নীলধ্বজের প্রতি জনা: একাদশ শ্রেণী বাংলা কবিতা

নীলধ্বজের প্রতি জনা একাদশ শ্রেণী বাংলা সাহিত্য চর্চার কবিতা। নীলধ্বজের প্রতি জনার রচয়িতা হলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। নীলধ্বজের প্রতি জনা কবিতা হতে বড় প্রশ্ন ও উত্তর নিম্নে দেওয়া হল।

Bengali Class xi / Eleven Nildhojer Prati Jana Question Answer. নীলধ্বজের প্রতি জনা হতে 5 নং প্রশ্ন ও উত্তরগুলি দেওয়া হল।

বিষয়বাংলা
শ্রেণীএকাদশ শ্রেণী বাংলা কবিতা
গল্পনীলধ্বজের প্রতি জনা
রচনামাইকেল মধুসূদন দত্ত
নীলধ্বজের প্রতি জনা

Table of Contents

বাড়ির কাছে আরশিনগর কবিতা হতে বড় প্রশ্ন ও উত্তর

নীলধ্বজের প্রতি জনা – মাইকেল মধুসূদন দত্ত


প্রশ্ন-১ ‘নীলধ্বজের প্রতি জনা’ কবিতায় জনা অর্জুনের কাপুরুষতার কী কী দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন? (২০১৪

মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যের ‘নীলধ্বজের প্রতি জনা’ পত্র-কবিতায় অর্জুন চরিত্রটি প্রত্যক্ষভাবে নেই। পাঠক সমাজ মাহেশ্বরপুরীর রানি জনার দৃষ্টিতে তৃতীয় পান্ডব তথা অর্জুনকে প্রত্যক্ষ করেন। 

রাজমাতা জনা ভেবেছিলেন, রাজা নীলধ্বজ নিশ্চয়ই পুত্রহত্যার প্রতিশোধ নেবেন। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যায়, নীলধ্বজ পুত্র হন্তারক অর্জুনের সঙ্গে সখ্যতা স্থাপন করেছেন। তাই জনা ক্ষুব্ধ ও লজ্জিত।

জনা স্বামীকে বোঝাতে চেয়েছেন যে, অর্জুনের নিজস্ব কৃতিত্ব বলে কিছু নেই – সবই ছলাকলা ও কৃষ্ণের সহায়তা। তাই জনা কখনো ‘মহাপাপী’ কখনো ‘নরাধম’ আবার কখনো ‘বর্বর’ বলে অর্জুনকে তিরস্কার করেছেন।

ক্ষত্রিয় বীর অর্জুন মহাযোদ্ধা হিসেবে পরিচিত। কিন্তু প্রকৃত যোদ্ধার রণকৌশল তিনি অনুসরণ করেন নি। জনার কাছ থেকে আমরা অর্জুনের এই কাপুরুষতার একাধিক দৃষ্টান্ত পাই –

  • ১) স্বয়ংবর সভায় দ্রৌপদীকে লাভ করার জন্য অর্জুন ব্রাহ্মণ ছদ্মবেশ ধারণ করে প্রতারণা করেছিলেন।
  • ২) নিজের একক ক্ষমতায় অর্জুন খান্ডব বন দহন করতে সমর্থ হন নি। এই কাজে কৃষ্ণ তাকে সহায়তা করেছিলেন।
  • ৩) শিখণ্ডীর সাহায্য ব্যতীত তিনি কিছুতেই পিতামহ ভীষ্মকে বধ করতে পারতেন না।
  • ৪) কৃষ্ণের প্রত্যক্ষ সহায়তায় তিনি গুরু দ্রোণাচার্যকে বধ করেছেন।
  • ৫) কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে কর্ণের রথের চাকা মাটিতে বসে যায়। সেই রথচক্র উদ্ধারকালে অর্জুন নিরস্ত্র কর্ণকে হত্যা করেন।

এই প্রসঙ্গে অর্জুনের অবৈধ জন্ম নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন জনা। এইভাবে একাধিক প্রসঙ্গ উত্থাপন করে জনা তার স্বামী নীলধ্বজকেও উদ্দীপিত করতে চেয়েছেন। 


প্রশ্ন-২ ‘নীলধ্বজের প্রতি জনা’ কাব্যাংশে নীলধ্বজের প্রতি জনার যে ক্ষোভ ও অভিমান প্রকাশিত হয়েছে, তা নিজের ভাষায় লেখো।  (২০১৫, ২০১৯) 

