কাব্যের উপেক্ষিতা : প্রবন্ধ (প্রশ্ন ও উত্তর)

কাব্যের উপেক্ষিতা প্রবন্ধ হতে প্রশ্ন ও উত্তর নিম্নে দেওয়া হল। Bengali B.A.(General) KABYER UPEKSHITA Question Answer. প্রবন্ধ কাব্যের উপেক্ষিতা হতে 2, 5, 10 নং প্রশ্ন ও উত্তরগুলি দেওয়া হল।

প্রবন্ধকাব্যের উপেক্ষিতা
গ্রন্থপ্রাচীন সাহিত্য
রচনারবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকাশিত১৯৭০ সালের জুলাই
কাব্যের উপেক্ষিতা

কাব্যের উপেক্ষিতা প্রবন্ধ হতে প্রশ্ন ও উত্তর

Bengali B.A.(General) প্রবন্ধ কাব্যের উপেক্ষিতা হতে প্রশ্ন ও উত্তর।


প্রবন্ধ কাব্যের উপেক্ষিতা হতে প্রশ্ন মান – ২

১। রবীন্দ্রনাথের কোন গ্রন্থ থেকে ‘কাব্যের উপেক্ষিতা’ প্রবন্ধটি নেওয়া হয়েছে? গ্ৰন্থটি কখন প্রকাশিত হয় ?

  • ‘প্রাচীন সাহিত্য’ গ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে।
  • গ্ৰন্থটি ১৯৭০ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত হয়।

২। ‘রামায়ণ’, ‘শকুন্তলা’, ‘কাদম্বরী’ কাদের লেখা?

  • ‘রামায়ণ’ – বাল্মীকি
  • ‘শকুন্তলা’ – কালিদাস, 
  • ‘কাদম্বরী’ – বাণভট্ট

৩। ‘কাব্যের উপেক্ষিতা’ প্রবন্ধটি কবে কাদেরকে উদ্দেশ্য করে লেখা?

১৩০৭ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ মাসে কবি বাল্মীকি, কালিদাস ও বাণভট্টকে উদ্দেশ্য করে লেখা। 

৪। রবীন্দ্রনাথ কোন কোন নারীর চরিত্রকে কাব্যের উপেক্ষিতা বলেছেন ?

‘রামায়ণ’-এর ঊর্মিলা, ‘শকুন্তলা’ কাব্যের অনসূয়া ও প্রিয়ংবদা এবং ‘কাদম্বরী’ কাব্যের পত্রলেখা – এই চারটি চরিত্রকে রবীন্দ্রনাথ কাব্যের উপেক্ষিতা বলেছেন।

৫। সমগ্র রামায়ণ মহাকাব্যে ঊর্মিলাকে কতবার কোথায় কোথায় দেখানো হয়েছে?

সমগ্র রামায়ণ মহাকাব্যে ঊর্মিলাকে একবার মাত্র দেখানো হয়েছে বধূ বেশে বিদেহ নগরীর রাজসভায়।

৬। ‘সেদিনকার সেই বিশ্বব্যাপী বিলাপের মধ্যে’ – সেদিন বলতে কোন দিনের কথা বলা হয়েছে ?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘কাব্যের উপেক্ষিতা’ প্রবন্ধ থেকে গৃহীত আলোচ্য অংশে যেদিন রামচন্দ্র, সীতা দেবী ও লক্ষ্মণ অযোধ্যা ছেড়ে বনবাসে চলে যায় সেদিনের কথা বলা হয়েছে।

৭। ‘সীতার অশ্রুজলে ঊর্মিলা একেবারে মুছিয়া গেল’ – তাৎপর্য লেখো?

রাম-সীতার দুঃখ ভারাতুর জীবন কাহিনী হল রামায়ণ। লক্ষণ সবসময় রামচন্দ্রের পাশে থেকে সর্বজন বিদিত হয়েছে। কিন্তু যে ঊর্মিলা রাম-সীতার জন্য তার স্বামী লক্ষ্মণকে উৎসর্গ করেছে তার কথা রামায়ণে নেই। সে সীতার মহিমার আড়ালে নিষ্প্রভ হয়ে গেছে।

৮। ‘ঊর্মিলা চিরবধূ, নির্বাক, কুন্ঠিতা, নিঃশব্দ চারিণী’ – তাৎপর্য লেখো।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘কাব্যের উপেক্ষিতা’ প্রবন্ধে ঊর্মিলা রাজবধূ হয়েও সব হারানোর দুঃখে নিরব। বিদেহ নগরীর বিবাহ সভায ক্ষণিকের জন্য ঊর্মিলা দেখা দিয়েছেন বধূ রূপে। এরপর তার প্রসঙ্গ আর উত্থাপন করা হয়নি। তাই ঊর্মিলা প্রতিবাদহীন ভাবে নির্বাক-কুন্ঠিতা, চিরকালীন নিঃশব্দচারিণী।

৯। ‘অতএব এই নামটির জন্য বাল্মীকির নিকট কৃতজ্ঞ আছি’ – কোন নানটির জন্য কে কৃতজ্ঞ আছেন ?

আদি কবি বাল্মীকির রামায়ণ কাব্যের লক্ষ্মণ-পত্নী ঊর্মিলা নামটির মাধুর্যের জন্য ‘কাব্যের উপেক্ষিতা’ প্রবন্ধে লেখক রবীন্দ্রনাথ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। তাঁর মতে এমন মধুর নাম সংস্কৃত কাব্যে আর দ্বিতীয় নেই।

১০। ‘তাই কি কবি সীতার স্বর্ণমন্দির হইতে এই শোকোজ্জ্বলা মহাদুঃখিনীকে একেবারে বাহির করিয়া দিয়েছেন’ – তাৎপর্য লেখো।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘কাব্যের উপেক্ষিতা’ প্রবন্ধ থেকে আলোচ্য অংশটি গৃহীত হয়েছে।

প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে ঊর্মিলার দুঃখ সীতাদেবীর দুঃখ থেকে বেশি হৃদয়ঙ্গম। তাই বোধহয় কবি বাল্মীকি রামায়ণে সীতার সঙ্গে ঊর্মিলার প্রসঙ্গ আনেননি।

১১। ‘মাণ্ডবী ও শ্রুতকীর্তি সম্বন্ধে আমরা কিছু জনিনা, জানিবার কৌতূহলও রাখি না।’ –  আমাদের জানবার কৌতূহল নেই কেন?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘কাব্যের উপেক্ষিতা’ প্রবন্ধে বর্ণিত ভরতের স্ত্রী মাণ্ডবী ও শত্রুঘ্নের স্ত্রী শ্রুতকীর্তি দুজনই স্বামীকে কাছে পেয়েছিলেন। এমনকি তাদের কোনো প্রকার আক্ষেপের কোনো কারণ ছিল না। অন্যদিকে ঊর্মিলার স্বামী থেকেও নেই, তিনি একাকিনী। তাই রবীন্দ্র-মানস সেই বিরহে কাতর ঊর্মিলার প্রতিই সহানুভূতি দেখিয়েছেন।

১২। ‘কাব্যের উপেক্ষিতা’ প্রবন্ধে লেখক কাকে সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিতা বলেছেন ?

