সাহিত্যচর্চা (দ্বাদশ শ্রেণী বাংলা) ভাত – মহাশ্বেতা দেবী
রচয়িতা | মহাশ্বেতা দেবী |
কি ধরনের রচনা | ছোটো গল্প |
অন্তর্ভুক্ত | দ্বাদশ শ্রেণী বাংলা |
পাঠ্য বই | সাহিত্যচর্চা |
ভাত – সাহিত্যচর্চা – দ্বাদশ শ্রেণী বাংলা
১. মহাশ্বেতা দেবীর ‘ভাত’ ছোটো গল্প অবলম্বনে উচ্ছবের চরিত্রটি বিশ্লেষণ কর।
প্রশ্নের মান | ৫ |
উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা | not |
পরিচয় – মহাশ্বেতা দেবী রচিত ‘ভাত’ ছোটোগল্পের কেন্দ্ৰীয় তথা প্রধান তথা নায়ক চরিত্র উচ্ছবের চাউনি ছিল উগ্র, পরনে ছিল খুবই ছোটো লুঙ্গি, চেহারা ছিল বন্য।
ভাতের কাঙাল – মাতলা নদীর বেনো জলে স্ত্রী-সন্তানকে হারিয়ে প্রায় পাগল হয়ে যাওয়া উচ্ছব সবাইকে ফিরে পাবার আশায় শূন্য ভিটেমাটি অনেকদিন ঘুরে বেড়ায়। তাই লঙ্গরখানার খিচুড়ি সে খেতে পারে নি। সতীশবাবুর কাছে ভাত চেয়েও সে পায় নি। তাই সরকার প্রদত্ত চাল চিবিয়ে কয়েকদিন কাটিয়ে দেয় সে। শেষে গ্রাম সম্পর্কিত বোন বাসিনীর কলকাতা বাসী মনিবের বাড়িতে আশ্রয় নেয় ভাতের আশায়। বাসিনীর মনিব বাড়িতে পাঁচ রকম চালের ভাত হয় শুনে ‘ভাতের আহিঙ্কে’ উচ্ছবের ‘চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসে’।
দুর্ভাগ্য পীড়িত – এক ঝড়-বৃষ্টির রাতে মাতাল মাতলা নদীর প্রবল ঢেউয়ে ভেসে যায় উচ্ছবের স্ত্রী-সন্তান-সংসার। সে নিজে ভেসে গিয়েও গাছে বাধা পেয়ে কোনো ক্রমে প্রাণে বেঁচে যায়। তাই উচ্ছবকে এক দুর্ভাগ্য পীড়িত চরিত্র বলাই যায়।
বাস্তব বুদ্ধির অভাব – উচ্ছবের মধ্যে বাস্তব বুদ্ধির যথেষ্ট অভাব ছিল। তাই স্ত্রী-সন্তানের বিয়োগ ব্যথায় পাগল হয়ে গিয়ে লঙ্গরখানায় খাবার কথা ভুলেই যায় সে। তাছাড়া সরকার থেকে ঘর তৈরি করতে অনুদান দেওয়া হবে শুনেও সে কলকাতায় যাওয়ার জন্য চঞ্চল হয়ে উঠেছিল।
পর দুঃখে কাতর – উচ্ছব ছিল দয়ালু গোছের মানুষ। তাই পরিবারকে হারিয়ে সে প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া স্বার্থ স্বার্থপর সতীশ মিস্ত্রির হরকুল, পাটনাই আর মোটা ধানে মড়ক লাগলে সে তার কান্না গোপন করতে পারে নি।
পরিনতি – সতীশ মিস্ত্রির দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়ে, পরিবারের শোকে পাগল হয়ে ভাতের আশায় উচ্ছব কলকাতায় আসে। কিন্তু সেখানেও সেই ভাত খাওয়ার জন্যই তার জেল হয়। অর্থাৎ তার ভাগ্য এখানেও তার সাথে বিরূপতা করে।
২. ‘ এ সংসারে সব কিছু চলে বড়ো পিসিমার নিয়মে’ – কোন সংসারের কথা বলা হয়েছে? এ প্রসঙ্গে বড়ো পিসিমার চরিত্র বিশ্লেষণ করো।
