সাহিত্যের সামগ্ৰী প্রবন্ধ হতে প্রশ্ন ও উত্তর নিম্নে দেওয়া হল। Bengali B.A.(General) RANGAMANCHA Question Answer. প্রবন্ধ সাহিত্যের সামগ্ৰী হতে 2, 5, 10 নং প্রশ্ন ও উত্তরগুলি দেওয়া হল।
প্রবন্ধ | সাহিত্যের সামগ্ৰী |
গ্রন্থ | সাহিত্য |
রচনা | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর |
প্রকাশিত | বঙ্গদর্শন পত্রিকা ১৩১০ বঙ্গাব্দে |
সাহিত্যের সামগ্ৰী প্রবন্ধ হতে প্রশ্ন ও উত্তর
Bengali B.A.(General) প্রবন্ধ সাহিত্যের সামগ্ৰী হতে প্রশ্ন ও উত্তর।
প্রবন্ধ সাহিত্যের সামগ্ৰী হতে প্রশ্ন মান – ২
১। ‘সাহিত্যের সামগ্রী’ প্রবন্ধটি কবে কোন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়?
১৩১০ বঙ্গাব্দে নবপর্যায় বঙ্গদর্শন পত্রিকায়।
২। ‘সাহিত্যের সামগ্রী’ প্রবন্ধটি কোন প্রবন্ধ গ্রন্থের অন্তর্গত ?
‘সাহিত্যের সামগ্রী’ প্রবন্ধটি ‘সাহিত্য’ প্রবন্ধ গ্রন্থের অন্তর্গত।
৩। রবীন্দ্রনাথের মতে সাহিত্য কী?
রবীন্দ্রনাথের মতে সাহিত্য আত্মগত ভাবোচ্ছ্বাস নয়, তার লক্ষ্য পাঠক সমাজ। পাঠকের আনন্দের জন্য রচিত সৃষ্টিই হল সাহিত্য।
৪। রবীন্দ্রনাথ সহিত্যের সামগ্ৰী বলতে কী বুঝিয়েছেন?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে সাহিত্যের সামগ্রী হল তাই যা অন্যের হৃদয়ে সঞ্চালিত হওয়ার জন্য কোনো প্রতিভাশালী কবি বা স্রস্টার হৃদয়রস প্রার্থনা করে। যা আমাদের হৃদয়ের দ্বারা সৃষ্টি না হয়ে উঠলে অন্যের হৃদয়ের মধে প্রতিষ্ঠা লাভ করে থাকতে পারে না তাই সাহিত্যের সামগ্ৰী
৫। “সাহিত্যে এই দুটো বাজে কথা কোনো কোনো মহলে চলিত আছে” – কোন দুটি কথার উল্লেখ এখানে করা হয়েছে ?
রবীন্দ্রলাথ ঠাকুর রচিত সাহিত্যের সামগ্ৰী প্রবন্ধ থেকে গৃহীত আলোচ্য অংশে ‘নীরব কবিত্ব’ এবং ‘আত্মগত ভাবোচ্ছ্বাস’ – এই দুটি বিষয়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
৬। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘সাহিত্যের সামগ্রী’ প্রবন্ধে কোন সম্রাটের কথা বলেছেন? তাঁর কোন কাজের কথা তিনি উল্লেখ করেছেন ?
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘সাহিত্যের সামগ্রী’ প্রবন্ধে মৌর্য সম্রাট অশোকের কথা বলেছেন।
- আলোচ্য প্রবন্ধে লেখক সম্রাট অশোকের শিলালিপি খোদাই করার ব্যাপারটি বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন।
৭। কী উপায়ে জ্ঞানের উদ্দেশ্য যথার্থভাবে সফল হতে পারে ?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘সাহিত্যের সামগ্রী’ প্রবন্ধে বলেছেন জ্ঞানের বিষয় যে ভাষায়, মে উপায়ে প্রথম অভিব্যক্ত হয় পরবর্তীকালে তাকে নানা ভাষায় নানা উপায়ে আরো উজ্জ্বল করে প্রকাশ করতে পারলে তার উদ্দেশ্য যথার্থভাবে সফল হতে পারে।
৮। “ইহায় সাহিত্য, ইহায় ললিতকলা” – কে, কোথায় এই কথা বলেছেন ? তার মতে সাহিত্য বা ললিতকলা কী ?
