মনুষ্য ফল: প্রবন্ধ (প্রশ্ন ও উত্তর)

মনুষ্য ফল প্রবন্ধ হতে প্রশ্ন ও উত্তর নিম্নে দেওয়া হল। Burdwan University 1st Semester প্রবন্ধ Bengali B.A.(General) MANUSYA FAL Question Answer. প্রবন্ধ মনুষ্য ফল হতে 2, 5, 10 নং প্রশ্ন ও উত্তরগুলি দেওয়া হল।

প্রবন্ধমনুষ্য ফল
গ্রন্থকমলাকান্তের দপ্তর
রচনাবঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
প্রকাশিতবঙ্গদর্শন
মনুষ্য ফল

Table of Contents

মনুষ্য ফল প্রবন্ধ হতে প্রশ্ন ও উত্তর

Bengali B.A.(General) প্রবন্ধ মনুষ্য ফল হতে প্রশ্ন ও উত্তর।


প্রবন্ধ মনুষ্য ফল হতে প্রশ্ন মান – ২

১। মনুষ্যফল প্রবন্ধটি কোন গ্রন্থের অন্তর্গত? এটি কখন কোন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়?

‘কমলাকান্তের দপ্তর’ গ্রন্থের অন্তর্গত। ১৮৭৩ খ্রী: বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায়।

২। ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ গ্রন্থটি কাকে উৎসর্গ করা হয়েছে ? 

শ্রীযুক্ত বাবু রামদাস সেন মহাশয়কে

৩। “আফিমের একটু বেশি মাত্রা চড়াইলে “— কোন প্রবন্ধের অংশ এই অবস্থায় বক্তা মানুষদের কী মনে করতেন ?

  • উদ্ধৃত অংশটি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ গ্রন্থের অন্তর্গত ‘মনুষ্যফল’ প্রবন্ধ থেকে নেওয়া হয়েছে।
  • আফিমের মাত্রা বেশি হলে বক্তা কমলাকান্তের মনে হত মানুষেরা যেন ফল বিশেষ।

৪। ‘মনুষ্যফল’ প্রবন্ধের লেখক মানুষকে কীসের সাথে তুলনা করেছেন এবং কে ?

  • ‘মনুষ্যফল’ প্রবন্ধের লেখক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মানুষকে বিভিন্ন প্রকার ফলের সাথে তুলনা করেছেন।
  • ফলের মতোই মানুষ মায়াবৃন্তে সংসার বৃক্ষে ঝুলে থাকে, আবার পাকলে পড়ে যায়। অনেকে পাকতে না পেয়ে অকালে ঝরে যায়। অর্থাৎ সংসার বৃক্ষে মনুষ্যরূপ ফলের জন্ম শুধু পরিনামে মৃত্যুবরণের জন্য।

৫। কাদের মনুষ্য জন্ম সার্থক ?

প্রাবন্ধিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতে কোনো কোনো ফল সুপক্ক হলে গঙ্গাজলে ধুয়ে তাকে দেব সেবায় বা ব্রাহ্মণ ভোজনে দেওয়া হয়। সেই সব ফলের জন্ম সার্থক, তেমনি যারা দেশের স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে দেশ মাতৃকার জীবন উৎসর্গ করে তাদের মনুষ্য জীবন সার্থক।

৬। কাদের মনুষ্যজন্ম বৃথা?

প্রাবন্ধিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতে কোনো কোনো ফল পোকায় খায়, কোনোটা শুকিয়ে ঝরে পড়ে যায়, আবার কোনোটা মাটিতে পড়ে গেলে শিয়ালে খায়। এই সব ফলের জন্ম বৃথা। তেমনি যারা সাফল্য অর্জন করেও ধূর্ত, স্বার্থবাদী লোকের পাল্লায় পড়ে নিজেদের জীবনের উদ্দেশ্য ভুলে যায়, সেই সব ব্যক্তির মনুষ্য জন্ম বৃথা।

৭। কমলাকান্ত দেশের বড়ো মানুষদের কোন ফলের সাথে তুলনা করেছেন এবং কেন? 

  • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘মনুষ্য ফল’ প্রবন্ধে কমলাকান্ত দেশের বড়ো মানুষদের কাঁঠালের সাথে তুলনা করেছেন।
  • কমলাকান্ত লক্ষ্য করেছেন সমাজের কোনো কোনো মানুষ রসালো খাজা কাঁঠালের মতো উত্তম। কোনো কোনো মানুষ বড়ো হলেও তাদের মধ্যে অসারত্বর ভাব বেশি। কারোর আবার বাইরের সাজ-সজ্জায় সার – সমাজের মানুষের কোনো উপকারেই লাগে না। তাই কমলাকান্তের এই রূপ উক্তি।

৮। “যদি পাকিল তো বড়ো শৃগালের দৌরাত্ম” – কোন প্রবন্ধের অংশ ? কাদের কেন শৃগাল বলা হয়েছে ? 

  • আলোচ্য অংশটি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘মনুষ্যফল’ প্রবন্ধ থেকে গৃহীত।
  • আলোচ্য অংশে শৃগাল বলতে দেওয়ান, কারকুন, গোমস্তা নায়েব, মোসাহের এবং আশীর্বাদকদের বোঝানো হয়েছে। সমাজে একশ্রেণীর মানুষ আছে যারা কর্মসূত্রে কোনো না কোনো ভাবে ধনী ব্যাক্তিদের কাছ থেকে অর্থ শোষণ করার জন্য সর্বদায় উৎসুক হয়ে থাকে। প্রাবন্ধিক তাদেরই এখানে শৃগাল বলে কল্পনা করেছেন।

৯। “তারা কেবল একটু রসের প্রত্যাশাপন্ন” – তারা কারা? অংশটির তাৎপর্য কি? 

  • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘মনুষ্যফল’ প্রবন্ধের আলোচ্য অংশে তারা হল কন্যা দায়গ্রস্ত বা মাতৃ দায়গ্রস্ত ব্যাক্তি, পুস্তক লেখক, সংবাদ পত্র প্রকাশক দরিদ্র টোল পণ্ডিত প্রাভৃতি সাহায্য প্রার্থী।
  • আলোচ্য অংশে প্রাবন্ধিক ধনী ব্যক্তিদের কাঁঠালের সাথে তুলনা করতে গিয়ে বলেছেন কাঁঠাল পাকলে মাছিরা যেমন তার থেকে রস সংগ্রহের জন্য ভনভন করে, তেমনি এক শ্রেণীর মানুষ আছে যারা সামান্য অর্থ আহায্যের প্রতাশায় ধনী ব্যক্তিদের আশে পাশে ঘুরে বেড়ায়।

১০। কমলাকান্ত সিভিল সার্ভিস সাহেবদের কোন ফলের সাথে তুলনা করেছেন এবং কেন ?

  • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘মনুষ্যফল’ প্রবন্ধে কমলাকান্ত সিভিল সার্ভিস সাহেবদের আমের সাথে তুলনা করেছেন
  • আম এদেশের ফল নয় বলে মনে করা হয়। কেউ কেউ অনুমাণ করেন যে, পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ থেকে থেকে আম ভারতে আসে। ভারতে ইংরেজদের আগমনের পর দেশে ঐ প্রকার চাকুরি এবং তার জন্য সাহেবদেরও আগমন ঘটেছে বলে মনে করা হয়। তাই এরূপ উক্তি করা হয়েছে।

১১। ‘মনুষ্যফল’ প্রবন্ধের প্রাবন্ধিক আমের কি কি শ্রেণিবিভাগ করেছেন ?

  • মনুষ্য ফল প্রবন্ধের প্রাবন্ধিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আমের বিভিন্ন শ্রেণীবিভাগ করেছেন। তিনি মনে করেন কোনো কোনো আম কাঁচায় বড়ো টক, পাকলে মিষ্টি হলেও টক ভাব থেকে যায়। এখানে তিনি ব্রিটিশ কর্মচারীদের আচরণ প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন।
  • প্রাবন্ধিকের মতে কোনো কোনো আম কাঁচা-মিঠে হয়। অর্থাৎ কোনো কোনো কর্মচারীর আচরণ ভালো হলেও পরবর্তী কালে তা খারাপ হয়ে যায়।
  • একপ্রকার আম আছে যাদের দেখতে রাঙা এবং বেশি দামে বিক্রি হয়। অর্থাৎ এমন অনেক রাজকর্মচারী আছে যারা অকর্মণ্য হলেও বাহ্য আড়ম্বরের জন্য উচ্চপদে নিযুক্ত হয় এবং প্রতিপত্তি লাভ করে।

১২। “সদ্য গাছ হইতে পাড়িয়া এই ফল খাইতে নাই ” – কোন ফলের কথা এখানে বলা হয়েছে ? এই ফলকে খাওয়ার জন্য লেখক কী পদ্ধতি বের করেছেন ?

  • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘মনুষ্যফল’ প্রবন্ধের আলোচ্য অংশে আমের কথা বলা হয়েছে।
  • প্রাবন্ধিক বলেছেন আমকে পেড়ে সঙ্গে সঙ্গে খেতে নেই। তাকে সেলাম জলে ফেলে খোসামোদ রূপ বরফ দিয়ে ঠাণ্ডা করে খেতে হয়। অর্থাৎ তিনি সিভিল সার্ভিসের সাহেবদের তোষামোদ লুব্ধতার প্রতি কটাক্ষ করেছেন।

১৩। “কমলাকান্ত কখনও সে অপরাধে অপরাধী নয়” – কোন অপরাধের কথা বলা হয়েছে ? কমলাকান্ত কেন সেই অপরাধে অপরাধী নয় ? 

  • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘মনুষ্যফল’ প্রবন্ধের আলোচ্য অংশে কুলীন ব্রাহ্মণদের বহুবিবাহ করাকে অপরাধ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।
  • কমলাকান্ত কুলীন ব্রাহ্মণ হলেও বিবাহ করেন নি, তাই তিনি এই অপরাধে অপরাধী নন।

১৪। নারিকেলের চারটি সামগ্রী কী কী ? তার সঙ্গে রমণীর কোন কোন বৈশিষ্ট্যের সাদৃশ্য দেখানো হয়েছে ?

  • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘মনুষ্যফল’ প্রবন্ধে কমলাকান্ত নারিকেলের চারটি সামগ্রীর কথা বলেছেন। এগুলি হল জল, শস্য, মালা, ও ছোবড়া।
  • নারিকেলের জল হল স্ত্রীলোকের স্নেহ, শস্য হল স্ত্রীলোকের বুদ্ধি, মালা হল স্ত্রীলোকের বিদ্যা এবং ছোবড়া হল স্ত্রী লোকের রূপ।

১৫। কমলাকান্ত স্ত্রী জাতির স্নেহের সাথে কীসের তুলনা করেছেন এবং কেন ?

  • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘মনুষ্যফল’ প্রবন্ধে কমলাকান্ত নারী জাতির স্নেহের সাথে নারিকেলের জলের তুলনা করেছেন।
  • নারী জাতির স্নেহ নারকেলের জলের মতো স্নিগ্ধ। সংসারের যত জ্বালা-যন্ত্রণা দূর করতে পারে নারীর স্নেহ। গ্ৰীষ্মের তাপে ডাবের জলের মতো যেমন আর কিছু নেই, তেমনি সংসারের তাপে পুরুষের কাছে মাতা, কন্যা, ভগিনী রূপী নারীর স্নেহের মতো আর কিছু নেই। 

১৬। কমলাকান্ত নারকেলের শস্যের সাথে কার সাদৃশ্য পেয়েছে এবং কেন ?

  • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘মনুষ্যফল’ প্রবন্ধে কমলাকান্ত নারকেলের শস্যের সাথে স্ত্রী জাতির বুদ্ধির সাদৃশ্য পেয়েছেন।
  • নারকেলের শস্য যেমন করকচি বেলায় বেশি থাকে না, ভাবের অবস্থায় মিষ্টি ও বড়ো কোমল হয়। আবার ঝুনো হলে কঠিন হয়ে যায়। একই রকম ভাবে স্ত্রীলোকের বুদ্ধি অল্প বয়সে কোমল থাকে, বয়স্ক হলে কঠিন হয়ে যায়। তাই গৃহিনীরা সর্বদা কঠিন হয়।

১৭। “কখনো আধখানা বৈ পুরা দেখতে পাইলাম না” – কীসের কথা বলা হয়েছে এবং কেন ?

  • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘মনুষ্যফল’ প্রবন্ধের আলোচ্য অংশে কমলাকান্ত স্ত্রী জাতির শিক্ষা বা  বিদ্যার সঙ্গে নারকেলের মালার তুলনা করতে গিয়ে এই কথা বলেছেন।
  • কমলাকান্ত লক্ষ্য করেছেন স্ত্রী জাতির শিক্ষা বা বিদ্যা সর্বদাই অর্ধেক। নারকেলের মালার মতো খুব একটা কাজে লাগে না। আসলে প্রাবন্ধিক বলতে চেয়েছেন যে, স্ত্রী শিক্ষা সেই সময় খুব বেশি পরিণতি লাভ করেনি।

১৮। কমলাকান্ত নারীর রূপ-কে কীসের সাথে তুলনা করেছেন এবং কেন?

  • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘মনুষ্যফল’ প্রবন্ধে কমলাকান্ত নারীর রূপকে নারকেলের ছোবড়ার সাথে তুলনা করেছেন।
  • নারকেলের ছোবড়া এবং স্ত্রীলোকের রূপ দুইই বাইরের অংশ ও অত্যন্ত অসার। ছোবড়া দিয়ে দড়ি তৈরি হয়, যাতে জাহাজ বাঁধা যায়। তেমনি স্ত্রীলোকের রূপ নামক দড়ির টানে নানা মানুষের হৃদয় জাহাজকেও বাঁধা যায়। ছোবড়া থেকে তৈরি দড়ির সাহায্যে অনেকে আত্মহত্যা করে, তেমনি নারীর রূপে লুব্ধ হয়েও অনেকে আত্মহত্যা করে।

১৯। “এদেশে এক জাতির লোক সম্প্রতি দেখা দিয়েছে ” – এখানে কাদের কথা বলা হয়েছে ? তাদের কীসের সাথে তুলনা করা হয়েছে? 

  • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাঠায় রচিত ‘মনুষ্যফল’ প্রবন্ধের আলোচ্য অংশে দেশ হিতৈষী নামে খ্যাত ব্যক্তিদের কথা বলা হয়েছে।
  • কমলাকান্ত দেশ হিতৈষীদের শিমুল ফুলের সাথে তুলনা করেছেন। পত্রহীন শিমুল গাছে ফুল যেমন দৃষ্টিকটু, তেমনি তথাকথিত দেশ হিতৈষীদের বাকচাতুর্যও দৃষ্টিকটু। কথার সঙ্গে তাদের কাজের সামঞ্জস্য নেই। শিমুল ফুল ফেটে চারিদিকে তুলো যেমন ছড়িয়ে পড়ে, তেমনি এই সব দেশ হিতৈষীরা বাক্যের তুবড়ি সৃষ্টি করেন। কিন্তু সেই বাক্যের কোন ভিত্তি থাকে না।

২০। কমলাকান্ত ধুতুরা ফলের সাথে কাদের তুলনা করেছেন এবং কেন?

  • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘মনুষ্যফল’ প্রবন্ধে কমলাকান্ত ধুতুরা ফলের সঙ্গে অধ্যাপক ব্রাহ্মণদের তুলনা করেছেন।
  • অধ্যাপক ব্রাহ্মণগণ কথায় সুপণ্ডিত হলেও ধুতুরা ফলের মতো কান্টকময়। সংস্কৃত ব্যাকরণের কাঁটার আঘাতে তারা জীবন অতিষ্ট করে তোলেন। ধুতুরার ফলের মতো তারা তাদের শাস্ত্রীয় বচন আবৃত্তির মাধ্যমে মানুষকে সহজেই আকৃষ্ট করে তোলেন।

২১। “এই নেশায় বঙ্গদেশ আজিকালি মাতিয়া উঠিয়াছে ” – উক্তিটির তাৎপর্য কি?

কমলাকান্ত রূপী বঙ্কিমচন্দ্র ‘মনুষ্যফল’ প্রবন্ধে ধুতুরা ফলের সঙ্গে অধ্যাপকগণের তুলনা করেছেন। তাঁর মতে সেই সময়ের লেখকরা তাদের লেখাকে আরো বেশি আকর্ষণীয় করার জন্য ধুতুরার বীজের ন্যায় সংস্কৃত শাস্ত্রের বচন, শ্লোকাদি উদ্ধৃত করে লেখার আড়ম্বর সৃষ্টি করতেন।

২২। কমলাকান্ত আমাদের দেশের লেখকদের কীসের সাথে তুলনা করেছেন এবং কেন কেন?

  • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘মনুষ্যফল’ প্রবন্ধে কমলাকান্ত আমাদের দেশের লেখকদের তেঁতুলের সাথে তুলনা করেছেন
  • তেঁতুলের নিজ সম্পত্তি বলতে যেমন খোলা আর সিটে, তেমনি এদেশের লেখকদের রচনা আমার, ও পাঠকের অরুচিকর। দুধের সঙ্গে তেঁতুল মিশলে দুই যেমন দইয়ে পরিণত হয় তেমনি কোন ভাল বিষয় অবলম্বন করলেও তারা তাদের দেয়। গুণের অনুপস্থির জন্য তাকে মন্দ করে

২৩। কমলাকান্ত কোন ফলের কথা বলতে গিয়ে দু-জন রাঁধুনির কথা বলেছেন ? রাঁধুনি দ্বয়ের নাম কী ? কার রান্নাকে ভালো বলা হয়েছে ?

  • কমলাকান্ত তেঁতুল ফল অর্থাৎ লেখকদের কথা বলতে গিয়ে দু-জন রাঁধুনির নাম করেছেন।
  • আলোচ্য প্রবন্ধে উল্লিখিত রাঁধুনি দু-জন হলেন ফয়জু নেড়ে ও পদীপিসি। 
  • কমলাকান্ত রূপী বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতে ফয়জু জাতিতে নেড়ে হলেও রাঁধে অমৃত।

২৪। কমলাকান্ত হাকিমদের কোন ফলের সাথে তুলনা করেছেন এবং কেন? 

  • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘মনুষ্যফল’ প্রবন্ধে কমলাকান্ত হাকিমদের কুমড়োর সাথে তুলনা করেছেন।
  • কুমড়োকে যদি মাটি থেকে তুলে চালে না রাখা হয় তাহলে মাটিতেই গড়াগড়ি খায়। তেমনি হাকিমরা যদি তাদের কার্যে সাফল্য দেখাতে না পারে তাহলে তাদের অবস্থাও এই কুমড়োর মতোই হয়।

২৫। কমলাকান্তের পদবী কী? তিনি নিজেকে কোন ফল বলেছেন?

  • কমলাকান্তের পদবী হল চক্রবর্তী।
  • কমলাকান্ত নিজেকে সংসার বৃক্ষে সবথেকে অকর্মণ্য, কদর্য্য, টক ফল বলেছেন। কিন্তু নির্দিষ্ট করে কোনো ফলের নাম বলেননি।

২৬। ‘মনুষ্যফল’ প্রবন্ধে কটি ফলের উল্লেখ আছে ? কোন ফলের সাথে কোন শ্রেণীর মানুষের তুলনা করা হয়েছে ?

‘মনুষ্যফল’ প্রবন্ধে আটটি ফলের কথা আছে।

কাঁঠাল’     সমাজের বড়ো মানুষরা 
‘আম’ সিভিল সার্ভিসের সাহেবরা
‘কলা’ ও নারিকেল’  নারী জাতি,
‘শিমুল’দেশ হিতৈষীগণ 
তেতুল দেশী লেখকগণ
কুমড়ো দেশী হাকিমগণ
অকর্মণ্য, কদর্য, টকফল কমলাকান্ত চক্রবর্তী
মনুষ্যফল’ প্রবন্ধে আটটি ফল

প্রবন্ধ মনুষ্য ফল হতে প্রশ্ন মান – ৫

১। কমলাকান্ত আমের সাথে কাদের তুলনা করেছেন এবং কেন ?

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘মনুষ্যফল’ প্রবন্ধে কমলাকান্ত আফিমের মাত্রা চড়িয়ে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সাথে বিভিন্ন ফলের তুলনা করেছেন। সেই সূত্রে দেশীয় সিভিল সার্ভিসদের আম্র ফল অর্থাৎ আমের সাথে তুলনা করেছেন।

“মনুষ্যফল’ প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্রের উদ্দেশ্য হল রকমারি ফলের সঙ্গে বিভিন্ন মানুষের জীবন ও কার্যকলাপের উপর আলোক পাত করে তার যথার্থ বিশ্লেষণ। এই বিশ্লেষণের সূত্র ধরেই তিনি আমাদের দেশের সিভিল সার্ভিস সাহেবদের আম্র ফলের সাথে তুলনা করেছেন। তার কারণ প্রসঙ্গে বলেছেন সাহেবরা এবং আম উভয়েই সাগর পার থেকে এসেছে। উভয়েরই বাহ্য রূপ ও আড়ম্বর চোখে পড়ার মতো। আম দেখতে যেমন লাল লাল, তেমনি সিভিল সার্ভিসের সাহেবদেরও দেখতে সুন্দর।

আমের মধ্যে কোনোটা অতি মিষ্ট, কোনোটা কাঁচায় টক কিন্তু পাকলে মিষ্টি, কোনোটা আবার জাত টক। একই ভাবে দেশের সিভিল সার্ভিস মানুষদের মধ্যে কেউ কেউ অত্যন্ত ভালো, কেউ প্রথম বয়সে উগ্র হলেও পরিণত বয়সে ভদ্র আচরণ করে থাকেন, কেউ আবার পড়াশোনা করেও অশিক্ষিতের মতো আচরণ করে থাকে। 

আম পেড়েই খেতে নেই, তাকে রেখে দিয়ে শীতল করে খেতে হয় তবেই তার মিষ্টতা প্রকাশ পায়। একইভাবে সিভিল সার্ভিসের সাহেবদের প্রথমে গ্রহণ না করে তোষামোদ করে গ্রহণ করাই শ্রেয়। এই কারণেই প্রাবন্ধিকের এই ধরনের তুলনা।

২। আমাদের দেশের বড়ো মানুষদের কাঁঠাল ফলের সঙ্গে তুলনা করা কতখানি সার্থক হয়েছে তা আলোচনা করো।

‘মনুষ্যফল’ প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সংসারের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষকে বিভিন্ন ফলের সঙ্গে উপমিত করে তাদের স্বভাব পরিচয় ফুটিয়ে তুলবার চেষ্টা করেছেন। সেদিক থেকে কাঁঠালের সঙ্গে বড়ো মানুষদের তুলনা খুবই সার্থক।

কাঁঠালের অনেকগুলি পর্যায়। মুচি অবস্থায় সংখ্যায় থাকে অগণিত। পরে যত পরিণত হয় সংখ্যা তত কমে। সব কাঁঠাল একরকমের হয় না। কিছু এঁচোড়েই থাকে পাকে না – এগুলি ডালনা রেঁধে খাওয়া হয়। কিছু কাঁঠাল গাছেই থাকে, তখন শিয়ালের উপদ্রব হয়। আবার কিছু ঘরে পাকানো হয়, তখন মাছির উপদ্রব হয়। যথার্থ দেবসেবায় খুব কম কাঁঠালই লাগে।

সমাজের বড়ো মানুষরাও এই কাঁঠালের মতোই। অসংখ্য সন্তানের মধ্যে অনেককে এঁচোড়ে ডালনা রেঁধে ফেলতো এক শ্রেণীর মেয়েরা। যারা পাকবার সুযোগ পেত তাদের চারপাশে ঘুরঘুর করতো নানারকমের শৃগাল ও মাছি। দেওয়ান, কারকুন, নায়েব, গোমস্তা ইত্যাদি কত রকমের মাছি একটু রস পাবার বা স্বার্থ গোছাবার জন্য বড়ো মানুষের চারপাশে ঘুরঘুর করবেই। প্রাবন্ধিকের মতে এদেশের বহু বড়ো মানুষের সম্পদ পাকা কাঁঠালের রসের মতোই দেবসেবা বা ব্রাহ্মণ সেবার কাজে লাগে না। তাই বলা যায় কাঁঠালের সঙ্গে ধনবান মানুষেদের এই তুলনার মধ্য দিয়ে প্রাবন্ধিক বাস্তব সত্যকে ব্যক্ত করেছেন।

৩। “তাহাদের আমি শিমুল ফুল ভাবি” – তাহাদের বলতে কাদের বোঝানো হয়েছে ? শিমুল ফুলের সঙ্গে তাহাদের তুলনা করার কারণ কী?

