সুয়েজ খালে হাঙর শিকার: একাদশ শ্রেণী বাংলা প্রবন্ধ

সুয়েজ খালে হাঙর শিকার একাদশ শ্রেণী বাংলা সাহিত্য চর্চার প্রবন্ধ। সুয়েজ খালে হাঙর শিকারের রচয়িতা হলেন স্বামী বিবেকানন্দ। সুয়েজ খালে হাঙর শিকার প্রবন্ধ হতে বড় প্রশ্ন ও উত্তর নিম্নে দেওয়া হল।

Bengali Class xi / Eleven Suez Khale Hangar Shikar Question Answer. সুয়েজ খালে হাঙর শিকার হতে 5 নং প্রশ্ন ও উত্তরগুলি দেওয়া হল।

বিষয়বাংলা
শ্রেণীএকাদশ শ্রেণী বাংলা প্রবন্ধ
গল্পসুয়েজ খালে হাঙর শিকার
রচনাস্বামী বিবেকানন্দ
সুয়েজ খালে হাঙর শিকার

Table of Contents

সুয়েজ খালে হাঙর শিকার প্রবন্ধ হতে বড় প্রশ্ন ও উত্তর

সুয়েজ খালে হাঙর শিকার – স্বামী বিবেকানন্দ


১। ‘যাঃ, টোপ খুলে গেল! হাঙর পালালো’ – টোপ খুলে হাঙর কিভাবে পালিয়ে গিয়েছিল? অথবা, হাওর ধরার প্রথম চেষ্টার বিবরণ দাও। ৫ (২০১৪)

স্বামী বিবেকানন্দের ‘পরিব্রাজক’ গ্রন্থের অন্তর্গত ‘সুয়েজ খালে হাঙর শিকার’ প্রবন্ধটি ভ্রমন সাহিত্যের এক উল্লেখযোগ সৃষ্টি। প্রাবন্ধিক ইউরোপ যাত্রাকালে একবার প্লেগ রোগের সংক্রামণের সম্ভাবনায় সুয়েজ খালে আটকে পড়েন। সহযাত্রীদেরও একই অবস্থা। এরকম পরিস্থিতিতে জাহাজের একজন ফৌজি লোক উৎসাহি হয়ে হাঙর শিকারের ব্যবস্থা করেছিল।

ফৌজি লোকটি নিজেই সমস্ত তোড়জোড় করে জাহাজ খুঁজে এক ভীষন বড়শি জোগাড় করে। তাতে সের খানেক মাংস দড়ি দিয়ে জোর করে বাঁধা হয়। তার পর একটা মোটা কাছি বাঁধা হয় এবং চার হাত বাদ দিয়ে এক খানা মস্ত কাঠ ফাতনা হিসাবে লাগানো হয়। এর পর ফাতনা শুদ্ধ বড়শি ঝুপ করে জলে ফেলে দেওয়া হয়। কিন্তু কিছু দূরে এক নৌকার কাছে ফাতনা আটকে যায়। সেটিকে দূরে ঠেলে দেওয়ার জন্য জাহাজ থেকে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হয়। ফলে আরব পুলিশ মারাত্মক কিছু একটা ঘটবে বলে বেশ কোমর বেঁধে মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত হয়। পরে তিনি ঘটনা বুঝতে পেরে ফাতনাটিকে দূরে সরিয়ে দেন।

তারপর হাঙরের প্রতিক্ষায় সবাই উদবিগ্ন হয়ে রইল। কিছু সময় পর একটি হাঙর বড়শির কাছে এসে লেজ নেড়ে শরীর দুলিয়ে চলে যায়। পরে আবার ঘুরে এসে টোপ টা মুখে, দিতেই ৪০-৫০ জন লোক কাছি ধরে টান দেয়। এইভাবে প্রথম বার হাঙর ধরার চেষ্টা করা হলেও ভালো করে টোপ না খাওয়ায় হাঙরটি পালিয়ে যায়।


২। “হে ভারতের শ্রমজীবী” – শ্রমজীবী সম্পর্কে স্বামী বিবেকানন্দের ধারণা ‘সুয়েজ খালে হাঙ্গর শিকার’ রচনা অবলম্বনে লেখ।  ৫ (২০১৫, ২০১৯)