মহাকাব্য মহাভারতের ‘অশ্বমেধ পর্ব’ থেকে নীলধ্বজ ও তার পুত্র প্রবীরের কাহিনি সংগ্রহ করে মাইকেল মধুসূদন দত্ত ‘নীলধ্বজের প্রতি জনা’ পত্র কবিতাটি রচনা করেছেন।

মূল মহাভারতে জনা চরিত্রটি নেই। কাশীরাম দাসের বাংলা মহাভারতে জনার কাহিনি পাওয়া যায়। কবি সেখান থেকেই জনা চরিত্রটি গ্রহণ করে অশ্বমেধ পর্বের সঙ্গে সংযুক্ত করে দিয়েছেন। জনার মাধ্যমে উনিশ শতকীয় নারী চেতনা প্রকাশ পেয়েছে।

মাহেশ্বরী-পুরীর যুবরাজ প্রবীর পাণ্ডবদের অশ্বমেধ যজ্ঞের অশ্বটিকে আটক করেছিলেন। তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন প্রবীরকে হত্যা করেছিলেন। পিতা হয়ে রাজা নীলধ্বজ অর্জুনের এই অন্যায় কর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত না হয়ে সন্ধি স্থাপন করেছিলেন। প্রবীরের মৃত্যুতে নীলধ্বজ উদাসীন হলেও জনার হৃদয় ছিল শোক-সন্তাপে বিদীর্ণ।

স্বামী নীলধ্বজের আচরণে জনা প্রথমে বিস্মিত এবং পরে বিক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। একদিকে কাপুরুষ স্বামীকে তিরস্কার, অন্যদিকে পুত্র-ঘাতক পাণ্ডবদের প্রতি মর্মান্তিক ব্যঙ্গ আর সেই সঙ্গে বীরপুত্রের জন্য মায়ের মর্মভেদী বিলাপ জনা চরিত্রকে স্বাতন্ত্র্য দান করেছে।

স্বামী নীলধ্বজের কাপুরুষোচিত ব্যবহারে ক্ষত্রিয়-কন্যা জনা ক্রুদ্ধ হয়ে চিঠিতে লিখেছেন –

                         “তব সিংহাসনে

           বসিছে পুত্রহা রিপু – মিত্রোত্তম এবে !

          সেবিছ যতনে তুমি অতিথি-রতনে”।

‘নীলধ্বজের প্রতি জনা’ কবিতায় জনার ক্রুদ্ধ অভিমানী স্বর এভাবে উচ্চারিত হয়েছে।

জনা তাঁর স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেও জানিয়েছেন –

           “কিন্তু বৃথা এ গঞ্জনা। গুরুজন তুমি;

           পড়িব বিষম পাপে গঞ্জিলে তোমারে”।

এভাবেই জনার মধ্যে অভিমানবোধ, ক্ষোভ ও মর্মপীড়া লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে।     


প্রশ্ন-৩ ‘কিন্তু বৃথা এ গঞ্জনা’ – বক্তা কে ? তিনি কাকে গঞ্জনা করতে চেয়েছেন ? কেন তার মনে হয়েছে এই গঞ্জনা বৃথা ? (২০১৬, ২০১৮, ২০২৩)

আলোচ্য অংশটি মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যের অন্তর্গত ‘নীলধ্বজের প্রতি জনা’ পত্র কবিতা থেকে গৃহীত হয়েছে।

প্রশ্নে উদ্ধৃত উক্তিটির বক্তা হলেন মাহিশ্বরী পুরীর রানি জনা। 

মাহিশ্বরী পুরীর রানি জনার মনে হয়েছে তার স্বামীকে গঞ্জনা দেওয়া বৃথা। কারণ, নীলধ্বজ হল পুরীর রাজা এবং জনার স্বামী। হিন্দু শাস্ত্র অনুসারে স্বামীকে গঞ্জনা দেওয়া পাপ। তাই জনা বলেছেন –

         “পড়িব বিষম পাপে গঞ্জিলে তোমারে”। 

জনা একজন কুলনারী, বিধির বিধানে সে পরাধীন। জনার নিজের শক্তি নেই যে তার মনের বাসনা পূরণ অর্থাৎ তার পুত্রের হত্যাকারী অর্জুনের বিনাশ করবে। তার স্বামী রাজা নীলধ্বজের উচিত ছিল অর্জুনকে হত্যা করে জনার মনোবাসনা পূরণ করার। কিন্তু ভাগ্যদোষে স্বামীও তার প্রতি বিরূপ। তাই জনার মনে হয়েছে রাজা নীলধ্বজকে গঞ্জনা দেওয়া বৃথা। 