‘কাব্যের উপেক্ষিতা’ প্রবন্ধে লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রামায়ণ কাব্যের লক্ষণ পত্নী উর্মিলাকে সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিতা বলেছেন

১৩। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কাব্যের উপেক্ষিতা’ প্রবন্ধে ঋষি শিষ্যদ্বয় ও সখী দুজনের নাম লেখ।

ঋষি শিষ্যদ্বয় – ষারঙ্গব ও ষারদ্বত

সখী – অনসূয়া ও প্রিয়ংবদা

১৪। রবীন্দ্রনাথের মতে রাজা দুষ্যন্ত শকুন্তলাকে চিনতে পারেননি কেন?

রবীন্দ্রনাথের মতে রাজা দুষ্যন্তের রাজসভায় শকুন্তলা একা গিয়েছিল। কিন্তু তার সখীদ্বয় ছাড়া সে সম্পূর্ণ নয়, খণ্ডিত। তাছাড়া শকুন্তলা অরণ্য প্রকৃতির মধ্যেই অনন্যা, কিন্তু রাজসভা ছিল তপোবনের বাইরে। তাই রাজা দুষ্যন্ত রাজসভার মধ্যে বেমানান এবং খণ্ডিতা শকন্তলাকে চিনতে পারেন নি।

১৫। ‘তাহারা তো ছায়া নহে’ – কারা ছায়া নয় এবং কেন ? 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘কাব্যের উপেক্ষিতা’ প্রবন্ধের আলোচ্য অংশে শকুন্তলার দুই সখী প্রিয়ংবদা ও অনসূয়ার কথা বলা হয়েছে।

রবীন্দ্রনাথের মতে শকুন্তলার সাথে তার দুই সখী অন্তর্হিত হয়নি। তারা জীবন্ত এবং কাব্যের বাইরের জগতে অনভিনীত নাটকের নেপথ্যে তারা বেড়ে উঠেছে, তাই তারা ছায়া নয়।

১৬। ‘তুমি প্রত্যুষের তারার মতো’ – কে, কার সম্বন্ধে এই কথা বলেছেন?

‘কাব্যের উপেক্ষিতা’ প্রবন্ধে লক্ষ্মণ পত্নী ঊর্মিলার সম্বন্ধে প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই উক্তিটি করেছেন।

১৭। ‘নামকে যারা নামমাত্র মনে করেন আমি তাহাদের দলে নই’ – বাখ্যা কর।

রামায়ণের সর্বজন উপেক্ষিতা ঊর্মিলার নামের মাধুর্য প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘কাব্যের উপেক্ষিতা’ প্রবন্ধে এই মন্তব্য করেছেন।

প্রাবন্ধিকের মতে গোলাপ প্রকৃতির দান, তাই এর মাধুর্য সংকীণ, সীমাবদ্ধ। কিন্তু মানুষের মাধুর্য এমন সর্বাংশে সুগোচর নয়। তার মধ্যে অনেকগুলি সূক্ষ্ম সুকুমার সমাবেশে অনির্বচনীয়তার উদ্রেক করে। শুধু ইন্দ্রিয় দিয়ে নয়, তাকে কল্পনা দিয়ে সৃষ্টি করতে হয়। আর নামকরণ সেই সৃষ্টিকার্যে সাহায্য করে।

১৮। ‘কাব্য হীরার টুকরার মতো কঠিন’ – প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ব্যাখ্যা করো। 

শকুন্তলার জীবনে তার দুই সখী অনসূয়া ও প্রিয়ংবদার গুরুত্ব বোঝাতে প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘কাব্যের উপেক্ষিতা’ প্রবন্ধে আলোচ্য কথাটি বলেছেন।

শকুন্তলার চরম দুঃখের দিনে তার দুই সখীর অনুপস্থিতি কাব্যের বিচারে ন্যায় সঙ্গত হলেও শকুন্তলার পক্ষে তা অত্যন্ত নিষ্ঠুরতা।

১৯। কাদম্বরী আখ্যায়িকার নায়ক ও নায়িকার নাম লেখো।

  • নায়ক – চন্দ্রাপীড় 
  • নায়িকা – কাদম্বরী 

২০। পত্রলেখার পরিচয় দাও ? 

পত্রলেখা পরজিত রাজা লকুতেশ্বরের কন্যা। সে ছিল রাজনন্দিনী। অনতি যৌবনা এই রাজদুহিতাকে রাজমাতা বিলাসবতী যুবরাজ চণ্ডাপীড়ের তামুলকরঙ্কবাহিনী করে পাঠিয়েছিলেন।

২১। ‘সেখানে স্বর্গের অমৃত বিন্দু কই’ – প্রাবন্ধিক কোন প্রসঙ্গে কেন এই উক্তি করেছেন ?

প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মনে করেন যে কবি কল্পনা পত্রলেখাকে সখীত্বের এমন অপরূপ ভূ-খণ্ডের মধ্যে স্থাপন করেছেন তা যথেষ্ট পরিমাণে জীবনরস সঞ্জিবিত নয়। তার মূলে জীবনসংরাগের প্রত্যক্ষ প্রেরণার অভাব রয়েছে। তাই তিনি সেখানে স্বর্গের অমৃত বিন্দু দেখতে পান নি।

২২। ‘তাহা স্বর্গের ন্যায় নিষ্কণ্টক’ – প্রাবন্ধিকের এই উক্তির কারণ কি? 

প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘কাদম্বরী’ কাব্যের চন্দ্রাপীড় ও পত্রলেখার মধ্যে অপরূপ সখীত্বের সম্পর্কের কথা এখানে বলেছেন।

বানভট্টের কাব্যে পত্রলেখার প্রতি কাদম্বরীর ঈর্ষার আভাস মাত্র নেই। এমনকি স্বামী চন্দ্রাপীড়ের সাথে পত্রলেখার প্রীতি সম্বন্ধ বলেই কাদম্বরী তাকে প্রিয় সখী জ্ঞানে সাদরে গ্রহণ করেছে। কাব্যে পত্রলেখা সম্পর্কের এক অপরূপ ভূ-খণ্ডের মধ্যে আছে। সেখানে ঈর্ষা, সংশয়, সঙ্কট, বেদনা কিছুই নেই – তা স্বর্গের মতই নিষ্কণ্টক।

২৩। ‘আমরা বলি কবি অন্ধ’ – প্রাবন্ধিকের এরকম মনে হওয়ার কারণ কী ?