প্রাবন্ধিক স্বামী বিবেকানন্দ তার ‘সুয়েজ খালে হাঙর শিকার’ প্রবন্ধে ভারতের শ্রমজীবী মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। সুক্ষ্ম বিশ্লেষণী মনোভাবে আমরা যদি প্রাবন্ধিকের কথা ভাবি, তাহলে দেখব যে ভারতবর্ষ সুজলা-সুফলা শস্যপূর্ণা হয়ে উঠেছিল তার মূলে কার অবদান ছিল? কাদের নিরলস নিরন্তর পরিশ্রমের ফলে সমাজের অগ্রগতির চাকা সচল ছিল? – সবকিছুর মূলেই ছিল সমাজের সাধারণ মানুষ। লেখকের ভাষায় যদি বলা যায়, তা হল ‘বিজাতিবিজিত স্বজাতি নিন্দিত ছোটো জাত’। 

তারা কি কোনোদিন সমাজে মর্যাদা পেয়েছে? বা তাদের কি সমাজের শিক্ষিত, বিত্তশালী নেতৃত্বস্থানীয় মানুষ কাছে টেনে নিয়েছে? তা তো হয় নি বরং তারা চিরদিনই অবহেলিত, অপমানিত, বঞ্চিতই থেকে গিয়েছে। অথচ সমাজের এই সাধারণ শ্রমজীবী মানুষদের অক্লান্ত পরিশ্রমেই ভারতবর্ষ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের কাছে একদিন সহায় আশ্রয় হয়ে উঠেছিল। এদের শ্রমে কোনোদিন ছেদ পড়ে নি। দিন-রাত, সুখ-দুঃখ, জীবন-মরণ, সবকিছুকে ছাপিয়ে শ্রমজীবী মানুষদের কর্মধারা প্রবাহিত থেকেছে। সৃষ্টির আদিকাল থেকে তারা মানুষের প্রয়োজনে কর্মরত। 

দেশের মানুষের চোখে আঙুল দিয়ে প্রাবন্ধিক তা দেখিয়ে দিয়েছেন। তিনি ‘স্বামীজি’ বলে সম্বোধন করে ত্রিগুণাতীতানন্দকে বলেছেন যে, “তোমাদের পিতৃপুরুষ দুখানা দর্শন লিখেছেন, দশখানা কাব্য বানিয়েছেন, দশটা মন্দির করেছেন – তোমাদের ডাকের চোটে গগন ফাটছে।” কথাটা সম্পূর্ণ সত্যি। চিরকাল শিক্ষিত, ধার্মিক কিছু কীর্তিমানদেরই সম্মান প্রদর্শন করা হয়, কখনো সমাজের সাধারণ শ্রমজীবী মানুষদের মর্যাদা দেওয়া হয় না। তাই লেখক চিরপদদলিত শ্রমজীবী মানুষদের প্রণাম জানিয়ে আমাদের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত করার চেষ্টা করেছেন।


৩। “জাহাজের পিছনে বড়ো বড়ো হাঙর ভেসে বেড়াচ্ছে।” – লেখকের অনুসরণে হাঙ্গর ভেসে বেড়ানোর দৃশ্য নিজের ভাষায় লেখ ? ৫ (২০১৬, ২০২০)

স্বামী বিবেকানন্দের ‘পরিব্রাজক’ গ্রন্থ থেকে গৃহীত ‘সুয়েজ খালে হাঙর শিকার’ প্রবন্ধটি ভ্রমণ সাহিত্যের এক উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি। এই প্রবন্ধে লেখক সুয়েজ খালে প্রথম হাঙর দেখার বিরল অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পূর্ণ সুয়েজ বন্দর হাঙরের জন্য বিখ্যাত। জাহাজের যাত্রীদের মধ্যে তাই হাঙর দেখার প্রবল উৎসুক্য ছিল। সুয়েজে জাহাজ দাঁড়িয়ে থাকার সময় সকালে হঠাৎ খবর রটে গেল জাহাজের পিছনে হাঙর ভেসে বেড়াচ্ছে। জাহাজের ডেকে অতি উৎসাহী সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করল। কিন্তু হাঙরের দেখা মিলল না। তাই বিমর্ষ ও মনঃক্ষুন্ন হয়ে লেখক দাঁড়িয়ে ছিলেন। এমন সময় দেখলেন ঝাঁকে ঝাঁকে ছোট মাছ, ইলিশের মতো দ্রুতগতি বনিটো বা গাঙধাড়ার মতো একজাতের মাছ এদিক ওদিক ছুঁটে বেড়াচ্ছে অথচ হাঙর নিরুদ্দেশ। 