জনার একমাত্র পুত্র প্রবীর তাকে ছেড়ে চলে গেছে। যে গেছে সে আর কোনোভাবেই ফিরে আসে না। তাই এই অবস্থায় কাউকে গঞ্জনা দেওয়া বৃথা। 

বক্তা জনা কখনোই নিজে পার্থের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করতে পারেন না। তাই তার মর্মপীড়া মৃত্যুর মধ্যেই সমাপ্ত হওয়ার কথা জানিয়ে লিখেছেন –

     “ছাড়িব এ পোড়া প্রাণ জাহ্নবীর জলে”।


 প্রশ্ন-৪ মহারথী প্রথা কি হে এই, মহারথী?’ – কার প্রতি কে এই উক্তি করেছেন? মহারথী প্রথা কী? কে কিভাবে তা লঙ্ঘন করেছেন?  (২০১৭, ২০২২) 

প্রশ্নোদ্ধৃত অংশটি মাইকেল মধুসূদন দত্ত বিরচিত ‘নীলধ্বজের প্রতি জনা’ পত্রকবিতা থেকে গৃহীত হয়েছে। এখানে জনা তার স্বামী নীলধ্বজের প্রতি আলোচ্য উক্তিটি করেছেন

ক্ষত্রিয় যোদ্ধাদের কয়েকটি রীতি বা আদর্শ ছিল। যেমন – নিরস্ত্র প্রতিপক্ষ যোদ্ধাকে যুদ্ধে আহ্বান না করা, তাকে আক্রমণ না করা, অসমবয়সী অপেক্ষাকৃত দুর্বলকে অস্ত্রাঘাত না করা, তাকে যুদ্ধে হত্যা না করা। ক্ষত্রিয় মহাবীরেরা এই মহান আদর্শ গুলি অনুসরণ করেন। এগুলিই মহারথী প্রথা। রানি জনা এই মহারথী প্রথার কথাই বলেছেন।

জনা অভিযোগ করেছেন যে, অর্জুন মহারথী প্রথা না মেনেই তার পুত্র প্রবীরকে হত্যা করেছে। অভিযোগের সুরে জনা বলেছেন একইভাবেই অর্জুন ভীষ্ম-বধ করেছিলেন, অন্যায়ভাবে কর্ণ-বধ করেছিলেন আর যুদ্ধের নিয়ম না মেনেই আচার্য দ্রোণকে হত্যা করেছিলেন।

সুতারাং জনার কথা অনুযায়ী অর্জুন মহাপাপী, নরাধম ও বর্বর। অর্জুন সম্পর্কে ভালো ধারণা পোষণ করেন নি রানি জনা। অর্জুন ছলনার আশ্রয় নিয়ে প্রবীরকে হত্যা করেও মহারথী প্রথার আদর্শ লঙ্ঘন করেছেন।


প্রশ্ন-৫ ‘ভুলিব এ জ্বালা, এ বিষম জ্বালা, দেব, ভুলিব সত্বরে।’ – কে, কাকে উদ্দেশ্য করে এ কথা বলেছেন? এখানে কোন জ্বালার কথা বলা হয়েছে? তিনি কীভাবে সেই বিষম জ্বালা ভুলতে চেয়েছেন? (২০২০) 

‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যের অন্তর্গত ‘নীলধ্বজের প্রতি জনা’ কবিতায় কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত মাহেশ্বরী পুরীর রাজমহিষীর মনের অন্তর্বেদনার পরিচয় দিয়েছেন। জনা নীলধ্বজকে উদ্দেশ্য করে আলোচ্য উক্তিটি করেছেন।

জনা তার একমাত্র পুত্র প্রবীরের মৃত্যুর জন্য কষ্ট পেয়েছেন। এখানে জনার বিলাপে পুত্র শোকের বিষয় জ্বালার কথাই উচ্চারিত হয়েছে।

অন্যায় সমরে তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন হত্যা করেছিলেন প্রবীরকে। মাহেশ্বরী পুরীর যুবরাজ প্রবীর পাণ্ডবদের অশ্বমেধের যজ্ঞাশ্ব ধরেছিলেন। সেই অপরাধেই তৃতীয় পাণ্ডব পার্থ তাকে হত্যা করেছিলেন। পুত্রশোকে একান্ত অস্থিরা জনা নীলধ্বজকে জানিয়েছিলেন –

            “টুট কিরীটির গর্ব আজি রণস্থলে !