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাঠায় রচিত ‘মনুষ্যফল’ প্রবন্ধের আলোচ্য অংশে ‘তাহাদের’ বলতে তথাকথিত দেশহিতৈষীদের, যারা দেশের হিত সাধনের জন্য সাড়ম্বরে প্রচার করে থাকেন তাদের বোঝানো হয়েছে।

কমলাকান্তের আড়ালে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষদের বিভিন্ন ফলের সঙ্গে উপমিত করে তাদের স্বভাবকে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন। সেই প্রসঙ্গেই তিনি দেশহিতৈষীদের উপমিত করেছেন শিমুল ফুলের সঙ্গে। এই উপমা খুবই তাৎপর্ণপূর্ণ। কারণ, শিমুল ফুল বড়ো বড়ো রাঙা রাঙা হয় এবং দূর থেকে সহজেই নজরে পড়ে, কিন্তু ফুলের বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ সুগন্ধ, কোমলতা, সৈন্দর্য্য কিছুই নেই। শিমুল ফলও অন্তর্লঘু। চৈত্র মাসে যখন ফাটে দেশময় তুলো ছড়িয়ে মানুষের বিরক্তি বাড়ায়, কিছু উপকার করতে পারে না।

শিমুল ফুল ও ফলের মতোই দেশহিতৈষীরাও তাদের কাজের বিজ্ঞাপন বা প্রচার সাড়ম্বরেই করেন। কিন্তু মানুষের প্রকৃত হিত সাধনের মানসিকতা ও ক্ষমতা তাদের নেই। খবরের কাগজে লিখে, সভা-সমিতিতে বক্তৃতা দিয়ে হিত সাধন হয় না। বাকচাতুর্যে আমাদের মুগ্ধ করলেও এদের না আছে দেশভক্তি, না আছে স্বজাতি প্রীতি। তাৎপর্য পূর্ণ হয়েছে।

৪। নারকেলের চারটি সামগ্ৰীর সাথে বঙ্কিমচন্দ্র স্ত্রীলোকের কোন কোন গুণের তুলনা করেছেন এবং কেন?

‘মনুষফল’ প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নারকেলের চারটি সমগ্রী – জল, শস, মালা ও ছোবড়ার সাথে স্ত্রী লোকের স্নেহ, বুদ্ধি, বিদ্যা ও রূপের তুলনা করেছেন।

স্ত্রী-জাতির স্নেহ নারকেলের জলের মতো স্নিগ্ধ। সংসারে যত জ্বালা-যন্ত্রণা দূর করতে পারে নারীর স্নেহ। রোগ, শোক, অশান্তি সব কিছুই এই স্নিগ্ধ স্নেহের পরশেই দূর হয়ে যায়।

কমলাকান্ত নারকেলের শস্যের সাথে স্ত্রী-জাতির বুদ্ধির সাদৃশ্য পেয়েছেন। নারকেলের শস্য করকচি বেলায় বেশি থাকে না, ডাবের অবস্থায় মিষ্টি ও বড়ো কোমল হয়, কিন্তু ঝুনো হলে কঠিন হয়ে যায়। একইরকম ভাবে স্ত্রী লোকের বুদ্ধিও অল্প বয়সে কোমল থাকে, কিন্তু বয়সকালে কঠিন হয়ে যায়।

কমলাকান্ত স্ত্রী জাতির শিক্ষা বা বিদ্যার সঙ্গে নারকেলের মালার তুলনা করেছেন। তিনি লক্ষ্য করেছেন যে, স্ত্রী জাতির শিক্ষা বা বিদ্যা বস্তুটি সর্বদায় অর্ধেক, নারকেলের মালার মতোই খুব একটা কাজে লাগেনা। 

কমলাকান্ত নারীর রূপকে নারকেলের ছোবড়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন। নারকেলের ছোবড়া এবং স্ত্রী জাতির রূপ উভয়ই বাহ্যিক অংশ এবং অত্যন্ত অসার। ছোবড়া দিয়ে তৈরি দড়ি জাহাজ বাঁধতে কাজে লাগে, তেমনি স্ত্রীলোকের রূপের দড়িতেও অনেক হৃদয় জাহাজ বাঁধা যায়। আবার নারীর রূপে মুগ্ধ হয়ে অনেকে আত্মহত্যাও করেছে।

৫। “সকলগুলি পাকিতে পায় না – কতক অকালে ঝরিয়া পড়ে” – উৎস নির্দেশ করো। এখানে কীসের কথা বলা হয়েছে? লেখক অকালে ঝরে পড়ার কী কী কারণ দেখিয়েছেন?

উদ্ধৃত অংশটি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ গ্ৰন্থের অন্তর্গত ‘মনুষ্য ফল’ নামক প্রবন্ধ থেকে গৃহীত হয়েছে।

আলোচ্য অংশে সামাজিক অসফল মানুষদের কথা বলা হয়েছে। 

ফল যেমন অকালে ঝরে পড়ে তেমনি মানুষেরও জীবন অসফলতা ক্লিষ্ট হয়। সেই প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে লেখক গাছের ফলের রূপকের ব্যবহার করেছেন। ফলের অকালে ঝরে পড়ার যে সমস্ত কারণ দেখিয়েছেন সেই কারণগুলিই একজন মানুষের সাফল্যের অন্তরায় হিসেবে দেখা যায়। যেমন কোনোটিকে পোকায় খায়, কোনোটিকে পাখিতে ঠোকরায়, কোনোটা শুকিয়ে আপনি ঝরে পড়ে। 

মানুষের অসাফল্যের মধ্যেও ফলের অনুরূপ দৃশ্যই দেখা যায়। কোনো মানুষের মাথায় কুচিন্তা ঢুকিয়ে স্বাভাবিক সাফল্যের পথ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। কোনো মানুষের ওপর প্রত্যাশার চাপ বাড়িয়ে তাকে নষ্ট করা হয়। কেউ আবার নিজের দোষে নিজেকে নষ্ট করে ফেলে। এই রকম আরো অনেক কারণে একজন মানুষ জীবনে সাফল্য অর্জন করতে পারে না।

৬। “ছোবড়া, স্ত্রীলোকের রূপ” – উক্তিটি কার? এই কথার সাপেক্ষে বক্তা কী যুক্তি দেখিয়েছেন?

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ গ্ৰন্থের অন্তর্গত ‘মনুষ্য ফল’ নামক প্রবন্ধের আলোচ্য উক্তিটি কমলাকান্ত চক্রবর্তীর।

আলোচ্য প্রবন্ধে কমলাকান্ত চক্রবর্তী নারিকেলের সঙ্গে স্ত্রীলোকদের তুলনা করতে গিয়ে এই কথা বলেছিলেন। তাঁর মতে স্ত্রীলোকের রূপ নারিকেলের ছোবড়ার মতোই বাইরের সামগ্রী। নারিকেলের ছোবড়া যেমন কচি অবস্থায় চমৎকার নয়ন মনোহর, স্ত্রীলোকেরও তেমনি কৈশোরের রূপ অত্যন্ত লাবণ্যময়। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে নারিকেল যখন ঝুনো হয়, তখন তার ছোবড়ার মধ্যে যেমন শুষ্ক ভাব লক্ষ্য করা যায়, স্ত্রীলোকের রূপের ক্ষেত্রেও তাই। তাছাড়া নারিকেলের ছোবড়া আর স্ত্রীলোকের রূপ দুইই অসার বস্তু। তাকে অতিক্রম করে তবেই সারবস্তুর সন্ধান পাওয়া যায়।

৭। “যদি এ সকলের হাত এড়াইয়া, পাকা কাঁঠাল ঘরে গেল তবে মাছি ভন ভন করিতে আরম্ভ করিল।” – ‘এ সকল’ বলতে লেখক কী বুঝিয়েছেন তা লেখো।

‘মনুষ্য ফল’ প্রবন্ধে কমলাকান্তের বেনামীতে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষকে বিভিন্ন জাতীয় ফল বলে মনে করেছেন। তারা যেন সংসারোদ্যানের মায়াবৃন্তে ফলের মতোই ঝুলছে এবং একই পরিণতি প্রাপ্ত হচ্ছে। আলোচ্য অংশে তিনি সংসারের ধনী ব্যক্তিদের ‘কাঁঠাল’ বলে মেনে নিয়েছেন। কাঁঠালের যেমন বিভিন্ন অবস্থা এবং কোনো অবস্থাতেই যথোপযুক্ত সংরক্ষণের ব্যবস্থা না করলে পরিত্রাণের কোন উপায় নেই সংসারে ধনী ব্যক্তিদেরও সেই অবস্থা। 

ইঁচড় অবস্থাতেও কাঠাল লোভী মানুষের হাত থেকে নিস্তার পায় না, অল্পবয়সী ধনীদেরও তেমনি কুসঙ্গী জোটে এবং তারা তাকে সর্বপ্রকার শোষণ করে নিতে চায়। যদি এদের হাত এড়িয়ে কাঁঠাল কোনক্রমে পাকাবার সুযোগ পায়, তা হলেও তার নিস্তার নেই। একমাত্র যদি গাছঘেরা থাকে অথবা উঁচু ডালে ফলে, তবেই বাঁচবার সুযোগ পায়, নাহলে শিয়ালের পেটে যাবে। ধনীদের ক্ষেত্রেও যদি তারা সদুপদেশ ও উত্তম অভিভাবক দ্বারা বেষ্টিত থাকে অথবা চরিত্রমাহাত্ম্য দ্বারা অনেকটা ঊর্ধ্বলোকে অবস্থান করতে পারে, তবেই রক্ষা, নতুবা শিয়ালরূপী নায়েব, গোমস্তা, মোসাহেব প্রভৃতি ধূর্তরা সর্বস্বান্ত করে ছাড়বে। এই উপদ্রবকে এখানে ‘এ’ সকলের কথা বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

এদের হাত এড়িয়ে যদি কাঁঠাল পাকাবার সুযোগ পায়, তবু তার নিস্তার নেই। পাকা কাঁঠালের গন্ধে মাছি এসে উপস্থিত হয়। মাছি অবশ্য পূর্ব-কথিত উপদ্রবগুলির মতো কাঁঠালকে শেষ করে দেয় না, সে অল্পস্বল্প রসের প্রত্যাশী। মনুষ্যজগতে এই মাছিরা হল সাধারণত অনুগ্রহপ্রার্থী, মাতৃদায়গ্রস্ত, লেখক, সম্পাদক, দূর-সম্পর্কিত আত্মীয় পুত্র, টোলের অধ্যাপক প্রমুখ।

৮। “কাঁচায় বড় টক – পাকিলে সুমিষ্ট বটে, কিন্তু তবু হাড়ে টক যায় না।” – কাদের সম্বন্ধে লেখক এই মন্তব্য করেছেন? এরূপ মন্তব্যের কারণ কী? 

‘মনুষ্য ফল’ প্রবন্ধটিতে লেখক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কমলাকান্ত নামক জনৈক আফিংখোরের জবানিতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মনুষ্যকে বিভিন্ন জাতীয় ফলরূপে বর্ণনা করেছেন। আলোচ্য অংশে তিনি বিলাতি সিভিল সার্ভিসের সাহেবদের সম্বন্ধে বলেছেন।

কমলাকান্ত সাহেবদের সংসারোদ্যানের মায়াবৃন্তে ঝুলন্ত আম্রফল বলে মনে করেন। বঙ্কিমচন্দ্রের যুগে এ দেশে এই বিলাতি সিভিলিয়ানগণই ছিলেন সর্বোচ্চ পদাধিকারী রাজকর্মচারী, অতএব অভিজাত সমাজেও সর্বশ্রেষ্ঠ কুলীনের মর্যাদা তারাই পেতেন। ফলের মধ্যেও আমকেই রাজার মর্যাদা বা শ্রেষ্ঠ ফলের সম্মান দেওয়া হয়, যেমন তার রূপ, তেমনি তার গুণ, অতএব ফলের সঙ্গে সিভিলিয়ানের তুলনা অসমীচীন নয়।

সাধারণভাবেই সুমিষ্ট আমের কাচা অবস্থায় টক ভাব থাকে। এই বিলাতি সিভিলিয়ানদেরও তাই। ইংল্যান্ডের আবহাওয়াজাত এই ইংরেজগণ শিক্ষা-দীক্ষায় মানসিকতায় সম্পূর্ণ ভিন্ন জগতের অধিবাসী। কাজেই এদেশে এসে এখানকার পরিবেশে সহজে মানিয়ে নিতে পারেন না। তদুপরি ভারতীয়গণ তাদের প্রজা। কাজেই ভারতীয়দের সঙ্গে সম্পর্কে অম্লত্ব থাকাই স্বাভাবিক। 

ভালো জাতের আম পাকলে যেমন সুমিষ্ট হয়, ঐ সিভিলিয়ানগণও পরিণত বয়সে তেমনি বুদ্ধিতে, বিচক্ষণতায়, সহয়তা এবং এদেশে বিভিন্ন সৎ কর্মের অনুষ্ঠানেও যথেষ্ট ঔদার্য ও মহত্বের পরিচয় দিয়েছেন। ভারতের বহু প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেই তাঁরা জড়িত ছিলেন। কিন্তু সাধারণভাবে ওদের জাত্যাভিমান বজায় ছিল বলে ভারতীয়দের সঙ্গে একাত্ম হয়ে উঠতে পারেননি – এটিই তাদের আঁটিতে টকত্বের লক্ষণ।

