বাংলা ভাষা ও শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির ইতিহাস হতে দ্বিতীয় পর্ব ভাষা হতে শব্দার্থতত্ত্ব নামক পঞ্চম অধ্যায় হতে প্রশ্ন উত্তর নিম্নে দেওয়া হল। উচ্চ মাধ্যমিক দ্বাদশ শ্রেণী বাংলা সিলেবাস অনুসারে দ্বিতীয় পর্ব ভাষা হতে শব্দার্থতত্ত্ব আলোচন করা হয়েছে ।
বাংলা ভাষা ও শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির ইতিহাসদ্বিতীয় পর্ব ভাষা হতে শব্দার্থতত্ত্ব
১.শব্দার্থ পরিবর্তন বলতে কী বোঝো ? শব্দার্থ পরিবর্তনের ধারা গুলি আলোচনা কর।
প্রশ্নের মান | ৫ |
উচ্চ মাধ্যমিক | ২০১৫, ২০১৭,২০২০ |
শব্দার্থ পরিবর্তন :-
সময়ের সাথে ভাষার প্রতিটি বিভাগ পরিবর্তিত হয়। শব্দার্থও এর বাইরে নয়। একই শব্দ সময়ের সাথে বিভিন্ন অর্থ প্রকাশ করে। শব্দের অর্থের এই পরিবর্তনকেই শব্দার্থ পরিবর্তন বলে।
শব্দার্থ পরিবর্তনের ধারা :-
শব্দার্থ পরিবর্তনের ধারাকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা যায়। যথা –
- ক) শব্দার্থের প্রসার বা বিস্তার,
- খ)শব্দার্থের সংকোচ বা সংক্ষেপ,
- গ) শব্দার্থের সংশ্লেষ বা সংক্রম বা রূপান্তর,
- ঘ) শব্দার্থের উৎকর্ষ বা উন্নতি,
- ঙ) শব্দার্থের অপকর্ষ বা অবনতি।
ক) শব্দার্থের প্রসার বা বিস্তার :-
যখন কোনো শব্দ তার মূল অর্থ বা বুৎপত্তিগত অর্থ ত্যাগ করে ব্যাপকতর অর্থ গ্ৰহণ করে, তখন তাকে শব্দার্থের বিস্তার বা সম্প্রসারণ বলে।
উদাহরণ :-
শব্দ | মূল অর্থ | অর্থের বিস্তার |
---|---|---|
গাঙ | গঙ্গা নদী | যেকোনো নদী |
কালি | কালো রঙের তরল পদার্থ | যে কোনো রঙের কালি |
খ) শব্দার্থের সংকোচ বা সংক্ষেপ :-
যখন কোনো শব্দ ব্যাপকতর অর্থ ত্যাগ করে অথবা অর্থ সমষ্টির মধ্যে কোনো একটি অর্থ প্রধান হয়ে ওঠে, তখন তাকে শব্দার্থেরসংকোচবাসংক্ষেপ বলে।
উদাহরণ:-
শব্দ | আদি অর্থ | বর্তমান অর্থ |
---|---|---|
অন্ন | খাদ্য দ্রব্য | ভাত |
কৃপণ | কৃপার পাত্র | ব্যয়কুণ্ঠ |
গ) শব্দার্থের সংশ্লেষ বা সংক্রম বা রূপান্তর :-
শব্দের অর্থ ক্রমান্বয়ে সংকোচ ও প্রসারের ফলে মূল অর্থ ত্যাগ করে যখন সম্পূর্ণ নতুন কোনো অর্থ লাভ করে, তখন তাকে শব্দার্থেরসংশ্লেষবাসংক্রমবারূপান্তর বলে।
উদাহরণ:-
শব্দ | আদিঅর্থ | বর্তমানঅর্থ |
---|---|---|
কলম | শর বা খাগ | লেখনী |
সন্দেশ | খবর | মিষ্টান্ন |
