বাড়ির কাছে আরশিনগর: একাদশ শ্রেণী বাংলা কবিতা

বাড়ির কাছে আরশিনগর একাদশ শ্রেণী বাংলা সাহিত্য চর্চার কবিতা। বাড়ির কাছে আরশিনগরের রচয়িতা হলেন লালন ফকির। বাড়ির কাছে আরশিনগর কবিতা হতে বড় প্রশ্ন ও উত্তর নিম্নে দেওয়া হল।

Bengali Class xi / Eleven  Barir Kache Arshinagar Question Answer. কবিতা বাড়ির কাছে আরশিনগর হতে 5 নং প্রশ্ন ও উত্তরগুলি দেওয়া হল।

বিষয়বাংলা
শ্রেণীএকাদশ শ্রেণী বাংলা কবিতা
গল্পবাড়ির কাছে আরশিনগর
রচনালালন ফকির
বাড়ির কাছে আরশিনগর

Table of Contents

বাড়ির কাছে আরশিনগর কবিতা হতে বড় প্রশ্ন ও উত্তর

বাড়ির কাছে আরশিনগর – লালন ফকির


১। “তবু লক্ষ যোজন ফাঁক রে।” – কার সঙ্গে এই ব্যবধান ? একত্র থেকেও এই ব্যবধানের তাৎপর্য কী ?  ১+৪  (২০১৪, ২০১৭) 

বাউল তত্ত্বের ভগীরথ লালন ফকিরের ‘বাড়ির কাছে আরশিনগর’ কবিতায় কবি জানিয়েছেন পড়শী তথা মনের মানুষের সঙ্গে তার এই ব্যবধান।

সত্যসন্ধানী ললন ঈশ্বর সাধনার নতুন পথ আবিষ্কার করেছিলেন বাউলতত্ত্বের মাধ্যমে। মানব মনের যে সংকীর্ণ ভেদাভেদ মানুষকে অস্পৃশ্য করে দেয় লালন তার বাউলতত্ত্বের মাধ্যমে সেই প্রচীরকে ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছেন। লালন মনে করেন মানব মনের অন্তঃস্থলে পরমাত্মা ঈশ্বরের অবস্থান। তাকে খুঁজে পাওয়াই হল আত্মতত্ত্ব। এই আত্মতত্ত্বের দর্শন বা সন্ধান পাওয়া সহজসাধ্য নয়। একমাত্র সাধক তাঁকে দেখতে পান। 

বিষয়বাসনা বা স্বার্থপরতা ত্যাগ না করলে ‘মনের মানুষ’-এর সন্ধান পাওয়া যায় না। আত্ম নিবেদন আর আত্মানুসন্ধানের ব্যর্থতায় মনের মানুষ” ব্রাত্য থেকে যায় এই জীবনে। কবির কথায়, মন রূপ গ্রামকে বেষ্টন করে আছে অজ্ঞানতা ও বিষয়বাসনারূপ অগাধ পানি, যা ঈশ্বরের সঙ্গে সাধকের মিলনের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করে। আর এই ব্যর্থতাই পড়শি বা ‘মনের মানুষ’-এর সঙ্গে সাধকের লক্ষ যোজন ফাঁক বা অনেক দূরত্ব তৈরি করে দেয়।

লালন আর তাঁর পড়শির মধ্যে তৈরি হয় লক্ষ যোজন দূরত্ব। ঈশ্বরের অধিষ্ঠান যে আমাদের হৃদয়ে বিষয়ী মানুষ পার্থিব বাসনায় মত্ত হয়ে তা অনুভব করে না। তাই একই জায়গায় বসবাস করলেও উভয়ের মধ্যে রয়ে যায় লক্ষ্য যোজন দূরত্ব।


২। “বলবো কি সেই পড়শীর কথা” – ‘পড়শী’ কে? উক্তিটির আলোকে ‘পড়শী’র স্বরূপ সম্পর্কে আলোচনা কর। ১+৪ (২০১৫, ২০১৯, ২০২২)

‘বাড়ির কাছে আরশিনগর’কবিতায় কবি লালন ফকির ‘পড়শি’ বলতে জীবন দেবতা তথা মনের মানুষ কে বুঝিয়েছেন।