৯। “পক্ষান্তরে কতকগুলি কটুভাষী আছেন তাহারা ফলের মধ্যে মাকাল ফলকেই যুবতীগণের অনুরূপ বলেন। যে বলে, সে দুর্মুখ – আমি ইহাদিগের ভৃত্যস্বরূপ, আমি তাহা বলিব না।” – আলোচ্য অংশটি কোন্ প্রবন্ধ থেকে নেওয়া হয়েছে। প্রসঙ্গসহ উদ্ধৃতিটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।

উদ্ধৃত অংশটি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ গ্ৰন্থের অন্তর্গত ‘মনুষ্য ফল’ নামক প্রবন্ধ থেকে গৃহীত হয়েছে। উদ্ধৃতিটিতে তিনি যুবতীর সঙ্গে মাকাল ফলের তুলনার সাদৃশ্য বিষয়ে তাঁর বক্তব্য বলেছেন।

লোকশ্রুতি অনুযায়ী স্ত্রীজাতিকে কদলীবৃক্ষের সঙ্গে তুলনার একটা প্রথা প্রচলিত থাকলেও তা বক্তার অভিপ্রেত নয়। কারণ, এই দুইয়ের মধ্যে তিনি বড় একটা সাদৃশ্য দেখতে পান না। তাদের মধ্যে সাদৃশ্য যা তিনি লক্ষ্য করেছেন তা হল উভয়েই বানরের প্রিয়। কিন্তু শুধুমাত্র একটি সাদৃশ্যের কারণে স্ত্রীজাতিকে কদলী বলে মনে করা তিনি সঙ্গত বিবেচনা করেন না।

আবার কিছু কিছু লোক আছেন যাদের লেখক কটুভাষী বলে নিন্দা করেন, তারা রমণীকুলমণি যুবতীদের ‘মাকাল ফল’ বলে মনে করে থাকেন। তাদের এই তুলনা যে অসার্থক, লেখক তেমন কথা বলছেন না, শুধু ঐ তুলনাকারীদের দুর্মুখ কটুভাষী বলে ধিক্কার জানিয়েছেন। কিন্তু তাদের এই রূপায়ণে যে লেখক তথা কমলাকান্তের মৌন সম্মতি রয়েছে, তা কিন্তু অনুমান করা চলে। সত্য কথাও অপ্রিয় হলে বলতে নেই। তাই যারা যুবতীদের মাকাল ফলের সঙ্গে উপনিত করে অসাধারণ মুগ্ধ দৃষ্টিশক্তি বিচারবোধের পরিচয় দিয়েছেন, কমলাকান্ত তাদের নিজের গুরু বলে স্বীকার করেছেন। কিন্তু নিজে অপ্রিয় সত্য উচ্চারণ করতে পারেননি। 

মাকাল ফলের সঙ্গে যুবতীর তুলনা দৃশ্যত সার্থক বলেই মেনে নিতে হয়। যুবতীগণ সাধারণত তাদের দেহ সৌন্দর্যেই সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকে। মাকাল ফলেরও রূপের বাহার গর্ব করবার মতোই। কিন্তু মাকাল ফল যেমন অন্তঃসারশূন্য অধিকাংশ যুবতীও তেমনি ভিতর ফোপরা, জ্ঞান-বুদ্ধি বর্জিত। কমলাকান্ত ‘মনুষ্য ফল’ প্রবন্ধে যে সুক্ষ্ম দৃষ্টির সাহায্যে অপরাপর মনুষ্যের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য নিরীক্ষণ করেছেন, তাতে তার দৃষ্টিশক্তিতে যুবতীর অন্তঃসারহীনতা যে সহজেই ধরা পড়েছিল, তা তাঁর মৌন সমর্থন থেকেই অনুমান করা চলে।

১০। “সংসারশিক্ষাশূন্যা কামিনীকে সহসা হৃদয়ে গ্রহণ করিও না – তোমার কলিজা পুড়িয়া যাইবে। আম্রের ন্যায় ডাবকেও বরফ জলে রাখিয়া শীতল করিও – বরফ না জোটে, পুকুরে পাঁকে পুঁতিয়া রাখিয়া ঠাণ্ডা করিও – মিষ্ট কথায় না করিতে পার, কমলাকান্ত চক্রবর্তীর আড্ডা, কড়া কথায় করিও।” – নারীজাতি সম্পর্কে লেখকের সতর্কতা সম্বন্ধীয় প্রতিবিধানটি সংক্ষেপে লেখো।

নারীজাতির বিভিন্ন অবস্থা ভেদে যেমন তার দৈহিক ও মানসিক অবস্থার রূপান্তর ঘটে, তেমনি নারিকেলেরও বিভিন্ন অবস্থায় বিভিন্ন অঙ্গের নানারূপ লক্ষণ প্রকটিত হয়। যেমন কচি ডাবের জলের মতোই নারীস্নেহেরও নানাপ্রকার গুণ বর্ণনা করে অবশেষে লেখক এ বিষয়ে কিছুটা সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। আলোচ্য অংশে সেই সতর্কতা সম্বন্ধীয় প্রতিষেধকটির কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

নারিকেলের জল নিঃসন্দেহে অতিশয় স্নিগ্ধ, তাপিত প্রাণকে তা শীতল করে। কিন্তু কখনোই গাছ থেকে পেড়েই নারিকেলের জল পান করতে নেই। কারণ, তা রৌদ্রতাপে কিছুটা উত্তপ্ত থাকায় তা তৃষ্ণা নিবারণের কিংবা মানসিক তৃপ্তি বিধানের সহায়ক হয় না। তাকে স্নিগ্ধ করবার জন্য কমলাকান্ত বিধান দিয়েছেন যে, গাছ থেকে ডাব পেড়ে, যেমন আমের ক্ষেত্রে, তেমনি ডাবের ক্ষেত্রেও, তাকে বরফ-জলে কিছুক্ষণ ভিজিয়ে রেখে শীতল করে নিতে হয়। যদি বরফ জোগাড় করা সম্ভব না হয়, তাহলে ভাবকে পাঁকের মধ্যে ঠেসে দিতে হয়, তাহলেই তা শীতল হয়ে ব্যবহারোপযোগী হয়।

নারিকেলকে এখানে নারীর রূপকে যেমন ব্যবহার করা হয়েছে, তেমনি তার জল ব্যবহারের জন্য যে প্রয়োগবিধির কথা বলা হয়েছে, তাও নারীস্নেহের ব্যবহারবিধিরই বিভিন্ন রূপ মাত্র। নারীকে জীবনে গ্রহণ করতেই হয়, কিন্তু তাকে সংসার জীবনের পক্ষে যথোপযোগীভাবে শিক্ষিত করে নিয়ে তবে তাকে গ্রহণ করতে হয়। সদ্য গাছ থেকে পাড়া নারিকেলের জলে যেমন ভিতরে জ্বালা ধরায়, তেমনি সংসার-জ্ঞানশূন্যা নারী অত্যধিক প্রশ্রয় লাভ করলে, সে অন্তরে শুধু জ্বালাই সৃষ্টি করবে। প্রথম প্রথম তাকে মিষ্ট ব্যবহার এবং স্নেহদ্বারা বশ করে তাকে সংসার বিষয়ে কিছুটা জ্ঞান দিতে হবে। এটিকেই বরফ জলে ভিজানোর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। কিন্তু অনেক নারী মিষ্ট কথায় তুষ্ট হয় না, বশ মানে না সেক্ষেত্রে স্নেহের পরিবর্তে শাসনের অধীনে আনতে হয়। কড়া কথায় তার রুক্ষ মেজাজ শান্ত করতে হয় – পাঁকে পুতে রাখার এটিই তাৎপর্য।

১১। “যখন তুমি সংসারের রৌদ্রে দগ্ধ হইয়া, হাঁপাইতে হাঁপাইতে, গৃহের ছায়ায় বসিয়া বিশ্রাম কামনা কর, তখন এই শীতল জল পান করিও সকল যন্ত্রণা ভুলিবে। তোমার দারিদ্র্য-চৈত্রে বা বন্ধুবিয়োগ বৈশাখে – তোমার যৌবন-মধ্যাহ্নে বা রোগতপ্ত বৈকালে, আর কিসে তোমার হৃদয় শীতল হইবে?” – উদ্ধৃত অংশটি কোন প্রবন্ধ থেকে নেওয়া হয়েছে? উদ্ধৃত উক্তিতে লেখক ডাবের শীতল জলের সঙ্গে নারীস্নেহের সাদৃশ্য কীভাবে বুঝিয়েছেন তা লেখো।

উদ্ধৃত অংশটি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ গ্ৰন্থের অন্তর্গত ‘মনুষ্য ফল’ নামক প্রবন্ধ থেকে গৃহীত হয়েছে। আলোচ্য অংশটিতে তিনি সুপেয় ডাবের জলের সঙ্গে নারীস্নেহের সাদৃশ্যটুকু সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন। 

এই সংসার এক রণাঙ্গন, এখানে অবিরাম যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হয়। অবিরাম সংগ্রামে দেহমনের যে ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয় তা সম্পূরণের জন্যই দেহমনকে মাঝে মাঝেই সাময়িকভাবে বিশ্রাম দিতে হয়। বাস্তবজীবনে আমরা কর্মক্লান্ত দেহমনের শ্রান্তি দূরীকরণের জন্য ঘরের ছায়ায় বা গাছের নীচে আশ্রয় গ্রহণ করে স্নিগ্ধ ডাবের জল পান করি। এর ফলে দেহমন আবার সজীব হয়ে ওঠে, আবার সংসার সমরাঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়বার সামর্থ্য খুঁজে পাই।

আমাদের জীবনের এই বিশেষ দিকটিতে প্রধানত দেহই প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করে। কিন্তু আমাদের জীবনের আর একটা বড় দিক রয়েছে, যা আমাদের দেহযন্ত্রকে পরিচালনা করে, তা হল আমাদের মনের দিক। মনের দিক থেকেও আমরা নানাভাবে বিধ্বস্ত হচ্ছি। কখনো বা রোগের আক্রমণে, কখনো বা স্বজনবিয়োগ ব্যথায়, কখনো বা আর্থিক অনটনবশত। 

আমরা যখন সন্তপ্তচিত্তে ঘরে ফিরে আসি তখন সেই তাপিত হৃদয়ে শান্তিবারি সেচন করবার দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয় আমাদের মা-বোনদেরই। মায়ের আদর স্নেহ, স্ত্রীর ভালোবাসা, কন্যার শ্রদ্ধা – নারীস্নেহের স্পর্শে চিত্তদাহ প্রশমিত হতে পারে। তাছাড়া পুরুষের তপ্তহৃদয়ে শান্তিবারি সেচনের দ্বিতীয় কোনো উপায় নেই। কাজেই নারিকেলের জলের সঙ্গে নারীস্নেহের উপমাটি অতিশয় সার্থক বলেই মনে হয়।

১২। “করকচি বেলায় বড় থাকে না; ডাবের অবস্থায় বড় সুমিষ্ট, বড় কোমল; ঝুনোর বেলায় বড় কঠিন, দন্তস্ফুট করে কার সাধ্য? তখন ইহাকে গৃহিণীপনা বলে। গৃহিণীপনা রসাল বটে, কিন্তু দাঁত বসে না।” – আলোচ্য অংশে ডাবের বিভিন্ন অবস্থার সঙ্গে লেখক কীভাবে স্ত্রীজাতির বুদ্ধির তুলনা করেছেন তা বুঝিয়ে দাও।

‘মনুষ্য ফল’ প্রবন্ধের আলোচ্য অংশে প্রাবন্ধিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নারিকেলের শস্য বা শাঁস তথা স্ত্রীজাতির বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন। এই উপমাটির বর্ণনায় তিনি অসাধারণ সুক্ষ্ম দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্লেষণ ক্ষমতার চূড়ান্ত সদ্ব্যবহার করেছেন।

ফলের শাঁসই যেমন তার প্রধান সারবস্তু তার গুণাগুণ এবং পরিমাণের উপরই ফলের সার্থকতা ও প্রকৃত মূল্য বোঝা যায়, মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিও তেমনি মান নির্ণয়ের মাপকাঠিরূপে ব্যবহৃত হতে পারে। বস্তুত উভয়ের এই তুলনা-প্রতি-তুলনাটি যথার্থই সার্থক। নারিকেলের শাঁস সর্ব অবস্থায় একপ্রকার থাকে না, যখন তার করকচি ডাব অবস্থা, তখন তার মধ্যে শুধু জলই থাকে, শাঁস প্রায় থাকে না বললে চলে। নারীর বুদ্ধিকে নারিকেলের শাঁসের সঙ্গে তুলনা করার ফলে তাদের ক্ষেত্রেও অবস্থাভেদে এই পার্থক্যের লক্ষণ বিচার করে দেখা প্রয়োজন। নারী যখন কুসুমকোমল বালিকা মাত্র, তখন তারও বুদ্ধিবৃত্তি বিকশিত হবার কথা, করকচি ডাবের মতোই তার মধ্যেও শুধু স্নেহের উপাদান বর্তমান থাকে। 

