সাহিত্যের উদ্দেশ্য প্রবন্ধ হতে প্রশ্ন ও উত্তর নিম্নে দেওয়া হল। Bengali B.A.(General) SAHITYER UDDESHYA Question Answer. প্রবন্ধ সাহিত্যের উদ্দেশ্য হতে 2, 5, 10 নং প্রশ্ন ও উত্তরগুলি দেওয়া হল।
প্রবন্ধ | সাহিত্যের উদ্দেশ্য |
গ্রন্থ | প্রাচীন সাহিত্য |
রচনা | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর |
প্রকাশিত | ভারতী ও বালক পত্রিকা |
সাহিত্যের উদ্দেশ্য প্রবন্ধ হতে প্রশ্ন ও উত্তর
Bengali B.A.(General) প্রবন্ধ সাহিত্যের উদ্দেশ্য হতে প্রশ্ন ও উত্তর।
প্রবন্ধ সাহিত্যের উদ্দেশ্য হতে প্রশ্ন মান – ২
১। ‘সাহিত্যের উদ্দেশ্য’ প্রবন্ধটি কখন, কোন পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ?
১২৯৪ বঙ্গাব্দে, ভারতী ও বালক পত্রিকায়
২। “বিষয় বিশুদ্ধ সহিত্যের প্রাণ নহে” – প্রাবন্ধিকের একথা বলার কারণ কী?
‘সাহিত্যের উদ্দেশ্য’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশুদ্ধ সাহিত বলতে বিষমযুক্ত সাহিত্যের কথা বলেন নি। সাহিত্যে বিষয় থাক বা না থাক, তাতে কিছু আসে যায় না। বিশুদ্ধ সাহিত্যে বিষয় গৌন। তাই প্রাবন্ধিক আলোচ্য উক্তিটি করেছেন।
৩। “আজকাল লেখা পাইলেই তাহার উদ্দেশ বাহির করিতে চেষ্টা করে” – কাদের কথা বলা হয়েছে? এরকম করার কারণ কী?
‘সাহিত্যের উদ্দেশ্য’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ভাষার সাহিত্য সমালোচকদের কথা এখানে বলতে চেয়েছেন।
বাংলা ভাষার সাহিত্য সমালোচকরা কোনো একটা উদ্দেশ্য ধরতে না পারলে লিখতে পারেন না, তাই তাদের উদ্দেশ্য খুঁজে বেড়াতে হয়।
৪। সাহিত্যের মধ্যে উদ্দেশ্য খুঁজে বের করাকে প্রাবন্ধিক কোন ঘটনার সাথে তুলনা করেছেন ?
‘সাহিত্যের উদ্দেশ্য’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্যের মধ্যে থেকে উদ্দেশ্য খুঁজে বের করার চেষ্টাকে শিক্ষকের ছাত্রকে ঝুঁটি ধরে মারার অভ্যাসের সাথে তুলনা করেছেন। সেই শিক্ষক যদি মুণ্ডিত মস্তক ছাত্র পায় তখন তার পক্ষে তা শোকের কারণ হয়।
৫। ঐতিহাসিক রচনা কোন গুণে বেঁচে থাকে ?
প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে ঐতিহাসিক রচনায় ইতিহাস অংশটুকু অসত্য বলে প্রমাণিত হলেও ওই রচনাটি বেঁচে থাকতে পারে একমাত্র তার সাহিত্যগুণের জন্য
৬। দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাসের সঙ্গে সাহিত্যের পার্থক্য কী ?
দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস প্রভৃতি নির্মাণ ধর্মী, তাদের বিশেষ বিশেষ উদ্দেশ্য থাকে। কোনো একটা বিশেষ তত্ত্ব নির্ণয় বা কোনো একটা বিশেষ ঘটনা বর্ণনার মধ্য দিয়ে দর্শন, বিজ্ঞান ও ইতিহাস এগিয়ে চলে। কিন্তু সাহিত্য সৃষ্টি ধর্মী তার কোনো উদ্দেশ্য থাকে না, সাহিত্যই সাহিত্যের উদ্দেশ্য।
৭। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য শব্দের কী ব্যাখ্যা করেছেন?
‘সাহিত্যের উদ্দেশ্য’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্য শব্দের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, “সাহিত্য অর্থেই একত্র থাকার ভাব – মানুষের সহিত থাকিবার ভাব – মানবকে স্পর্শ করা, মানবকে অনুভব করা।”
৮। সাহিত্য দিয়ে আমাদের কোন কার্য সাধিত হয়?