প্রায় আধঘন্টা থেকে ৪৫ মিনিট অপেক্ষা করার পরে সবাই যখন অধৈর্য্য তিতিবিরক্ত ঠিক সেই সময় ওই আসছে আওয়াজ শোনা যায়। সবাই জলের দিকে তাকিয়ে দেখে জলের পাঁচ সাত ইঞ্চি নীচ দিয়ে একটা প্রকান্ড কালো বস্তু ভেসে আসছে। গদাই লস্করি চালে সামনের দিকে তার যাত্রা। তার আগে আগে চলেছে ছোট ছোট আড়কাটি মাছ বা পাইলট ফিশ। আরেক ধরনের ছোট মাছ হাঙরের পেটে, পিঠে, ঘাড়ে লেপটে রয়েছে। এদের চোষক মাছ বলে। এই দুই প্রকার মাছ পরিবেষ্টিত না হয়ে হাঙর চলেন না। 

সপারিষদ এই হাঙরকে দেখে লেখক ও জাহাজের অন্যান্য যাত্রীরা যথেষ্ট আনন্দ পেয়েছিলেন। লেখকের অভিজ্ঞতায় প্রথম হাঙর দেখা ছিল তার জীবনের পরম পাওয়া।


৪। “মানব জাতির উন্নতির বর্তমান অবস্থার জন্য যতগুলি কারণ প্রাচীন কাল থেকে কাজ করেছে তার মধ্যে বোধ হয় ভারতের বানিজ্য সর্ব প্রধান” – কোন কোন জিনিসের আশায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভারতে বাণিজ্য করতে আসে? কোন কোন পথে কী ভাবে এই বাণিজ্য চলত ? সুয়েজ খাল খননের পর বাণিজ্যে কী সুবিধা হয়? ১+৩+১ (২০১৭)

‘সুয়েজ খালে হাঙর শিকার’ প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক স্বামী বিবেকানন্দ ভারতবর্ষের বাণিজ্যকে মানব জাতিয় উন্নতির বর্তমান অবস্থার প্রধান কারণ বলে বর্ণনা করেছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ সুতির কাপড়, তুলা, পাঠ, নীল লাক্ষা, চাল, হীরে, মতি, রেশমি, পশমিনা, লবঙ্গ, এলাচ, মরিচ, জাইফল, জয়িত্রি প্রভৃতি জিনিসের আশায় ভারতে বানিজ্য করতে আসত।

ভারতের সঙ্গে বিদেশের এই বাণিজ্য দুটি প্রধান ধারায় চলত। – একটি স্থলপথে আফগানি ইরানি দেশ হয়ে আর অন্যটি জলপথে রেড সি হয়ে। সিকান্দার শাহ ইরান বিজয়ের পর নিয়ারকাস নামে এক সেনাপতিকে জলপথে সিন্ধু নদের মুখ হয়ে সমুদ্র পার করে লোহিত সাগর দিয়ে রাস্তা দেখতে পাঠান। তারপর তুর্কিরা রোম সাম্রাজ্য দখল করে ইতালিয়দের ভারত বাণিজ্যের রাস্তা বন্ধ করে দিলে জেনোয়া নিবাসি কলম্বাস আটলান্টিক পার হয়ে ভারতে আসার নতুন পথ আবিষ্কারের চেষ্টা করেছিল। অবশ্য তার ফলে আবিষ্কার হয় আমেরিকা। 

এরপর পর্তুগিজরা ভারতে নতুন পথ-আফ্রিকা বেড়ে আবিষ্কার করে। ফলে ভারতের লক্ষ্মী পর্তুগালের উপর সদয়া হয়। এরপর একে একে ফরাসি, ওলন্দাজ, দিনেমার, ইংরেজ সকলেই পর্তুগিজদের অনুসরণ করে। ইংরেজের ঘরে ভারতের বানিজ্য, রাজস্ব সমস্ত। তাই ইংরেজরা এখন সকল লোকের বড় জাত।

কিন্তু বর্তমানে এই বাণিজ্যে আর তেমন কদর নেই। কারণ, আমেরিকা প্রভৃতি দেশে ভারতের জিনিসপত্র অনেক স্থলে ভারত অপেক্ষা উত্তম উৎপন্ন হচ্ছে। তাই ইউরোপীয়রা ভারতের কাছে তাদের ঋণের কথা স্বীকার করতে চায় না।