প্রশ্নের মান | ১+৪ |
উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা | not |
উৎস – বাংলা সাহিত্যে ‘দলিত কণ্ঠস্বর’ লেখিকা মহাশ্বেতা দেবীর ‘ভাত’ গল্প থেকে আলোচ্য অংশটি গৃহীত।
নির্দিষ্ট সংসার – আলোচ্য অংশে ‘ এ সংসারে’ বলতে কলকাতার বড়ো বাড়িকে কেন্দ্র করে গল্পে যে সামন্ততান্ত্রিক সংহারের ছবি অঙ্কিত হয়েছে, সেই সংসারের কথাই বলা হয়েছে।
বড়ো পিসিমার চরিত্র – মহাশ্বেতা দেবীর ‘ভাত’ গল্পে কলকাতার বড়ো বাড়ির কর্ত্রীরূপে বড়ো পিসিমাকে আমরা দেখতে পাই। গল্পে তার চরিত্রের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে। –
একান্নবর্তী পরিবারের আটপৌরে প্রতিনিধি – গল্পে বড়ো পিসিমা নামহীন, একান্নবর্তী পরিবারের সম্পর্কগত সম্বোধনেই তার পূর্ণাঙ্গ পরিচয় মেলে। আবার এই সম্বোধনের পারিবাহিক মর্যাদার ভূমিকা তাকে বিবাহ সম্বন্ধ স্থাপনেও বিরত রেখেছে। এই ত্যাগ নিদর্শন এক আদর্শময়ীর উজ্জ্বল মাহাত্ম্য বলে বিবেচিত হয়।
দেবতার সেবা সংকল্প – বড়ো বাড়ির বুড়ো কর্তা বিপত্নীক হলে সংসার সামলাতে নাকাল হয়ে পড়েন। ফলে এই বিরাট সংসার তদারকি করতে গিয়ে দায়িত্ববান পিসির বিয়ে করা হয় নি। বাড়ির লোকেরা অবশ্য বলে পিসিমার বিয়ে হয়েছে দেবতার সাথে, উমাপতি-ই তার পতি। মানুষ নয়, দেবতার প্রতিই তিনি কৃত-সংকল্প এবং সে বিষয়ে তিনি একেবারেই নৈষ্ঠিক।
কর্ত্রীরূপে পিসিমা – বড়ো বাড়ির সংসারের রাশ পিসিমার হাতেই। অর্থাৎ তিনি গৃহকর্ত্রী, তার বুদ্ধি ও দক্ষ পরিচালন গুণেই বাড়ির অন্দরমহল ও বহির্মহল সুনিয়ন্ত্রিত। হেঁসেল দেখা, বাবার সেবা করা, বামুন-চাকর-ঝিদের ওপর নজরদারি সব কাজেই পিসিমা পারদর্শী।
তিক্ত স্বভাবেও অনুকম্পাবোধ – বাড়ির বড়ো বউ উচ্ছব কে দেখে যখন বিরক্ত ও কুণ্ঠা প্রকাশ করে, তখন পিসিমা নিজস্ব স্বভাব অনুযায়ী রুক্ষ স্বরে বলে – ‘ ময়ূর ছাড়া কার্তিক আসবে না কি ? এই চোদ্দ দফায় কাজ করবে, পেটে দুটো খাবে বই তো নয়’। বোঝা যায়, একটা মানবিক কোমল অনুভূতি এবং বিবেচনাই পিসিমার চরিত্রকে একটু ভিন্ন আস্বাদী করে তোলে।
চারিত্রিক স্বভাবগত একমাত্রিক কলঙ্ক – বুদ্ধিমত্তা, দক্ষতা সম্পন্ন, অনুভূতিশীলা এবং কর্তৃত্বকারিনী হওয়া সত্ত্বেও পিসিমা বাড়ির চাল লুকিয়ে বিক্রি করেন – সেটাই সৌর কলঙ্কের মতো বেমানান হয়ে ওঠে তার চরিত্রে।
৩. ‘ফুটন্ত ভাতের গন্ধ তাকে বড়ো উতলা করে’ – তাকে বলতে কাকে বোঝানো হয়েছে ? ফুটন্ত ভাতের গন্ধ তাকে কেন উতলা করে ?