প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘কাদম্বরী’ কাব্যের কবি বাণভট্ট সম্পর্কে এই উক্তি করেছেন।

রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বলেছেন যে কাদম্বরী ও মহাশ্বেতার দিকে তাকিয়েই কবি বাণভট্টের চোখ ঝলসে গেছে। তিনি পত্রলেখার পত্রলেখার প্রণয়তৃষ্ণার্ত চিরবঞ্চিত নারী হৃদয়টির কথা একেবারে ভুলে গিয়েছেন। তিনি পক্ষপাত দুষ্ট বলেই পত্রলেখার হৃদয়ের নিগূঢ়তম কথা কিছুই জানতে পারেন নি। এই কারণেই প্রাবন্ধিক ‘কাদম্বরী’ কাব্যের কবিকে অন্ধ বলেছেন।

২৪। ‘পূর্ণ চন্দ্রদ্বয়েও সে তাহার আদেশ অগ্রাহ্য করে নাই’ – কোন প্রসঙ্গে প্রাবন্ধিক একথা বলেছেন ?

বানভট্টের ‘কাদম্বরী’ কাব্যে পত্রলেখা পত্নী নয়, প্রণয়িনী নয়, কিংকরীও নয়, সে পুরুষের সহচর, এই প্রকার অপরূপ সখীত্ব দুটি সমুদ্রের মাঝখানে একটি বালুতটের মতো। কুমার-কুমারীর প্রবল সংরাগ-জনিত তরঙ্গলীলাকে তিনি যে পর্যন্ত আসার অনুমতি করেছেন সেখানেই সেটি থেমেছে বলে প্রাবন্ধিক মনে করেন। তাই তার উক্তি পূর্ণচন্দ্রোদয়েও সেই তরঙ্গস্রোত কবির আদেশ অগ্রাহ্য করে নি। 

২৫। ‘কেবল তাহার কৃপণতা এই বিগতনাথা রাজদুহিতার প্রতি।’ – রাজদুহিতা কে? তার প্রতি কবির কৃপণতার স্বরূপটি কী ?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘কাব্যের উপেক্ষিতা’ প্রবন্ধে উল্লেখিত রাজদুহিতা হল পরজিত লকুতেশ্বরের কন্যা পত্রলেখা।

কবি বাণভট্ট পত্রলেখাকে চন্দ্রাপীড়ের সহচরী রূপেই দেখিয়েছেন। পএলেখা রাজকুমারের পত্নী, প্রণয়িনী কিংবা কিংকরীও নয়। নারীর স্বাভাবিক প্রণয় লিপ্সা, যৌবন-সংরাগ ইত্যাদি অনভূতি গুলির প্রতি কবি দৃষ্টিপাত করেননি। অথচ কাদম্বরী, মহাশ্বেতা প্রভৃতি চরিত্র অঙ্কনে তিনি মুক্ত হস্ত। এই কারণেই প্রাবন্ধিক আলোচ্য মন্তব্যটি করেছেন।

২৬। ‘পুরুষের হৃদয়ের পার্শ্বে সে জাগিয়া রহিল কিন্তু ভিতরে পর্দাপন করিল না।’ – এই উক্তি কেন করা হয়েছে ?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘কাব্যের উপেক্ষিতা’ প্রবন্ধে পত্রলেখার হৃদয়ে নারী সুলভ প্রেমের প্রকাশের আলোচনা প্রসঙ্গে এই উক্তি করা হয়েছে।

‘কাদম্বরী’ কাব্যে পত্রলেখার বন্ধুত্ব দেখানো হলেও তার নারীত্বের দিকটি ছিল সম্পূর্ণ অবহেলিত সেই কারণেই প্রাবন্ধিক এই উক্তি করেছেন।

২৭। ‘অথচ সখীত্বের মধ্যে লেশমাত্র অন্তরাল ছিল না’ – কার সখীত্বের কথা বলা হয়েছে? ব্যাখ্যা কর।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘কাব্যের উপেক্ষিতা’ প্রবন্ধে আলোচিত ‘কাদম্বরী’ কাব্যের চন্দ্রাপীড় ও পত্রলেখার সখীত্বের কথা বলা হয়েছে।

প্রথম দিনের বিভিন্ন কার্যকলাপ থেকে চন্দ্রাপীড় ও পত্রলেখার মধ্যে যে সখীত্ব গড়ে ওঠে তার মধ্যে ছিল না কোনো লজ্জা, আশঙ্কা, সন্দেহ – এই কথাই এখানে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

২৮। ‘ইহাকে সামান্য পরিজনের মতো দেখিও না’ – কোন প্রসঙ্গে কার কথা বলা হয়েছে ?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘কাব্যের উপেক্ষিতা’ প্রবন্ধে পত্রলেখা সম্বন্ধে আলোচনা প্রসঙ্গে একথা বলা হয়েছে।

রাজমাতা বিলাশবতী তার পুত্র চন্দ্রাপীড়ের কাছে পত্রলেখাকে প্রেরণ করেন এবং সেই সঙ্গে আচরণ সম্পর্কে সতর্ক করে তাকে আলোচ্য নির্দেশটি দেন।

২৯। পত্রলেখা কার কাছে বড়ো হয়েছে ? চন্দ্রাপীড় ও পত্রলেখার সখীত্বকে রবীন্দ্রনাথ কীসের সাথে তুলনা করেছেন ?