প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে সাহিত্যের প্রভাবে আমরা হৃদয়ের দ্বারা হৃদয়ের যোগ অনুভব করি। হৃদয়ের প্রবাহ রক্ষা হয়, হৃদয়ের সঙ্গে হৃদয় খেলতে থাকে। হৃদয়ে জীবন ও স্বাস্থ্য সঞ্চার হয়।
৯। সাহিত্যের উদ্দেশ্য কী?
প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে সাহিত্যের উদ্দেশ্য আনন্দ। আনন্দই সাহিত্যের আদি-মধ্য-অন্ত। সাহিত্য যেহেতু সৃষ্টি সেহেতু সেই সৃষ্টির উদ্দেশ্য আনন্দ, আনন্দই সৃষ্টির মূল কথা।
১০। “সাহিত্য স্বত উৎসারিত হইয়া সেই যোগ সাধন করে” – বক্তা এখানে ‘স্বত উৎসারিত’ শব্দ ব্যবহার করেছেন কেন?
মানুষের হৃদয়ের সঙ্গে হৃদয় যোগ করার জন্য কোনো কৃত্রিম উপায় নেই। কিন্তু সাহিত্যের মাধ্যমে সেই যোগ সাধন সম্ভব। সাহিত্যের এই সংযোগ সাধন প্রক্রিয়া যে অকৃত্রিম সেই কথা বোঝানোর জন্যই প্রাবন্ধিত স্ব’ত উৎসারিত’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন।
১১। “সাহিত্য স্বত উৎসারিত হইয়া সেই যোগ সাধন করে” – এখানে যোগ সাধন বলতে কী বোঝানো হয়েছে ?
প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘সাহিত্যের উদ্দেশ্য’ প্রবন্ধে যে যোগ সাধনের কথা বলেছেন তা হল মানুষের হৃদয়ের সাথে হৃদয়ের সংযোগ সাধন।
১২। “সৃষ্টির উদ্দেশ্য পাওয়া যায় না, নির্মাণের উদ্দেশ্য পাওয়া যায়।” – ব্যাখ্যা কর
১৩। “যে শিক্ষকের ঝুঁটি ধরিয়া মারা অভ্যাস সহসা ছাত্রের মুন্ডিত মস্তক তাহার পক্ষে অত্যন্ত শোকের কারণ হয়।” – কোন প্রসঙ্গে লেখকের মন্তব্য করেছেন?
‘সাহিত্যের উদ্দেশ্য’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্যের মধ্যে থেকে উদ্দেশ্য খুঁজে বের করার চেষ্টা প্রসঙ্গে শিক্ষকের ছাত্রকে ঝুঁটি ধরে মারার অভ্যাসের কথা বলেছেন।
১৪। ‘সাহিত্যের উদ্দেশ্য’ প্রবন্ধটি কোন গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত?
‘সাহিত্যের উদ্দেশ্য’ প্রবন্ধটি ‘সাহিত্য’ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত ।
প্রবন্ধ সাহিত্যের উদ্দেশ্য হতে প্রশ্ন মান – ৫
১। “উদ্দেশ্য না থাকিয়া সাহিত্যে এইরূপ সহস্র উদ্দেশ্য সর্ধিত হয়।” – ব্যাখ্যা করো।
প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘সাহিত্যের উদ্দেশ্য’ প্রবন্ধে আলোচ্য মন্তব্যটি করেছেন।
রবীন্দ্রনাথ মনে করেন সাহিত্য উদ্দেশ্যহীন। বিশুদ্ধ সাহিত্যের উদ্দেশ্য নেই। সাহিত্যে স্থূল বস্তু লভ্য নয়। তার মধ্যে যদি কিছু বস্তু পাওয়ার থাকে তবে তা হল রস বস্তু অর্থাৎ আনন্দ। সুতরাং প্রচলিত ধারণায় যাকে উদ্দেশ্য বলা হয় সাহিত্যে সে বস্তু পাওয়া যায় না। যদি বা তেমন কিছু বস্তু সামান্য পরিমাণে পাওয়া যায় তা নিতান্তই গৌণ এবং অস্থায়ী।