ঘ) শব্দার্থের উৎকর্ষ বা উন্নতি :-
কোনো শব্দের অর্থ যখন সাধারণ থেকে উন্নত স্তরে ব্যবহৃত হয়, তখন তাকে শব্দার্থের আরোহ বা উৎকর্ষ বা উন্নতি বলে।
উদাহরণ:-
শব্দ | আদিঅর্থ | বর্তমানঅর্থ |
---|---|---|
মন্দির | গৃহ | দেবালয় |
থান | ভূমি | দেবস্থান |
ঙ) শব্দার্থের অপকর্ষ বা অবনতি :-
যখন একটি শব্দ উন্নত অর্থ ত্যাগ করে হীন অর্থে প্রযুক্তি হয়, তখন তাকে শব্দার্থের অবরোহ বা অবনতি বা অপকর্ষ বলে।
উদাহরণ :-
শব্দ | আদি অর্থ | বর্তমান অর্থ |
---|---|---|
প্রীতি | পিরীত | কলঙ্ক যুক্ত ভালোবাসা |
নেক | ভালো | ন্যাকা |
২. শব্দার্থের উপাদানমূলক তত্ত্বটি উদাহরণসহ ব্যাখ্যা কর
প্রশ্নের মান | ৫ |
উচ্চ মাধ্যমিক | ২০১৮ |
শব্দার্থের উপাদানমূলক তত্ত্ব :- শব্দের উপাদানমূলক বিশ্লেষণের মূল ধারণা হল শব্দের অর্থকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত করে অন্যান্য শব্দের সঙ্গে তার ভাবগত উপাদানের ঐক্য খুঁজে নেওয়া। এর ফলে বিভিন্ন শব্দের শ্রেণীবদ্ধ করণ করা সম্ভব হয়। উপাদানমূলক তত্ত্বে শব্দকে কিছু অর্থগত উপাদানের সমষ্টি হিসেবে দেখা হয়।
যেমন :-
শব্দ | অর্থগত উপাদান |
---|---|
মা | মানব জাতীয় + স্ত্রী বোধক + প্রাপ্তবয়স্ক + একবচন |
শব্দের উপাদানমূলক তত্ত্বের মতে এই উপাদান গুলির সমষ্টিই শব্দের অর্থ সৃষ্টি করে। এর ফলে বিভিন্ন অর্থ যুক্ত শব্দের সৃষ্টি হয়। অতএব এই তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে শব্দ গুলিকে শ্রেণিবদ্ধ করা যায়।
যেমন :-
পুরুষ | = বৃষ, মোরগ |
নারী | =গাভী, মুরগি |
শিশু | = বাছুর, মোরগ ছানা |
এই তত্ত্বের মূল উপযোগিতা হল এই যে, এই তত্ত্বের মাধ্যমে শব্দ সমষ্টিকে সহজেই অর্থের ভিত্তিতে শ্রেণীভুক্ত করা যেতে পারে এবং তাদের মধ্যে অন্তর্নিহিত সাধারণ উপাদানকে শনাক্ত করা যেতে পারে; যার উপর ভিত্তি করে এই শ্রেণি গুলি তৈরি হয়।
উপাদানমূলক তত্ত্ব সর্বপ্রকার শব্দের অর্থের ব্যাখ্যা করতে সমর্থ নয়। সব শব্দের উপাদানের প্রাচুর্য নেই। তাছাড়া বিভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য সর্বজনগ্রাহ্য উপাদান বিরল। কিন্তু কিছু সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও উপাদানমূলক তত্ত্ব শব্দের স্বাভাবিক শ্রেণি নির্ধারণ এবং বিন্যাসের আলোচনায় বিশেষ ভাবে উপযোগী।