রাজমাতা মহাদেবী বিলাসবতীর কাছে পত্রলেখা মেয়ের মতো বড়ো হয়েছে। 

রবীন্দ্রনাথ চন্দ্রাপীড় ও পত্রলেখার সখীত্বকে দুই সমুদ্রের মধ্যে একটি বালুতটের সাথে তুলনা করেছেন।

৩১। ‘সেই কারণেই এই অন্তঃপুর বিচ্যুতা অন্তঃপুরিকার জন্য সর্বদায় ক্ষোভ জন্মিতে থাকে।’ – অন্তঃপুর বিচ্যুতা কে? ক্ষোভের কারণ কী ?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘কাব্যের উপেক্ষিতা’ প্রবন্ধে বর্ণিত অন্তঃপুর বিচ্যুতা হলেন ‘কাদম্বরী’ কাব্যের পত্রলেখা। 

পত্রলেখা নারী, কিন্তু নারী সুলভ লজ্জা, সংকোচ তার মধ্যে কবি প্রকাশ করেননি। তাই তার ক্ষোভ থাকা স্বাভাবিক বলে প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথ মনে করেন।

৩১। ‘এই সম্বন্ধটি অপূর্ব সুমধুর, কিন্তু ইহার মধ্যে নারী অধিকারের পূর্ণতা নাই।’ – প্রসঙ্গটি সংক্ষেপে বুঝিয়ে দাও।

বানভট্টের ‘কাদম্বরী’ কাহিনীতে যুবরাজ চন্দ্রাপীড়ের সর্বক্ষনের সহচরী পত্রলেখা। সে প্রিয় শিষ্যা, ঘনিষ্ঠতম সখী ও সর্বক্ষণের সঙ্গী হলেও চন্দ্রাপীড় ও পত্রলেখার সম্পর্কের মধ্যে কখনও কোনো দুর্বল মুহূর্তে হৃদয়ের প্রেম আকর্ষণ অনুভূত হয়নি। তাই তাদের সম্পর্কটি সুমধুর হলেও এর মধ্যে নারী হৃদয়ের স্বাভাবিক মনস্তত্ত্বের সঙ্গতি রক্ষা হয়নি বলে প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথ মনে করেছেন।


প্রবন্ধ কাব্যের উপেক্ষিতা হতে প্রশ্ন মান – ৫

১। রামায়ণের ঊর্মিলাকে উপেক্ষিত বলার কারণ কী?

‘কাব্যের উপেক্ষিতা’ প্রবন্ধে সংস্কৃত সাহিত্যে উপেক্ষিতা চরিত্রের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সর্বপ্রধান স্থান ঊর্মিলাকে। তার তরুণী জীবনের সূচনাতেই বিপর্যয় নেমে এসেছে। লক্ষ্মণের আদর্শ ভ্রাতৃ প্রেম তাকে গৃহত্যাগী করে। তাই সুদীর্ঘ বারো বছরের জন্য লক্ষ্মণের সাথে ঊর্মিলার বিচ্ছেদ অনিবার্য হয়ে ওঠে।

লক্ষ্মণের ভ্রাতৃ ভক্তি, আদর্শ, নিষ্ঠা উপযুক্ত পুরষ্কারে পুরষ্কৃত হয়েছে। মহাকবি বাল্মীকি তার চরিত্র মহিমা উজ্জ্বল বর্ণে চিত্রিত করেছেন। ভারতবর্ষের ঘরে ঘরে লক্ষ্মণের আত্মত্যাগ ও দুঃখ ভোগের মহিমা কীর্তিত হয়েছে। কিন্তু ঊর্মিলার দুঃখ ভোগ মহাকবির সহানুভূতি আকর্ষণ করেনি। এই উপেক্ষিতার প্রতি রবীন্দ্রনাথ পরম মমত্ববোধ করেছেন এবং তার দুঃখ ভোগের তাৎপর্য পরিস্ফূট করেছেন।

লক্ষ্মণের জীবনের একটিই লক্ষ্য, সর্বোতভাবে রাম-সীতার সেবা করা। এই জন্য সে নিজেকে পরিপূর্ণ ভাবে উৎসর্গ করেছে। এই আত্মোৎসর্গ নিঃসন্দেহে মহৎ, কিন্তু এর পাশে ঊর্মিলার আত্মত্যাগ কম মহিমাময় নয়। লক্ষ্মণ নিজেকে উৎসর্গ করেছে, কিন্তু ঊর্মিলা নিজের চেয়েও বড়ো যে স্বামী, তাকেও রাম ও সীতার জন্য দান করেছে। নিজেকে দান করার চেয়েও কঠিন এই কাজ। তাই ঊর্মিলার মহত্ব আমাদের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করে, তার জন্য পাঠক হিসেবে বেদনা বোধ করি। কিন্তু মহাকবি এই নীরব দুঃখীনির দুঃখ বহনের উল্লেখ পর্যন্ত করেননি। সীতার দুঃখের বিবরণ ঊর্মিলাকে একেবারে আড়াল করে দিয়েছে।

২। “কাব্য হীরার টুকরার মতো কঠিন” – কোন প্রসঙ্গে কথাটি বলা হয়েছে ? মন্তব্যটি ব্যাখ্যা করো? 

রবীন্দ্রনাথের ‘প্রাচীন সাহিত্য’ গ্রন্থের অন্তর্গত ‘কাব্যের উপেক্ষিতা’ প্রবন্ধ থেকে আলোচ্য অংশটি উদ্ধৃত হয়েছে। কাব্য-কাহিনীর গৌণ চরিত্র গুলির আকর্ষণীয়তা এই প্রবন্ধের বিষয়। কালীদাসের ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম’ নাটকের দুটি গৌণ চরিত্র – প্রিয়ংবদা ও অনসূয়া সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে প্রাবন্ধিক এই মন্তব্য করেছেন।

কাব্যের সিদ্ধি লাভের জন্য কবিদের অতি কঠোর শিল্পনীতি অনুসরণ করতে হয়। কাহিনী গড়তে হয় বাহুল্য বর্জিত ভাবে। দৃঢ় সংবদ্ধ, অবান্তর প্রসঙ্গ বর্জিত ও সুবলয়িত কাব্য কাহিনী হীরক খণ্ডের মত। হীরকতুল্য সংহতি ও ঔজ্জ্বল্য অর্জনের জন্য কাহিনীকারকে নির্মম ভাবে অনেক আকর্ষনীয় অথচ গৌণ প্রসঙ্গ পরিহার করতে হয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে শকুন্তলার কাহিনীতে প্রিয়ংবদা ও অনসূয়া চরিত্র দুটি যেভাবে মাঝপথে খণ্ডিত করা হয়েছে তা অন্যায় বলা চলে না।

শকুন্তলা পতিগৃহে যাত্রা করার পর তার সখীদ্বয় অনসূয়া ও প্রিয়ংবদার কোনো উল্লেখ নাটকে নেই। সুখের দিনে তারা একত্র ছিল। কিন্তু শকুন্তলা যেদিন দুষ্যন্তের রাজসভায় চরম অসম্মান ও দুঃখের সম্মুখিন হল সেদিন এই দুঃখে যারা অংশ নিতে পারত সেই দুই সখী কাছে ছিল না। শিল্পনীতির শাসন মেনে সংযত কবি নিষ্ঠুর ভাবে তাদের দূরে সরিয়ে রেখেছেন।

৩। “তাহারা জ্ঞান বৃক্ষের ফল খাইয়াছে, যাহা জানিত না তাহা জানিয়াছে”। – রবীন্দ্রনাথের এই মন্তব্যটির তাৎপর্য বুঝিয়ে দাও।