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘সাহিত্যের সামগ্ৰী’ প্রবন্ধে আলোচ্য কথাটি বলেছেন।
- রবীন্দ্রনাথ বলতে চেয়েছেন যে, কোনো ভাবকে নিজে অনুভব করে অন্যের বোধগম্য করে রূপায়িত করার নামই সাহিত্য বা ললিতকলা।
৯। “প্রকাশই সাহিত্যের প্রধান ধর্ম” – লেখক কেন একথা বলেছেন?
স্রষ্টা তার সৃষ্টিকে কেবল নিজের জন্য সঞ্চিত করে রাখে না, তাকে সকলের আনন্দ বিধানের জন্য তুলে ধরে। সৃষ্টির প্রধান ধর্মই হল প্রকাশ করা। তাই রবীন্দ্রনাথ আলোচ্য কথাটি বলেছেন।
১০। মানুষের সৃষ্টি কয় প্রকার ও কীকী ?
মানুষের সৃষ্টি দুই প্রকারের – একটি চিরকালীন, অন্যটি ক্ষণকালীন। ক্ষণকালীন সৃষ্টি কেবল প্রয়োজন মেটায়, অন্যদিকে চিরকালীন সৃষ্টি প্রয়োজনের ঊর্দ্ধে উঠে চিরস্থায়ীত্বের অমরতা আনে।
১১। “জ্ঞানের কথা একবার জানিলে আর জানিতে হয় না” – একথা বলার কারণ কী ?
আসলে জ্ঞানের কথা একবার জানা হয়ে গেলেই তার প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়। আগুন গরম, জল তরল প্রভৃতি সম্বন্ধে একবার জ্ঞান লাভ করার পর তা নতুন করে জানার প্রয়োজন হয় না। এই কারণেই প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘সাহিত্যের সামগ্রী’ প্রবন্ধে আলোচ্য উক্তিটি করেছেন
১২। “কিন্তু ভাবের কথা বারবার অনুভব করিয়া শ্রান্তি বোধ হয় না” – এই মন্তব্যের কারণ কী?
প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথের মতে ভাব হল অনুভূতির জিনিস, ভাবের কথাকে অপরের অনুভূতিতে সঞ্চারিত করে দিতে হয়। সেখানে প্ৰমাণ, তত্ত্ব, যুক্তি, তর্ক প্রভৃতির অপেক্ষা রাখে না এই অনুভূতি লোক পরম্পরায় সঞ্চালিত হয়ে আসে। সেই জন্যই বারবার অনুভব করে শ্রান্তিবোধ হয় না।
১৩। “কিন্তু রচনা সম্পূর্ণ নিজের” – রচনাকে সম্পূর্ণ নিজের বলা হয়েছে কেন ?
আসলে ভাব, বিষয়, তত্ত্ব সাধারণ মানুষের। তা একজন যদি বের না করে কোনো একসময় অন্য একজন বের করবে। কিন্তু রচনা একজনের যেমন হবে আরেক জনের তেমন হবে না। তাই প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথ রচনাকে লেখকের সম্পূর্ণ নিজের বলেছেন।
১৪। সারবান সাহিত্য কী? তার স্থায়িত্ব সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য কী ?
- যে সাহিত্যে জ্ঞানের বিষয় থাকে, তথ্য পরিবেশিত হয় তাকেই সারবান সাহিত্য বলে।
- রবীন্দ্রনাথের মতে সারবান সাহিত্যের স্থায়িত্ব কম। কারণ, জ্ঞানের কথা একবার জানা হয়ে গেলে আর তার প্রয়োজন থাকে না।
১৫। সাহিত্যে ভাবের সঙ্গে রচনার সম্পর্ক কী ?