‘বাড়ির কাছে আরশিনগর’ কবিতাটি রূপক প্রতীকের সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা অনন্য কবিতা। এই কবিতায় এক পড়শীর কথা বলা হয়েছে। আপাত অর্থে বিপুল জলরাশি বেষ্টিত আরশিনগর গ্রামে বসবাসকারী প্রতিবেশী রূপে চিত্রিত হলেও এই পড়শি আসলে বাউলের একান্ত কামনার ধন, সাধনার লক্ষ্যবস্তু, মনের মানুষ অর্থাৎ স্বয়ং ঈশ্বর।

পড়শির স্বরূপ বোঝাতে গিয়ে কবি বলেছেন তিনি আরশিনগর অর্থাৎ মানব মনেই বসত করেন। কিন্তু তাকে দেখা যায় না। নৌকা ছাড়া বিপুল জলরাশি পেরিয়ে যেমন সেই গ্রামে পৌঁছানো যায় না, তেমনি বিষয়বাসনা রূপ প্রতিবন্ধকতা মনের মধ্যে বাস করা পড়শীর সাথে মিলনের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি করে।

কবির বর্ণনায় সেই পড়শির অবয়ব অদ্ভুত। তার হাত, পা, কাঁধ, মাথা নেই। অর্থাৎ তিনি নিরাকার, অবয়বহীন, উপলব্ধির বস্তু। কবির ভাষায় –

 “ও তার হস্ত-পদ-স্কন্ধ-মাথা নাই রে।” 

 পড়শি তথা মনের মানুষ-এর অবস্থান সম্পর্কে কবি বলেছেন –

“ও সে ক্ষণেক থাকে শূণ্যের উপর

আবার ক্ষণেক ভাসে নীরে”।

বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মতই পঞ্চভূতে গড়া অনু ব্রহ্মাণ্ড এই মানবদেহে অবস্থান করলেও তিনি কখনো বস্তুজগতে কখনো শূণ্য মার্গে বিচরণ করেন।

এই পড়শির এক বিশেষ গুণ আছে। তাঁর ছোঁয়াতে যম যাতণা দূর হয়। তিনি যেমন অসীম, তেমনি অসীম তার ক্ষমতাও। তাঁর সান্নিধ্য লাভ বা তার ছোঁয়া পেলে ইহলোকের সকল যন্ত্রণা থেকে মুক্তি লাভ সম্ভব। তিনি হলেন বাউলের ঈশ্বর, মুক্তিদাতা। তাই কবির ভাষায় –

 “পড়শী যদি আমায় ছুঁত

আমার যম-যাতনা যেত দূরে”।

এই পড়শীকে ধরা ছোঁয়া যায় না। তিনি চিরদিন অধরাই থেকে যান। তিনি দেহের মধ্যেকার দৃষ্টিপ্রদীপ। তবু তিনি অধরা, অলভ্য। তাই কবি বলেছেন –

“আবার সে আর লালন একখানে রয়

তবু লক্ষ যোজন ফাঁক রে”।

এই ভাবেই কবিতায় পড়শীর স্বরূপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।


৩। ‘আমি বাঞ্ছা করি দেখব তারি’ – কবি কাকে দেখতে চেয়েছেন? কীভাবে তার দর্শন পাওয়া যাবে ?  ১+৪ (২০১৬, ২০১৮, ২০২০, 

বাউল সাধক লালন ফকির রচিত ‘বাড়ির কাছে আরশিনগর’ কবিতায় কবি তার ‘মনের মানুষ’ অর্থাৎ পড়শী কে দেখতে চেয়েছেন।

বাউল গান তত্ত্বনির্ভর। কবি একজন বাউল সাধক হিসাবে জানেন ঈশ্বর বা মনের মানুষ -এর অবস্থান মনের ভিতরে। কিন্তু বৈষয়িক কাতরতায় মগ্ন মানুষ সহজে তাঁর সাক্ষাৎ পায় না। তাঁকে পাওয়া যায় ধ্যানে আর জ্ঞানে। কাঠোর সাধনা আর আত্মোপলব্ধির সাহায্যে তাঁর দেখা পাওয়া যেতে পারে বলে কবি মনে করেন। তাঁকে না পেলে ভক্তের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয় না। মনের মানুষের সাক্ষাৎ পেলে মোক্ষলাভ ঘটে, ভাবযন্ত্রনা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। বাউল তত্ত্বের মর্মকথা এই পরমার্থ সন্ধানী হওয়া।