             খণ্ডমুণ্ড তার আন শূল-দণ্ড-শিরে !

             অন্যায় সমরে মূঢ় নাশিল বালকে ;

                       নাশ, মহেষ্বাস, তারে !”

বীরপুত্র প্রবীর মহাবিক্রমে ক্ষাত্রধর্ম পালন করে রণাঙ্গণে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। তার জন্য গর্ব করা উচিত বলে মনে করেন জনা। তিনি আরো জানিয়েছেন, অন্যায় সমরে যে মূঢ় প্রবীরকে হত্যা করেছেন, তাকে যেন তাঁর স্বামী যোগ্য শাস্তি দেন। অর্জুনের শাস্তি প্রাপ্তির মধ্যে দিয়েই জনা তাঁর পুত্র হারানোর শোক ও বিষম যন্ত্রণা ভুলতে চান।


প্রশ্ন-৬ ‘হায় পাগলিনী জনা’ – পাঠ্যকবিতা অনুসরণে পাগলিনী জনার চরিত্র বিশ্লেষণ করো। অথবা , ক্ষত্র-কুলবালা আমি; ক্ষত্র কুল বধূ – বক্তার এমন মন্তব্যের তাৎপর্য আলোচনা কর।

কবি মধুসূদন দত্ত রচিত ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যের অন্তর্গত ‘নীলধ্বজের প্রতি জনা’ পত্রকবিতায় জনা হল রাজা নীলধ্বজের পত্নী, যিনি যথার্থই বীরাঙ্গনা চরিত্র। মাতৃত্ববোধ তার মধ্যে প্রবল। তিনি ক্ষত্রিয় কুলবালা ও ক্ষত্রিয় কুলবধূ। এই পত্রকবিতায় জনা চরিত্রের যে স্বরূপ উদ্ভাসিত হয়েছে, তার নিম্নলিখিত ভাবে উপস্থাপন করা যায়।

জননীরূপে জনা :-

জনার একমাত্র অবলম্বন তার পুত্র প্রবীর। জননীর কাছে সন্তান হল তার সবথেকে আকাঙ্ক্ষার জায়গা। আর সেই সন্তানকে হারিয়ে জননী জনা নিঃস্ব হয়েছেন। তাই সন্তানহারা মায়ের আক্ষেপ –

      “হা পুত্র ! শোধিলি কি রে তুই এই রূপে

                                                     মাতৃধার ?”

বীরাঙ্গনা রূপে জনা :-

পুত্র প্রবীরের মৃত্যুকে জনা গর্ব হিসেবেই দেখেছেন। তিনি বীরাঙ্গনা, তাই স্বামীকে উদ্দীপ্ত করেছেন অর্জুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রায়। তিনি রণসাজে সজ্জিত হওয়ার জন্য প্রার্থনা করেছেন নীলধ্বজকে। জনা জানতে চেয়েছেন – 

          “সাজিছ কি, নররাজ, যুঝিতে সদলে-

            প্রবীর পুত্রের মৃত্যু প্রতিবিধিৎসিতে”

প্রতিহিংসাপরায়ণা :-

পুত্রশোকের আকুলতা জনাকে উন্মাদিনী করে দিয়েছে। জনা তার শোকের আগুন ‘ফাল্গুনীর লোহে’ নির্বাপিত করতে চেয়েছেন। পুত্রঘাতীকে উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়ার জন্য স্বামীর কাছে প্রার্থনা জানিয়েছেন –                                                   

              “খণ্ডমুণ্ড তার আন শূলদণ্ড-শিরে”।

প্রতিবাদিনী জনা :-

আলোচ্য পত্রকবিতায় কবি জনাকে প্রতিবাদী চরিত্র হিসাবে অঙ্কন করেছেন। মহান চরিত্র যথা ব্যাস, অর্জুন, কৃষ্ণ প্রত্যেকেই অন্যায় করেছেন, তা জানাতে ভোলেনি জনা। কুন্তী ও দ্রৌপদীর চরিত্র নিয়েও প্রশ্ন করতে দ্বিধাবোধ করেন নি জনা।

অসহায়া জনা :-

পাঠ্য কবিতায় জনা চরিত্রটিকে অসহায় রূপে চিহ্নিত করা যেতে পারে। শোকাতুর জনা পুত্রহত্যার প্রতিশোধ নিতে পারেন নি। স্বামী নীলধ্বজকে বোঝাতে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। সেই অর্থে তিনি অসহায়া। তাই অভিমানিনী জনা জাহ্নবীর জলে আত্মবিসর্জন দিতে চেয়েছেন –

      “ছাড়িব এ পোড়া প্রাণ জাহ্নবীর জলে”!