প্রাবন্ধিক বলেছেন বিশুদ্ধ সাহিত্যের মধ্যে উদ্দেশ্য বলে মা হাতে ঠেকে তা আনুসঙ্গিক এবং ক্ষণস্থায়ী। উদ্দেশ্য না থাকলেও সাহিত্যের প্রভাবে হৃদয়ে হৃদয়ে শীততাপ সঞ্চারিত হয়, বায়ু প্রবাহিত হয়, ঋতুচক্র ফেরে, গান ও রূপের হাট বসে যায়। অর্থাৎ সাহিত্যে নিজস্ব কোনো উদ্দেশ্য না থাকলেও সাহিত্যের মাধ্যমে এইসব শত সহস্র উদ্দেশ্য সাধিত হয় বলে প্রাবন্ধিক মনে করে।
২। “আনন্দই তাহার আদি-মধ্য-অন্ত” – ব্যাখ্যা করো।
প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘সাহিত্যের উদ্দেশ্য’ নামক প্রবন্ধে সাহিত্যের উদ্দেশ্যের কথা বলতে গিয়ে আলোচ্য মন্তব্যটি করেছেন।
সাহিত্যের মূল উদ্দেশ্য এবং কারণ হল আনন্দ। যে-কোনো উপায়ে আনন্দের প্রকাশ, আনন্দের সঞ্চার ছাড়া সাহিত্যের আর দ্বিতীয় কোনো কারণ কিংবা উদ্দেশ্য নেই। এই আনন্দের সঞ্চার করার যে যুক্তিপূর্ণ বা হিসেব করা কথায় সাহিত্য রচনা করতে হবে এমন কোনো মানে নেই। বন্ধুদের সাথে কথা বলার সময় যেমন কাজের কথার চেয়ে অনেক অনর্থক কথার অবতারণা করা হয়ে থাকে, তেমনি সাহিত্যের ক্ষেত্রেও রস সঞ্চারের জন্য অজস্র কথার ফুলঝুরি ফোটানো হয়ে থাকে।
শুধুমাত্র কাজের কথা দিয়ে সাহিত্য বা শিল্প সৃষ্টি হতে পারে না। যে কোনো একটি সূতা দিয়েই চুলের বিনুনি বাঁধা যেতে পারে। কিন্তু তাতে অনাবশ্যক রঙের কাজ ও সুতোর সাজ লাগিয়ে সুদৃশ্য করে তোলো হয়। এই অনাবশ্যক কাজটাই আনন্দ সঞ্চারী। এই অনাবশ্যক কাজ না হলেও প্রয়োজন মেটে কিন্তু মন ভরে না। হতে পারেনা 1, আনন্দ সঞ্চারের জন্য সাহিত্যেও তেমনি অপ্রয়োজনীয় কথা তুলে ধরা হয়।
৩। “সাহিত্য অর্থেই একত্র থাকিবার ভাব” – কে, কোথায় এই উক্তি করেছেন ? এই কথার তাৎপর্য লেখো।
প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘সাহিত্যের উদ্দেশ্য’ প্রবন্ধে আলোচ্য কথাটি বলেছেন।
সাহিত্য মানে যে একত্র থাকার ভাব তা ‘সাহিত্য’ নামের মধ্যেই নিহিত আছে। ‘সহিত’ কথা থেকে সাহিত্য কথাটি এসেছে। মানুষের সঙ্গে, মানুষের অনুভবের সঙ্গে, যুগের সঙ্গে, কালের সঙ্গে, অসীমের সঙ্গে, আনন্দের সঙ্গে একত্রিত হয়ে মানুষকে স্পর্শ করা, অনুভব করা। তাই সাহিত্য মানে একত্র থাকিবার ভাব – মানুষের সহিত থাকিবার ভাব।
মহাকবি কালিদাসের ‘মেঘদূত” কাব্যের মধ্যে যক্ষের যে বিরহ তা সাহিত্যের কারণে যক্ষের একান্ত হয়ে থাকে নি, সেই বিরহ সমস্ত পাঠককুলের চিত্তে সঞ্চারিত হয়ে গেছে। এই যে একসূত্রে সকলকে এক করে দেওয়া এটাই হল ‘সহিত’ অবস্থা। সাহিত্য এই ভাবে সঙ্গে সঙ্গে চলে, সঙ্গে সঙ্গে থাকে।
৪। “সৃষ্টির উদ্দেশ্য পাওয়া যায় না, নির্মাণের উদ্দেশ্য পাওয়া যায়।” – কোন প্রবন্ধে কথাটি আছে? কথাটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ কর।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘সাহিত্যের উদ্দেশ্য’ নামক প্রবন্ধে উদ্ধৃত উক্তিটি করেছেন।