নারিকেল যখন মধ্য অবস্থায় পৌঁছায় অর্থাৎ, নেয়াপতি ডাবে রূপান্তরিত হয়, তখন তা শাঁসে-জলে পরম আস্বাদ্য হয়ে ওঠে। জল তো তখন সুপেয় বটেই, শাঁসও তখন সর্বাধিক মিষ্টতা লাভ করে, আবার যথেষ্ট কোমলতাও বর্তমান থাকে। নারীও যখন যৌবনে উপনীতা হয়, তখনই তার পরম গৌরবের অবস্থা। যুবতী নারী সর্বতোভাবেই কামনার ধন। তখন তার বুদ্ধি যথেষ্ট বিকশিত হয় অথচ সংসারে জটিলতা-কুটিলতা তখনও তাকে প্যাঁচালো করে তুলতে পারে না। 

নারিকেল যখন ঝুনো অবস্থায় রূপান্তরিত হয়, তখন তা পরিপূর্ণতা লাভ করে বটে, কিন্তু তাতে আর কোমলতা থাকে না। ফলে তাতে দস্তস্ফুট করা কষ্টকর। তবে পরিণত ঝুনো নারিকেলের শাঁসই সর্বাধিক পরিপক্ক এবং পুষ্টিকর হলেও আস্বাদনের পক্ষে খুব সহজ নয়। নারী যখন পরিণত অবস্থায় গৃহিণীতে পরিণত হন, তখন তারও সংসারবুদ্ধিটি হয় তেমনি টনটনে। এতদিন সংসারের ঘাত-প্রতিঘাতে কীভাবে বেঁচে থাকতে হবে, তার কৌশলটি তিনি আয়ত্ত করে ফেলেছেন, কাজেই সহজে তাকে টলানো যায় না। ভবিষ্যতের অবস্থায় বর্তমান সম্বন্ধে তাকে সতর্কভাবে চলতে হয়। অন্তরে তার স্নেহের ধারাটি থাকে লুকায়িত, বাইরে থাকে আপাত কঠিন আবরণ, যেখানে দাঁত ফোটানো সহজ নয়। বস্তুত ভবিষ্যৎ ভেবেই বুদ্ধিমতী গৃহিণীকে এই রসসিক্ততা সত্ত্বেও কাঠিন্যের রূপ বজায় রাখতে হয়। 

অতএব নারিকেলের শাঁসের সঙ্গে নারীবুদ্ধির এই উপমাটি যে সর্বতোভাবেই সার্থক, এটুকু বলেই যথেষ্ট নয়; বক্তব্যটি যে পরিবেশিতও হয়েছে অতিশয় সুরুচিপূর্ণ এবং হৃদয়গ্রাহী ভঙ্গিতে একথাও স্বীকার করে নেওয়া প্রয়োজন।

১৩। “আমি হতভাগা, দুইয়ের এককেও আহরণ করিতে পারিলাম না। অন্য ফল আকর্ষী দিয়া পাড়া যায়, নারিকেল গাছে না উঠিলে পাড়া যায় না। গাছে উঠিতে গেলেও হয় নিজের পায়ে দড়ি বাঁধিতে হইবে, না হয় ডোমের খোশামোদ করিতে হইবে।” – আলোচ্য অংশটি কোন্ প্রবন্ধ থেকে নেওয়া হয়েছে? কমলাকান্তের ভাগ্যে স্ত্রীরত্ন না জোটার কারণ আলোচনা করো।

আলোচ্য অংশটি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘মনুষ্য ফল’ নামক প্রবন্ধ থেকে নেওয়া হয়েছে। 

কমলাকান্তের ভাগ্যে কেন নারিকেল বা নারী কোনটিই জুটলো না, তার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি নারিকেলের কথাটিই শুধু উল্লেখ করেছেন। কিন্তু নারিকেলকেই যেহেতু তিনি নারীর রূপকে ব্যবহার করেছেন, অতএব এর মধ্যে থেকেই আমরা তার প্রকৃত বক্তব্য অর্থাৎ, দার পরিগ্রহ না করার ব্যাপারটা বুঝে নিতে পারি। যে-কোনো ফলই আঁকশির সহায়তায় গাছ থেকে নামিয়ে আনা যায়। কিন্তু নারিকেল সম্বন্ধে এই নিয়ম খাটে না। 

গাছে না উঠলে নারিকেল পাড়া কখনো সম্ভবপর নয়। আবার নারিকেল পাড়তে গেলে হয় স্বয়ং-গাছে উঠতে হবে নতুবা অপর কারো সহায়তা গ্রহণ করতে হয়। সেইক্ষেত্রে গাছে উঠবারও একটা বিশেষ বিধি আছে। দড়ির বেড় পায়ে জড়িয়ে তবেই গাছে ওঠা সম্ভব। আর যদি অপরের সাহায্য গ্রহণ করতে হয়, তবে ডোমজাতীয় নীচ ব্যক্তি ছাড়া অপর কোনো ব্যক্তির সহায়তা পাওয়া যাবে না। কমলাকান্ত পায়ে বেড়ি পরতে যেমন রাজি নন, তেমনি ডোম জাতীয় নীচ ব্যক্তির সহায়তা নিতেও প্রস্তুত নন, অতএব তাঁর ভাগ্যে কোনো দিন নারিকেল জোটেনি।

নারিকেলের রূপক আবরণ উন্মোচন করলেই আমরা কমলাকান্তের নারী সম্পর্কিত দুর্ভাগ্যের কারণটা বুঝতে পারি। তিনি সংসারকে সাধারণভাবে গাছরূপে বর্ণনা করেছেন। অতএব গাছে না উঠলে নারিকেল না পাওয়ার ব্যাপারটিকে এইভাবে ব্যাখ্যা করা চলে যে সংসারে সংসারী হয়ে প্রবেশ না করলে নারীরত্ন প্রাপ্তির কোনো সম্ভাবনা নেই। উদাসীন কমলাকান্ত আপন মনে থাকেন বলে চাকরি বজায় রাখতে পারলেন না। পরের অনুগ্রহেই যার জীবিকা নির্বাহিত হয় তার পক্ষে যে সংসারধর্ম পালন করা সম্ভবপর নয়, তা সহজেই বোঝা যায়। আবার গাছে উঠতে হলেও যে পায়ে বেড়ি পড়তে হয়; সেই সংসারের বন্ধনে স্বেচ্ছায় আবদ্ধ হবার কথা কল্পনা করাও তার পক্ষে অসম্ভব। পক্ষান্তরে, পুরোহিত বা ঘটক প্রভৃতি নীচমন ব্যক্তির সহায়তায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবার মতো মনের ভাব তাঁর নয়। তাই কমলাকান্তের ভাগ্যে স্ত্রীরত্নও জুটলো না।

১৪। “কালক্রমে চৈত্রমাস আসিলে রৌদ্রের তাপে, অন্তর্লঘু ফল ফট করিয়া ফাটিয়া উঠে; তাহার ভিতর হইতে খানিক তুলা বাহির হইয়া বঙ্গদেশময় ছড়াইয়া পড়ে।” – আলোচ্য অংশের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো।

আলোচ্য অংশটি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘মনুষ্য ফল’ নামক প্রবন্ধ থেকে নেওয়া হয়েছে। প্রবন্ধের আলোচ্য অংশটিতে তিনি শিমুল ফুলের পরিণত রূপ অর্থাৎ, শিমুল ফলের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে প্রকৃতপক্ষে দেশহিতৈষীদের বক্তৃতার বক্তব্য বিষয়কে বাস্তবে রূপায়িত করতে অক্ষমতার কথাই বর্ণনা করেছেন। 

বঙ্কিমচন্দ্র যে কালে প্রবন্ধটি রচনা করেন, তখন দেশে নবজাগরণের তরঙ্গ দেখা দিলেও তা তেমন উত্তাল হয়ে উঠতে পারেনি। দেশে শিক্ষাবিস্তারের প্রচেষ্টা চলছে, নারীজাগরণ তখনো দেখা না দিলেও তাদের শিক্ষাদানের জন্য কিছু কিছু বিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে, কিছু কিছু সমাজসংস্কারমূলক কাজও চলছে, স্বদেশী আন্দোলন আরম্ভ না হলেও কারো কারো মধ্যে এই নিয়ে ভাবনা-চিন্তা শুরু হয়েছে। বস্তুত তাদের ভাবনা চিন্তাকে কার্যে রূপায়িত করবার মতো বাস্তব পরিবেশ তৈরি হয়নি। আবার কিছু ছিলেন শুধু বক্তৃতাবাগীশ, তাঁরা বাক্যের ফুলঝুরি ছোটালেও মোটেই কর্মে তৎপর ছিলেন না। এদের সম্বন্ধেই এখানে বলা হয়েছে।

শিমুল ফুলের রং টকটকে লাল, সহজেই মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে। কিন্তু চৈত্রমাসে যখন গাছে ফুল ফোটে, তখন গাছ থাকে নিষ্পত্র। সবুজের আভাহীন এই ন্যাড়া গাছে এমন টকটকে ফুল চোখে বড় লাগে। এই ফুল থেকে ফল হয়, তার বাইরে শক্ত খোলস, ফল পাকলেই খোলস ফেটে যায় এবং ভিতরের বস্তু তুলো হয়ে আকাশে উড়ে যায়, কিছু আর অবশিষ্ট থাকে না। সমকালে দেশে এক ধরনের দেশহিতৈষীর আবির্ভাব ঘটেছিল, যাদের দিব্যদ্রষ্টা আফিংখোর কমলাকান্ত রাঙা শিমুল ফুল ও তার শূন্যগর্ভ ফল বলে মনে করেছেন।

সদ্য-আবির্ভূত দেশহিতৈষীরা শিক্ষিত ছিলেন এবং আধুনিকতার পোশাকের চাকচিক্যে সহজেই শিমুল ফুলের মতো সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারতেন। তাঁরা ছিলেন বচনবাগীশ ও বক্তৃতাপটু। বক্তৃতায় সমাজসংস্কারের কথা বলতেন, দেশোদ্ধারের কথা বলতেন। কিন্তু তার পরিণতি ঘটতো শিমুল ফলেরই মতো। শূন্যগর্ভ এইসব বক্তৃতাকে সুফলপ্রসু করে তোলবার কোনো প্রয়াস তারা পেতেন না। বচনেই তাদের সব কর্মের সমাপ্তি ঘটতো। শিমুল ফুলের শক্ত খোলসটা গাছের নীচে পড়ে থাকে, ভিতরের বস্তু উড়ে যায় – ওদের বক্তৃতাও ফানুশের মতো উড়েই যেতো, সারপদার্থ আর কিছুই পাওয়া যেত না।

১৫। “বোধ হয় এই হিসাবেই বঙ্গীয় লেখকেরা আপনাপন প্রবন্ধের মধ্যে অধ্যাপকদিগের নিকট দুইচারিটা বচন লইয়া গাঁথিয়া দেন। প্রবন্ধ-গাঁজার মধ্যে সেই বচন ধুতুরার বীচিতে পাঠকের নেশা জমাইয়া তোলে।” – লেখক কাদের সম্বন্ধে কেন এরূপ মন্তব্য করেছেন? ‘প্রবন্ধ-গাঁজা’ ও ‘বচন ধুতুরা’ উপমা দুটি দ্বারা লেখক কী বোঝাতে চেয়েছেন?