সুয়েজ খাল খননের পর সুয়েজ পথ এশিয়া ও আফ্রিকার জনবহুল ও কাঁচামাল উৎপাদনকারী এলাকার সাথে ইউরোপ ও আমেরিকার শিল্প ও ব্যবসা বানিজ্যে উন্নত ও জনবহুল এলাকার সাথে সংযোগ স্থাপন করেছে। তাই সমগ্র বিশ্বে বাণিজ্যের সম্প্রসারণে এই সুয়েজ খাল খননের গুরুত্ব অপরিসীম ও গুন্ধুত্বপূর্ণ। 


৫। প্লেগ রোগের সংক্রমণের সম্ভাবনায় লেখক ও তার সহযাত্রীদের কী সমস্যায় পড়তে হয়েছিল? ৫ (২০১৮)

স্বামী বিবেকানন্দের ‘পরিব্রাজক’ গ্ৰন্থ থেকে গৃহীত ‘সুয়েজ খালে হাঙর শিকার’ প্রবন্ধটি ভ্রমণসাহিত্যের এক উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি। ১৪ ই জুলাই লেখকদের জাহাজ রেড সী পার হয়ে সুয়েজ খালে প্রবেশ করে। জিনিসপত্র নামানোর পরে রাত্রিতে জাহাজ অনায়াসেই সুয়েজ বন্দর পার হয়ে যেতে পারত, কিন্তু প্লেগ রোগের সম্যসায় তা হলো না। কারণ, এই সময় সমগ্র মিশর প্লেগ রোগে আক্রান্ত, আবার লেখকের মতে ‘আমরা আনছি প্লেগ সম্ভবত – কাজেই দোতরফা ছোঁয়াছুঁয়ির ভয়’। 

এই মারণ রোগের হাত থেকে বাঁচতে মিশর সরকার বেশ কিছু নিয়ম জারি করেন – (ক) ভারতবাসীরা কোনো মিশরীয় আদমিকে ছুঁতে পারবে না। (খ) ভারত থেকে আগত জাহাজকে বন্দরে প্রবেশ করতে দেওয়া যাবে না। (গ) মিশরীয় কুলিরা বিদেশাগত জাহাজ ছুঁতে পারবে না।

এই অবস্থায় কুলিরা ক্রেনে করে মাল সুয়েজী নৌকায় ফেলবে এবং সেখান থেকে সুয়েজ বন্দরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করবে। যদি কোনো প্রকারের ছোঁয়া লেগে যায় তাহলে দশ দিন লক্ষ্য রাখা হবে। কারন, লেখক বলেছেন ‘প্লেগ’ বিষ শরীরে প্রবেশ করলে দশদিনের মধ্যে তা ফুটে বেরোয়। তাই দশ দিনের আটক।

নিতান্ত ছোঁয়াছুঁয়ির ভয়েই লেখক ও তার সহযাত্রীদের ২৪ ঘণ্টা সুয়েজ বন্দরেই বসে থাকতে হয়। এভাবেই সুয়েজ বন্দরে লেখক ও তার সহযাত্রীদের সমস্যায় পড়তে হয়েছে।


৬। “একথা ইউরোপীরা স্বীকার করতে চায় না” – কোন কথা ইউরোপীয়রা স্বীকার করতে চায় না? কেন চায় না? 

‘পরিবাজক’ গ্রন্থের অন্তর্গত ‘সুয়েজ খালে হাঙর শিকার’ প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক স্বামী বিবেকানন্দ ধর্ম, শ্রমজীবী বা কৃষিজীবী অথবা ব্যবসা-বাণিজ্য সব ক্ষেত্রে ভারতের শ্রেষ্ঠত্বের কথা বলেছেন। ভারতবর্ষ পৃথিবীর অন্যান্য সমৃদ্ধশালী দেশগুলির উন্নতির প্রধান কারণ, আয়ের উৎস হয়ে উঠেছিল। কিন্তু ইউরোপীয়রা তাদের সাফল্যের পেছনে ভারতবর্ষের এই মহাধ অবদানের কথা কিছুতেই স্বীকার করতে চায় না।

ইউরোপীয়রা নিজেদেরকে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ব্যবসাবাণিজ্য সব দিক থেকে শ্রেষ্ঠ মনে করে। কিন্তু ভারতবর্ষের কৃতিত্বকে তারা স্বীকার করতে চায় না, পর্তুগিজরা ভারতে বাণিজ্য করতে আসার নতুন পথ আবিষ্কার করেছিল। সেই পথ অনুসরন করে একে একে ফরাসি, ওলন্দাজ, দিনেমার এবং ইংরেজরা ভারতে আসে। এখন ইংরেজের ঘরে ভারতের বানিজ্যের সামগ্রিক আধিক। তাছাড়া এখন আমেরিকা প্রভৃতি দেশে ভারতের জিনিসপত্র ভারত অপেক্ষা উত্তম রূপে উৎপন হচ্ছে। তাই ভারতের সামগ্রির আর তেমন কদর নেই।