প্রশ্নের মান | ১+৪ |
উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা | not |
প্রশ্নোদ্ধৃত উক্তিটিতে ‘তাকে’ বলতে বাস্তব বাস্তববাদী লেখিকা মহাশ্বেতা দেবীর ‘ভাত’ গল্পের কেন্দ্রীয় তথা নায়ক চরিত্র উচ্ছব নাইয়ার কথা বলা হয়েছে।
প্রবল ঝড় জলে মাতলার উন্মত্ততায় ভেসে যায় উচ্ছবের পরিবার। স্ত্রী-পুত্র-কন্যা হারিয়ে যায় মাতলার গর্ভে। ঘরবাড়ি সংসার মাটিতে লুটোপুটি খায় উচ্ছবের। অসহায় উচ্ছব সর্বস্বান্ত হয়ে যায়। উচ্ছবের মতো মাতলার তীরবর্তী মানুষ জনের একই শোচনীয় পরিনতি দেখা যায়। কিন্তু প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কাছে হার মেনে নিতে চায়নি উচ্ছব, তাই ভগবানের শরণাপন্ন হয়েও ব্যর্থ হয়। শারীরিক ও মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত উচ্ছব প্রেত হয়ে ওঠে। অভুক্ত উচ্ছব জীবনের দিশা হারিয়ে ফেলে।
গ্রাম সম্পর্কের বোন বাসিনীর হাত ধরে উচ্ছব কলকাতা শহরে আসে। বাসিনীর মনিব মস্ত বড়ো লোক, সেখানে অফুরন্ত ভাত। সবই আবার বাদা অঞ্চলের জমি থেকে আসে। বড়ো বাড়ির ভাত নাকি ফেলাও যায় – এ গল্প উচ্ছব সহ গ্রামের সকলেই জানে। তাই বুক ভরা আশা নিয়ে উচ্ছব বাসিনীর সাহচর্যে বড়ো বাড়িতে আশ্রয় নেয়। তার বিশ্বাস সেখানে কাজের বিনিময়ে পেট ভরে ভাত খেতে পারবে। তাই ভাতের হতাশা উচ্ছব আড়াই মন কাঠ কাটে। ফুটন্ত ভাতের গন্ধে আপ্লুত মনে সে হাত চালিয়ে কাঠ কেটে চলে।
অনাহার অনাহারক্লিষ্ট মানুষের কাছে একমুঠো ভাত অমৃত তুল্য। প্রশ্নোদ্ধৃত পংক্তিটিতে উচ্ছবের মননের প্রতিফলন তাই সার্থকতা সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে।
৪. ‘এ সব কথা শুনে উচ্ছব বুকে বল পায়’ – উচ্ছব কে? সে কোন কথা শুনে কেন বুকে বল পেয়েছিল লেখ
প্রশ্নের মান | ১+৪ |
উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা | not |
বাস্তববাদী লেখিকা মহাশ্বেতা দেবী রচিত ‘ভাত’ গল্পের অন্তর্গত প্রশ্নোদ্ধৃত উক্তিটিতে উল্লিখিত উচ্ছব হল হরিচরণ নাইয়ার পুত্র উৎসব নাইয়া। সে মাতলা নদীর তীরবর্তী হতদরিদ্র, অসহায়, দারিদ্র্য পীড়িত মানুষের প্রতিনিধি।
প্রবল ঝড় জলে মাতলার উন্মত্ততায় ভেসে যায় উচ্ছবের পরিবার। স্ত্রী-পুত্র-কন্যা হারিয়ে যায় মাতলার গর্ভে। ঘরবাড়ি সংসার মাটিতে লুটোপুটি খায় উচ্ছবের। অসহায় উচ্ছব সর্বস্বান্ত হয়ে যায়। উচ্ছবের মতো মাতলার তীরবর্তী মানুষ জনের একই শোচনীয় পরিনতি দেখা যায়। কিন্তু প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কাছে হার মেনে নিতে চায়নি উচ্ছব, তাই ভগবানের শরণাপন্ন হয়েও ব্যর্থ হয়। শারীরিক ও মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত উচ্ছব প্রেত হয়ে ওঠে। অভুক্ত উচ্ছব জীবনের দিশা হারিয়ে ফেলে।