যে ধুতুরা ফুল থেকে ফলের জন্ম, সেই ফুলগুলি আকারে অতিশয় দীর্ঘ। ফলগুলি বর্তুলাকার এবং তীক্ষ্ণ কন্টকে আবৃত। ফলের মাদকতাগুণ অত্যন্ত বেশি। যে সমস্ত মাদকদ্রব্য মত্ততা সৃষ্টিতে সক্ষম হয় না, তার সঙ্গে ধুতুরার বীজ মিশিয়ে নিলে তার মাদকতাগুণ অবশ্য বৃদ্ধি পাবে। কমলাকান্ত অধ্যাপক ব্রাহ্মণদের রচনার মধ্যে অথবা তাদের রচিত শাস্ত্রীয় বচনের মধ্যে এই ধুতুরা ফল ও ফুলের লক্ষণ দেখতে পেয়েই তাদের উক্ত ফলের সংজ্ঞায় চিহ্নিত করেন।

বঙ্কিম-পূর্ব বাংলা গদ্যসাহিত্যের একটি ধারা প্রধানত ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের দ্বারা পরিস্ফুট হচ্ছিল অথবা তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সংস্কৃতগামী হয়ে উঠছিল। সংস্কৃত সাহিত্যের অনুসরণে তদানীন্তন বাংলা সাহিত্যেও তখন দীর্ঘ সমাসবহুল বাক্যের প্রচলন ছিল। কমলাকান্ত এই দীর্ঘ বচনগুলিকে লম্বা ধুতুরা ফুল বলে মনে করতেন। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতগণ শাস্ত্রব্যবসায়ী। সংস্কৃত ভাষায় রচিত সেই শাস্ত্রে সাধারণ লোক, এমন কী ইংরেজিতে কৃতবিদ্যা পণ্ডিতগণও আয়ত্ত করতে অনেক সময় সক্ষম হন না। সংস্কৃত ভাষার দুরূহতাই এর অন্যতম কারণ বলে মনে করা হয়।

ধুতুরা ফলের বীজ আছে, তাদের মাদকতাগুণের জন্যই এর আকর্ষণ। বঙ্কিম সমকালীন প্রাবন্ধিকগণের অনেকেই যে সমস্ত প্রবন্ধ রচনা করতেন, তাদের মধ্যে সারবস্তু বিশেষ থাকতো না কল্পনার বুদবুদে ঠাসা সেই সমস্ত প্রবন্ধকে কমলাকান্ত গাঁজা বা মাদকতাপূর্ণ অলীক বস্তু বলে মনে করেন। কিন্তু এগুলি পাঠ করেও যদি পাঠকের মনে মত্ততা সৃষ্টি না হয়, এই আশঙ্কায় প্রাবন্ধিকগণ সেই প্রবন্ধে কিছু শাস্ত্রবচন ঢুকিয়ে তার গুরুত্ব বৃদ্ধি করতে চান। শাস্ত্রবচনের বোধগম্যতার প্রয়োজন নেই, এর দর্শন শ্রবণ পঠনেই পাঠকের বুদ্ধিভ্রংশ ঘটতে পারে – এর এমনই গুণ। পাঠক আর তখন যুক্তিতর্কের ধার ধারেন না, বিশ্বাসের আতিশয্যে প্রাবন্ধিকের প্রতি মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েন। অধ্যাপক ব্রাহ্মণদের রচনার সঙ্গে তাই ধুতুরা ফলের সাদৃশ্য অবশ্যস্বীকার্য।

১৬। “পদীপিসি কুলীনের মেয়ে, প্রাতঃস্নান করে, নামাবলী গায়ে দেয়, হাতে তুলসীর মালা কিন্তু রাঁধিবার বেলা কলাইয়ের দাল, আর তেঁতুলের মাছ ছাড়া আর কিছুই রাঁধিতে জানেন না। ফয়জু জাতে নেড়ে, কিন্তু রাঁধে অমৃত।” – আলোচ্য অংশে রূপকের আবরণে লেখকের বক্তব্য পরিস্ফুট করো।

আলোচ্য অংশটি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘মনুষ্য ফল’ নামক প্রবন্ধ থেকে নেওয়া হয়েছে।

তেঁতুলের খোলা আর বীচি সার, এছাড়া ভিতরে যে সারবস্তু আছে তার একমাত্র গুণ তার অম্লত্ব এবং এই অম্লও অতি নিকৃষ্ট শ্রেণির। কিন্তু আমাদের দেশীয় লোকদের খাদ্য তালিকায় এই তেঁতুল ছাড়া আর গতি নেই। শুদ্ধাচারী পদীপিসিরা যতই বিশুদ্ধ উপায়ে রান্না করুন না কেন, নিকৃষ্ট কলাইয়ের ডাল আর ততোধিক নিকৃষ্ট তেঁতুল সহযোগে মাছ ছাড়া আর কিছু রান্না করবার ক্ষমতা নেই। বলা বাহুল্য, খাদ্য হিসেবেও এগুলি অত্যধিক নিকৃষ্ট জাতীয়। 

কমলাকান্তের ভাষায় , “তেঁতুলের মত কুসামগ্রী আমি সংসারে দেখিতে পাই না। যেই কিয়ৎ পরিমাণে খায়, তাহারই অজীর্ণ হয়, সেই অম্ল উদ্‌গার করে। যেই অধিক পরিমাণে খায়, সেই অম্লপিত্তরোগে চিররুগ্ন।” কিন্তু যারা দেশীয় খাদ্য খাবার দায় এড়িয়ে বিলাতি বা মোগলাইখানা খেতে শিখেছেন, মুসলমান পাচক ফয়জুর হাতের সেই রান্না খেয়ে তারা স্বর্গসুখ অনুভব করতে পারেন।

প্রশ্নোদ্ধৃত বর্ণনাটির রূপক আবরণ উন্মোচন করলেই বোঝা যায় যে, কমলাকান্ত এখানে দেশীয় লেখকদের লেখার অপকৃষ্টতা বর্ণনা করে তার তুলনায় বিলাতি সাহিত্যের উৎকর্ষের কথাই বলেছেন। পদীপিসিকৃত তেঁতুল-মাছ প্রকৃতপক্ষে দেশীয় ভাষায় রচিত সাহিত্য এবং ম্লেচ্ছ ফয়জুর রান্না হলো বিলাতি সাহিত্য। বঙ্কিমচন্দ্রের পূর্ববর্তী এবং সমকালেও বাংলা গদ্যসাহিত্যের ছিল একেবারেই বাল্যবস্থা – ভাষা, রচনারীতি কিংবা বিষয়বস্তু কোনোদিক থেকেই তার মধ্যে উপভোগ করবার মতো কিছুই ছিল না। বঙ্কিমচন্দ্র স্বয়ং লেখক হয়েও দেশীয় লেখকদের এত নিন্দা করেছেন তার কারণ তিনিই বস্তুত পাশ্চাত্যের প্রভাবে প্রথম বাংলা গদ্যসাহিত্যকে একটা ভদ্র সুরুচিসম্মত রূপ দিয়ে বাংলা সাহিত্যের দৈন্যদশা ঘুচিয়েছিলেন।

১৭। “যদি চালে তুলিয়া দিলে, তবেই ইহারা উঁচুতে ফলিলেন – নহিলে মাটিতে গড়াগড়ি যান। যেখানে ইচ্ছা, তুলিয়া দাও, একটু ঝড় বাতাসেই লতা ছিড়িয়া ভূমে গড়াগড়ি।” – লেখক কুষ্মাণ্ডর তুলনা কার সঙ্গে করেছেন? এরূপ তুলনার কারণ কী?

দেশীয় হাকিমগণ লেখকের দৃষ্টিতে কুষ্মাণ্ডরূপে ধরা পড়েছিল। আলোচ্য অংশে সেই কুষ্মাণ্ডরূপী হাকিমদেরই কিঞ্চিৎ বর্ণনা পাওয়া যায়।

আমাদের দেশীয় কুষ্মাণ্ড বা কুমড়া দু’রকমভাবেই ফলতে পারে। যদি কেউ মাচা বেঁধে উপরে তুলে না দেয়, তবে সেই কুষ্মাণ্ড মাটিতেই গড়াগড়ি যায়, নিজের চেষ্টায় কখনোই তা উপরে উঠতে পারে না। কেউ যদি তাকে ধরে চালে তুলে দেয়, তবে তা সেখানে থাকবে, কিন্তু তার স্থায়িত্ব বড় অল্প। কোনো প্রকার ঝড় ঝাপটা এলেই তা চাল থেকে গড়িয়ে নীচে পড়ে ভূমিতেই গড়াগড়ি খায়। নিজের এমন কোন শক্তি নেই, যার সাহায্যে সে চালের উপর আপনার স্থায়ী আসন করে নিতে পারে অথবা আরো উঁচুতে উঠতে পারে। অপরের সহায়তাই তার একমাত্র অবলম্বন।

লেখক আমাদের দেশীয় হাকিমদের এই কুষ্মাণ্ড জাতীয় ফলের সঙ্গে যে তুলনা করেছেন, তা তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং সুক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ শক্তিরই যথার্থ রূপায়ণ। বঙ্কিমচন্দ্র স্বয়ং একজন দেশীয় হাকিম ছিলেন এবং সারা দেশে সর্বাপেক্ষা শিক্ষিত ব্যক্তির মর্যাদাসম্পন্ন ছিলেন। তা সত্ত্বেও তিনি দেশীয় হাকিমদের এই পরানুগ্রহনির্ভরতা যে কতখানি সত্য, তা হাড়ে হাড়ে অনুভব করেছিলেন। এই হাকিমদের মর্যাদা নির্ভর করতো একান্তভাবেই বিদেশী ইংরেজ শাসকদের ইচ্ছা ও মর্জির ওপর। শিক্ষা, যোগ্যতা, অভিজ্ঞাতা কোনই মূল্য পেতো না। ইংরেজ শাসকগণ তাদের যেখানে স্থাপন করতেন, সেখানেই তাদের স্থান নির্দিষ্ট ছিল। কাউকে একটু উচ্চপদে স্থান দিলেও তাকে সর্বদা সন্ত্রস্ত থাকতো হতো, কারণ সামান্য বিচ্যুতিতেই তার পদাবনতি কিংবা কর্মচ্যুতি ঘটতে পারতো। দেশীয় হাকিমদের স্বাধীন সত্তা প্রকাশের কোনো অবকাশই ঘটত না। তাই কমলাকান্ত, ফলের মধ্যে সর্বাধিক অপদার্থ কুষ্মাণ্ডকে দেশীয় হাকিমরূপেই বর্ণনা করেছেন।


প্রবন্ধ মনুষ্য ফল হতে প্রশ্ন মান – ১০

১। “আমার বোধ হয়, মনুষ্যসকল ফলবিশেষ – মায়াবৃন্তে সংসারবৃক্ষে ঝুলিয়া রহিয়াছে …… পৃথক পৃথক সম্প্রদায়ের মানুষ পৃথক জাতীয় ফল।” – ফলের সঙ্গে মনুষ্যের এই তুলনা কতখানি সার্থক, আলোচনা করো।

সমাজের যে সকল দোষ-ত্রুটির কথা বঙ্কিমচন্দ্র স্বনামে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করতে সঙ্কোচ অথবা অসুবিধা বোধ করতেন, সেই সমস্ত কথাই তিনি আফিংখোর কমলাকান্তের জবানিতে প্রকাশ করেছেন। কমলাকান্ত আফিংখোর বলেই তার বাস্তব মূল্য হয়তো অস্বীকার করা যেতে পারে, কিন্তু আসলে কমলাকান্তের ছদ্মবেশে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় খাঁটি সত্যের স্বরূপকেই তুলে ধরেছেন।

‘মনুষ্য ফল’ প্রবন্ধটির প্রথমেই কমলাকান্ত বলেছেন, ‘আফিমের একটু বেশী মাত্রা চড়াইলে আমার বোধ হয়’ এবং পরে আবার বলেছেন, ‘কখন কখন বিমাইতে ঝিমাইতে দেখিতে পাই যে’, অর্থাৎ প্রারম্ভেই বঙ্কিমচন্দ্র তথা কমলাকান্ত স্বীকার করে নিয়েছেন যে তিনি নেশার ঘোরে এই সমস্ত অপ্রিয় ভাষণ করে সমাজের বিভিন্ন স্তরের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের দোষের দিকগুলি দেখিয়ে দিয়েছেন। এর মধ্যে যদি সত্য না থাকে, তবে আফিংখোরের প্রলাপোক্তি বলে তাকে উপেক্ষা করা চলতে পারে।

আসলে বঙ্কিমচন্দ্র সাদাচোখে যে সত্য উদ্ঘাটন করতে সাহস পাননি অথবা সঙ্কোচবোধ করেছিলেন, নেশাখোরের ছলনায় সেই সত্যকেই প্রকাশ করেছেন। ফলে ‘মনুষ্য ফল’ প্রবন্ধে তিনি ফলের রূপকে মনুষ্যজাতির বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বিশেষ বিশেষ লক্ষণ বা ধর্মকে যথাযথভাবেই প্রকাশ করতে পেরেছেন। 

আফিংখোর কমলাকান্তের দৃষ্টিতে সংসার-বৃক্ষে মনুষ্যমাত্রই এক-একটি ফল। তাদের কেউ বা কাঁঠল, কেউ বা আম, কেউ বা নারিকেল, আবার কেউ বা কুষ্মাণ্ড প্রভৃতি। এদের অবস্থান কারো বা গাছের মগডালে কারো বা গোড়ার দিকে। সব ফলই সুখাদ্য নয়; কোনোটিকে পোকায় খায়, কোনোটি পাখির ভোজে যায়। আবার কোনো কোনো ফল তিক্ত বা কষায় হলেও তার সাহায্যে প্রাণদায়ী ওষুধ তৈরি হতে পারে। অর্থাৎ, অনেক মানুষের জীবনই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়; আবার কোনো কোনো সত্যাশ্রয়ী মানুষ অপ্রিয়ভাষী হলেও পরিণামে হিতকারী। আবার কতকগুলি লোক একেবারেই মাকাল জাতীয়।

