যে দিয়ে আবিষ্কার করেছেন। জাগতিক নিয়মের মধ্যে বেঁচে থাকার জন্যও প্রতি মুহূর্তে দুঃখকে বরণ করে নিতে হয়।

Leave a Comment