অন্য দিকে ইউরোপীয়দের ভাবনায় ভারতের মানুষেরা অতি নগন্য, চাষাভূষা, তাঁতী, জেলে সম্প্রদায়ের মানুষ, ছোট জাত। ধীরে ধীরে দেশ, সভ্যতা, প্রাধান্য সব কিছুর পরিবর্তন হচ্ছে। তাই সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কালের অনিবার্য নিয়মে ও স্বাজাত্যবোধের কারণে ইউরোপীয়রা ভারতের অস্তিত্ব স্বীকার করতে চায় না। ভারত যে তাদের ধন, সভ্যতার প্রধান সহায় ও সম্বল একথা তারা মানতে চায় না।


৭। “এই দুই প্রকার মাছ পরিবেষ্টিত না হয়ে চলেন না।” – দুই প্রকার মাছের পরিচয় দাও। এদের ছাড়া হাঙর একা চলেন না কেন ? 

স্বামী বিবেকানন্দের ‘পরিব্রাজক’ গ্রন্থের অন্তর্গত ‘সুয়েজ খালে হাঙর শিকার’ নামক প্রবন্ধে হাঙরের সঙ্গে একত্রে চলা দুই প্রকার মাছ হল আড়কাঠী মাছ বা পাইলট ফিস এবং হাঙর চোষক।

দ্বিতীয়বার বিদেশ যাত্রাকালে বিবেকানন্দ সুয়েজ খালে হাঙর শিকারের অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। জাহাজের ডেকের উপর দিয়ে হাঙর দেখার প্রচন্ড উৎসাহে তিনি প্রথমে দেখেছিলেন বনিটো মাছ। তারপর আধঘন্টা থেকে পঁয়তাল্লিশ মিনিট অপেক্ষার পর সবাই যখন অধৈর্য্য এমন সময়ে একজন বলে উঠল ঐ ঐ আসছে। চেয়ে দেখি দূরে একটা প্রকান্ড কালো বস্তু ভেসে আসছে। বৃহদাকৃতির সেই বস্তুটিই হল সপারিষদ হাঙর। হাঙর যখন চলে তখন তার সঙ্গে আরো দুই প্রকার মাছ পরিবেষ্টিত হয়ে থাকে। এরাই হল পাইলট ফিস ও হাঙর চোষক।

পাইলট ফিস হাঙরের আগে আগে সাঁতার কেটে হাঙরকে তার শিকার দেখিয়ে দেয়। অর্থাৎ এরা হাঙরের সহযোগী শিকারী হিসাবে কাজ করে থাকে। হাঙর শিকারের জন্য যখন দৃষ্টিনন্দিত ও সুখাদ্য টোপ ফেলা হয়েছিল, তখন পাইলট ফিসেরা হাঙরকে বড়শির কাছাকাছি এনেছিল। হাঙরের সহকারি হিসাবে এরা সর্বদা হাঙরের আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়, হাঙরকে শিকার দেখিয়ে দেয় এবং প্রয়োজনে প্রসাদও পায়। 

দ্বিতীয় শ্রেণীর মাছেরা হল হাঙর চোষক। মাথার নীচের দিকে কিরকিরে একটি অংশর সাহায্যে এরা হাঙরের ঘাড়ে পিঠে চিপসে থাকে, সানন্দে লুটোপুটি খায় হাঙরের গায়ের উপর। আসলে এরা হাঙরের গায়ের পোকা-মাকড় বা শ্যাওলা খেয়ে বেঁচে থাকে। হাঙরের শরীর চুষে বাঁচে বলেই এদের নাম ‘হাঙর চোষক’ মাছ। 

সর্বদা ‘সহায়পারিষদ’ হিসাবে এই মাছগুলি পরিবেষ্টিত হয়ে হাঙরের চলাফেরা। আলোচ্য প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক এভাবেই ভ্রমণ রসিকের সরল মন নিয়ে হাঙর দর্শনের অপূর্ব অভিজ্ঞতা প্রাঞ্জল ভাষায় বর্ণনা করেছেন।


৮। সংক্ষেপে হাঙর শিকার-এর বর্ণনা লিপিবদ্ধ করো। ৫ (২০২৩)