লালন দেখেছেন, ‘পড়শী’ ও তার মধ্যে ‘অগাধ পানি’, তাই তাঁর কাছে যাওয়া সহজসাধ্য নয়। কিন্ত পড়শীকে পাওয়ার আকাঙ্খা প্রবল। দেহখাঁচায় তাকে ধরতে পারলে তিনি তাঁর পায়ে মনোবেড়ি পরাতেন। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন বিষয়াসক্তিকে সম্পূর্ণ দূরে সরিয়ে শুদ্ধ স্বভাবের অধিকারী হওয়া। লোভ-মোহ-কামনা-বাসনা থেকে মুক্ত হতে পারলেই চিত্তশুদ্ধি ঘটা সম্ভব। 

পড়শীকে দেখার আকাঙ্খা বা ব্যকুলতাই ভক্তের ভক্তির প্রগাঢ়তা। লালনের মনোবাঞ্ছা সীমার বন্ধন থেকে মুক্তির বাসনায় পর্যবসিত। নিরাকার পরম ব্রহ্ম ভক্তের কাছে ধরা দেন শুদ্ধ চৈতন্যের মধ্যে দিয়েই। 


৪। “আমি একদিনও না দেখিলাম তারে”। – কার দেখা একদিনও পাওয়া গেল না ? সে কোথায় বাস করে ? না দেখার কারণ ব্যাখ্যা করো। ১+১+৩

‘বাড়ির কাছে আরশিনগর’ কবিতায় কবি লালন ফকির তার পড়শি অর্থাৎ জীবনদেবতা তথা মনের মানুষ-এর দেখা পেলেন না।

কবির মতে পড়শি বা মনের মানুষ -এর অবস্থান তাঁর দেহভাণ্ডের মধ্যেই অর্থাৎ আপন হৃদয় মন্দিরে।

লালন ফকির তাঁর গানে বলেছেন যে, তিনি একদিনও তাঁর পড়শিকে দেখতে পান নি। অথচ তাঁর পড়শি বাড়ির কাছেই বসবাস করেন। আসলে লালনের ‘পড়শি’ হলেন তাঁর জীবনদেবতা বা মনের মানুষ। তাঁকে তো চাইলেই কাছে পাওয়া যায় না বা ডাকলেই কাছে এসে হাজির হবেন না। তিনি হলেন ঈশ্বর, আল্লা বা মনের মানুষ – যাই বলা যাক না কেন, সর্বোপরি বলা যায় সাধনার ধন। 

মানবজীবনে তাঁকে উপলব্ধি করতে হলে সাধন-ভজনের মধ্যেই তা সম্ভব। আর সাধনাতো একদিনে হয় না, যতদিন না পার্থিব আসক্তি লুপ্ত হয়ে তাঁর চরণে মন একান্তভাবে সমর্পিত হয়, ততদিন তিনি অধরাই থেকে যান। মানুষ ভাবে ঈশ্বর বা আল্লাকে একটু ডাকলেই তিনি ধরা দিয়ে দেন, বা তাঁর আশিস মাথায় বর্ষিত হবে। মানুষ অজ্ঞতাবশত সামান্য সাধন-ভজনেই তাকে লাভ করতে চায়, কিন্তু এটা ভ্রান্ত। তিনি আমাদের কাছেই রয়েছেন, তাঁর অবস্থান মানুষের হৃদয়মন্দিরে। কিন্তু তাঁকে বুঝতে গেলে উপলব্ধি করতে হলে গভীর বিশ্বাসে ভজনা করে যেতে হবে বিশ্বাস, যুক্তি-তর্কের ওপরে। এই বিশ্বাসের ওপর ভর করে মানুষ বিরুদ্ধভাবগুলি কাটিয়ে উঠতে পারে।

তিনি আমাদের কাছেই আছেন, দেহেই রয়েছেন এই কথা তো শুধু বললেই হবে না, ভাব-কর্ম না থাকলে তাঁর দর্শন বা উপলব্ধি হয় না বা তাঁকে দেখাও যায় না। বিশ্বাস গাঢ় হলেই শ্রদ্ধা আসে, ভক্তি আসে, হৃদয়ে ধর্মরাজ্য স্থাপিত হয়। এরপরই পাওয়া যায়, উপলব্ধি করা যায় মনের মানুষকে। লালন ফকির তাঁর এই গানের মধ্য দিয়ে যেন সেই কথাই বলতে চেয়েছেন।


৫। ‘সে ক্ষণেক থাকে শূন্যের উপর / আবার ক্ষণেক ভাসে নীরে।’ – নীর ও শূন্য শব্দ দুটির অভিধানিক ও কাব্যিক অর্থ লেখ। 