সাহিত্যে ভাবের অঙ্গ হল রচনা। দেহ বা অঙ্গ না থাকলে যেমন ব্যক্তির অস্তিত্ব স্বীকার করা যায় না, তেমনি রচনা ছাড়া সাহিত্য হয় না।
১৬। মানুষের মাঝে অমরতা লাভের কয়টি মাধ্যমের কথা রবীন্দ্রনাথ বলেছেন?
মানুষের মাঝে অমরতা লাভের জন্য প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথ চারটি মাধ্যমের কথা বলেছেন যথা – সাহিত্য, স্থাপত্য, ভাস্কর্য এবং চিত্র। অর্থাৎ ভাবের কথা কবিতা, নাটক, গল্প ইত্যাদির আকারে লেখা যায়; মঠ, মন্দির ইতাদি নির্মাণ করা যায; মূর্তি খোদাই করা যায় কিংবা চিত্র অঙ্কণ করা যায়।
১৭। “পাহাড়কে তিনি কথা কহিবার ভার দিয়েছিলেন” – কে কিভাবে পাহাড়কে কথা কহিবার ভার দেন ?
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘সাহিত্যের সামগ্রী’ প্রবন্ধ থেকে গৃহীত আলোচ্য অংশে পাহাড়কে কথা কহিবার ভার দিয়েছিলেন মৌর্য সম্রাট অশোক।
- সম্রাট অশোক নিজের বক্তব্য বা ভাবের কথা পাহাড়ের গায়ে খোদাই করিয়ে সেই কথা উত্তরকালের মানুষদের বলবার ভার দিয়েছিলেন।
১৮। ললিত কলা কি?
ভাব কোনো ব্যক্তি বিশেষের নয়, সর্বসাধারণের। আর এই ভাবকে নিজের মতো করে অঙ্গিকরণ করে সকলের মধ্যে সঞ্চালিত করার নামই হল সাহিত্য। প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথের মতে তাই ললিতকলা।
প্রবন্ধ সাহিত্যের সামগ্ৰী হতে প্রশ্ন মান – ৫
১। “ভাবকে নিজেরে করিয়া সকলের করা – ইহাই সাহিত্য, ইহাই ললিতকলা” – তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘সাহিত্যের সামগ্রী’ প্রবন্ধ থেকে আলোচ্য অংশটি গৃহীত।
কবি ও সাহিত্যিক কলা কৌশলপূর্ণ রচনার মধ্যে দিয়ে সাহিত্যের ভাবময় দেহ সৃষ্টি করেন। এক একজন সাহিত্যিক তার নিজের মতো করে কলা কৌশল সৃষ্টির দ্বারা সাহিত্য গড়ে তোলেন। সাধারণের চোখে দেখা যে জগৎ আর কবির চোখে দেখা জগৎ – এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। কবির চোখে দেখা জগৎ অলৌকিক জগৎ। এই জগৎকে নিয়ে কবি বা সাহিত্যিক তার প্রতিভা বলে যা সৃষ্টি করেন তাই সাহিত্য।
সাহিত্যের মধ্যে লেখক নিজেকে অমর করে রাখেন। ভাবের সঙ্গে ভাব প্রকাশের উপায় সম্মিলিত ভাবে বোঝাই সাহিত্য। ভাব সর্বসাধারণের হলেও তার প্রকাশের উপায়টি লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব। কবি ও সাহিত্যিক তার প্রকাশ ভঙ্গির অনবদ্যতায় ভাবকে সকলের অন্তরের সামগ্রী করে তোলেন। নিজের ভাবকে সকলের মধ্যে সঞ্চারিত করে তোলাই সাহিত্যের প্রধান কথা। তাই প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রশ্নোদ্ধৃত উক্তিটি করেছেন।