আলোচ্য অংশটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কাব্যের উপেক্ষিতা’ প্রবন্ধের অন্তর্গত কালীদাসের ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম’ নাটকে অনসূয়া ও প্রিয়ংবদা চরিত্র সম্পর্কে মন্তব্য।

‘অভিজ্ঞজ্ঞান শকুন্তলম’ নাটকে কবি কালীদাস শকুন্তলার পতিগৃহে যাত্রার দৃশের পর অনসূয়া ও প্রিয়ংবদার কথা উল্লেখ করেন নি। নাটকে বর্জিত হলেও চরিত্র দুটির সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে পাঠকের জল্পনার শেষ নেই। শকুন্তলা বিরহিত তপোবনে তারা কি ভাবে দিন যাপন করত, দুষ্যন্তের রাজসভায় শকুন্তলার অসম্মানের সংবাদে তারা কেমন দুঃখ অনুভব করেছে তা আমাদের জানতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু কবি এই সব প্রসঙ্গ নাটকের পক্ষে অবান্তর বিবেচনা করেছেন।

নাটকে যখন আমরা তিন সখীকে একসঙ্গে দেখি তখন তারা স্বর্গীয় সারল্যের ও পবিত্রতার পরিবেশে স্থাপিত। সংসারের কোনো অভিজ্ঞতা তখন তাদের ছিল না। কিন্তু কামনা-বাসনাময় বাস্তব সংসারের প্রকৃতি যখন তারা অনুভব করল তখনও কী সেই আদিম সারল্য অক্ষুন্ন ছিল? পার্থিব বাসনা-কামনার সঙ্গে পরিচই হল জ্ঞানবৃক্ষের ফল। শকুন্তলার পরিণাম উপলক্ষে এই বিষয়ে অনসূয়া ও প্রিয়ংবদা অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছিল। 

কবির বর্ণনা থেকে নয়, প্রিয়সখী শকুন্তলার দঃখ ভোগের দৃষ্টান্তেই তারা বাস্তব জীবনের সঙ্গে পরিচিত হয়েছে। এই অভিজ্ঞতার পরে তাদের যে মানসিক পরিণতি সম্ভাবিত, নাটকের মধ্যে তা দেখানো হয়নি। আমরা কেবল অনুমানে বুঝতে পারি জীবনের অভিভজ্ঞতা দুটি তরুণীর মনে কত প্রভাব ফেলেছে, কীভাবে তাদের রূপান্তরিত করে দিয়েছে।

৪। “পত্রলেখা পত্নী নহে, প্রণয়িনীও নহে, কিঙ্করিও নহে, পুরুষের সহচরী।” – পত্রলেখা সম্বন্ধে এরকম মন্তব্যের যথার্থতা ব্যক্ত করো।

আলোচ্য অংশটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘কাব্যের উপেক্ষিতা’ প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত হয়েছে।

রবীন্দ্রনাথের মতে সংস্কৃত সাহিত্যের উপেক্ষিতাদের মধ্যে বাণভট্ট রচিত ‘কাদম্বরী’ কাব্যের পত্রলেখা অন্যতম। এই কাব্যের নায়ক চন্দ্রাপীড়ের সর্বক্ষণের সহচরী সে। কিন্তু এই সহাবস্থান তাদের চিত্তে কোনো প্রণয় আবেগ সৃষ্টি করেনি। কবি এই দুই তরুণ-তরুণীকে বন্ধুত্বের সম্পর্কে সংবদ্ধ রেখেছেন এবং দেখিয়েছেন কোনো অবাস্থাতেই বন্ধুত্বের সংকীর্ণ সীমা লংঘন করে একে অপরের প্রতি নর-নারী পক্ষে স্বাভাবিক প্রেমের আকর্ষণ অনুভব করেনি। এই ব্যবধান স্থায়ী হওয়ার নয়। কিন্তু কবি বাণভট্ট একে চিরস্থায়ী করে রেখেছেন।

পাঠক হিসেবে এই বিবরণ রবীন্দ্রনাথের নিকট যুক্তি সম্মত ও বাস্তব সম্মত মনে হয়নি। তাঁর মনে পশ্ন জেগেছে চন্দ্রাপীড় ও পত্রলেখা দীর্ঘকাল পরস্পরের সন্নিহিত ভাবে থাকা সত্বেও কিভাবে ওই বন্ধুত্বের সংকীর্ণ স্থানটুকুর মধ্যে অবিচলিত ভাবে অধিষ্ঠান করতে পারলো। যৌবনের অনিবার্য আবেগে পরস্পরের প্রতি প্রেমের বন্ধন রচিত হওয়ার বাস্তব সম্ভবনাকে কবি বাণভট্ট আদৌও গুরুত্ব দেননি। ফলে পত্রলেখা নারী হিসেবে এই কাহিনীর মধ্যে পূর্ণ মর্যাদা পায় নি। তাদের এই সম্পর্ক যতই অপূর্ব বা মধুর হোক না কেন কখনোই তার বাস্তব হতে পারে না।

৫। “এই সম্পর্কটি অপূর্ব সুমধুর, কিন্তু ইহার মধ্যে নারী অধিকারের পূর্ণতা নাই।” – প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বিষয়টি ব্যাখ্যা করো।

আলোচ্য অংশটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘কাব্যের উপেক্ষিতা’ নামক প্রবন্ধের অন্তর্গত।

বাণভট্টের ‘কাদম্বরী, কাব্যের একটি আকর্ষণীয় গৌণ চরিত্র পত্রলেখা। মহারানী বিলাসবতী তাকে তরুণ রাজপুত্র চন্দ্রাপীড়ের সহচরী রূপে নিযুক্ত করেন। উভয়ের মধ্যে এক অপূর্ব সখ্যতার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এই সম্পর্ক প্রসঙ্গেই আলোচ্য উক্তিটি করা হয়েছে।

রবীন্দ্রনাথের মতে সংস্কৃত সাহিত্যের উপেক্ষিতাদের মধ্যে বাণভট্ট রচিত ‘কাদম্বরী’ কাব্যের পত্রলেখা অন্যতম। এই কাব্যের নায়ক চন্দ্রাপীড়ের সর্বক্ষণের সহচরী সে। কিন্তু এই সহাবস্থান তাদের চিত্তে কোনো প্রণয় আবেগ সৃষ্টি করেনি। কবি এই দুই তরুণ-তরুণীকে বন্ধুত্বের সম্পর্কে সংবদ্ধ রেখেছেন এবং দেখিয়েছেন কোনো অবাস্থাতেই বন্ধুত্বের সংকীর্ণ সীমা লংঘন করে একে অপরের প্রতি নর-নারী পক্ষে স্বাভাবিক প্রেমের আকর্ষণ অনুভব করেনি। এই ব্যবধান স্থায়ী হওয়ার নয়। কিন্তু কবি বাণভট্ট একে চিরস্থায়ী করে রেখেছেন।