আলোচ্য পংক্তি দুটি বাউল তত্ত্বের ভগীরথ লালন ফকিরের ‘বাড়ির কাছে আরশিনগর কবিতায় উদ্ধৃত হয়েছে। কবি ‘হস্ত-পদ-স্কন্ধ-মথা’ হীন নিরাকার পড়শীর আদর্শজনিত অবস্থাকে ফুটিয়ে তুলতে এই পংক্তি দুটি ব্যবহার করেছেন। ‘নীর’ শদের আভিধানিক অর্থ জল এবং ‘শূন্য’ শব্দের আভিধানিক অর্থ আকাশ বা নির্জন স্থান।

দেহতত্ত্ব বিষক যে কোনো গানে থাকে গূঢ় রহস্যময়তা। বাউল সম্প্রদায় নিরাকার ঈশ্বর তত্ত্বে বিশ্বাসী। জলে-স্থলে অন্তরীক্ষে তার অবস্থান। ব্রহ্মময় জগৎ সংসারে সব কিছুর মধ্যেই ঈশ্বরকে খুঁজে নিতে হয় বলে কবি মনে করেন। কবির ঈশ্বরও নিরাকার। তিনি থাকেন হৃদয়ের শূন্য স্থানে আবার কখনো তিনি মানুষের চেতনার স্রোতে মিশে যান। এই পড়শী রূপী ঈশ্বর কখনো বস্তুজগৎ নিরপেক্ষ, আবার কখনো বাস্তব আশ্রয়ে প্রকাশিত। এই দুটি ভাবই কবি এখানে ফুটিয়ে তুলেছেন। তাই ‘শূন্য’ ও ‘নীর’ শব্দ দুটি কবি ব্যবহার করেছেন।


৬। “পড়শী যদি আমায় ছুঁত আমার যম-যাতনা যেত দূরে” – ‘যম-যাতনা’ কথা অর্থ কী ? কীভাবে যম-যাতনা দূরে যেত বলে কবি মনে করেন? 

বাউল গানের গঙ্গোত্রী কবি লালন ফকিরের ‘বাড়ির কাছে আরশীনগর’ কবিতায় আলোচ্য ‘যম-যাতনা’ কথার অর্থ ভাবযন্ত্রণা বা মৃত্যুযন্ত্রণা। সংসারের মায়া বন্ধনে আবদ্ধ জীবকে প্রতিনিয়ত এই ভাবযন্ত্রণায় কাতর হতে হয়।

মানব মনের অন্তরাত্মার গূঢ় চেতনাকে লালন উপলব্ধি করলেন বাউল সাধনার মাধ্যমে। মন-রূপ আরশিনগরে যে ‘মনের মানুষ’ -এর অবস্থান মুক্তিকামী মানুষ তারই সন্ধানে অবিরত সাধনা করেন। নিরাকার ব্রহ্মাস্বরূপ ঈশ্বরকে উপলব্ধি করতে পারেন একমাত্র কঠোর সাধনার দ্বারা। তাই অহং, হিংসা, দেষ, লোভ লালসা, বিষয়বাসনা বর্জন করতে হয়। তাহলেই মানবতার শীর্ষে উন্নীত হয়ে পরম আনন্দে মনের মানুষের সন্ধান পাওয়া যায়। আত্মা তখন পার্থিব সুখ দুঃখের ঊর্ধ্বে উঠে স্বয়ংসম্পূর্ণ অবস্থানে বিরাজ করে।

মনের মানুষ-এর সাক্ষাৎলাভ বা স্পর্শলাভ লালনের একমাত্র বাঞ্ছা। দেহের অভ্যন্তর সত্তার সঙ্গে সেই অলীক মানুষ মিশে থাকেন। সীমার মাঝে অসীমকে অনুভব করেও লালন স্থির নয়। এই অস্থিরতাই তাঁর মোক্ষলাভকে ব্যঞ্জিত করে। ‘যম-যাতনা’ থেকে মুক্তি পাওয়ার অর্থ সেই পরম মোক্ষ। মোক্ষলাভে পার্থিব সুখ-দুঃখ ও বিষয় যন্ত্রনাকে দূরে রেখে মানুষ আত্মশুদ্ধিতে মনোনিয়োগ করতে পারে। আর তখনই ঐশ্বরিক সত্তার অনুভূতি জাগে।

Leave a Comment