২। “সাহিত্যের প্রধান অবলম্বন জ্ঞানের বিষয় নহে ভাবের বিষয়” – কে, কোথায় এই মন্তব্য করেছেন ? মন্তব্যটির তাৎপর্য আলোচনা করো।
প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘সাহিত্যের সামগ্রী’ প্রবন্ধে আলোচ্য মন্তব্যটি করেছেন।
মানব সমাজে সাহিত্য লেখককে চিরকালীন করে চির নবীন রাখতে চায়। এই চাওয়া জ্ঞানের মধ্যে দিয়ে হতে পারে না। জ্ঞানের বিষয় জানা মাত্রই সব আকর্ষণ ফুরিয়ে যায়। দ্বিতীয়বার আর জানার আকর্ষণ থাকে না। আগুন গরম, পাথর কঠিন, জল তরল – এগুলি জ্ঞানের কথা, এগুলি একবার জানা হয়ে গেলে বিষয় পুরাতন হয়ে যায়।
সাহিত্যে ভাবের কথা, ভাবের বিষয় কখনও পুরাতন হয় না। শরৎচন্দ্রের ‘দেবদাস’ উপন্যাসে জনপ্রিয় দেবদাসের জীবন ট্র্যাজিডি আজও সমানভাবে জনপ্রিয়। ভাব ও ভাবের প্রকাশ চিরন্তন, তাই ভাবের প্রকাশের বাহন যে সাহিত্য তাও চিরন্তন।
ভাবের কথা বারবার অনুভব করেই মানুষ আবিস্ট হয়। এই ভাব তথা অনুভূতি লোক পরম্পরায় প্রবাহিত হয়ে নতুনকালের লোকের কাছে নতুনরূপে দেখা দেয়। বারেবারে এইরূপ নতুন করে মেলে ধরা একমাত্র ভাবের পক্ষেই সম্ভব। সেই প্রসঙ্গে আলোকপাত করতে গিয়েই প্রাবন্ধিক আলোচ্য মন্তবটি করেছেন।
৩। “প্রকাশই কবিত্ব” – কে কোথায় এই উক্তি করেছেন ? উক্তিটির তাৎপর্য আলোচনা করো।
প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘সাহিত্যের সামগ্রী’ প্রবন্ধে আলোচ্য মন্তব্যটি করেছেন।
‘সাহিত্য’ শব্দের উৎপত্তি বিশ্লেষণ করে রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন যে সাহিত্য কথাটিতে একটি মিলনের ভাব দেখা যায়। এই মিলন কেবল ভাবে-ভাবে, ভাষায়-ভাষায়, গ্রন্থে-গ্রন্থে মিলন নয়। এই মিলন মানুষে-মানুষে, অতীতের সাথে বর্তমানের, দূরের সঙ্গে নিকটের, বহির্বস্তুর সঙ্গে হৃদয়ের মিলন। অর্থাৎ কবি কেবলমাত্র তার নিজের আনন্দের জন্য কাব্য রচনা করেন না। কবির উদ্দেশ্য হল পাঠকের হৃদয়ে আনন্দ দান করা। পাঠকের হৃদয়ে আনন্দ দান করার মধ্যেই কাব্যের স্বার্থকতা লুকিয়ে আছে।
লৌকিক জগতে যাকে ঘৃণা করে দূরে সরিয়ে রাখা হয় কাব্যের জগতে কবি সেই লৌকিক জগতের ঘৃণার বস্তুকে তাঁর অপূর্ব নির্মাণক্ষম শক্তির সাহায্যে কাব্যের জগতে ফুটিয়ে তোলেন। আর কাব্যের পাঠক তাকে সাদরে গ্রহণ করে। তাই প্রকাশের মধ্যেই কাব্যের চরম স্বার্থকতা প্রকাশ পায় বলে প্রাবন্ধিকের এই উক্তি।