গ্রাম সম্পর্কের বোন বাসিনীর হাত ধরে উচ্ছব কলকাতা শহরে আসে। বাসিনীর মনিব মস্ত বড়ো লোক, সেখানে অফুরন্ত ভাত। সবই আবার বাদা অঞ্চলের জমি থেকে আসে। বড়ো বাড়ির ভাত নাকি ফেলাও যায় – এ গল্প উচ্ছব সহ গ্রামের সকলেই জানে। তাই বুক ভরা আশা নিয়ে উচ্ছব বাসিনীর সাহচর্যে বড়ো বাড়িতে আশ্রয় নেয়। তার বিশ্বাস সেখানে কাজের বিনিময়ে পেট ভরে ভাত খেতে পারবে।
কিন্তু ভাতের বদলে উচ্ছবের কপালে জোটে সামান্য ছাতু। পরম তৃপ্তিতে ছাতু খাওয়ার পর সে জানতে পারে কাঠ কাটলে হোম, আর হোম হলে ভাত। ভাতের হতাশা হাত চালিয়ে সে কাঠ কাটতে থাকে। এরপর সে জানতে পারে রান্না শেষ, খাওয়ার জায়গাও পরিস্কার করা হয়েছে। আর তখনই সে নিশ্চিত ভাবে ভাত খাওয়ার আনন্দে বুকে বল পায়।
৫. ‘ভাতে হাত ঢুকিয়ে দিতে সে স্বর্গ সুখ পায় ভাতের স্পর্শে’ – কে কীভাবে এই ভাত জোগাড় করেছিল ? তার এই অনুভূতি হয়েছিল কেন?
প্রশ্নের মান | ১+২+২ |
উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা | not |
বাস্তববাদী লেখিকা মহাশ্বেতা দেবী রচিত ‘ভাত’ গল্পে দুর্যোগ পীড়িত, দারিদ্র্য, লাঞ্ছিত, অভুক্ত উচ্ছবের ভাত জোগাড় করার কথা বলা হয়েছে।
উচ্ছবের এই ভাত জোগাড় করার কাহিনী ছিল অভিনব। ঝড়,জলে, বন্যায় ভেসে যাওয়া সংসার ফেলে গ্রাম সম্পর্কের বোন বাসিনীর হাত ধরে উচ্ছব শহরে বড়ো বাড়িতে আসে। ইতিপূর্বে সে বাসিনীর মনিব বাড়ির বৈভব ও হেলা ঢেলা ভাতের গল্প শুনেছে। তাই উচ্ছব সেখানে কাজ নেয়।
বড়ো বাড়িতে বুড়ো কর্তা লিভারের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছে। ডাক্তার জবাব দিয়েছে বলে ছোটো বউ-এর বাবা তান্ত্রিক এনে হোম-যজ্ঞ করে মৃত্যু আটকানোর চেষ্টা করছে। শুধু ভাতের আশায় উচ্ছব হোমের জন্য প্রয়োজনীয় কাঠ কাটতে থাকে । অবশেষে রান্না যখন শেষ, ঠিক তখনই বুড়ো কর্তা মারা যায়। ফলে অশোচ বাড়ির ভাত না খেয়ে সবই ফেলে দিতে হবে। বাসিনী যখন ডেকচি ভরা ভাত উচ্ছবকে ফেলতে দেয় তখন সে বাদার কামটের মতো হিংস্র ভঙ্গি করে ডেকচি নিয়ে দৌড়াতে থাকে। এভাবেই অভুক্ত উচ্ছব ভাতের জোগাড় করেছিল।
অশোচ বাড়ির ভাত নিয়ে উচ্ছব এক দৌড়ে স্টেশনে পৌঁছায়। সেখানে বসে খাবল খাবল ভাত খায় সে। বহুদিন সে ভাত স্পর্শ করে নি। ঝড়, জলের রাতে শেষবারের মতো সে ভাত খেয়েছিল। দীর্ঘদিন পর ভাত পেয়ে আজ তার মনের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়েছে। তাই ভাতের ছোঁয়ায় সে স্বর্গ সুখ অনুভব করে। ভাতের ডেকচিতে হাত ঢুকিয়ে সে পরম শান্তি পেয়েছিল আর এক অনির্বচনীয় স্বর্গ সুখের অনুভূতি লাভ করেছিল।