সৃষ্টি আর নির্মাণ দুটির মধ্যেই গড়ে তোলার ব্যাপার বোঝানো হয়ে থাকে। তবে শব্দ দুটির মধ্যে কিছু উদ্দেশ্যগত পার্থক্য আছে। নির্মাণ করার অর্থ হল এমন কিছু গড়ে তোলা যার মধ্যে পূর্ব পরিকল্পনা বিদ্যমান। যেমন কোনো বাড়ি, কিংবা কোনো কলকারখানা, কিংবা কোনো বস্তু যখন গড়ে তোলা হয়, তখন তাকে গড়ে তোলার আগে অনেকগুলি পরিকল্পনা ও কর্মধারার স্তর পার করে আসতে হয়। কিন্তু সৃষ্টির ক্ষেত্রে সেই রকম কোনো পরিকল্পনার স্তর পার করে আসার প্রয়োজন পড়ে না।
প্রকৃতিতে যেমন ফুল ফোটে। ফুল ফোটা সকলেই দেখতে পায় কিন্তু কেন এবং কোন রহস্যের মধ্যে দিয়ে ফুল ফোটে তা অনুমান করা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। কারণ, তা হল সৃষ্টি। সৃষ্টি সর্বদাই রহস্য মণ্ডিত। কোনো প্রকাশিত কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সৃষ্টি হতে পারে না। পূর্ব পরিকল্পিত কর্মকাণ্ডের সূত্রে যা পাওয়া যায় তা নির্মাণ করা হয়ে যায়।
আমরা যাকে সাহিত্য সৃষ্টি বলে থাকি তা অবশ্যই কোনো কবিতা, চিত্র, গল্প বা উপন্যাসকে গড়ে তোলা। কিন্তু সেই রকম গড়ে তোলার ব্যাপার বাড়ি তৈরি করার ক্ষেত্রে কিংবা ইটের পাঁজা পোড়ানোর ক্ষেত্রে নেই। সেখানে গড়ে তোলার আগে অনেক কর্মকাণ্ডের ধাপ সুপরিকল্পিতভাবে পার করে আসতে হয়।
কোনো কিছু নির্মাণ করার আগে এই যে এত স্তর বা ধাপ পেরিয়ে আসতে হয় তার কারণ একটাই নির্মাণের উদ্দেশ্য। কিছু গড়ে তোলা বা নির্মাণ করার মূল কারণই তাই। কোনো উদ্দেশ্য না থাকলে আমরা কিছুই গড়ে তুলি না। আমাদের বাস করার জন্য, রোদের তাপ থেকে, বৃষ্টি জলধারা থেকে বাঁচার জন্য আমরা বাড়ি তৈরি করি, বাড়ির ছাদ পোক্ত করে তৈরি করি। বাড়ি করতে হবে বলে ভাল মতো ইট তৈরি করি। এই সমস্ত তৈরি করার পিছনে কোনো না কোনো উদ্দেশ্য কাজ করে। উদ্দেশ্য ছাড়া কিছুই নিৰ্মাণ করার প্রেরণা আসে না।
সৃষ্টির জন্য কোনো উদ্দেশ্যের আবশ্যকতা নেই। বস্তুত, সৃষ্টির কোনো উদ্দেশ্য পাওয়া যায় না। তবু যদি জোর করে তার উদ্দেশ্য খুঁজতে হয়, তাহলে এই কথা বলা যেতে পারে যে, সৃষ্টিই সৃষ্টির উদ্দেশ্য। সাহিত্যই সাহিত্যের উদ্দেশ্য। আরো গভীরভাবে যদি দেখি তাহলে এই কথা বলা যেতে পারে যে সৃষ্টির পশ্চাতে একটাই উদ্দেশ্য খুঁজে পাওয়া যেতে পারে, তা হল আনন্দ। আনন্দের কারণেই সৃষ্টি। কোনো প্রয়োজনের তাড়না তার পিছনে কাজ করে না।
প্রবন্ধ সাহিত্যের উদ্দেশ্য হতে প্রশ্ন মান – ১০
১। “সৃষ্টির ন্যায় সাহিত্যই সাহিত্যের উদ্দেশ্য” – কোন প্রবন্ধে এই কথা বলা হয়েছে? কে বলেছেন? কথাটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ কর।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সাহিত্য’ গ্রন্থের অন্তর্গত একটি বিশিষ্ট প্রবন্ধ ‘সাহিত্যের উদ্দেশ্য’। সাহিত্যের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী, সেই প্রসঙ্গে এই প্রবন্ধে আলোচনা করা হয়েছে। বিষয় সন্ধানী মানুষ সব কিছুর মধ্যেই বিষয়ের সন্ধান করে থাকেন। সাহিত্যের মধ্যেও তারা বিষয় বা সারবস্তু খুঁজে ফেরেন। কিন্তু প্রকৃত সাহিত্যের মধ্যে বিষয় থাকবেই, এমন কথা নেই। সাহিত্যের মধ্যে আলাদা করে বিষয় কিম্বা উদ্দেশ্য খুঁজে বের করা, আর প্রবহমান জাহ্নবীর জলে আলাদা করে তরঙ্গ খোঁজা একই রকম পণ্ডশ্রম।