৩.শব্দার্থ পরিবর্তনের কারণগুলি আলোচনা কর
প্রশ্নের মান | ৫ |
উচ্চ মাধ্যমিক | no |
অভিধা,লক্ষণ ও ব্যঞ্জনার মধ্যে দিয়ে ভাষা বিজ্ঞানসম্মতভাবে শব্দের অর্থের পরিবর্তন ঘটে। শব্দার্থ পরিবর্তনের মূল কারণ দুটি —
- ক) স্থুল কারণ,
- খ) সূক্ষ্ম কারণ।
ক) স্থুল কারণ :-
শব্দার্থ পরিবর্তনের স্থূল কারণ তিনটি। যথা –
i) ঐতিহাসিক কারণ :-
জীবনধারায় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শব্দের অর্থও পরিবর্তিত হয়।
যেমন :-
প্রাচীনকালে’নাগর’শব্দের অর্থ ছিল নগরের অধিবাসী, কিন্তুবর্তমান অর্থ অবৈধ প্রেমিক।
ii) ভৌগোলিক কারণ :-
একই শব্দ ভিন্ন ভিন্ন ভৌগোলিক পরিবেশে প্রায়ই ভিন্ন ভিন্ন অর্থ বহন করে।
যেমন :-
বঙ্গদেশেঅভিমান শব্দের অর্থ স্নেহমিশ্রিত অনুযোগ, কিন্তু পশ্চিম ভারতে এর অর্থ অহংকার।
iii) উপকরণগত কারণ :-
উপকরণের নাম ও ধর্ম অনুসরণে অনেক সময় বস্তুর নামকরণ হয়। পরে উপকরণটি পরিবর্তিত হয়ে গেলেও পুরোনো নামটি থেকে যায়। সেক্ষেত্রে পুরোনো নামে নতুন জিনিস বোঝায়।
যেমন :-
পূর্বে’কালি’বলতে কালো রঙের উপকরণে গঠিত তরল পদার্থকে বোঝাত, কিন্তু যেকোনো রঙের উপকরণে গঠিত পদার্থকেও ‘কালি’বলা হয়।
খ) সূক্ষ্ম কারণ :-
শব্দার্থ পরিবর্তনের সূক্ষ্ম কারণ চারটি। যথা –
i) সাদৃশ্য :-
একটি বস্তুর সাথে অন্য বস্তুর সাদৃশ্যে শব্দের অর্থ পরিবর্তিত হয়।
যেমন :-
কালো রঙের তৈলবীজ ‘তিল’ – এর সাদৃশ্যে মানুষের গায়ে থাকা ছোটো কালো রঙের দাগকেও ‘তিল’বলা হয়।
ii) সংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস :-
সাধারণ লোকের ধারণা এই যে, অশুভ বিষয় বা বিপজ্জনক বস্তুর নাম উচ্চারণ করতে নেই।
যেমন :-
বাংলার মানুষ ‘সাপ’কথাটির পরিবর্তে ‘নাগ’বা ‘লতা’শব্দ উচ্চারণ করে।
iii) শৈথিল্য ও আরামপ্রিয়তা :-
ভাষা ব্যবহারে শিথিলতা বা আরামপ্রিয়তার কারণে শব্দ সংহতি বা বাক্যাংশকে সংহত করার প্রবণতা দেখা যায়।
যেমন :-
ক্ষৌরকর্ম >কামানো, খাবার জিনিস >খাবার, সন্ধ্যার সময় প্রদীপ দেওয়া >সন্ধে দেওয়া ইত্যাদি।
iv) আলংকারিক প্রয়োগ :-
উপমা, রূপক ইত্যাদি অলংকারের সাহচর্যে অনেক সময় শব্দের অর্থ পরিবর্তিত হয়।
যেমন :-
‘সন্ধ্যামণি’শব্দটি ‘সন্ধ্যা কালের মণি’এই রূপকার্থে ব্যবহৃত হত। বর্তমানে একটি সাধারণ ফুলের নাম ‘সন্ধ্যামণি’।