৪। “জ্ঞানের কথা একবার জানিলে আর জানিতে হয় না” – কোন প্রবন্ধ এই কথাটি আছে? কথাটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ কর।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত সাহিত্যের সামগ্রী প্রবন্ধে আলোচ্য কথাটি আছে।
যা জ্ঞানের কথা তা মানুষ একবার জানলে আর জানতে চায় না। যে জ্ঞান আগে পণ্ডিতদের কাছে অগম্য ছিল, তা হয়ত আজ শিক্ষার্থী বালকদের কাছে অপরিচিত নয়। জ্ঞান আগে বিস্ময়ের সঞ্চার করেছিল, তা যদি আবার প্রকাশিত হয় তবে তার মধ্যে বিস্ময়ের কিছু থাকে না। তাই জ্ঞানের কথা একবার জানলে আর জানাতে হয় না।
জ্ঞানের বিষয় হল চিরকালীন সত্য। অর্থাৎ আগুন গরম, সূর্য পূর্ব দিকে ওঠে, পাথর কঠিন, জল তরল প্রভৃতি। এই পরিচিত তত্ত্ব যারা মাত্রই আমাদের আকর্ষণের বিন্দুমাত্র উৎসাহ থাকে না। কিন্তু সূর্যোদয়ের সৌন্দর্য ও আনন্দ জীবসৃষ্টির পর থেকে আজ পর্যন্ত মানবমনে অম্লান আছে। সুতরাং হৃদয়ভাবের কথা বারবার জানলেও তা পুরানো হয় না। যে অনুভূতি দীর্ঘকাল ধরে লোক মানসের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আসছে, কালক্রমে তার গভীরতা বৃদ্ধি পায়।
প্রবন্ধ সাহিত্যের সামগ্ৰী হতে প্রশ্ন মান – ১০
১। ‘সাহিত্যের সামগ্রী’ প্রবন্ধের মূল বক্তব্যটি নিজের ভাষায় বুঝিয়ে বল।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সাহিত্য’ গ্ৰন্থের একটি বিশিষ্ট প্রবন্ধ ‘সাহিত্যের সামগ্রী’। এখানে প্রাবন্ধিক সাহিত্যের যথার্থ সামগ্রী কী? সে সম্পর্কেই আলোচনা করতে চান। সাহিত্যিক যে সাহিত্য সৃষ্টি করেন তা নিজের আনন্দের জন্যই নয়, তার লক্ষ্য পাঠক সমাজ। কারণ, লেখকের মনের জগৎ বা অনুভূত ভাবরাশি যতবেশি অন্যলোকের মনে সঞ্চারিত হয়, তাঁর তৃপ্তিও ততই বেশি হয়।
মানুষের হৃদয়ের প্রধান আকাঙ্ক্ষা অন্য সবার মনে স্থান লাভের মধ্যে দিয়ে অমরত্ব লাভ করা। সেই উদ্দেশ্যেই তাঁর সাহিত্য সৃষ্টি। মানুষের মনে জায়গা পাওয়া উদ্দেশ্য বলেই সাহিত্যে অবলম্বিত হয় ভাবের বিষয়, জ্ঞানের বিষয় নয়। “যাহা জ্ঞানের কথা তাহা প্রচার হইয়া গেলেই তাহার উদ্দেশ্য সফল হইয়া শেষ হইয়া যায়।….. হৃদয় ভাবের কথা প্রচারের দ্বারা পুরাতন হয় না।”
জ্ঞানের কথা একবার জানা হয়ে গেলে আর জানবার ইচ্ছে কারো হয় না, কিন্তু হৃদয় ভাবের কথা বার বার জানলেও শ্রান্তি হয় না। সূর্য পূর্বদিকে উদিত হয় এই তথ্য জানবার আগ্রহ আমাদের নেই, কিন্তু সূর্যোদয় কালের সৌন্দর্য বারবার উপভোগ করলেও অনাগ্রহ জন্মায় না। তাই সাহিত্য সৃষ্টির মাধ্যমে যদি মানুষের মনে জায়গা পেতে হয় তাহলে সে সাহিত্যের বিষয় হবে অবশ্যই ভাবের কথা। এই জন্য সাহিত্যের প্রধান অবলম্বন জ্ঞানের বিষয় নহে, ভাবের বিষয়।