পাঠক হিসেবে এই বিবরণ রবীন্দ্রনাথের নিকট যুক্তি সম্মত ও বাস্তব সম্মত মনে হয়নি। তাঁর মনে পশ্ন জেগেছে চন্দ্রাপীড় ও পত্রলেখা দীর্ঘকাল পরস্পরের সন্নিহিত ভাবে থাকা সত্বেও কিভাবে ওই বন্ধুত্বের সংকীর্ণ স্থানটুকুর মধ্যে অবিচলিত ভাবে অধিষ্ঠান করতে পারলো। যৌবনের অনিবার্য আবেগে পরস্পরের প্রতি প্রেমের বন্ধন রচিত হওয়ার বাস্তব সম্ভবনাকে কবি বাণভট্ট আদৌও গুরুত্ব দেননি। ফলে পত্রলেখা নারী হিসেবে এই কাহিনীর মধ্যে পূর্ণ মর্যাদা পায় নি। তাদের এই সম্পর্ক যতই অপূর্ব বা মধুর হোক না কেন কখনোই তার বাস্তব হতে পারে না।

৬। “একা শকুন্তলা শকুন্তলার এক-তৃতীয়াংশ।” – প্রসঙ্গটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।

আলোচ্য অংশটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘কাব্যের উপেক্ষিতা’ প্রবন্ধের অন্তর্গত।

কালিদাসের ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম’ নাটকে শকুন্তলার পতি গৃহে যাত্রার পরে অনসূয়া ও প্রিয়ংবদার কথা উল্লেখ করা হয়নি। কাহিনীর পক্ষে এই সহায়ক গৌণ চরিত্র দুটির আর প্রয়োজন ছিল না বলে কবি তাদের অন্তরালে সরিয়ে দিয়েছেন। নাটকের শিল্পনীতির দিক থেকে তা কিছুমাত্র আপত্তিকর নয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ পাঠকের মনোবৃত্তির দিক থেকে উপেক্ষিত চরিত্র দুটির জন্য উদ্ধৃত অংশে আক্ষেপ করেছেন।

‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম’ নাটকে পতিগৃহে যাত্রার পূর্ব পর্যন্ত আমরা যতবার শকুন্তলাকে দেখি সর্বদায় তার সঙ্গী হিসেবে উপস্থিত থাকে অনসূয়া ও প্রিয়ংবদা। তারা তিন জনে যেন একই সত্তার তিন অংশ, তিনজনে মিলে যেন একটি পূর্ণ বক্তিত্ব। বস্তুত রাজা দুষ্যন্তের সঙ্গে শকুন্তলার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে অনসূয়া ও প্রিয়ংবদার সহায়তায়। এইভাবে চরিত্র তিনটিকে কবি একাকার করে গড়েছেন বলেই বিচ্ছিন্ন একাকি শকুন্তলাকে মনে হয় খণ্ডিত ও অসম্পূর্ণ।

যে দুই সখীর সৌহার্দ্য বেষ্টনে শকুন্তলার শ্রী (সৌন্দর্য) পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ পেয়েছিল, তাদের দূরে সরিয়ে নেওয়ায় সে যেন অনাবৃত, অসম্পূর্ণ হয়ে ওঠে। সখী-সাহচর্য বিছিন্ন শকুন্তলাকে যে রাজা দুষ্যন্ত চিনতে পারেনি তা আশ্চর্য নয়। তারা সঙ্গে থাকলে হয়ত দুষ্যন্তের পক্ষে পূর্ব স্মৃতি স্মরণ করা সহজ হত – রবীন্দ্রনাথ এমন অনুমাণও করেছেন।


প্রবন্ধ কাব্যের উপেক্ষিতা হতে প্রশ্ন মান – ১০

১। পত্রলেখাকে কাব্যের উপেক্ষিতা বলা হয়েছে কেন – রবীন্দ্রনাথকে অনুসরণ করে লেখো।

বাণভট্টের ‘কাদম্বরী’ কাব্যের প্রধান নারী চরিত্র গুলির অনতম পত্রলেখা। পরাজিত কুলুতরাজের এই বন্দিনী কন্যাকে মহিষী বিলাসবতী পরম আদরে লালন করেন। উজ্জয়িনী রাজ তারাপীড়ের পুত্র শিক্ষা সমাপনান্তে প্রাসাদে ফিরে এলে বিলাসবতী পত্রলেখাকে তার তাম্বুলকরঙ্ক বাহিনী যুক্ত করেন এবং সর্ব ব্যাপারে পত্রলেখাকে অন্তরঙ্গ করে নিতে নির্দেশ দেন।

প্রথম সাক্ষাৎকারের মুহূর্তেই চন্দ্রাপীড়ের মনে মুগ্ধতা জন্মে, পত্রলেখার মনও চন্দ্রাপীড়ের প্রতি সেবা রসে পূর্ণ হয়ে ওঠে। চন্দ্রাপীড় যেখানে যেত পত্রলেখা সঙ্গে সঙ্গে ফিরত দেহের ছায়ার মতো। এই ভাবে দুজনের মধ্যে দিনে দিনে এক মহতী ভালোবাসা গড়ে উঠতে থাকে। কিন্তু নয়, এই ভালোবাসা প্রণয়-প্রণয়িনীর প্রেম নয়, এই ভালোবাসা সখ্যতার সীমায় সীমাবদ্ধ।

এরকম আন্তরিক ও নিকট সান্নিধ্য সত্বেও পত্রলেখার মনে নারী সুলভ দুর্বলতা জন্মায়নি, পুরুষের উপর নারীর অধিকার বোধ জাগেনি। চন্দ্রাপীড়ও চিরদিন পত্রলেখাকে বন্ধুর মতই দেখেছে, বন্ধুত্বের সম্পর্কের সীমা লংঘন করেনি। পত্রলেখা কোনোদিন পত্নীত্বের বা প্রণয়ীনির পদ দাবি করে নি। সে চন্দ্রাপীড়ের নিকট থেকে যে সম্মান পেয়েছে তাতে তাকে নিছক কিংকরী বা দাসিও মনে করা যায় না, সে পুরুষের সহচরী মাত্র – পুরুষের নারী বন্ধু।