স্বামী বিবেকানন্দ দ্বিতীয়বার পশ্চিমি দেশে যাত্রা করেছিলেন। কলকাতা থেকে গোলকোণ্ডা যাওয়ার পথে লেখকের জাহাজ এসে ভিড়েছিল সুয়েজ বন্দরে। সুয়েজ বন্দরের একটি বিশেষত্ব হল পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র অস্ট্রেলিয়ার সিডনি বন্দর ও এই সুয়েজ বন্দরে সবথেকে বেশি হাঙর দেখতে পাওয়া যায়।

সকালবেলা যাত্রীদের চিৎকার কানে আসে লেখকের। খবর পান জাহাজের পিছনে বড়ো বড়ো হাঙর ভেসে বেড়াচ্ছে। সময় অপচয় না করে লেখক পৌঁছে যান জাহাজের পিছন দিকে। সেখানে তখন কাতারে কাতারে সেকেন্ড ক্লাসের যাত্রীদল। সবাই বলছে ভাসছিল কিন্তু এখন সরে গেছে দূরে। তাই অপেক্ষা ছাড়া পথ নেই। প্রায় ধৈর্যচ্যুতি ঘটে এমন সময় আবার চিৎকার। ওই আসছে! হ্যাঁ, জলের পাঁচ-সাত ইঞ্চি নীচে প্রকাণ্ড থ্যাবড়া মাথাযুক্ত সামুদ্রিক প্রাণী হাঙর উপস্থিত। ভয়ংকর মাছটি গম্ভীর চালে আসছে। সামনে পথ দেখানোর জন্য রয়েছে পাইলট ফিস্ আর আশে-পাশে পিঠে রয়েছে ‘হাঙর চোষক’।

জাহাজের মধ্যে ছিল এক ফৌজি। সে একটা বড়শি খুঁজে এনে সেরখানেক শুয়োরের মাংস কাছির মাথায় দড়ি দিয়ে বেঁধে বড়ো কাঠের একটি ফাতনা চার-পাঁচ হাত দূরে লাগিয়ে ছিলেন। তারপর সেটাকে জাহাজের নীচে থাকা চৌকি পুলিশের সহায়তায় সমুদ্রে ফেলা হল। সবার কৌতূহলী দৃষ্টি রয়েছে সেই ফাতনার দিকে। কিছু সময় পরে একটি হাঙর এসে বড়শি ধরার মতো অবস্থায় এসেও লেজ নেড়ে শরীর দুলিয়ে চলে যায়। আবার হাঙরটা ঘুরে এসে টোপটা মুখে দিতেই চল্লিশ-পঞ্চাশ জন লোক কাছি ধরে টান দিল। কিন্তু ভালো করে টোপ না খাওয়ায় হাঙরটি পালিয়ে যায়।

লোভ তো সংবরণ করা যায় না। শুয়োরের মাংসের লোভ বলে কথা। আবার হাঙর এসে টোপটা মুখে নিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখছে। তাড়াতাড়ি করে কাছি না-টেনে হাঙরটিকে টোপ খাওয়ার সময় দিল। এরপর হাঙরটা টোপ খেয়ে চলে যাওয়ার উপক্রম করতেই সবাই মিলে কাছিতে টান দিল। বড়ো জলজ প্রাণীটিকে কিছুটা টেনে তুললেও আর পারছিল না। এরপর সতর্কতার সঙ্গে পুলিশদের সহায়তায় হাঙরের লেজের দিকে আবার একটি কাছি দিয়ে বেঁধে টেনে জাহাজের ওপরে তোলা হল। হাঙরের লেজে এত শক্তি যে এর আঘাতে ঘোড়ার ঠ্যাং পর্যন্ত ভেঙে যায়। 

জাহাজে তোলার পর ফৌজি কড়িকাঠ দিয়ে তার মাথার ওপর দুমদুম করে আঘাত করে প্রাণটুকু শেষ করে দেয়। যদিও এই দৃশ্য দেখে মহিলারা তাদের স্বাভাবিক চরিত্রে নিষ্ঠুর বলে আখ্যা দিচ্ছিলেন ফৌজিকে। এরপর তো হাঙরের পেট চিরে হাড়, মাংস, চামড়া সব আলাদা করে ফেলা হল। হাঙরের দেহটা ছিন্নভিন্ন হয়ে এক রাশ হল তার দেহাবশেষ। জাহাজের চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল তার তীব্র গন্ধ। সেদিন অবশ্য লেখকের খাওয়া-দাওয়া সম্পূর্ণ মাটি হয়ে গিয়েছিল।


Leave a Comment