বিশুদ্ধ সাহিত্যের উদ্দেশ্য আছে বলে যা মনে হয় তা আনুষঙ্গিক এবং নিতান্তই ক্ষণস্থায়ী। যে রচনার স্পষ্ট উদ্দেশ্য আছে, যে রচনা কোনো তত্ত্ব বা বিশেষ বিষয় সম্পর্কে পাঠককে অবহিত করতে চায়, তাকে বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস নামে চিহ্নিত করা যায়। বিশুদ্ধ সাহিত্যের কোনো উদ্দেশ্য থাকে না। সাহিত্য হল সৃষ্টি, সৃষ্টির কোনো উদ্দেশ্য থাকে না। নির্মাণের উদ্দেশ্য থাকে। ফুল কেন ফোটে, এ প্রশ্নের মীমাংসা হয় না। কিন্তু ইটের পাঁজা কেন পোড়ে, সুরকির কল কেন চলে, তা সকলেই জানে। সাহিত্য সৃজনধর্মী। সাহিত্যই সাহিত্যের উদ্দেশ্য।
সাহিত্যের যদি কোনো উদ্দেশ্য নাই থাকে, তাহলে সাহিত্য পাঠে লাভ কী? এমন প্রশ্ন কারো মাথায় আসতেই পারে, কিন্তু এর উত্তর দেওয়া সহজ নয়। তবে এটুকু বলা যায় যে, সাহিত্য পাঠে এক অনির্বচনীয় আনন্দের আস্বাদন হয়। “সাহিত্যের প্রভাবে আমরা হুদয়ের দ্বারা হৃদয়ের যোগ অনুভব করি, হৃদয়ের প্রবাহ রক্ষা হয়, হৃদয়ের সহিত হৃদয় খেলাইতে থাকে, হৃদয়ে জীবন ও স্বাস্থ্য-সঞ্চার হয়।” সাহিত্য মানেই হল একত্রে থাকবার – সঙ্গে থাকবার ভাব। মানবের ‘সহিত’ থাকবার ভাব। মানবকে স্পর্শ করা, অনুভব করার ব্যবস্থা করে সাহিত্য। উদ্দেশ্য না থাকলেও সাহিত্যের মধ্যে দিয়ে এমন অনেক মহৎ কাজ সম্পন্ন হতেই পারে।
বন্ধুতে বন্ধুতে মিলন ঘটলে কত বাজে কথা হয়। কত হাসি, কত আলাপ, কত আনন্দ! তার মধ্যে দিয়ে হৃদয়ের বিকাশও ঘটে। বিষয়ী লোকের অভিপ্রায় অনুসারে শুধু কাজের কথা নিয়ে পড়ে থাকলে হাস্যকৌতুক ও আনন্দের স্থান থাকত না। তখন শুধু দেখতে পাওয়া যেত “শুষ্ক দেহ, লম্ব মুখ, শীর্ণ গণ্ড, উচ্চ হনু, হাস্যহীন শুষ্ক ওষ্ঠাধর, কোটর প্রবিষ্ট চক্ষু।” আর সেটা আমাদের কারো কাম্য নয়।
সাহিত্যের অর্থই হল বাজে কথা। এখানে কাজের কথা, হিতের কথা, সমাজ কল্যাণের কথা থাকা আবশ্যক নয়। মেঘদূতের কবি কালিদাস তাঁর কাব্যে বাজে কথাই লিখেছেন। মেঘকে দেখে প্রিয় বিরহে কাতর যে যক্ষ চেতন-অচেতনের পার্থক্য ভুলে মেঘকেই দূত ক’রে প্রিয়ার কাছে পাঠাতে চায়, তার কথায় সংসারের কোন প্রয়োজন সিদ্ধ হয়? কোন সমস্যার সমাধান হয়? অথচ, শ্রেষ্ঠ সাহিত্য এমনই। বহু শতাব্দী ধরে মানুষ তা পাঠ করে আসছে-কিসের জন্য। নিশ্চয় এক অহেতুক আনন্দের আস্বাদন করে তৃপ্ত হবার জন্য। সাহিত্য এরকমই বাজে কথা। তা হৃদয়ের বিকাশ ও স্মৃর্তির কারণ। তা আনন্দের উৎস। “আনন্দই তার আদি মধ্য অন্ত। আনন্দই তাহার কারণ এবং আনন্দই তাহার উদ্দেশ্য।”