রবীন্দ্রনাথের অনুযোগ, বাণভট্ট পত্রলেখাকে তার স্বাভাবিক মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করেছেন। নিবিড় সান্নিধ্য সত্ত্বেও চন্দ্রাপীড় সম্পর্কে পত্রলেখার এমন শীতল, নিরাবেগ মনোভাব কিছুতেই বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না। বাণভট্ট যেন এই নারীর হৃদয়ের প্রতি দৃষ্টিপাত করার সময় পান নি। কাদম্বরী ও মহাশ্বেতাই তাঁর অখন্ড মনোযোগ অধিকার করে নিয়েছে। যৌবনের তরঙ্গাবেগে বন্ধুত্ব সম্পর্কের সংকীর্ণ ভূ-খন্ডটি যে চিরস্থায়ী হয়ে থাকতে পারে না কবি বানভট্টের মনে এই চেতনার উদয় হয়নি।

পত্রলেখার প্রতি বিশেষভাবে কবির অবজ্ঞা প্রকাশ পেয়েছে কাদম্বরী সম্পর্কে তাঁর ইর্ষালেশ হীন মনোভাব চিত্রণে। চোখের সমুখে চদ্ৰাপীড়-কাদম্বরীর প্রণয় লীলা দেখেও পত্রলেখার মনে কোনরূপ ভাবান্তর দেখা দিল না, কাদম্বরীও তাকে সখী ভাবে গ্ৰহণ করল – এটি রবীন্দ্রনাথের বিবেচনায় অবান্তর। বাণভট্ট তাঁর কাহিনীর মধ্যে এই চরিত্রটিকে পরিপূর্ণ নারীত্বের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেননি। তাই পত্রলেখা এই কাহিনীর মধ্যে নারীর স্বাভাবিক মর্যাদা থেকে বঞ্চিত রয়ে গেছে।

একটি নারীর নারী-ব্যক্তিত্বের পূর্ণতার জন্য যে স্বাভাবিক প্রেমানুভূতির বিকাশ দেখানো প্রয়োজন বাণভট্ট তা দেখান নি। অন্তরের অপূর্ণতার জন্যই পত্রলেখা অসম্পূর্ণ, খণ্ডিত। পত্রলেখার তরুণী হৃদয়ের তরঙ্গলীলাকে বাণভট্ট একটি সংকীর্ণ সীমার মধ্যে আবদ্ধ রেখেছেন, পূর্ণ যৌবন দিনের প্রবল হৃদয় আবেগেও সে সীমা লংঘিত হল না। এই অবাস্তবতাকে বাস্তবরূপে দেখানোর চেষ্টার মূলে আছে চরিত্রটি সম্পর্কে কবির যথোচিত মনোযোগের অভাব। তাই পত্রলেখাকে কাব্যের উপেক্ষিতা চরিত্র বলতে হয়।

২। সংস্কৃত সাহিত্যের অনাবৃতাদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ কাকে প্রধান স্থান দিয়েছেন? তাকে কাব্যের উপেক্ষিতা বলার কারণ আলোচনা করে। 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সংস্কৃত সাহিত্যের অনাবৃতাদের মধ্যে রামায়ণের লক্ষ্মণ পত্নী ঊমিলাকেই প্রধান স্থান দিয়েছেন।

বাল্মীকির রামায়ণ মহাকাব্যে কাহিনীর কেন্দ্রে স্থাপন করা হয়েছে সীতা চরিত্রটিকে। সীতার দুঃখভোগের মহিমাকে উজ্জ্বল রূপে চিত্রিত করাই মহাকবি বাল্মীকির উদ্দেশ্য ছিল। সীতা চরিত্রের উপর থেকে পাঠকের মন যাতে কোনোভাবেই বিচলিত না হয়, হয়তো সেই জন্যই বাল্মীকি আর কোনো নারী চরিত্রকে কাব্যের মধ্যে অনুরূপ প্রাধান্য দেন নি।

সীতার মতোই কোনো কোনো দিক থেকে সীতার চেয়েও বেশি যন্ত্রণা ভোগ করেছে এমন আরেকটি চরিত্র ঊর্মিলা। রাম, লক্ষ্মণ প্রমুখের বিবাহের সময়ে কন্যা সম্প্রদানের বর্ণনায় একবার আমরা ঊর্মিলার উল্লেখ পাই। নববধূ বেশে এক তরুণী কণ্যা বিবাহ সভায় উপস্থিত, রাজা জনক তাকে লক্ষ্মণের হাতে সম্প্রদান করলেন। এর পর এত বড়ো রামায়ণ কাব্যে আর কোথাও ঊর্মিলার প্রসঙ্গ তোলেননি কবি।

মহাকবি বাল্মীকি ঊর্মিলার বিস্তারিত পরিচয় দেননি, কিন্তু দেওয়ার অবকাশ ছিল। রাম-সীতার জন্য লক্ষ্মণ যখন বনগমনের জন্য প্রস্তুত হল তখন ঊর্মিলার সঙ্গে সুদীর্ঘ বিচ্ছেদের পটভূমিকায় এই দম্পতির বর্ণনা অপ্রাসঙ্গিক হত না। রাম, লক্ষ্মণ ও সীতা অযোধ্যা থেকে বিদায় নিচ্ছেন, তার মধ্যেও কোথাও কেন ঊর্মিলার প্রসঙ্গ এল না এই প্রশ্ন পাঠকের মনে আসা স্বাভাবিক। তাছাড়া রাজকুমারদের বিদায়ের পরে শোকাতুরা ঊর্মিলা কিভাবে প্রাসাদে কাল যাপন করত তা বাল্মীকি আমাদের জানান নি। মহাকবির এমন আশ্চর্য নিরবতা রবীন্দ্রনাথের মনে ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে।

উপাস্য দেবতা স্বরূপ রাম-সীতার জন্য লক্ষ্মণের আত্মত্যাগের মহিমা মহাকবি বাল্মীকি সমুজ্জ্বল বর্ণে এঁকেছেন। কিন্তু সে তুলনায় ঊর্মিলার ত্যাগ আরো বড়ো। সে নিজের চেয়েও মহার্ঘ যে স্বামী, সেই স্বামীকেই রাম-সীতার জন্য ত্যাগ করেছেন। সদ্য বিবাহিত জীবনের প্রণয় সুখকে বিসর্জন দিয়ে বিরহ যন্ত্রণাকে সে বরণ করে নিয়েছে। তবুও তার এই ত্যাগের মহিমা কেউ স্মরণ করে না।