একথাও ঠিক, ভাবের বিষয় হলেই তা যথার্থ সাহিত্য হয়ে ওঠে না, অন্যের মনে সঞ্চার করে দেবার জন্য তার উপযুক্ত মাধ্যম চাই। জ্ঞানের বিষয়কে পৌঁছে দিতে হয় মস্তিষ্কের কাছে, সেখানে সাদা-মাটা ভাষায় বিষয়টা বুঝিয়ে দিলেই চলে। কিন্তু ভাবের বিষয়কে পৌঁছে দিলে হয় না, নানা রকম আভাস-ইঙ্গিত, ছলাকলার আশ্রয়ে তাকে সৃষ্টি করে তুলতে হয়। এই যে আভাস-ইঙ্গিতপূর্ণ, ছলা-কলা সমন্বিত সৃষ্টি, এরই নাম রচনা।
রচনা হল ভাবের দেহের মতো। এই দেহের সৌন্দর্যের গুণেই তাতে আশ্রিত ভাব পাঠকের কাছে আদর পায়। এছাড়া, ভাব সর্বসাধারণের, রচনাই লেখকের নিজস্ব। সেই জন্য “রচনার মধ্যেই লেখক যথার্থ রূপে বাঁচিয়া থাকেন ভাবের মধ্যে নহে, বিষয়ের মধ্যে নহে।” অবশ্য রচনা বলতে ভাব ও ভাব প্রকাশের উপায় দুই-ই সম্মিলিত ভাবে বোঝায়, তবে বিশেষ করে ঐ উপায়টাই লেখকের ভাবনা নয়।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, যে-ভাব সকল মানুষের, সেই ভাবকে লেখক প্রথমে নিজের করে নেন, তারপর তাকে সর্বসাধারণের উদ্দেশ্যে ভাষার মাধ্যমে প্রকাশ করেন। এই হল সাহিত্য। একই ভাবকে এক একজন লেখক তাদের রুচি, শিক্ষা, মানসিকতা, সামর্থ্য অনুযায়ী পৃথকভাবে গ্রহণ করতে পারেন এবং নিজের মতো করেই তার রূপ দিতে পারেন। ফলে লেখক ভেদে একই ভাবের ভিন্নরূপ সৃষ্টি সম্ভব হয়।
জ্ঞানের বিষয় ও ভাবের বিষয়ের পার্থক্য এইখানে আর একবার ধরা পড়ে। ট্রুথ বা সত্য ব্যক্তিভেদে পৃথক হতে পারে না তা ব্যক্তি নিরপেক্ষ। কিন্তু, ভাবের বিষয় ব্যক্তিসাপেক্ষ। সুর্যোদয়কে সকলে সূর্যোদয় বলেই মানবেন, কিন্তু সূর্যোদয়ের সৌন্দর্য এক একজন এক এক রকম উপভোগ করবেন। এই কারণেই চিরন্তন ভাব সকলকে অবলম্বন করে যুগে যুগে দেশে দেশে নানা জনে কত সাহিত্য সৃষ্টি করে চলেছেন। তাদের কারো রচনার সঙ্গে অন্যের কোনো রচনার মিল নেই। অথচ, তা সাহিত্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
সুতরাং সাহিত্যের সামগ্রী হল সেই সকল হৃদয়ভাব, যা সর্বসাধারণের অথচ প্রতিভাশালী স্রষ্টার হৃদয়ের সুরে ও রঙে বিশিষ্টতা লাভ করে সৃষ্টি হয়ে উঠে অন্যের হৃদয়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। আগে তা স্রষ্টার নিজের হয়, তারপর হয় সকলের। এই জন্যই বলা হয়েছে, “ভাবকে নিজের করিয়া সকলের করা ইহাই সাহিত্য, ইহাই ললিতকলা।”