‘নীলধ্বজের প্রতি জনা’ কবিতায় মূল চরিত্র জনা। সমগ্র কবিতার ছত্রে ছত্রে জনার বীরাঙ্গনা রূপ ফুটে উঠেছে। জনার কটাক্ষ, প্রতিবাদ, প্রতিহিংসা, অভিমান সমস্ত কিছুই তাকে বীর রমনীতে পরিণত করেছে। যদিও শেষ পর্যন্ত নিজেক ব্যর্থ মনে করে জনা আত্মবিসর্জনের পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে।


প্রশ্ন-৭ ‘বীরাঙ্গনা’ শব্দের অর্থ কী? জনা কি প্রকৃতই বীরাঙ্গনা – যুক্তিসহ লেখো।

‘নীলধ্বজের প্রতি জনা’ কবিতায় উল্লেখিত ‘বীরাঙ্গনা’ শব্দের অর্থ হল ক্ষত্রিয় তেজে উদীপ্ত রমণী।

কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যের অন্তর্গত ‘নীলধ্বজের প্রতি জনা’ কবিতার মধ্যে জনার তেজস্বিনী, বীরাঙ্গনা মূর্তি অঙ্কিত হয়েছে। জনার নামে নামাঙ্কিত এই পত্র কাব্যটিতে জনার তেজ, ক্ষোভ এবং অসহায় হৃদয়ের কথা ব্যক্ত হয়েছে। এখানে জনা বীরপুত্র প্রবীরের মৃত্যুকে গর্বের সঙ্গে দেখেছেন। অর্জুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রায় তিনি স্বামীকে বারবার উদ্দীপ্ত করেছেন। তিনি রণসাজে সজ্জিত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন নীলধ্বজকে।

নগরীতে উৎসবের আয়োজনের কারণ জানতে চেয়েছেন জনা। প্রথমেই তিনি স্বামীকে সরাসরি অভিযোগ করেন নি। তার মধ্যে কুণ্ঠা ছিল, সেই কুণ্ঠা থেকে জানতে চেয়েছেন –

           “সাজিছ কি নররাজ যুঝিতে সদলে –

            প্রবীর পুত্রের মৃত্যু প্রতিবিধিৎসিতে,

           নিবাইতে এ শোকাগ্নি ফাল্গুনির লোহে ?”

বীরপুত্র যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছে, তার মৃত্যুর কারণ অর্জুন। তাই জনা  নীলধ্বজ যেন অর্জুনকে যথোচিত শাস্তি দেন। কিন্তু যখন শুনেছেন তাঁর স্বামী অর্জুনকেই সাদরে বরণ করতে চলেছেন তখন জনার ক্ষোভ-দুঃখ তীব্র মাত্রা যোগ করেছে।

তিনি পাণ্ডব পক্ষের দুর্বলতার দিকগুলি স্বামীর সামনে তুলে ধরেছেন। অর্জুন প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, অর্জুন হলেন মহাপাতক। কারণ, খাণ্ডব-দাহনে কৃষ্ণের সহায়তা, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে ভীষ্ম নিধনে শিখণ্ডীর সাহায্য লাভ, ছলনার আশ্রয়ে দ্রোণাচার্যের হত্যা সাধন, অন্যায় সমরে কর্ণ-হত্যা – সবই অর্জুনের কু-কর্মের দৃষ্টান্ত।

নিতান্তই অবোধ বালকের মতো অর্জুনের স্বামী নীলধ্বজ যখন পদলেহনের জন্য উৎসাহিত হয়ে পড়েছেন, তখন শোকে দুঃখে হতাশায় জনা মৃত্যুর পথ বেছে নিয়েছেন –

         “ছাড়িব এ পোড়া প্রাণ জাহ্নবীর জলে;”

‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যে জনা চরিত্রের মধ্যে মাতৃ-হৃদয়ের অপূর্ব স্নেহের ধারা এবং তার স্নেহ-বাৎসল্যের সঙ্গে বীরাঙ্গনা মূর্তিটির যথাযথ প্রকাশ ঘটেছে।


প্রশ্ন-৮ কুন্তী ও দ্রৌপদী সম্পর্কে জনা কী কী অভিযোগ করেছেন?

মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত ‘নীলধ্বজের প্রতি জনা’ কবিতায় জনা পুত্রশোকে শোকাতুরা। মহাভারতে বিভিন্ন চরিত্রের নিন্দায় তিনি সরব হয়েছিলেন। শোকাকুলা জনার মনে হয়েছিল ভোজ রাজার কন্যা কুন্তী ‘স্বৈরিণী’, অর্জুন তাঁর ‘জারজ’ সন্তান। কুমারী অবস্থাতেই তিনি সন্তান গ্রহণ করেছিলেন। তাই জনার চোখে কুন্তী ‘কুলটা’ নারী।

অর্জুন-পত্নী দ্রৌপদীকে নিয়েও জনার বিরক্তির কারণ ছিল। তিনি বলেছেন দ্রৌপদী ভ্রমরের মধ্যে মক্ষীরানির মতো। তিনি রবির অধীনী, সমীরণ-প্রিয়া, পৌরব-সরসে নলিনী। সুতরাং জনার চোখে দ্রৌপদী হলেন ‘ভ্রষ্টা’ রমণী।


প্রশ্ন-৯ কৌরববংশের বিরুদ্ধে জনার অভিযোগগুলি সংক্ষেপে লেখো

‘নীলধ্বজের প্রতি জনা’ পত্রকাব্যে পৌরাণিক জনা চরিত্রটিকে কবি মধুসূদন দত্ত নবরূপ দান করেছেন। একমাত্র পুত্র প্রবীরকে হারিয়েছেন রানি জনা। অথচ তার স্বামী মাহেশ্বরপুরী-রাজ নীলধ্বজ পুত্রশোকে বিহ্বল নন। তিনি অর্জুন ও কৃষ্ণকে নিয়েই ব্যস্ত। তাই বিরক্ত, অসহায়া জনা তার সমস্ত ক্ষোভ-বিদ্বেষ উগরে দিয়েছেন পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে।

কৌরববংশের বিরুদ্ধে জনার একাধিক অভিযোগ। প্রথমেই পার্থের বিরুদ্ধে তার অভিযোগ। জনার মনে হয়েছে, অন্যায় সমরে কর্ণ ও পিতামহ ভীষ্মকে নিধনকারী অর্জুন কখনও ক্ষত্রপতি বীরশ্রেষ্ঠ নয়। তাঁকে ‘নরনারায়ণ’ রূপে পূজা করা অর্থহীন। জনা একই সঙ্গে জানিয়েছেন খাণ্ডব দহন করার মধ্যেও অর্জুনের একক কৃতিত্ব নেই। যে আচার্য তাকে শিক্ষা দিয়েছেন, তাকেও তিনি ছলনায় হত্যা করেছে। জনার মন্তব্য –

                                                                “দ্রোণাচার্য গুরু –

 কি কুছলে নরাধম বধিল তাঁহারে,”

অর্জুনের বীরত্বে জনার কোনও বিশ্বাসও নেই। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন যুদ্ধের রীতি নিয়ে –

                                                                      “কহ মোরে শুনি,

 মহারথী-প্রথা কি হে এই, মহারথি?”

জনা কুন্তীকে চিহ্নিত করেছে ‘স্বৈরিণী’ রূপে, আর তার পুত্রবধূ দ্রৌপদীকে চিহ্নিত করেছেন ‘পৌরব-সরসে নলিনী’ রূপে। দ্বৈপায়ন ঋষি ব্যাস কীভাবে ভ্রাতৃবধূদ্বয়ের সন্তানের জনক হয়েছিলেন সেই বিষয়েও প্রশ্ন তুলেছে জনা।

জনার চোখে কৌরবদের প্রতিটি ঘটনা লজ্জাকর ও হীনকর বলেই মনে হয়েছে। আসলে কবি  মধুসূদন চেয়েছিলেন, ভারতীয় পুরাণকে নতুন আলোক-সম্পাতে উপস্থাপন করতে।

Leave a Comment