এদেশীয় ধনী ব্যক্তিদের কমলাকান্ত কাঁঠালের সাথে তুলনা করেছেন। এঁচোড় অবস্থা থেকে পরিপক্ক অবস্থা পর্যন্ত কাঁঠল বা বড়লোকের সমাজে আদর। তবে যথেষ্ট সতর্ক না থাকলে এরা এঁচোড়ে পেকে নষ্ট হতে পারে অথবা তোষামোদকারী রূপ শৃগালের ভক্ষ্যও হতে পারে। ভুঁতুড়িসার কাঁঠাল বা অন্তঃসারশূন্য ধনীর সংখ্যাই বেশি হলেও কতক কাঁঠাল আছে খাজা অর্থাৎ, যাঁরা জ্ঞানে-গুণে, ধনে-মানে সত্যিকারের মহাজন, তোষামোদকারী এবং লোভীদের হাত থেকে যারা নিজেদের বেড়া দিয়ে আটকে রাখতে পারে এবং প্রকৃতই সমাজ-বৃক্ষের উচ্চতায় অবস্থান করেন একমাত্র তারাই নিরাপদ। 

কমলাকান্তের দৃষ্টিতে বিলাতি সিভিল সার্ভিসের সাহেবগণই এদেশে কুলশ্রেষ্ঠ বিবেচিত হয়ে থাকেন। এদেশে ফলের রাজা যেমন আম তেমনি বর্ণগৌরবে এবং কৌলীন্যের মর্যাদায় সাহেবরা আমের মতোই গৌরবের স্থান অধিকার করে আছেন। আম যেমন গাছ থেকে পেড়ে সদ্য সদ্য খেতে নেই, তেমনি বিলেত থেকে সবে আগত সাহেবদের কাছেও প্রথমেই ভিড়তে পারা যায় না। পাকা আমকেও যেমন ঠাণ্ডা জ্বলে রেখে পরে খেতে হয়, সাহেবদেরও তেমনি তোয়াজে বশ করতে হয়। কিন্তু সব আমই যেমন পাকলে মিষ্টি হয় না, তাদের হাড়ে টক থাকে, অনেক সিভিলিয়ানই তেমনি দীর্ঘকাল এদেশে বসবাসের পর পরিণত বয়সেও দেশবাসীর প্রতি বিদ্বেষ

ও ঘৃণার ভাব গোপন করতে পারেন নি। তবে নানাভাবে এদের পরিতুষ্ট করতে পারলে নিজের স্বার্থ উদ্ধার করে নেওয়া যায়। 

এদেশীয় স্ত্রীলোকদের সম্বন্ধে বিশ্লেষণে কমলাকান্ত অতিশয় চাতুর্যের সঙ্গে বাগ্‌বৈদগ্ধ্যের পরিচয় দিয়ে তাদের চরিত্রের যথাযথ রূপ উদ্ঘাটন করেছেন। প্রচলিত মতে নারীজাতি কদলীর সঙ্গে উপমিত হলেও কমলাকান্ত তা স্বীকার করেন না। কারণ কাঁদি কাঁদি ফলে যে কলা, তা একমাত্র কুলীন ব্রাহ্মণ ছাড়া অপর কেউ এমন কাঁদি কাঁদি কলা গ্রহণ করে না। এমন কি যুবতীদের যারা মাকাল ফল বলে মনে করে, কমলাকান্ত তাদের প্রভুরূপে স্বীকার করলেও তাদের দুর্মুখ বলেই মনে করেন। 

কমলাকান্তের মতে রমণীমণ্ডল নারিকেল ফলস্বরূপ। নারিকেলের ডাব এবং ঝুনো দুটি অবস্থা। তার ডাব অবস্থা অর্থাৎ, কিশোরী অবস্থাটি বড়ই মনোরম। ডাবের মধ্যে আহরণীয় উপাদানমাত্র একটিই সেটি তার জল। তারও প্রশংসায় তিনি পঞ্চমুখ। এই জলকে তিনি তুলনা করেছেন নারীর স্নেহের সঙ্গে। অপূর্ব তার বর্ণনা – “যখন তুমি সংসারের রৌদ্রে দগ্ধ হইয়া, হাঁপাইতে হাঁপাইতে, গৃহের ছায়ায় বসিয়া বিশ্রাম কামনা কর, তখন এই শীতল জল পান করিও – সকল যন্ত্রণা ভুলিবে। তোমার দারিদ্র্য-চৈত্রে বা বন্ধুবিয়োগ বৈশাখে – তোমার যৌবনমধ্যাহ্ন বা রোগতপ্ত বৈকালে, আর কিসে তোমার হৃদয় শীতল হইবে? মাতার আদর, স্ত্রীর প্রেম, কন্যার ভক্তি, ইহার অপেক্ষা জীবনের সন্তাপে আর কী সুখের আছে? গ্রীষ্মের তাপে ডাবের জলের মত আর কী আছে?”

নারকেলের আরো তিনটি সামগ্রী – শাঁস, মালা আর ছোবড়া। ঝুনো নারিকেলের জলে বড় ঝাঁঝ, অতএব সেটি অপেয়। শাঁস হল স্ত্রীলোকের বুদ্ধি। ঝুনো অবস্থায় সংসার-অভিজ্ঞা স্ত্রীলোকের বুদ্ধি বড় পরিপক্ক, বড় হিসেবি, ওখানে দস্তস্ফুট করা কষ্টকর। আর নারিকেলের মালাকে কমলাকান্ত বলেন স্ত্রীলোকের বিদ্যা, যা আধখানার বেশি একসঙ্গে দেখা যায় না। বস্তুত বঙ্কিমচন্দ্রের কালে স্ত্রীশিক্ষার সঙ্কীর্ণতার দিকটিই এখানে ধরা পড়েছে। আর ছোবড়া হল স্ত্রীলোকের রূপ। দুই-ই যথাক্রমে নারিকেল আর স্ত্রীলোকের বাহ্যিক অংশ। ছোবড়ার দড়িতে জাহাজ বাঁধা যায়, তেমনি স্ত্রীলোকের রূপের সাহায্যেও অনেক কিছু বশ করা যেতে পারে। আবার রমণীর রূপরজ্জু গলায় বেঁধে অনেকে আত্মহত্যাও করে।

তৎকালের দেশহিতৈষীগণ প্রকৃতপক্ষে কোনো গঠনমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না বলে তারা কমলাকান্তের অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত ছিলেন। কমলাকান্ত তাদের শিমুলের সঙ্গে তুলনা করেছেন, বাইরে তাদের শোভা থাকলেও শিমুল ফলের মতোই তারা ছিলেন অন্তঃসারশূন্য। তাদের বক্তৃতা যেন তুলো হয়ে আকাশে বিলীন হয়ে যেতো।

বাঙালি লেখকদের তিনি খোলা-সিটেধারী তেঁতুলের সঙ্গে তুলনা করেছেন। অতিশয় অম্লস্বাদ, গ্রহণে অম্লশূলের জ্বালা। অতি অল্প কথায় তিনি ফয়জুর খানসামার অমৃতসমান বিজাতীয় রান্নার সঙ্গে পদী পিসির তেঁতুলের ঝোলের সাহায্যে ইউরোপীয় সাহিত্যের সঙ্গে দেশীয় সাহিত্যের চমৎকার এক তুলনামূলক চিত্র অঙ্কন করেছেন।

অধ্যাপক ব্রাহ্মণগণ কমলাকান্তের দৃষ্টিতে ধুতুরা ফল। দীর্ঘ ধুতুরা ফুলের মতই তাদের লম্বা বচন। ধুতুরা ফলের বীজে আছে মাদকতা গুণ। দেশীয় লেখকগণ তাদের রচনায় ঐ রকম কয়েকটা বীজ মিশিয়ে দিয়ে পাঠকদের নেশা জনিয়ে দেন।

সর্বশেষে কমলাকান্ত দেশীয় হাকিমদের কুষ্মাণ্ডের সঙ্গে তুলনা করেছেন। কুষ্মাণ্ডকে যেমন মাচায় তুলে না দিলে নিজে থেকে সেখানে উঠতে পারে না, মাটিতে গড়াগড়ি যায়, তৎকালীন দেশীয় হাকিমদেরও ছিল সেই অবস্থা-মামা-কাকার জোরেই শুধু তারা উপরে উঠতে পারতেন। দেশী মুচির জুতো যেমন ইংরেজি জুতো নামে পরিচিত, তেমনি অনেক দেশীয় হাকিমও বিলাতি সাহেবের অনুকরণে বিলাতি হাকিম সেজে গৌরব বোধ করেন – কমলাকান্ত এদের সর্বাপেক্ষা অকর্মণ্য, কদর্য ও টক বলে অভিহিত করেছেন।

বঙ্কিমচন্দ্র স্বয়ং ছিলেন লেখক এবং দেশীয় হাকিম। কিন্তু লক্ষণীয় এই যে, ব্যঙ্গবিদ্রূপের বাণ থেকে তিনি নিজেকেও নিষ্কৃতি দান করেননি। বরং এই আলোচনায় তিনি সর্বাপেক্ষা নিষ্ঠুর হয়েছেন দেশীয় লেখক ও দেশীয় হাকিমের প্রতি। অথচ বঙ্কিমচন্দ্র স্বয়ং ছিলেন লেখক-কুল-শ্রেষ্ঠ এবং হাকিমরূপেও তাঁর বিচারনৈপুণ্য ও নিরপেক্ষতা ছিল সংশয়াতীত। তা সত্ত্বেও লেখক ও হাকিমদের সম্বন্ধে এই জাতীয় মন্তব্য করতে তিনি বিন্দুমাত্র দ্বিধান্বিত হননি। এইখানেই তাঁর সততার পরিচয়।


২। “আমি বলি, রমণীমণ্ডলী এ সংসারের নারিকেল। ” – এখানে ‘আমি বলি’ কথার তাৎপর্য কী? সমগ্র উক্তিটি বিশ্লেষণ ও সার্থকতা প্রতিপন্ন করো।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ গ্রন্থের বিভিন্ন প্রবন্ধে সমাজের নানা দিকের নানা বিষয়ের উপর আলোকপাত করেছেন একটা সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। তিনি কমলাকান্ত নামে জনৈক আফিংখোরের জবানিতে তাঁর বক্তব্য পরিবেশন করেছেন। বাহ্যত আফিংখোরের অলীকদর্শন বলে এটিকে অগ্রাহ্য করা চলতে পারতো, কিন্তু বঙ্কিম এই পন্থায় মায়ার আবরণে প্রকৃত সতাকেই প্রকাশ করেছেন। যে সমস্ত কথা তিনি সহজভাবে স্পষ্টভাষার স্বনামে প্রকাশ করতে সঙ্কোচ বোধ করতেন, তাকেই তিনি আফিংখোরের মুখ দিয়ে উচ্চারণ করিয়েছেন। বাংলা ভাষায় এই জাতীয় উদ্যম শুধু অভিনবই নয়, অনবদ্যও বটে। সমাজের দোষত্রুটির প্রতি শুধু অঙ্গুলি নির্দেশই নয়, প্রয়োজনস্থলে তিনি ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের চাবুকেও অনেককে জর্জরিত করেছেন। ‘কমলাকান্তের দপ্তরে’রই প্রথম একটি প্রবন্ধ ‘মনুষ্য ফল’, যেখানে তিনি প্রথম অনুরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।

প্রবন্ধটির প্রথমেই বলা হয়েছে – “আমার বোধ হয়, মনুষ্যসকল ফলবিশেষ – মায়াবৃন্তে সংসার-বৃক্ষে ঝুলিয়া রহিয়াছে।” পরে বিশেষিত করে বলা হয়েছে – “পৃথক পৃথক সম্প্রদায়ের মনুষ্য পৃথক জাতীয় ফল।” এখানে মনুষ্যসমাজের যে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তাদের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বলাভ করেছে বাঙালি নারীসমাজ। তাদের সম্বন্ধেই কমলাকান্ত সর্বাধিক বাঙমুখর এবং অপর সকলের মধ্যে কারোর সম্বন্ধে কৌতুকজনক বাক্যচ্ছটা ব্যবহার করেছেন, কাউকে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের বাণে বিদ্ধ করেছেন, কিন্তু নারীজাতি সম্বন্ধে কৌতুককর মন্তব্য করলেও সপ্রশংস উক্তি যথেষ্ট ধ্বনিত হয়েছে প্রবন্ধটিতে।