কৌঞ্চির দুঃখে পর্যন্ত যে মহাকবি অভিভূত হয়েছিলেন সেই বাল্মীকিও একবার ঊর্মিলার শোকাচ্ছন্ন মূর্তির দিকে চেয়ে দেখবার অবকাশ পান নি। দ্বাদশ বর্ষের বনবাস অন্তে লক্ষ্মণ যখন আবার অযোধ্যার প্রাসাদে ফিরে এসেছিল তখনও আমরা ঊর্মিলার কথা জানতে পারি না। সীতা প্রাসাদ ত্যাগ করে বনবাসিনী হয়েছেন, কিন্তু ঊর্মিলার পক্ষে প্রাসাদ বাসই যে বনবাস তুল্য হয়েছিল তা মহাকবি বাল্মীকির বিবরণে কোথাও বলা হয়নি।

কাব্যে মূল কাহিনীর নায়ক-নায়িকা চরিত্র পূর্ণাঙ্গরূপে গড়বার প্রয়োজনে অনেক গৌণ চরিত্র সৃষ্টি করা হয়। এই চরিত্রগুলি কাব্যের মধ্যে যার যেটুকু নির্দিষ্ট ভূমিকা তা পালন করে অপসৃত হয়ে যায়। কাব্যের দিক থেকে আর প্রয়োজন হয় না বলে কবি তাদের অন্তরালে সরিয়ে রাখেন। রামায়ণ কাব্যে দুঃখিনী রমণী ঊর্মিলা প্রসঙ্গে কথা বলার অনেক সুযোগ ছিল, কিন্তু কবি কোথাও সে সুযোগ কাজে লাগান নি। এই কারণেই রবীন্দ্রনাথ সংস্কৃত কাব্য সাহিত্যের উপেক্ষিতা রমণীর মধ্যে ঊর্মিলাকে সর্বপ্রধান স্থান দিয়েছেন।

৩। “সংস্কৃত কাব্যের আর দুইটি তপস্বিনী আমাদের চিত্ত ক্ষেত্রে তপোবন রচনা করিয়া বাস করিতেছে।” – এই দুই তপস্বিনীর নাম কি? তারা কাব্যে উপেক্ষিতা কেন আলোচনা করো।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘কাব্যের উপেক্ষিতা’ প্রবন্ধ থেকে গৃহীত আলোচ্য অংশে তপস্বিনী দুজন হল অনসূয়া ও প্রিয়ংবদা।

মহাকবি কালিদাসের ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম’ নাটকে শকুন্তলার পতিগৃহে যাত্রার দৃশ্য পর্যন্ত সর্বত্রই তাকে উপস্থিত করা হয়েছে দুই প্রিয়সখীর সঙ্গে। রাজা দুষ্যন্ত প্রথম যখন শকুন্তলাকে দেখে তখন অনসূয়া ও প্রিয়ংবদার সখীত্বের আবরণের মধ্যেই দেখেছিল। দুষ্যন্ত-শকুন্তলার সেই আকুল প্রেমের অনেকখানি পূর্ণ করে তুলেছিল এই দুই সখী।

শকুন্তলাকে একাকি সম্পূর্ণ মনে করা যায় না, সখীদের সঙ্গে মিলনে তিনজনে মিলে যেন এক সত্তা। সখীদের সন্নিধান থেকে বিচ্ছিন্ন শকুন্তলা খন্ডিতা, অসম্পূর্ণা। কলহাস্য মুখরা দুই তরুণী ব্যতীত শকুন্তলাকে চেনা কষ্টকর। তাই রবীন্দ্রনাথের অনুমান হয়ত বা এই জন্যই রাজা দুষ্যন্ত রাজ্যসভায় উপস্থিত শকুন্তলাকে চিনতে পারেননি।

প্রকৃতপক্ষে দুষ্যন্তের সঙ্গে প্রেমের সূচনায় শকুন্তলা-দুষ্যন্তের মধ্যে প্রত্যক্ষ সংলাপ খুবই কম। অধিকাংশ কথা আছে অনসূয়া ও প্রিয়ংবদার মুখে। শকুন্তলাকে পুষ্পের সঙ্গে তুলনা করে রবীন্দ্রনাথ সেই পুষ্পের বৃন্ত ও পল্লবের আবরণের সঙ্গে উপস্থিত করেছেন দুই সখীকে। এই আবরণ থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবে শকুন্তলার সৌন্দর্য্য পরিপূর্ণ হতে পারত না।

শকুন্তলার সঙ্গে এত নিবিড় সম্পর্কে সম্পৃক্ত তাপসী সখখীদ্বয়কে মহাকবি কালিদাস একটা পর্যায়ের পরে শুধু যে শকুন্তলার নিকট থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছেন তাই নয়, নাটক থেকেই তাদের নির্বাসিত করেছেন। শকুন্তলাকে বিদায় দিয়ে তপোবনে অনসূয়া ও প্রিয়ংবদা কিভাবে কাল কাটাত, দুষ্যন্তের রাজ্যসভায় শকুন্তলার অপমানের সংবাদ তাদের কিভাবে শোকগ্রস্ত করেছিল তা জানার জন্য পাঠকের ব্যাকুলতার অন্ত থাকে না।

কালিদাসের এই সংযম শিল্পনীতি সম্মত বলতে হয়। কিন্তু কাব্যের নিয়মে ন্যায় বিচার সম্মত হলেও এমনভাবে অনসূয়া ও প্রিয়ংবদাকে যবণিকার আড়ালে সরিয়ে দেওয়া অত্যন্ত নিষ্ঠুর। তাই অনসূয়া ও প্রিয়ংবদা কাব্যের উপেক্ষিতা। এদের সৃজনকর্তা এদের প্রতি অবিচার করেছেন, চরিত্র বিকাশের মাঝপথে অন্তরালে সরিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু পাঠকের কল্পনায় অনসূয়া ও প্রিয়ংবদা পরিণত হয়ে উঠতে থাকে।

পাঠকের দিক থেকেই রবীন্দ্রনাথ এই চরিত্র দুটির পরিনামের আভাস দিয়েছেন। অনসূয়া ও প্রিয়ংবদা বাসনা-কামনাময় বাস্তব জীবনের পরিচয় জানত না। চোখের সামনে রাজা দুষ্যন্ত-শকুন্তলার প্রেম এবং সেই প্রেমের হৃদয় বিদারক পরিনাম দেখে তারা জীবন সম্পর্কে অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছে। এই অভিজ্ঞতার তাপ নিশ্চয়ই তাদের সেই সখী ভাবের সারল্যটুকু বিনষ্ট করে দিয়েছে। দেহে, মনে রূপান্তরিতা এই অনসূয়া ও প্রিয়ংবদার চিত্র নাটকে নেই, কিন্তু এই উপেক্ষিতাদের পূর্ণাঙ্গ রূপ পাঠক সমাজ কল্পনায় গড়ে নেয়।

Leave a Comment