‘রমণীমণ্ডলী’ সম্বন্ধে নিজস্ব অভিমত প্রকাশের পূর্বেই কমলাকান্ত বলেছেন ‘আমি বলি’ – এই কথাটি তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, পূর্বকাল থেকেই নারীজাতি সম্বন্ধে নানা জনে নানা মন্তব্য প্রকাশ করায় তাদের কথা প্রায় লোকশ্রুতির মর্যাদা লাভ করে। যেমন, নারীজাতির সঙ্গে কদলীবৃক্ষের এবং মাকাল ফলের তুলনা। কমলাকান্ত এই বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন। তিনি মনে করেন যে কদলীবৃক্ষে কদলী তো কাঁদি কাঁদি ফলে কিন্তু নারীর ক্ষেত্রে তার প্রযোজ্য নয়। তাদের একমাত্র সাদৃশ্য এখানেই যে, উভয়েই বানরের প্রিয়। কিন্তু তার জন্য তিনি নারীকে কদলী বলে স্বীকার করতে সম্মত নন। আবার কোনো কোনো কটুভাষী দুর্মুখ ব্যক্তি নারীকে অন্তঃসারহীন রাঙা মাকাল ফলের সঙ্গে তুলনা করে থাকেন। উক্ত দুর্মুর্খদের প্রাঞ্জল দৃষ্টি ও স্পষ্টবাদিতার জন্য গুরু বলে স্বীকার করলেও কমলাকান্ত নারীকে ‘মাকাল ফল’ বলতেও সম্মত নন। এদের অভিমতের বিরোধিতা করেই ‘আমি বলি’ বলে তিনি তাঁর বক্তব্য পরিবেশন করেছেন।

কমলাকান্ত রমণীমণ্ডলীকে ‘নারিকেল ফল’ বলে অভিহিত করেছেন। নারিকেলের দুটি প্রধান অবস্থা একটি কচি ডাব অপরটি ঝুনো নারিকেল। “করকচি বেলা উভয়েই বড় স্নিগ্ধকর – নারিকেলের জলে শরীর স্নিগ্ধ হয় – কিশোরীর অকৃত্রিম বিলাস লক্ষণ শূন্য প্রণয়ে হৃদয় স্নিগ্ধ হয়।” বস্তুত নারীজাতির স্বভাবসরলতা, মাধুর্য, স্নেহপরায়ণতা- আদি সুকোমল বৃত্তিগুলি কমলাকান্তের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। কিশোরীর রূপের বর্ণনায়ও তিনি মুক্তকন্ঠ। তাই বলেন, “দেখিতে কেমন উজ্জ্বল শ্যাম-কেমন জ্যোতির্ময়, রৌদ্র তাহা হইতে প্রতিহত হইতেছে – যেন সে নবীন শ্যাম শোভায় জগতের রৌদ্র শীতল হইতেছে।” কচি ডাবের জলের সঙ্গে কমলাকান্ত নারীর স্নেহকে তুলনা করে বলেছেন, “উভয়ই বড় স্নিগ্ধকর। যখন তুমি সংসারের রৌদ্রে দগ্ধ হইয়া, হাঁপাইতে হাঁপাইতে, গৃহের ছায়ায় বসিয়া বিশ্রাম কামনা কর, তখন এই শীতল জল পান করিও সকল যন্ত্রণা ভুলিবে। তোমার দারিদ্র্য-চৈত্রে বা বন্ধুবিয়োগ বৈশাখে – তোমার যৌবন মধ্যাহ্নে বা রোগতপ্ত বৈকালে, আর কিসে তোমার হৃদয় শীতল হইবে? মাতার আদর, স্ত্রীর প্রেম, কন্যার ভক্তি, ইহার অপেক্ষা জীবনের সন্তাপে আর কী সুখের আছে?” 

কমলাকান্ত নারিকেলের চারটি সামগ্রীর কথা বলেছেন – জল, শাঁস, মালা আর ছোবড়া। নারিকেল ঝুনো হয়ে গেলে তার জলেও থাকে বড় ঝাঁঝ তাকে গ্রহণ করা সহজ নয়। আর নারিকেলের শাঁস হল স্ত্রীলোকের বুদ্ধি। কচি ডাবের শাঁস সুমিষ্ট কোমল হলেও ঝুনো নারিকেলের শাঁস বড় শক্ত, তাতে দস্তস্ফুট করা যায় না। গৃহিণীপনায় অভ্যস্থ স্ত্রীর হাত থেকে মালকড়ি খসানো এক দুঃসাধ্য ব্যাপার। কন্যা-পুত্রের আবদার কিংবা ব্যবসায়ের অজুহাতে কর্তার প্রার্থনাও তিনি অম্লানবদনে প্রত্যাখ্যান করতে পারেন। কমলাকান্ত হয়তো এখানে গৃহিণীর নিষ্ঠুরতার কথা বলতে চাননি, তিনি দুরদর্শিতার, ভবিষ্যতের চিন্তার কথাই বোঝাতে চেয়েছেন।

নারিকেলের মালার সঙ্গে কমলাকান্ত স্ত্রীজাতির বিদ্যার তুলনা করেছেন। মালা মানেই যেমন নারিকেলের আধখানা, নারীর বিদ্যাও সেই আধখানার বেশি তিনি কখনো দেখতে পাননি। বস্তুত এই প্রবন্ধ রচনাকালে আমাদের দেশ নারীশিক্ষায় যে অনেকটা পশ্চাৎপদ ছিল, কমলাকান্তের এই উক্তি, তারই একটা বাস্তব স্বীকৃতি।

সর্বশেষে কমলাকান্ত নারীর রূপকে নারিকেলের ছোবড়ারই তুল্য বলে মনে করেছেন। দুইই অসার বলে পরিত্যাজ্য। ছোবড়ার একটাই গুণ – এর থেকে দড়ি হয়, সেই দড়ি দিয়ে জাহাজ পর্যন্ত বাঁধা যায়। নারীর রূপের কাছিতেও তেমনি জাহাজ বাঁধা যায়, মনোরথ টেনে আনা যায়। গলায় দড়ি বেঁধে অনেকে আত্মহত্যা করে, নারীর রূপের রজ্জুতেও তেমন আত্মঘাতীর সংখ্যা কি কম? পায়ে দড়ি বেঁধে গাছে উঠতে হবে, নতুবা ডোমের সাহায্য নিতে হবে – এই ভয়ে কমলাকান্তের ভাগ্যে আর সংসারোদ্যানে নারীর অর্থাৎ, নারিকেল জুটলো না।


৩। ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ গ্ৰন্থের অন্তর্গত ‘মনুষ্য ফল’ প্রবন্ধের রচনাশৈলী বিশ্লেষণ করে।

বাংলা সাহিত্যের যুগপুরুষ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শুধু একজন সাহিত্যিকই ছিলেন না, বস্তুত যুগের প্রয়োজনে তাকে স্বেচ্ছা প্রবৃত্ত হয়েই সমাজ শিক্ষকের দায়িত্বও গ্রহণ করতে হয়েছিল। কিন্তু সামাজিক এবং পারিপার্শ্বিক নানা কারণেই তাঁর পক্ষে তাঁর মনের সমস্ত কথা খোলাখুলি প্রকাশ করা সম্ভবপর ছিল না। এই কারণেই, যা তিনি স্পষ্টভাষায় স্বনামে প্রকাশ করতে পারেননি, তাকে তিনি কমলাকান্ত চক্রবর্তী নামক আফিংখোরের বেনামিতে রঙ্গ-ব্যঙ্গের ছদ্মবেশ পরিয়ে প্রকাশ করেছেন। লক্ষণীয় যে যাদের তিনি ব্যঙ্গের কশাঘাত করেছেন, তাদের মধ্যে তিনি নিজেও রয়েছেন। চাবুকের আঘাত থেকে যে, বঙ্কিমচন্দ্র নিজেকেও রেহাই দেননি, তার প্রমাণ রয়েছে আলোচ্য ‘মনুষ্য ফল’ নামক প্রবন্ধটিতেই। অতএব প্রবন্ধ রচনায় তাঁর ভূমিকা যে নিরপেক্ষ ছিল, তা আমরা প্রথমেই স্বীকার করে নিতে পারি।

আলোচ্য ‘মনুষ্য ফল’ প্রবন্ধে লেখক তথা কমলাকান্ত মনুষ্যকে ফলের রূপে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু কথিত অলঙ্কারটিতে উপমেয় এবং উপমান সর্বাংশে সদৃশ হয় না, কারণ তা হলে অলঙ্কার হয় না। আলোচ্য ক্ষেত্রেও তা হয়নি। দুটি বিসদৃশ বস্তুর মধ্যে কোনো বিশেষ গুণ বা ধর্মের ঐক্যবোধ থেকেই এজাতীয় অলঙ্কার হতে পারে। অতএব, এখানেও কোনো মনুষ্যকেই কোনো ফলের সঙ্গে সর্বাংশে অনুরূপ বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। কমলাকান্ত বিশেষ বিশেষ ফলের বিশেষ গুণ বা ধর্মের সঙ্গে বিশেষ শ্রেণির মানুষের সাদৃশ্য দেখাতেই সচেষ্ট হয়েছেন।

কমলাকান্ত এখানে বড়মানুষদের ‘কাঁঠাল’, সিভিল সার্ভিসের সাহেবদের ‘আম্রফল’, স্ত্রীলোকদের ‘নারিকেল’, দেশহিতৈষীদের ‘শিমুল ফুল’, অধ্যাপক ব্রাহ্মণদের ‘ধুতুরা ফল’, লেখকদের ‘তেঁতুল’ এবং দেশী হাকিমদের ‘কুষ্মাণ্ড’ বলে মনে করেছেন। বলা বাহুলা, তিনি যেভাবে এক একটি ফলের বিশেষ বিশেষ গুনলক্ষণ বিচার করে তার সঙ্গে এক একজাতীয় মানুষের তুলনা করেছেন, তার বাস্তবতা কিংবা সত্যতা বিষয়ে দ্বিমত হবার অবকাশ নেই।

এখানে একটা প্রশ্ন উঠতে পারে যে, তিনি যে সমস্ত মনুষ্যসম্প্রদায় বা ফলের কথা বলেছেন, তাদের কি কোনো গুণ নেই। আছে বা নেই, সেটি আলোচ্য ক্ষেত্রে আসে না। কারণ প্রথমেই বলা হয়েছে যে, এই অলঙ্কারে সাদৃশ্য সর্বাঙ্গীণ হয়নি, তা বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কাজেই এ কারণে লেখক একদেশদর্শী বা নিন্দাভাজন হতে পারেন না। বরং তিনি যে অত্যন্ত সরসভাবে সাদৃশ্যগুলি তুলে ধরে উৎকৃষ্ট কৌতুকরসের জোগান দিতে পেরেছেন, তার জন্যই তিনি ধন্যবাদ লাভ করেন। 

স্ত্রীজাতির সঙ্গে নারিকেল ফলের তুলনার ক্ষেত্রে তাঁর বিশ্লেষণ ক্ষমতায় চমৎকৃত হতে হয়। অবশ্য কমলাকান্তের এই আলোচনায় সর্বত্রই যে শুধু নির্দোষ কৌতুকরসের প্রবাহই বইছে, তা নয়। কখনো কখনো তিনি ব্যঙ্গবিদ্রূপের তীক্ষ্ণ বাণেও কোনো কোনো সম্প্রদায়কে বিদ্ধ করেছেন। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য লেখক সম্প্রদায় এবং দেশী হাকিম সম্প্রদায়। বাঙালি লেখকদের বঙ্কিমচন্দ্র তুলনা করেছেন তেঁতুলের সঙ্গে যার বাইরের দিকটায় শুধু খোল আর সিটে এবং ভিতরে যে বস্তু, তা হলো নিকৃষ্ট জাতীয় অর্থ। এর পাঠকদেরও তিনি চিররুগ্ন বলে মনে করেন।

দেশী হাকিমদের প্রাবন্ধিক তুলনা করেছেন কুষ্মাণ্ডর সঙ্গে। পিছনে খোঁটার জোর না থাকলে এদের আর উপরে ওঠার ক্ষমতা থাকে না, ভূমিতে গড়াগড়ি যায়। বঙ্কিমচন্দ্র মনুষ্য জাতির মধ্যে এদের সর্বাপেক্ষা অকর্মণ্য ও কদর্য বলে মনে করেন। লক্ষণীয় এই বঙ্কিমচন্দ্র স্বয়ং লেখক এবং দেশী হাকিম ছিলেন। কাজেই ব্যঙ্গের চাবুকটা নিজের পিঠেই গ্রহণ করেছেন।

Leave a Comment